কলকাতার অজানা ঐতিহাসিক স্থান

স্বপ্নালী দে
5 রেটিং
1978 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

সময় বয়ে  চলে তার নিয়ম অনুযায়ী । ইতিহাস হচ্ছে সেই সময়ের অনুসারী। ভারতের একসময়ের অর্থাৎ ব্রিটিশ যুগে 1757 থেকে 1912 সাল পর্যন্ত রাজধানী হিসাবে কলকাতার একসময়ের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল । সেই শাসনের সুবাদে কলকাতায় এক সময় গড়ে উঠেছিল নিয়ো গথিক, ক্যারোক, নিও ক্লাসিকাল, প্রাচ্য ও ইসলামিক শৈলির সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ,উদ্যান, রাস্তাঘাট ,সেতু আরো কত কি। আমার বরাবরই কলকাতার এই সকল স্থাপত্যের প্রতি বিশেষত অজানা স্থান এর প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। তাই যখনই সময় পাই তখনই এই সকল অজানা স্থানগুলির ইতিহাস খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি।

সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে কলকাতার গুরুত্ব বরাবরই। কারণ প্রধানত ব্রিটিশরা এবং অল্প কিছু স্থানে ফরাসি, ডাচ ,পর্তুগিজ এই সকল ইউরোপীয় শাসনের সুবাদে কলকাতার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় স্থাপত্য ও শিল্পকলা ।আজ সেই  ভ্রমনপিপাসু কলকাতার বেশ কয়েকটি স্থানের বর্ণনা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।

মেটকাফ হল: প্রথমেই আসি কলকাতার স্ট্যান্ড রোড এবং হেয়ার  স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত মেটকাফ হল এর প্রসঙ্গে। এটি উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ।এটি দেখতে প্রাচীন গ্রীক মন্দির এর মত ।এই স্থাপত্যটি 1840 থেকে 1844 এর মধ্যে রবিনসন এবং পরবর্তীকালে স্যার চার্লস মেটকাফ ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসাবে আসার পর হুগলি নদীর তীরে এই হলটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে  1994 সাল নাগাদ এই হলটি পুনঃনির্মাণ করা হয় ।এটি বর্তমানে সিনেমা জগতের বিভিন্ন বিষয়ে একটি গ্যালারি হিসাবে গড়ে উঠেছে, এছাড়া বাঙালিয়ানার বিভিন্ন নিদর্শন যা দেখে দর্শকদের মন আনন্দে ভরে উঠবে সুন্দর বৃহৎ বৃহৎ থাম দিয়ে সুসজ্জিত এই সাদা হলটি বড়ই মনোরম। থাম গুলিতে আপনারা করিন্থিয়ান ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখতে পাবেন।

টাউন হল:এরপর যাই ব্রিটিশ আমলের আরেকটি স্থাপত্য প্রসঙ্গে তা হল কলকাতার টাউন হল। রোমান ডোরিক শৈলীতে নির্মিত এই হলটি 1813 সালে জন গার্স্টিন দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এই হলটির কেবলমাত্র নিচের তলাতেই ঘুরে দেখতে পারে ,যেখানে রয়েছে বড় বড় মূর্তি বড় বড় হাতে আঁকা তৈলচিত্র ইত্যাদি ।উপরে যাওয়ার অনুমতি এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের নেই। 1914 সালে বেশিরভাগ মানব মূর্তি ভিক্টোরিয়া হলে স্থানান্তরিত করা হলেও 1919 থেকে এটি কিন্তু বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যদিও স্বাধীনতার পরে এটি অন্যান্য স্থাপত্যের মত খুবই অবহেলিত হয়েছিল ,কিন্তু বর্তমানে এর গুরুত্ব বুঝে এই হলটি আবার সুসজ্জিত হয়ে ওঠে ।সাদা বড় বড় থামের দ্বারা সুসজ্জিত হলটি দেখলে আজও মনে হয় ইতিহাস বহমান।

মার্বেল প্যালেস :এবারে আসি আমার খুব পছন্দের একটি জায়গা প্রসঙ্গে যার নাম মার্বেল প্যালেস ।উত্তর কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য শালী স্থাপত্যের মধ্যে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ।কলকাতার বিখ্যাত মল্লিকবাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে মার্বেল প্যালেসের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। 1840 সালে জমিদার রাজা রাজেন্দ্রলাল মল্লিক যিনি স্থাপত্যের এক বৃহত্তর অনুরাগী হিসেবে পরিচিত তিনি প্রধানত তার বসতবাড়ি হিসাবে এই প্যালেস টি নির্মাণ করেন। এখানে যদিও ফটো তোলা নিষিদ্ধ ,কিন্তু আমার দুচোখে যে ক্যামেরা আছে তা দিয়ে এই সৌন্দর্যের বর্ণনা করলেও খুব কম হবে। যেমন গোলাপ কাঠের  বৃহৎ রানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি আছে তেমনি ঘরের আনাচে কানাচে রয়েছে বড় বড় মূর্তি ,বড় বড় তৈলচিত্র ,বিভিন্ন আসবাবপত্র ইত্যাদি ।আজও এদের নিজস্বচিড়িয়াখানা আছে যেখানে দেখতে পাবেন হরিণ থেকে শুরু করে আরো কত কি। বাগানের সৌন্দর্য অপরিসীম সেখানে বিভিন্ন পশুর মূর্তি সুসজ্জিত রয়েছে। এর বর্ণনা যা করলাম তা তো স্বল্প কিছু বাকিটা আপনারা ঘুরে আপনাদের চোখ ও সার্থক করে আসবেন।

সেন্ট জনস চার্চ :সেন্ট জনস চার্চ প্রসঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাতে পাকাপাকিভাবে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার পর প্রথম সাধারণ জনগণের জন্য একটি চার্চ নির্মাণ করেন যার নাম সেন্ট জনস চার্চ ।যদিও এটি একটি ক্যাথিড্রাল। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার এর কাছে নির্মিত এটি একটি প্রাচীন সাধারণ জনগণের জন্য নির্মিত চার্চ।এই সুন্দর চার্চটি কলকাতার হৃদয়ে অবস্থিত। জেমস এগ দ্বারা নির্মিত চার্চটি ইট-পাথর এবং কাঠ দ্বারা তৈরি। সাধারণত এটি”পাথুরে গির্জা” হিসাবে পরিচিত। এর পাথর আনা হয়েছিল বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে হুগলি নদী মারফত। নিও ক্লাসিকাল স্থাপত্যে নির্মিত একটি বৃহৎ বর্গাকার কাঠামোর ওপর অবস্থিত ।পাথুরে পেঁচানো 174 ফুট লম্বা শিখর এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এর মধ্যে রয়েছে একটি বৃহৎ ঘড়ি আর এই ঘড়ির ঢং ঢং শব্দেই এর প্রাচীনত্ব পবিত্রতা আমাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল।

বেলগাছিয়া রাজবাড়ী: তারপর চলুন যাই বেলগাছিয়া রাজবাড়ী প্রসঙ্গে ,যা পাইকপাড়া রাজবাড়ী নামেও খ্যাত ।একটি বৃহৎ বাগান দ্বারা নির্মিত এই রাজবাড়িটি বর্তমানে বেলগাছিয়া মিল্ক কলোনিতে অবস্থিত। 1823 সালে একজন ইতালিয়ান এর কাছ থেকে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি কিনে নিয়েছিলেন। পরে 1856 সালে কান্দির জমিদাররা এই রাজবাড়িটি কিনে নেন ।এই রাজবাড়ির সমস্ত আসবাবপত্র আনা হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ইতালি থেকে। দ্বারকানাথ ঠাকুর এই রাজবাড়ীতে ব্রিটিশদের মনোরঞ্জনের জন্য অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এখানে অনেক বড় বড় নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, যেমন রত্নাবলী। বর্তমানে রাজবাড়িটি খানিক ভগ্নস্তূপে পরিণত হলেও এর মাধুর্য ও ঐতিহ্য আজও ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে চলেছে।

লস্কর মেমোরিয়াল :এরপর চলুন যাই একটু অন্যরকম স্থাপত্য প্রসঙ্গে। লস্কর হলো একটি ‘পার্শিয়ান’শব্দ যার অর্থ হলো ভারত মহাসাগরের নাবিক বা  খালাসি। 1924 সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন 896 জন ভারতীয় নাবিকদের জন্য, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের প্রাণ দান করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বর্তমানে কলকাতার হেস্টিংস চত্বরের নেপিয়ার রোডে এই লস্কর মেমোরিয়াল টি নির্মাণ করেন। নেপিয়ার রোডটি চিনতে অসুবিধা হলেও ময়দানের দক্ষিনে এটি অবস্থিত এটা চিনতে বোধকরি সবারই সুবিধাই হবে। এই মেমোরিয়ালটির বর্ণনা না দিলে এই বিষয়টির প্রতি কারোরই তেমন আকর্ষণ তৈরি হবে না ।এই স্মৃতিসৌধটি সম্পূর্ণ প্রাচ্য শৈলীতে নির্মিত ।এর চারদিকে চারটি থাম এবং উপরের অংশে চারটি ছোট ছোট মিনার রয়েছে আর মাঝে রয়েছে একটি বৃহৎ ডোম ।সম্পূর্ণ ভারতীয় শিল্প স্থাপত্য তৈরি এই স্মৃতিসৌধটি তে ইন্দো ইসলামিক শৈলীর ছাপ রয়েছে ।এই লস্কর মেমোরিয়ালটির নিচে সুন্দরভাবে বইয়ের ন্যায় এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সত্যি যারা বাধ্য হয়ে দেশের হয়ে কাজ করার জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের এই স্মৃতিসৌধটি না ঘুরে আসলেই নয়।

শ্রী দিগম্বর জৈন পার্শ্বনাথ মন্দির :এরপরে আসি শ্রী দিগম্বর জৈন পার্শ্বনাথ মন্দির প্রসঙ্গে। এটি বেলগাছিয়া ব্রিজের কাছে অবস্থিত। বর্তমানে এই মন্দিরটি দিগম্বর জৈন কমিউনিটির কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। 1867 সালে রায় বদ্রি দাস বাহাদুর জৈনদের 23 তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এটি চারটি মন্দিরের সমষ্টি। প্রধান মন্দিরটি দশম তীর্থঙ্কর শীতলা নাথকে উদ্দেশ্য করে বানানো। মন্দিরের ভেতরটি অত্যন্ত উচ্চমানের শিল্পশৈলী তে ভরা। আর এর ভেতরের আয়না ও রঙিন কাচের কাজ মনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। এই মন্দিরের মধ্যে যে বৃহৎ ঝাড়বাতি আছে তা দেখার মত সুন্দর।দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর আঁকা সত্যিই দর্শকদের নজর কেড়ে নেয়। এছাড়া রয়েছে বৃহৎ একটি বাগান যেখানে ফোয়ারা, ফুল ইত্যাদি মনকে শান্তি দেয়।


চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল