হিন্দি জগতের বহু প্রতিপত্তির হাতছানি সত্ত্বেও সর্বদা বাংলার পর্দায় উজ্জ্বল

শাব্দিক প্রতিবেদন
0 রেটিং
2285 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

টিভিতে খবরটা দেখেই বুকটা কেঁপে উঠল  নিখিলবাবুর। এ কি দেখছেন তিনি? বড় বড় হরফে সেখানে লেখা আছে,” দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত”। এককালীন নিজের প্রিয় অভিনেতার এই অবস্থা শুনে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক,কারণ কেবল অভিনেতা নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হলেন বাঙালির আবেগের অপর নাম। ‘বর্ষীয়ান ই বটে’ মনে মনে ভাবলেন নিখিলবাবু। তাঁর নিজেরই বয়স এখন প্রায় পঁচাত্তরের দোরগোড়ায়, বয়সের ভারে সব সহজ কাজ ও হয়ে উঠেছে কঠিন। অথচ তরুণকালের সেই যুবক অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিয়াশি বছরের প্রান্তে এসেও যেভাবে একের পর এক ছবি উপহার দিয়েছেন তা সত্যিই অবাক হওয়ার মতই বিষয়। কতটা মানসিক ভাবে তরতাজা থাকলে এভাবে সময়কেও বুড়ো আঙুল দেখানো যায় তা উনি না থাকলে উপলব্ধি করা সম্ভব হতনা বোধহয়। কাঁপা কাঁপা হাতে ড্রয়ার থেকে বহুবছরের পুরানো খাতা টা বের করলেন নিখিলবাবু,
কলেজ লাইফে একসময়ে রিপোর্টিং লেখার শখ ছিল তাঁর, তাই প্রিয় অভিনেতার জীবন নিয়ে লেখার লোভ সামলাতে পারেননি। খাতার প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা,

 ●একঝলক সাক্ষাতে, নিজের অজান্তেই অপুর সংসারের “অপু” রূপে সত্যজিত রায়ের চোখে নির্বাচিত হয়ে যান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,~

   পাশে একটা সাদাকালো ছবি লাগানো, বান্ধবীর সাথে সেই কোন যৌবনে সিনেমায় গিয়ে দেখা তার প্রথম ছবি, -‘অপুর সংসার’।এখন ও চোখ বন্ধ করলে সিনেমা দেখার ঘটনা টা সবেমাত্র গতকাল বলেই মনে হয় তাঁর। শর্মিলা ঠাকুরের পাশে হাসিমুখে বসে আছে এক বছর তেইশের এক সদাহাস্য যুবক,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘকায় সুদর্শন যুবকটির এটাই ছিল ইতিহাস তৈরীর প্রথম ধাপ
এই ছবি দিয়েই বাংলা ছায়াছবি জগতে পদার্পণ তাঁর। ১৯৫৮ সালে সৌমিত্রবাবু গিয়েছিলেন সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘জলসাঘরের’ শ্যুটিং দেখতে। তখন ও তিনি জানেন না কী চমক অপেক্ষা করছে ভাগ্যে! শ্যুটিং শেষে সেখান থেকে বেরোতে যাবেন,এমন সময় পেছন থেকে ডাক পড়ল, কী ব্যাপার? পেছনে ঘুরে বিস্মিত হয়ে দেখলেন স্বয়ং সত্যজিত রায় কথা বলতে চাইছেন তাঁর সাথে। খানিক কথাবার্তা হল, তার ফাঁকেই জলসাঘরের বিশ্বম্ভর সেন, ওরফে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসও হাজির সেখানে। তাঁকে ডেকে অদ্ভুত একটা কথা বলে বসলেন ‘রে’ অর্থাৎ সত্যজিত রায়। বললেন, “এই হল সৌমিত্র। আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসারে ও অপু করছে।” সৌমিত্রবাবু তো অবাক! নিজেই জানতেন না কখন জীবনের প্রথম ছবির ‘অপু’ হিসেবে সত্যজিত রায়ের চোখে ফুটে উঠেছেন তিনি। মিস্টার রে এর নজর একদম সঠিক ছিল, তা প্রমাণ করলেন শ্যুটিং শুরুর প্রথম দিনে। এক শটেই বাজিমাত করে ফেললেন ‘অপু’, উল্টোদিকে তখন সুন্দরী শর্মিলা ঠাকুর ও অভিনয় করছেন তাঁর জীবনের প্রথম ছায়াছবি ‘অপুর সংসারে’…

●ইতিহাসটা অন্য ও হতে পারত,কারণ জীবন প্রথম ছবিতেই স্ক্রিন টেস্টে বাদ পড়েন সৌমিত্রবাবু ~


 সাফল্যের পাশে ব্যর্থতা না থাকলে বুঝি জীবন অসম্পূর্ণ ই থেকে যায়। অপুর সংসারের “অপু” হওয়ার আগেই সৌমিত্রবাবু হতে পারতেন পনেরো শতকের সেই মহান মহাপ্রভু ‘শ্রী চৈতন্যদেব’। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। ১৯৫৭ সালে কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ সিনেমায় তিনি গিয়েছিলেন অডিশন দিতে। সিনেমাটি মূলত ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জীবনী ও পুরীর নীলাচলে তাঁর যাত্রাপথের কাহিনী নিয়ে। কিন্তু অভিনয় দারুণ হওয়া সত্ত্বেও সৌমিত্রবাবু বাদ পড়ে গেলেন সেই ছবি থেকে। বাধা হয়ে দাঁড়ালো স্ক্রিন টেস্ট, এই স্ক্রিন টেস্টেই পাশ হতে পারলেন না তিনি।পরবর্তীকালে তাঁর বদলে ছবিটিতে অভিনয় করেন অসীম কুমার।
 
    মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাতা উল্টিয়ে চললেন নিখিলবাবু। পুরোনো দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে তাঁর মন। খাতার এক পাতায় সুন্দর করে সাজানো সৌমিত্রবাবুর একটি সাদাকালো ছবি। ছবির নীচে রঙিন কালিতে লেখা,

●বিখ্যাত এই নাট্যকার এর সাথে পরিচয়ের পরই, নিজেকে পুরোপুরি অভিনয় জগতের মাঝে সঁপে দেন তরুণ অভিনেতা~

“১৯৩৫,১৯ এ জানুয়ারী, জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি”। এই দিনই ঘর আলো করে জন্মেছিলেন ভবিষ্যতে সকলের মন জয় করা ‘ফেলুদা’। অভিনয় টা ছিল টা তাঁর রক্তে, কারণ বাড়ির পরিবেশেই প্রথম এই পথের সূচনা হয় তাঁর এবং তারপরেই এই পথে যাঁর হাত ধরে আরো অনেকদূর এগিয়ে ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, প্রখ্যাত নাট্যকার শিশির ভাদুড়ি মহাশয়। বয়সটা তখন ১৯, কলকাতা কলেজে ফাইনাল পড়ছেন সৌমিত্র। অভিনয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণে দেখতে গিয়েছেন একট বাংলা থিয়েটার, অভিনয়ে শিশির ভাদুড়ি। থিয়েটার চলাকালীনই অভিনয় জগতে আসার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। দেখা করলেন এই বিখ্যাত নাট্যকার এর সাথে। এভাবেই শুরু হল আরো একটি ইতিহা। ভাদুড়ি প্রোডাকশনে একটি ছোটো চরিত্রেও তিনি অভিনয় করলেন সৌমিত্রবাবু। শিশির ভাদুড়ির সাথে সম্পর্ক টা ধীরে গুরু-শিষ্য থেকে পরিণত হল বন্ধুত্বে। সেই সম্পর্ক এতটাই মজবুত ছিল যে শিশিরবাবুর মৃত্যুর তিনবছর পর ও যখন থিয়েটার হাউস প্রায় বন্ধের পথে, তখন ও সৌমিত্রবাবু উদ্যোগে সেখানের মেন্টর হিসেবে নাম ছিল তাঁর। সেই পথ চলা শুরু যা এখনো রয়েছে অব্যাহত ……

●বাঙালির আবেগ, ফেলু মিত্তির এর আবির্ভাব- 


 
 ২১,রজনী সেন রোড,কলকাতা-২৯….ঠিকানা টা চেনা চেনা লাগছে কি? লাগার ই কথা, ফেলুদা প্রিয় সকলেই জানেন যে,এই ঠিকানাতেই যে বাস করেছেন ছয় ফুট লম্বা,প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষটি,
শ্রী প্রদোষ মিত্র ওরফে আমাদের প্রিয় ফেলুদা। সত্যজিত রায়ের সৃষ্টি এক অনবদ্য চরিত্র, আর সেই চরিত্রের এক প্রবল ভাবমূর্তি হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ততদিনে আপামর বাঙালির মন এমনিতেই জয় করে ফেলেছেন তিনি, এমন সময় যোগ হল নতুন ইতিহাস তৈরির পথ। সত্যজিত রায় মূলত তাঁর কথা মাথায় রেখেই তৈরী করতেন গল্পের চোরাগলি। অনেক ভালো অভিনেতা পরবর্তীতে অভিনয় করলেও সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে সৌমিত্রবাবু কে দেখার পর যে কেউ ই শ্রদ্ধা মাথা নত করে বলতে বাধ্য হবেন যে, ফেলুদা শব্দটা কানে এলেই আর কাউকে নয় সর্বপ্রথম মনে পড়ে এই সৌমিত্রবাবু চট্টোপাধ্যায় কেই। 
  
  শুধু ফেলুদাই নয়, সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় এরপর আরো প্রায় ১৪ টি সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের ক্রমাগত মন জয় করে নেন তিনি। চারুলতার ‘অমল’, ঘরে বাইরের ‘সন্দীপ’, দেবীর ‘ ‘উমাপ্রসাদ’ এবং অরণ্যের দিনরাত্রিতে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে ‘অসীম’ এই প্রতিটা চরিত্রতেই তাঁর অসামান্য,সাবলীল  অভিনয় দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন দর্শকেরা। 
    তবে তিনি  কেবল সত্যজিতের সিনেমাতেই কাজ করে গেলেন এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। সাল টৃ তখন ১৯৬৫।মৃণাল সেন ও তপন সিনহার পরিচালিত সিনেমাতেও কাজ করলেন তিনি। মৃণাল সেনের ‘আকাশ-কুসুম’ এ যেমন প্রশংসিত অভিনয় করেন তেমন ই তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দি’ তেও ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন ও তৎকালীন বিখ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারের দিকেও প্রচ্ছন্ন একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে  দিয়েছিলেন সৌমিত্রবাবু। 

*●অভিনয় এর পাশাপাশি ধরা দিয়েছেন অন্যভাবে অন্যরূপে ফেলুদা, করেছেন পত্রিকা সম্পাদনাও, যার নামকরণ ও প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন সত্যজিত রায় স্বয়ং~


    
আচ্ছা সৌমিত্রবাবু কি কেবল একজন অভিনেতা? এটা যদি কারো প্রশ্ন হয়,তবে তার উত্তর হবে সরাসরি না। কারণ অভিনয় জগতের বাইরেও ওনার আরো অনেক সত্তা ছিল যা অনেকের ই অজানা।
 সালটা ১৯৬১, সিনেমা করতে করতেই ঠিক করলেন সৌমিত্রবাবু যে এবার একটি পত্রিকা ও প্রকাশনা করবেন তিনি। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, সত্যজিত রায়ের কাছে গেলেন পত্রিকার নামকরণ করে দেওয়ার জন্য। প্রিয়পাত্র সৌমিত্রের আবদারে  সত্যজিত পত্রিকার নাম দিলেন, ‘এখন’। তিনি শুধু নাম দিয়েই থেমে থাকলেন না, সাথে পত্রিকার কভার পেজের ডিজাইন ও করেন নিজের হাতে। সৌমিত্রবাবু ও নির্মাল্য আচার্যের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরী এই পত্রিকা প্রকাশনা তাদের তরফ থেকে বন্ধ হয়ে গেলেও, সত্যজিত বাবু কিন্তু আরো কয়েক বছর সেই পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। 
  
এই তো গেল পত্রিকা প্রকাশনার কথা,এছাড়াও কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন তাঁর বিপুল বৈচিত্রের এক একটি দিক। থিয়েটার ও বাংলা সিনেমা ছাড়াও তিনি সুজয় ঘোষ পরিচালিত ‘অহল্যা’ ছবিতে দর্শকের হৃদয় জয় করলেন আবার ও রাধিকা আপ্তে ও টোটা রায়চৌধুরীর সাথে। সিনেমা থেকে তিনি পুনরায় থিয়েটার জীবনে ফিরে আসেন নিজের প্রোডাকশন ‘নাম জীবন’ এর সাথে। 
টিকটিকি’ কিংবা ‘ফেরা’র মত নাটকে তাঁর অভিনয়ের কথা আজও বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। যাত্রাও করেছেন একটা সময়। ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় শেক্সপিয়ারের কিংবদন্তি নাটক রাজা লিয়র এ নাম ভূমিকায় অভিনয়  করেছেন, শুধু তো অভিনয় করেননি, বাংলা থিয়েটারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছিল রাজা লিয়ারের ভূমিকায় সত্যজিতের প্রিয় পুলুর অনবদ্য অভিনয়। বহু টাকা ও প্রচারের হাতছানি সত্ত্বেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কখনোই টলিউড ছেড়ে বলিউডের দিকে গেলেন না। বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে বিরাজ করে রইলেন সর্বদা….

    নিখিলবাবু আর পড়তে পারছেন না। বয়সের ভারে চোখে ব্যথা হচ্ছে তীব্র। তিনি জানেন এ খাতায় আর কী লেখা আছে। শেষ অধ্যায়ে এতে আছে সৌমিত্রবাবুর প্রাপ্তির কিছু অংশ। 

●বহুমুখী অভিনয় প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও, পাননি সঠিক সময়ে যোগ্য  সম্মান, প্রতিবাদে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড~

সেই যুবক বয়স থেকে বৃদ্ধবয়স পর্যন্ত বাঙালি যা পেয়েছে তাঁর থেকে সেই পাওয়া বহুগুণে ফিরিয়ে দিয়েছে ভালোবাসা হিসেবে। এতেই হয়তো তিনি পেয়েছেন তাঁর প্রাপ্তি। বলা যেতে পারে তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা। অথচ ভারতীয় চলচ্চিত্র মহলে তিনি একসময়ে খানিক উপেক্ষা ই ছিলেন। এত সুন্দর অভিনয়ের দক্ষতা সত্ত্বেও ২০০১ সাল অবধি কোনো জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়নি তাঁকে। প্রতিবাদ হিসেবে ‘দেখা’ সিনেমাটির জন্য পাওয়া স্পেশাল জুরি  অ্যাওয়ার্ড ফিরিয়ে দিলেন সৌমিত্রবাবু। ২০০৪ সালে অবশেষে পেলেন পদ্মভূষণ সম্মান। অবশেষে অভিনয় জগতের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে ২০০৬সালে পেলেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। এরপরে তিনি লাভ করলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার বালাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান লিজিওন অব অনার ও আরো অন্যান্য সম্মানের পালক যোগ হল তাঁর সোনার মুকুটে। 
   
    এর পরের ঘটনা খাতায় আর লেখা নেই, বয়সের কারণে আর লেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে খবর সবসময়ই রাখতেন নিখিলবাবু। সাম্প্রতিক কালে সৌমিত্রবাবুর অভিনীত ছবিগুলি দেখতেও ভুল হয়নি তাঁর। বেলা শেষে, সাঁঝবাতি, বরুণবাবুব বন্ধু এইসব সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখে আজ ও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। কী অসামান্য দক্ষতা আর হার না মানা মনোভাব পর্দায় অভিনীত উদয়ন পণ্ডিত বা খিদ্দার মতই দেখিয়ে গেলেন সত্যজিতের মানসপুত্র। 

খাতাটা বন্ধ করে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন নিখিলবাবু। লড়াইটা তাহলে অবশেষে থামল। দুর্ধর্ষ মগনলাল মেঘরাজকে যিনি রেয়াত করেননি, করোনাসুরের দাপট কোথাও একটা সেই ফাইটিং স্পিরিটে আঘাত হানল। বাকি কাজটা করল শরীরে আগেই ঢুকে থাকা রোগব্যাধি। ‘ অপরাজিত ‘ তাহলে আর রইলেন না অপু, ‘ ফাইট ‘ তাহলে অবশেষে শেষ করলেন খিদ্দা। ফেলুদা কখনো হারতে শেখেনি যদিও, তবু নিয়তির লেখা খন্ডানোর সাধ্য তো কারো নেই। শারীরিক ভাবে তাঁর দেহাবসান ঘটলেও মানসিকভাবে সবার মনে তিনি আজও জীবিত।  বাঙালির আবেগ, বাঙালিয়ানার আভিজাত্যের প্রতীক সৌমিত্র চ্যাটার্জি কখনো অমলিন হননি আর হবেনও না।খাতাটা চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করলেন নিখিলবাবু। বহু বছর আগের স্মৃতির পাতায় সেই যুবক অপুর কথা খুব মনে পড়ছে আজ! 
-‘না ফেরার দেশে খুব ভালো থাকবেন সৌমিত্রবাবু’ 
 মনে মনে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে চোখের জলটা মুছলেন তিনি। কিন্তু সত্যিই কি হেরে ছিলেন তিনি?পুনরায় ভাবলেন নিখিলবাবু। সারাজীবন জীবনকে উপভোগ করতে, প্রতিটা মুহূর্তে জীবনের রূপ রস গন্ধ চেটেপুটে নিতে চাইতেন সৌমিত্র। দীর্ঘ জীবনে সেটা নিজে করেছেন এবং বাঙালিকে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। অভিনেতা, কবি, লেখক, আবৃত্তিকার, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সফল এক মানুষ হিসেবেই সবাই তাঁকে মনে রাখল। আর, চিরকালের লড়াকু মানসিকতা? মৃত্যুর আগে কিন্তু কোভিড নেগেটিভ হয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্র। ‘ দুর্ধর্ষ দুশমন ‘ করোনা ভাইরাসকে কিন্তু সেই পরাজিত হতেই হল ফেলুদার কাছে। নিজে হারলেও প্রতিপক্ষকেও জিততে দেননি সৌমিত্র। যতই ভাবেন ততই অবাক হন নিখিলবাবু। কি অবিশ্বাস্য লড়াকু এই মানুষটা! মৃত্যুর পরেও সেই অপরাজিত রয়ে গেলেন সৌমিত্র। উদয়ন পণ্ডিতেরা যে হারতে জানে না!

এতক্ষণে হয়তো কানপুর সেন্ট্রাল স্টেশনের মতই পরপারের কোনও প্ল্যাটফর্মে দেখা হয়েই গেছে ফেলুদা এবং জটায়ুর। চোখ ক্রমশ ভারী হয়ে আসা সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি খেলে গেল নিখিলবাবুর। মঞ্চের রাজা লিয়ার বাংলা সংস্কৃতি জগতের রাজা হিসেবেই বিদায় নিলেন ইহজগত থেকে! এও কি কম প্রাপ্তি?চিরযৌবনের প্রতীক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মার গভীর শান্তি কামনা করে, ধীরে ধীরে এক গভীর নস্টালজিয়ায় ডুবে গেলেন তাঁর অনুরাগী নিখিলবাবু। চোখের কোনায় অবাধ্য জলটা কিছুতেই থামছে না,বারবার চলে আসছে অতীত স্মৃতির হাত ধরে…

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • sayan sarkar November 22, 2020 at 8:27 pm

    সত্যি লেখাটা দারুণ ।। অপুর জগতে হারিয়ে গেছিলাম 🌝❤️

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল