লাল মাটির দ্যাশ

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
2494 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

কেমোর অভাবে ব্যামো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো যে..ভ্রমণ অসুরের তাণ্ডবলীলায় আরো একবার ধরাশায়ী,এবারে আবার সঙ্গী নিজের ভাই-বোন সম ছাত্র ছাত্রীরা;মানে ওদের কেও গোল্লায় পাঠাবার ভূমিকা নিয়ে ফেলেছিলাম আর কি..সামনে শিক্ষকদিবস ছিল;সেই ছুতোয় তারাও আমার ঘড়ে ছোড়ে দৌরাত্ম করতে এক কথায় যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যেতে রাজি…তাই একটু প্ল্যানিং করতে হবে তো..আমার আবার পেটে না পড়লে;মাথায় বুদ্ধি ধরে না..

কি ভাবছেন !! নাহ নাহ জলীয় নয় আদ্যোপান্ত বিরিয়ানি রসে মজে;যখন বিরিয়ানি কে জড়িয়ে ধরে প্রেম করছি;ভাবছি এতো টা প্রেম কেন তার জন্য আমার..তখন বুঝলাম এখানকার বা কলকাতা’র বিরিয়ানিতে আলুর অবদান অপরিসীম;ওটা ছাড়া বিরিয়ানি টা জাস্ট জমে না..ভাবছেন- এ ব্যাটা পুঁই চচ্চড়ি খেয়ে থাকে আর পরের হেঁসেলে মুরগী রান্না করে কেতা নিচ্ছে! হ্যাঁ! অবরে সবরে মুরগীটা- পাঁঠাটা জোটে বটে তবে, বিরিয়ানি সম্বন্ধে লিখতে তো দোষ নেই! তার চেয়ে বড় কথা- আমি তো আর নদে বা শান্তিপুরের গোঁসাই নই যে- এসব খাওয়া নিষেধ! পুরোপুরি শাক্ত (বাবা অবশ্য নিরামিষ শাক্ত ছিলেন)! তাইলে লিখতে দোষ কি? তবে, ভীতুর মরণ – বিরিয়ানির প্লেটে, বুইলেন কিনা মহায়। তা যা নিয়ে কথা হচ্ছিল! কোলকাতার বিরিয়ানিতে আলুটাই ন্যাজ বা টেইল। আলু না দিলে – কোলকাতার বিরিয়ানিতে ব্যাকরণের গলতি হয়; কিংবা ‘পিণ্ডারে পলাশ বন ; পালাবো পালাবো মন’ এইরকম একটা ফিলিংস আসেনা..কি বলেন??

এই এইইইইই তো প্ল্যান এসে গেছে ; ব্যস আর আটকায় কে আমায়;’বতরে পিরিতের ফুল’ ফুটে গেছে পুরোদমে..পাহাড় ঘেরা;মুখোশ রাজ্যে যাওয়ার দিন ঘোষণা;সেই মতো প্রস্তুতি তুঙ্গে…আমার ইনস্টিটিউশন Way To Success এর ছাত্র ছাত্রীরাও লেগে পড়লো ব্যাগ প্যাক করতে..তাদেরও মন পালাবো পালাবো করছে;নিত্যদিনের পড়াশোনা এবং আমার বকাঝকার বেড়াজাল কেটে বেরোনোর জন্য…ওহ বলতে তো ভুলেই গেছি এ বছর আমাদের পঞ্চম জন্মদিন ; তাই পুরোদমে আমরা সাপের পাঁচ পা দেখে ফেলেছি…

এক পা দু পা করে দিন এগিয়ে এলো ৪ সেপ্টেম্বর,২০১৮ হাওড়া থেকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার রাত ১১.০৫ এ;গন্তব্য পুরুলিয়া..কিন্তু ১২.০৫ এও দেখা নেই আমাদের বাহনের..এমনিতেই সেদিন এ শহরের মাথায় আকাশ থুড়ি ব্রিজ ভেঙে পড়াতে মন টা খুব বিষন্ন ছিল…শহরের সাথে সাথে এই বাহন ও আমাদের ভার আর বহন করতে চাইছে না?এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রায় ২লিটার জল শেষ…অবশেষে বাহনের আগমনী ধ্বনি শোনা গেলো…স্বস্তির নিঃশ্বাস..তারপর লাল মাটির দেশে সাফল্য উদযাপনের নেশায় সারারাত কখন যে কেটে ভোর হয়ে এসেছে ঠাহর করা হয়নি..তখন নীলরঙা ভোরের আলোরা তখনও ভিড় জমায়নি,মাথার কাছে খোলা জানলা দিয়ে হিমেল হাওয়ার অবাধ ঢুকে পড়ার সাথে সাথে ভোরের উৎস খুঁজে পেলাম..

শৈশব যেন ঠিক একখানা গঙ্গা ফড়িং,তুমি যত দূরেই যাওনা কেন সে ঠিক তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে ছুটবে পিছু পিছু।জঙ্গল পেরোলেই ওই বাঁকের মুখে লালমাটির রাস্তাটা…দুপাশে সবুজ হলুদ ক্ষেত ,দূরে হাতে গোনা দু একটা বাড়ি ,কাশের ঝোপ…এইসব শৈশব এ অবগাহন তার সাথে আমার ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজনা সব টা মিলে অদ্ভুত ভাবে নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের কারখানার() তে সাফল্যের গন্ধ টের পেলাম..

গন্তব্য #অযোধ্যা_পাহাড়

লাল মাটি আর শাল-পিয়াল-পলাশ জড়ানো পথ … চারপাশ ঘিরে সবুজ পাহাড় ! ঘনঘোর বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা টইটম্বুর জলাধার পেরিয়ে ছুটে চললো তিন তিন খানা বোলেরো(যেন তামিল সিনেমার তালিম চলছে :P) পথের সঙ্গী অবিশ্রান্ত বর্ষণ..এরপর এ সেই নিরুদ্দেশের সবুজ অভিসার ঘেরা অযোধ্যা হিল টপ যেন বৃষ্টি থামিয়ে আমাদের স্বাদর অভ্যথর্না জানালো..তারপর থেকে শুধুই অদ্ভুত মুগ্ধতার পালা বদল প্রতি ক্ষনে ক্ষনে..

গন্তব্য #বামনী_ফলস এবং #তুগ্রা_ড্যাম

“পাহাড় মাটির স্তূপ/জলের কাছে চুপ”-ঠিক তাই হঠাৎ পাহাড় ঘেরা বনানী রাজ্যে অনেকটা নিচুতে প্রায় ৬০০ পা নিচে ভয়ংকর সুন্দরী বামনী বর্ষাস্নাত হয়ে চঞ্চল বসনা,উন্মত্ত যৌবনা রূপে ধরা দিয়েছে..বামনীর ধাপে উদাত্ত কণ্ঠে ‘লাগ্ যা গালে’ প্রেমের নেশা ধরানো সুর মূর্ছনায় আমাদের ভরিয়ে তুলেছিল আমারই বন্ধু,ভ্রাতৃপ্রতিম ব্যান্ড এবং এর দল…ধন্যবাদ জানাই তাদের কে..তোদের পথচলা শুভ হোক…

গন্তব্য #বরন্তি এবং #মুরাডি_লেক

অক্লান্ত জার্নি র পর যখন অনেকেই ঘুম আছন্ন কিংবা পেটের মধ্যে কারোর কারোর ছুঁচো অলিম্পিক জিতে যাওয়ার মতো করে ছুটে চলেছে তখনি খিদে,তেষ্টা সমস্ত কিছু চূড়ান্ত নৈস্বর্গিক বড়ন্তি(একটুও বাড়িয়ে বলছিনা) মিটিয়ে দেবে তা এতক্ষন গুনাক্ষরেও টের পাইনি,মনে গুন্ গুন্ করে গাইতে ইচ্ছে করছে –
“রুখা পাথর‍্যা মাটি,
ও যে খাঁটি যেমন হীরামতি”
(স্থানীয় বিখ্যাত ঝুমুর সংগীত)

সারাদিন আকাশ মেঘাছন্ন;তাই বহুচর্চিত বরণটির সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য হলোনা;যেই না এই বিফলতার কথা মনে আস্কারা দিচ্ছে তৎক্ষণাৎ দু’চোখ ভোরে আশ্চর্য মায়াজাল !! সেকি পাহাড় কে চুমু খাচ্ছে আকাশের মেঘ !! এও কি সম্ভব আমাদের বাংলার লালা মাটিতে?আগেই বলেছি এটা আমাদের সাফল্য উদযাপন তাই এখানে বিফলতাকেও যেন প্রকৃতি মাস্কারা মাখিয়ে আমাদের সামনে সাজিয়ে দিচ্ছে..

এরপর পাহাড়ের কোল ঘেঁষা মহুলবন রিসর্ট আমাদের খাঁচায় পুড়ে ফেলার বন্দোবস্ত করেই রেখেছিলো আগে থেকেই..তাই কাল বিলম্ব না করে ফ্রেশ হয়ে সারাদিনের ধকল কাটিয়ে (যদিও তখন আর ধকল মনে হচ্ছেনা)সন্ধ্যের আসল অনুষ্ঠান গল্পে,গানে নিজেদের সাফল্য উদযাপনের ব্যস্ততায় মেতে উঠলাম..তারপর গানে,গল্পে,আড্ডায় কখন অদূরে রাত ভোর হয়ে মধুর সকাল এনে দিয়েছে খেয়াল ই নেই

গন্তব্য #গড়পঞ্চকোট এবং #পাঞ্চেত

প্রাচীন দেউল,বাংলার রাজ-রাজা দের ইতিহাস মেখে পেলব কোমল অভ্যর্থনা জানাতে কসুর করেনি,সাথে ছিল স্থানীয়দের বিশ্বস্ততার সাথে হাটের কাজের নিপুন নিদর্শন,মুখের আড়ালে মুখোশের ধাপ্পা দেওয়ার খেলা,এরপর সেই উন্মত্ত পাঞ্চেত;উচ্ছবাসে উদ্ভাসিত হওয়ার রেশ যেন কাটতেই চাইনা..

প্রাপ্তি সাপের পাঁচ পা;যা লেখার আগেই বলে রেখেছিলাম..এখন মিলিয়ে দেখছি:-

#১.একটা সন্ধ্যে অনাবিল খুশি,উৎসবে মাতোয়ারা,গানের তালে তালে ফানুশের মানুষ খুঁজে নেওয়ার যুদ্ধ,ফিরে দেখা শৈশব,শৈশবের গল্প গাঁথা,ইচ্ছেমতো খেয়ে চলা,অনেকটা ইচ্ছেপূরণ,কিছুটা স্বপ্নের বাতাবরণ

#২.বৃষ্টির এক নিজস্বতা আছে।শব্দ,গন্ধ ও গতির মিশেলে এমন অলৌকিক আবেদন আর কারো আছে কিনা,কখনো ছিল কিনা আমার জানা নেই।ঝমঝম ঝিরঝির টুপটাপ মিহীনগুঁড়ি ইলশেগুঁড়ি রকমারি বৃষ্টি।বৃষ্টি তোমায় ছোঁবে, জড়িয়ে ধরবে, আদর করবে তারপর গড়িয়ে পড়বে পায়ের পাতায় খেয়ালী মেয়ের মতো।হাতের পাতায় বৃষ্টি এক নিখাদ তরল রূপকথা,ঘাসের আগায় কিংবা গাছের পাতায় দুলবে মুক্তা বিন্দুর মত আবার স্রোতে ভেসে যাবে মহা উল্লাসে।

#৩.বরন্তি….সদ্য ভ্রমন মানচিত্রে উঠে আসা পোশাকী নাম,স্থানীয় পরিচিতি মুরারডি ড্যাম নামেই।লাল মাটির শুকনো বুকে সবুজ ফসলের ঢেউ তুলতে চাই জল,তাই বুঝি পাহাড় গড়িয়ে নামা বর্ষাধারা জমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরী এই জলাশয়।চারপাশে ছোট বড় পাহাড়ের সীমানা আঁকা জলাধার যেন হঠাৎ করে শিশুকালের জলছবির খাতা…সবুজ জমি,নীলচে পাহাড়,গেরুয়া মাটি আর ঝিকিমিকি রোদ ঢালা এক জল থৈ থৈ রূপকথা।সব মিলিয়ে সুখা মাটি,গ্রামজীবন আর এক আদিম প্রকৃতির অনবদ্য মেলবন্ধন এর নাম বড়ন্তি।সদ্য ভ্রমন মানচিত্রে উঠে আসা পোশাকী নাম,স্থানীয় পরিচিতি মুরারডি ড্যাম নামেই।লাল মাটির শুকনো বুকে সবুজ ফসলের ঢেউ তুলতে চাই জল,তাই বুঝি পাহাড় গড়িয়ে নামা বর্ষাধারা জমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরী এই জলাশয়।চারপাশে ছোট বড় পাহাড়ের সীমানা আঁকা জলাধার যেন হঠাৎ করে শিশুকালের জলছবির খাতা…সবুজ জমি,নীলচে পাহাড়,গেরুয়া মাটি আর ঝিকিমিকি রোদ ঢালা এক জল থৈ থৈ রূপকথা।সবমিলিয়ে সুখা মাটি,গ্রামজীবন আর এক আদিম প্রকৃতির অনবদ্য মেলবন্ধন এর নাম বরন্তি।

#৪.’জাগো উমা’..,অকালবোধন নয় তবে আগমনীর কাশের দোলা,একান্ত শহুরে আমাদের ভোরাই,ঝুমুর এর ছান্দিক গতিপথে ভেসে বেড়ানো,ছৌ মুখোশের আড়ালে মানবিকতার আস্ফালন;বামনীর গতিপথে আমাদের মতো বামনের হঠাৎ অনুপ্রবেশ,পাঞ্চেতের কোলে আবেগতাড়িত হয়ে ঢোলে পড়া আরও কতোও কি?কিছুটা না হয় ব্যক্তিগত..

#৫.মৌটুসি এক ভোর।শার্সি গলে আলহাদী রোদ পায়ের পাতায় লুটোপুটি।লালমাটি,ধূলিপথ ছাড়িয়ে গেছে সবুজ টিলার দেশে।মনকেমনিয়া সে দেশে বাজে বাঁশি,প্রজাপতি ডানা ছড়ায়, ছলকে পরে আলো, রং তুলিতে আলো ছড়ায় এখান সেখান…হলদে কিংবা সবুজ,বাসন্তী বা আসমানি দেদার রঙের মেলা।পান্না ধোয়া জলে এক মরাল গ্রীবা ছুঁয়েছে সেই রামধনু ডানা,মুঠিগলা আলোর প্রজাপতি ভাসে… ছুঁয়ে যায় গ্রামঘর,মেঠোপথ,টিলাদের দেশ আর ফসল ফুলের সংসার…বৃষ্টি পথ,অবিশ্রান্ত গতিতে গাড়ির ছুটে চলা-“এ যেন অজানা এক পথ,কি জানি কোথায় হবে শেষ?”

[আলাদা করে পথ নির্দেশিকা কিংবা হোম স্টে এর যোগাযোগ দিলাম না;কারণ গুগল এ এই জায়গা এবং এর প্রতিটি আনাচ-কানাচ বহুল চর্চিত,যা চাইবেন সার্চ করলেই পাবেন]

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল