ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, রোলিং স্টোন গ্যাদারস নো মস, যার অন্তর্নিহিত মানে হলো, ভবঘুরের জ্ঞানের ভাঁড়ার ঠনঠনে। আমি এই প্রবাদের সঙ্গে একেবারেই একমত নই, আমার তো মনে হয়, বরং উল্টোটাই ঠিক। কালের সারণিতে কোহিনূরের যাত্রাপথে এই সামান্য মণি দেখেছে লালসা, যুদ্ধ, লুন্ঠন, হনন, অত্যাচার, ঔপনিবেশিকতা, শঠতার চরম নিদর্শন। পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নানা ঘটনা, নানা কাহিনীর এমন ঠাসবুনান যে, ঘটনাকে কাহিনীর থেকে আলাদা করে মুশকিল। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল, কোহিনূরের জন্মলগ্ন থেকে টাওয়ার অফ লন্ডন পর্যন্ত এই আকর্ষণীয় যাত্রার পেছনের সত্যিটা জানার। তাই অনেকিনের চেষ্টার ফলস্বরূপ এই কলম..
স্কুলের ইতিহাস বইতে শাহজাহানকে কোহিনূর মণির প্রথম স্বীকৃত মালিক হিসেবে জেনেছি। মণিটি খচিত ছিল ওনার অনিন্দ্যসুন্দর ময়ূর সিংহাসনে, জুয়েল ইন দ্য থ্রোন। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে ময়ূর সিংহাসনটি কোহিনূর সমেত লুন্ঠন করে নিয়ে যান। আমি অন্তত জেনেছি এইটুকুই। আসলে মণিটির ইতিহাস নথিবদ্ধ করা নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যথা ছিল না কোনোদিন, যতদিন না লর্ড ডালহৌসি ১৮৪৯ সালে দিল্লির এক সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরুণ অফিসার থিও মেটকাফকে নির্দেশ দেন মণিটির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে লিপিবদ্ধ করতে। তো লর্ড ডালহৌসির হঠাৎ কোহিনূর মণির ইতিহাস নিয়ে এতো মাথাব্যথা কেন হলো?
আসলেই থিও’র গবেষণা, থিও’র ভাষাতেই ছিল বাজারি গল্পগাছা। তবুও, ইন্টারনেট ঘাঁটলে তাঁর গবেষণালব্ধ গল্পগাছাগুলোই চোখে পড়বে। এমনকি উইকির বিবরণও থিও’র গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই লেখা। এই গবেষণার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কাজ হয়নি বিশেষ। এইভাবে বিভিন্ন সাইট ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় ইংল্যান্ডের একটি নামকরা খবরের কাগজের সাইটে। সেখান থেকে জানতে পারলাম যে বিখ্যাত স্কটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডারিম্পল কোহিনূর মণির রহস্য অনুসন্ধানে মৌলিক গবেষণা করেছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ফলের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় লেখিকা অনিতা আনন্দ এর সঙ্গে একসাথে একটি বই লিখেছেন, ‘কোহিনূর – দি স্টোরি অফ ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড’। সহধর্মিনী বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে কর্মরত – তাই তৎক্ষণাৎ আদেশ গেলো বইটির ব্যাপারে। সারা বার্মিংহাম-এ সিটি কাউন্সিলের উনচল্লিশটা লাইব্রেরি আছে, আর বইটির মাত্র একটি কপিই আছে কাউন্সিলের সমস্ত লাইব্রেরি মিলিয়ে। কিছুদিন অপেক্ষার পর সহধর্মিনীর দাক্ষিণ্যে বইটি হাতে এলো। পড়তে আরম্ভ করেছি আস্তে আস্তে। ডারিম্পল সায়েব নিজে লিখেছেন ‘জুয়েল ইন দ্য থ্রোন’ -এর কাহিনী, জন্মলগ্ন থেকে লাহোর চুক্তির সময় পর্যন্ত কোহিনূরের যাত্রা। আর অনিতা আনন্দ লিখেছেন ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ এর কাহিনী, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সাথে কোহিনূরের অভিজ্ঞতার গল্প।
এইবারে সময় সারণিতে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক,১৮৪৯ সালের বসন্ত, মার্চের ২৯ তারিখ। পঞ্জাবের বালক মহারাজা দলীপ সিংহ উপস্থিত হলেন লাহোর দুর্গের শিস-মহলে। দশ বছর আগে তিনি তাঁর বাবা মহারাজা রণজিৎ সিংহকে হারিয়েছেন। মা রানী জিন্দানও বিচ্ছিন্ন, নগরের বাইরে তিনি একটি প্রাসাদে বন্দির জীবন কাটাচ্ছেন। মহারাজা দলীপ সিংহের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ভীষণ বর্ণময়, বিলেতে থাকাকালীন রানী ভিক্টরিয়ার সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল; সে গল্প আর একদিন হবে’খন। যা বলছিলাম, বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যে চলছে চরম নৈরাজ্য, গৃহযুদ্ধ; বিশ্বাসঘাতকতার পরিবেশ চারপাশে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল, ভারতের শেষ স্বাধীন রাজ্যটির দখল নিতে। উপর্যুপরি কয়েকটা যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর কাছে শিখ বাহিনীর হার হয়, আর তাই মার্চের ১২ তারিখে শিখ বাহিনী আত্মসম্পর্পন করে। এক প্রকাশ্য সমাবেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে রাজা চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। মুহূর্তের মধ্যে শিখ খালসার পতাকা নেমে এলো, উঠে এলো ইউনিয়ন জ্যাক।
এহেন লাহোর চুক্তির সন্ধিপত্রে একটি বিশেষ ধারা ছিল: ‘শাহ সুজাউল মুল্ক কর্তৃক মহারাজা রণজিৎ সিংহকে প্রদত্ত কোহ-ই-নূর মণিটি লাহোরের মহারাজা ইংল্যান্ডের মহারানীকে সমর্পন করবেন’। চুক্তি স্বাক্ষরের কথা শুনে গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আই হ্যাভ কট মাই হেয়ার (খরগোশ)’, যার মানে হলো ‘আমি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সসম্মানে উত্তীর্ণ হলাম’। আসলে ভারত দখল আর কোহিনূর দখল সেসময়ে সমার্থক হয়ে গেছিলো।
১৮৪৯-এর ডিসেম্বরে এক বর্ণহীন সকালে লর্ড ডালহৌসি নিজে উপস্থিত হলেন লাহোরে অমূল্য এই মণিটির আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের সময়। ডিম্বাকৃতি মণিটি মহারাজ রণজিৎ সিংহের হাতের তাগায় খচিত ছিল, আর তা রাখা থাকতো লাহোরের তোষাখানায়। মণিটি রাখবার জন্য লেডি ডালহৌসি বিশেষ ভাবে বানিয়েছিলেন সুন্দর নরম কিড-লেদারের তৈরী ছোট্ট একটি পাউচ। বালক মহারাজার ব্রিটিশ অভিভাবক ডক্টর লোগিন-এর কাছ থেকে মণিটি নিয়ে লর্ড ডালহৌসি রসিদে লিখলেন, ‘আজকের দিনে আমি লাহোরের মহারাজার কাছ থেকে কোহিনূর মণিটি পেলাম’, দপ্তরের সিল সহ নিজের ও উইটনেসের স্বাক্ষর পড়ে গেলো ওতে। কোহিনূর হয়ে গেলো ইংল্যান্ডের মহারানীর সম্পদ।
এক সপ্তাহের মধ্যে লর্ড ডালহৌসি থিও মেটক্যাফের শরণাপন্ন হলেন। তাঁকে আদেশ দিলেন অবিলম্বে কোহিনূর মণির ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান করে একটা রিপোর্ট প্রস্তুত করতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই তরুণ অফিসারটি স্বভাবে ছিলেন আমুদে, কুকুর-ঘোড়া-পার্টিতে তাঁর কাটতো অবসর সময়, আর জুয়া খেলে দিল্লির বাজারে তাঁর বেশ ধার-দেনাও হয়ে গেছিলো। থিও’র আর একটা বেয়ারা শখ ছিল, বিবিধ বিখ্যাত মণি বা রত্ন নিয়ে গবেষণা বা চর্চা করা। বুদ্ধিমান বা পরিশ্রমী অফিসার হিসেবে থিও’র কোনো নামডাক না থাকা সত্ত্বেও লর্ড ডালহৌসি তাই এই থিও’র শরণাপন্ন হলেন। ডালহৌসির ইচ্ছে ছিল, লন্ডনে কোহিনূর মণিটির সাথে এই ঐতিহাসিক রিপোর্টটিও যেন পাঠানো যায়।
তুমুল উৎসাহে থিও গবেষণা চালু করলেও পড়লেন ফাঁপরে। আসলে মণিটি বহুবছর ছিল ভারতের বাইরে। আর তাই তার ঐতিহাসিক সত্যের বদলে মিলছিলো নেহাতই গল্প। থিও’র নিজের ভাষায়, তা নেহাতই দিল্লির বাজারি গল্পগাছা (‘Delhi bazaar tittle-tattle’)। মণিটি নাকি পাঁচ হাজার বছর আগে, শ্রীকৃষ্ণের সময়কালে মসলিপত্নমের কাছে গোদাবরীর তীরবর্তী কোনো খনি থেকে প্রাপ্ত। দাক্ষিণাত্যে নানা হাত ঘুরে এটি দিল্লির সুলতান মোহাম্মদ ঘোরির হাতে এসে পড়ে। তিনি নাকি এটি কোনো একটি মন্দির থেকে লুন্ঠন করেন। ঘোরির থেকে তুঘলক, তারপর লোদি, তারপর এসে পড়ে মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের হাতে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, মুঘলদের কাছে এর সমতুল্য আরও দুটি হিরে ছিল – দরিয়া-ই-নূর (আলোর সমুদ্র), বর্তমানে এটি আছে তেহরানে; আর ছিল গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড, বা অরলভ ডায়মন্ড, যেটি এখন রাশিয়ার ক্রেমলিনে রক্ষিত। তিনটে হীরের প্রতিটির সাইজ ছিল কমবেশি ১৯০ ক্যারেট করে। তাই কোহিনূরের আলাদা করে কোনো বিশেষ কদর মুঘল সম্রাটদের কাছে ছিল না। আর তাছাড়া মুঘলদের কাছে হীরের চাইতেও উজ্জ্বল বর্ণের পান্না বা চুনির কদর ছিল বেশি। ১৭৩৯ এ নাদির শাহ যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন মুঘল সম্রাট ছিলেন মোহম্মদ শাহ। থিও’র গবেষণা অনুযায়ী, মুঘল সম্রাটের সাথে ভুলবশত পাগড়ি বদলের সময় কোহিনূর নাকি নাদির শাহের হস্তগত হয়। নাদির শাহের মৃত্যুর পর তাঁর প্রধান দেহরক্ষী আফগান সর্দার আহমেদ শাহ আবদালি মণিটি হস্তগত করেন। এই সময় থেকে বহু বছর মণিটি ছিল আফগান কব্জায়। শেষ পর্যন্ত লাহোরের মহারাজা রণজিৎ সিংহ ১৮১৩ সালে মণিটি আফগান শাহদের যুদ্ধে পরাজিত করে ছিনিয়ে নেন। এই ছিল থিও’র গবেষণালব্ধ বিষয়বস্তু।
গবেষণা শেষে মণিটি লন্ডনে পাঠানো হয়। রানী ভিক্টরিয়া সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ক্রিস্টাল প্যালেসের সেই প্রদর্শনীতে ভিড় হলো অনেক, মাইলের পর মাইল লম্বা লাইন হলো। কোহিনূর বিবেচিত হলো একদা পৃথিবীর ধনরাশির সবচাইতে সমৃদ্ধ উৎস ভারতবর্ষের সবচাইতে মূল্যবান রত্ন হিসেবে। সমগ্র পৃথিবীর কাছে ইংল্যান্ডের মহারানীর এ যেন সদর্পে ঘোষণা – ভারতবর্ষ এখন আমার।কি আপনার ও মনে হচ্ছে না ভারত সেদিন জগৎ সভায় শ্রেষ্ট আসনই নিয়েছিলো?
পরবর্তী পর্বে,আপনাদের মনে উঁকি দেওয়া অনেক প্রশ্নের কিনারা হবে,কথা দিলাম..সাথে থাকুন,পড়তে থাকুন আর জানাতে থাকুন কেমন লাগছে? আপনাদের ‘কোহিনুর রহস্য’..
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য : গুগল
[…] বিগত পর্বের লিঙ্ক :- saabdik.com/kohinoor-mistry-part-1 […]
[…] বিগত পর্বের লিঙ্ক :- ১. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-1২. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-2 […]
[…] বিগত পর্বের লিঙ্ক :- […]