বিছানার এককোণে পড়ে আছে নিষ্প্রাণ দেহটা। খোলা চোখে ঠান্ডা সে এক দৃষ্টি! কিছুটা অভিমানী নয় কি? কোনদিকে সে দৃষ্টির অভিমুখ?
পাশের টেবিলে একটি খোলা চিঠির বান্ডিল। নীল রিবনের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে চিঠিগুলো অবাধ্যের মত উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঠান্ডা দৃষ্টিটা একভাবে তাকিয়ে আছে চিঠির বান্ডিলটির দিকে।
বান্ডিলের প্রত্যেকটি চিঠির হস্তাক্ষর একই মানুষের। সুদক্ষ হস্তাক্ষর, ঝরঝরে ইংরেজি সেগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য। আরও একটি বৈশিষ্ট্যের দিকে সহজেই চোখ চলে যেতে পারে।
প্রতিটা চিঠির প্রেরক হলেন কোনও এক ‘Jowhar’। আর প্রাপক? নিষ্প্রাণ সেই চোখ জোড়ার মালকিন। হ্যাঁ, প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাজের শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন পত্নী এডুইনার জীবনের শেষ অঙ্ক ছিল এমনই করুন।
ভারত স্বাধীন হবার ঠিক একবছর আগে সদ্য গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত স্বামীর সঙ্গে এদেশে আসেন এডুইনা। এদেশে বছর দুয়েকের বেশি থাকেননি। অথচ তার মধ্যেই ভারতের ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবনের বিতর্কে জড়িয়ে গেল তাঁরই নাম। অদ্ভুত বৈ কি। যদিও লেডি মাউন্টব্যাটেন এবং জওহরলাল নেহরুর প্রথম সাক্ষাৎ টাও বেশ অদ্ভুতই ছিল।
সালটা ১৯৪৬। শরদিন্দুর ভাষায় ” রাজনৈতিক আকাশে তখন ঘনঘটা, অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে বজ্রবিদ্যুৎ!” অবশ্য যে শহরে থাকাকালীন পরবর্তী একবছরে নেহরুর জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠবেন এডুইনা, সেই দিল্লিতে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় নি। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুরে। সেখানে এক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশদের পক্ষে হাজির ছিলেন মাউন্টব্যাটেন দম্পতি। জাতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন নেহরুও। আর প্রস্তাবিত স্বাধীন ভারতের সম্ভাব্য প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে দেখে আবেগের বাঁধ ভাঙল উপস্থিত প্রবাসী ভারতীয়দের। সবাই ছুটে আসতে লাগল তাঁর কাছে আসার জন্য। একজন সুন্দরী মেমসাহেব যে মাঝে ছিলেন, বুঝতেই পারেনি সেই জনতা। জনতার ভিড়ে এডুইনার পদপিষ্ট হবার মত পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। একটু ধাতস্থ হতে তিনি দেখলেন, ভিড়ের মাঝে তাঁর দুটো হাত ধরে টেনে নিরাপদ দূরত্বে সরানোর চেষ্টা করছেন দুজন। তাঁর স্বামী এবং নেহরু। প্রিয় জওহরের প্রথম স্পর্শ সেটাই। শুধু তো তাই নয়, প্রথম সাক্ষাৎ ও সেটাই। ভীত সন্ত্রস্ত এডুইনা কি তখন বুঝেছিলেন, সিঙ্গাপুরের সেই বিকেলের মতই বাকি জীবনেও তাঁর দুই হাত ধরে থাকবেন এই দুই পুরুষ? নাটকীয় এই প্রথম সাক্ষাৎ ফিল্মি চিত্রনাট্যকেও হার মানাবে।
সিঙ্গাপুরের সেই ঘটনাবহুল দিনের উপান্তে একসাথে ডিনারে যোগ দেন নেহরু এবং মাউন্টব্যাটেন দম্পতি। মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল হিসেবে দিল্লিতে পা রাখার পর সেই হঠাৎ পাওয়া বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয় তাঁদের। বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা জওহরলাল নেহরু তিক্ত দাম্পত্য জীবন নিয়ে বিমর্ষ ছিলেন, একথা তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরাও বলতে পারবেন না। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য নেহরু কেবল এক রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের মালিক, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক মানুষ। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, বিশ্ব ইতিহাস গুলে খাওয়া রোম্যান্টিক প্রকৃতির এই ব্যারিস্টার ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এক বুদ্ধিজীবী। এই প্রজ্ঞার সন্তুষ্টি হয়তো ঘটেনি তাঁর পরিবারের অভ্যন্তরে। তবে প্রজ্ঞার তল যে খুঁজে পেয়েছিলেন এডুইনা মাউন্টব্যাটেন, এবিষয়ে নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠরা মোটামুটি একমত। সাংবাদিক ডম মরেস নেহরুকে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘more like a poet than a statesman ‘ হিসেবে। রাজনীতির জটিলতায় নিজস্ব সত্তা বজায় রাখতে হিমশিম খেতেন ‘The Discovery of India’ গ্রন্থের অনবদ্য লেখক। অন্যদিকে এত বড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের প্রশাসনিক প্রধানের স্ত্রী হিসেবে ভারতে এসে প্রোটোকলের গুঁতোয় সাহিত্যপ্রেমী, রোম্যান্টিক সত্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন এডুইনাও। দুজনে যেন দুজনের মধ্যে খুঁজে পেলেন মুক্তি। তৎকালীন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, রাজনৈতিক হানাহানি, দেশভাগের যন্ত্রণার মাঝেই দুজনের ক্লান্ত মন দুজনের কাছে আশ্রয় খুঁজে নিত। মাউন্টব্যাটেন কন্যা পামেলা, ভারতের স্বাধীনতা কালে যাঁর বয়স ছিল ১৭, পরবর্তীকালে তাঁর মায়ের সঙ্গে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুলেছেন। তাঁর মতে, দুজনের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ” equality of spirit and intellect”। তাঁর মতে, মাউন্টব্যাটেন পরিবারের ঘনিষ্ঠ পণ্ডিতজির মধ্যে এডুইনা খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃত আত্মার সাথীকে। নাম যশ পদ নয়, তাঁর মায়ের একমাত্র কাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল মনের মিল। তাই ব্রিটিশ রাজের গর্বিত শাসক লুই মাউন্টব্যাটেন নয়, পরাধীন দেশের নেতা জওহর কালক্রমে পরিণত হন এডুইনার স্বপ্নের পুরুষে।
স্বাধীন ভারত ও ঔপনিবেশিকতা উত্তর ব্রিটেন, দুই জায়গাতেই নেহরু – এডুইনা সম্পর্ক বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। কেন এই সম্পর্কের বিষয়ে এত তিক্ততা? যেখানে নেহরু বা এডুইনা দুজনের কেউই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি কোনোদিন? এর একাধিক কারণ নিহিত। রক্ষণশীল ভারতে বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বিদেশি বিবাহিতা নারী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, এই ঘটনা এমনকি ২০২০ সালেও স্বাভাবিক বলে মনে করা হয় না। ‘ অবৈধ সম্পর্ক ‘ কথাটি ভারতে বহুল প্রচলিত এবং এই সম্পর্কটিকে সেই গোত্রেই ফেলা হয়। এবং, ঔপনিবেশক শাসকের সঙ্গে স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভারতীয় জনতা ভালভাবে নিতে পারেনি। অনেকে নেহরু এডুইনা সম্পর্কে যৌনতার গন্ধও খুঁজে পান, যদিও সেটি উড়িয়ে দিচ্ছেন পামেলা। তাঁর মতে, মায়ের মৃত্যুর পর নেহরুর সব চিঠিই তিনি পড়েছেন এবং তাঁদের সম্পর্কে যৌনতার লেশমাত্র যে ছিল না, এবিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। তাঁর মতে, নেহরু এবং লেডি মাউন্টব্যাটেন দুজনেই ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, সবসময়ই পুলিশ, সেনা, মন্ত্রীর দল তাঁদের ঘিরে থাকত। তার উপর দুজনেই বিবাহিত। অতএব, যৌনতার জন্য যে একাকীত্বের প্রয়োজন হয়, সেটি তাঁদের ছিল না। পামেলার মতে, যৌনতার উদ্দেশ্যই ছিল না তাঁদের। পরবর্তীকালের ব্রিটেনও নেহরু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে মাউন্টব্যাটেন পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিতে পারেননি। উইনস্টন চার্চিল তো প্রকাশ্যেই ‘ নেটিভদের ‘ সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নিন্দা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট পরবর্তী সময়েও বছর খানেক গভর্নর জেনারেল হিসেবে স্বাধীন ভারতে ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। প্রসঙ্গত, প্রাথমিক ভাবে ১৯৪৮ সালে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা থাকলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি ১৯৪৭ সালেই ভারত স্বাধীন হয়। বহু ষড়যন্ত্রপ্রিয় মানুষ এর পিছনে স্ত্রীর থেকে নেহরুকে দূরে সরানোর জন্য মাউন্টব্যাটেনের চক্রান্ত খুঁজে পান। যদিও পামেলা এসব অসার যুক্তিকে গুরুত্বহীন মনে করেন। তাঁর মতে, তাঁর মাকে যে প্রাপ্য সম্মান ও ভালবাসা দিতে পারেননি, এবিষয়ে অবহিত ছিলেন খোদ মাউন্টব্যাটেন। পামেলার বোন প্যাট্রিশিয়া জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে যে সঙ্গ এডুইনা পাননি, সেটা নেহরু তাঁকে দিচ্ছেন এটা বুঝতে ঝানু রাজনীতিক হিসেবে তাঁর বাবার অসুবিধা হয় নি। প্যাট্রিশিয়া আরও জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা স্বীকার করেছিলেন, ” She and Jawaharlal are so sweet together, they really dote on each other “। স্বাধীন ভারতে বহু মানুষ দেশভাগের পশ্চাতে লেডি মাউন্টব্যাটেন এবং নেহরুর সম্পর্ককে দায়ী করেন। তাঁদের মতে, এডুইনা নেহরুকে ভুলপথে চালিত করে দেশভাগের সম্মতি আদায় করেন। যদিও এসব চিন্তাভাবনা আদতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সনাতন ভ্রম ব্যতীত যে অন্য কিছু, তার কোনও প্রমাণ নেই।
১৯৪৮ সালে ভারত থেকে বিদায় নেন মাউন্টব্যাটেন দম্পতি। একে অন্যের সঙ্গে কাটানো বহুমূল্য সময়কে পিছনে রেখে পরস্পরের থেকে বিদায় নেন নেহরু ও এডুইনা। বিদায়কালে একটি এমারেল্ড আংটি নেহরুকে দিতে চান তিনি, যদিও তিনি জানতেন নেহরু কখনোই সেটি গ্রহণ করবেন না। সেজন্য সেটি নেহরু কন্যা ইন্দিরাকে উপহার দেন তিনি। নিছক বিবাহিত নারী পুরুষের চতুষ্কোণ সম্পর্ক এটি ছিল না, সেজন্যই নেহরুর পরিবার ও কন্যা কে অত্যন্ত ভালবাসতেন মাউন্টব্যাটেন পত্নী। শোনা যায়, বিদায়কালে নাকি ঠাট্টা করে ইন্দিরাকে তিনি একটি উপদেশ দিয়েছিলেন। কি সেটি? না দিল দরিয়া স্বভাবের নেহরু যদি কোনোদিন নিঃস্ব হয়ে যান, ইন্দিরা যেন আংটিটি বিক্রি করে বাবাকে আর্থিক সাহায্য করে! আপাত নিরীহ এই ঠাট্টার আড়ালে লুকিয়ে আছে নেহরুর প্রতি এডুইনার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। যদিও সেটাই নেহরুর সঙ্গে এডুইনার শেষ দেখা নয়। প্রায় প্রতি বছরই ভারতে আসতেন মাউন্টব্যাটেন দম্পতি। এডুইনা ও তাঁর স্বামী যে ভারতকে ভালবাসতেন, সেটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গেছেন এডুইনা, দাঁড়িয়েছেন দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে। গান্ধীজির শেষকৃত্যে শ্মশানে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন ও হন তিনি। যদিও তাতে এডুইনার বিশেষ কিছু যায় আসেনি। শিক্ষিতা এই নারী নিজের মনের কথাতেই চলতেন। পরবর্তীকালে নেহরু ঘনিষ্ঠ বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার পদে নিযুক্ত হন। তাঁর সাথেও এডুইনা সুসম্পর্ক রেখে চলতেন। আর ছিল চিঠি চালাচালি। ইংরেজি ভাষার দুই সুদক্ষ শিল্পীর চিঠিগুলি ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। নিবন্ধের শুরুতেই উল্লিখিত আছে, প্রিয় জওহরের চিঠিগুলিই জীবনের শেষদিনেও সঙ্গী ছিল এডুইনার। নিজ ভূমিতে জীবনের শেষদিন কাটেনি তাঁর। ১৯৬০ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সুদূর বোর্নিওতে এক পরিদর্শনে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কি আশ্চর্য, প্রবাসেও তাঁর সঙ্গী অমূল্য ওই চিঠির বান্ডিল। নেহরু তখন ৬৮। এর চারবছর পর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও।
নিবন্ধের শেষে ১৯৪৮ সালে মাউন্টব্যাটেন দম্পতির বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এডুইনার উদ্দেশ্যে করা নেহরুর আবেগঘন বক্তব্যের উল্লেখ না করলেই নয়। প্রসঙ্গত, ওই একবারই নেহরু প্রকাশ্যে এডুইনার প্রতি তাঁর দুর্বলতা সামনে এনেছিলেন।
“Wherever you have gone, you have brought solace, you have brought hope and encouragement. Is it surprising, therefore, that the people of India should love you and look up to you as one of themselves and should grieve that you are going?”
এটি কি নেহরুর নিজেরই স্বগতোক্তি নয়?
তথ্যসূত্র:
১। Daughter of Empire: Life as a Mountbatten – Pamela Hicks Mountbatten.
২। The Mountbattens: Their Lives and Loves- Andrew Lownie.
৩। The Last Vicereine – Rhiannon Jenkins Tsang.
৪। The Discovery of India – জওহরলাল নেহরু
৫। Indian Summer – Alex Von Tunzelmann
অনবদ্য।