১৫১৯ সাল। মধ্য এশিয়ার ফরগানার তুর্ক-মঙ্গোল কবি-রাজপুত্র জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর কতকটা ভাগ্যান্বেষণেই এসে পৌঁছলেন ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে চন্দ্রভাগার তীরে। প্রতিবারের মতো সমরখন্দকে কব্জা করার তৃতীয় প্রচেষ্টাও বিফল হয়েছিল তাঁর। কোথায় রাজপুত্র থাকবেন রাজপ্রাসাদে, তা না, মাসের পর মাস সাধারণ তাঁবুতে রাত্রিবাস আর দিনের বেলায় পাহাড় থেকে মরুভূমিতে ঘোড়ার পিঠে পরিযায়ী জীবনে তিনি হয়ে পড়লেন ক্লান্ত। একটা কোনো দেশে তো থিতু হতে হয়! আফগনানিস্তানেও তিনি ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু সুজলা-সুফলা পাঞ্জাবের আকর্ষণে তিনি অল্প সংখ্যক অনুচর নিয়ে অতিক্রম করলেন খাইবার গিরিপথ। পাঞ্জাব এককালে তাঁর ঠাকুরদা’র বাবা তিমুরের অধীনস্ত ছিল।তাই পাঞ্জাব সম্পর্কে তাঁর মনে একটা ‘সফ্ট কর্নার’ ও ছিল। উদ্দমী ও উচ্চাভিলাষী বাবর চাইলেন সমগ্র উত্তর ভারতের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। দিল্লিতে তখন সুলতান ইব্রাহিম লোদির শাসন। নানা সমস্যায় জর্জরিত তিনি – একে অর্থনীতি দুর্বল, তার ওপর প্রাদেশিক শাসকর্তাদের সাথে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই সুযোগে ১৫২৬ এর বসন্তে মাত্র পঁচিশ হাজার সৈন্য আর কুড়ি-পঁচিশটা কামান নিয়ে বাবর আক্রমণ করলেন দিল্লি। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান লোদি তাঁর এক লক্ষ সেনা আর এক হাজার হাতি নিয়ে সাম্রাজ্য দূরস্থান, নিজের প্রাণ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারলেন না। এই হারের অন্যতম কারণ ছিল সেই সময়ের বিচারে বাবরের অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি – যুদ্ধে কামান, বন্দুক আর গোলার ব্যবহার। বাবর স্থাপন করলেন মুঘল বংশের শাসন, যা বংশানুক্রমে স্থায়ী ছিল সাড়ে তিনশো বছর।
কলম ও তরবারি, দুই মাধ্যমেই বাবর ছিলেন সমান কুশলী। তিনি তাঁর জীবনের গল্প অকপট ভাবে বলে গেছেন তাঁর লেখা বাবরনামা বইতে। হৃদয় উজাড় করে তিনি লিখে গেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। তিনি সেখানে যেমন লিখে গেছেন আফগানিস্তান ও ভারতে প্রাপ্ত ফলের স্বাদের তুলনা, বা আফিম আর মদিরার মৌতাতের তুলনা, তেমনি শয্যায় পুরুষ ও মহিলা সঙ্গীর সাথে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতার তুলনাও। হ্যাঁ, তিনি তাঁর যৌনজীবন নিয়েও ছিলেন অকপট, সে গল্প হবে আর এক দিন। তিনি বাবরনামাতে তাঁর রাজত্বকালে প্রাপ্ত বিভিন্ন রত্নের সমৃদ্ধি নিয়েও কথা বলে গেছেন।
এই বাবরনামাতে তিনি লিখে গেছেন তাঁর জীবনে প্রাপ্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হিরের কথা। বাবরের পুত্র হুমায়ুন একসময় গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিৎ ও তাঁর পরিবারকে বন্দি করেন। বন্দিদশায় রাজা বিক্রমজিৎ হুমায়ুনকে উপঢৌকন হিসেবে বিপুল পরিমাণ সোনা, রত্ন ও মূল্যবান সামগ্রী দান করেন। সেই দানের মধ্যে অন্যতম ছিল একটি চমৎকার হিরে, যা বাবরের বর্ণনায়, শুধু তিনি নন, বহু মানুষ এর আগে এত বড় হিরে কখনো দেখেননি। বাবরের অনুমান, খুব সম্ভব এই হিরে এককালে আলাউদ্দিন খলজির ছিল। তাঁর ধারণায়, আকারে এই হিরে ১৫০ ক্যারেটের মতো, আর মূল্য? ‘সারা পৃথিবীর আড়াই দিনের খাবার খরচের সমান এই হিরের মূল্য’। সমসাময়িক সময়ে জনৈক এক মোহাম্মদের রত্ন সম্বন্ধীয় এক লেখাতেও (এর ওপর ভিত্তি করে এইচ বেভেরিজ লিখেছেন ‘বাবর’স ডায়মন্ড: ওয়াজ ইট কোহিনূর?’) ছিল এই হিরের উল্লেখ। মুঘল আমলের একেবারে শুরুর দিকে এই দুই তথ্য-সূত্রে আছে কোহিনূরের অস্তিত্বের আভাস। বিবরণ সুস্পষ্ট নয়, আর সেই সময় ভারতে বড় হিরে নেহাতই অপ্রতুল ছিল না। তবে এই হিরের কোহিনূর হবার সম্ভাবনা একটা থেকেই যায়।
যাই হোক, বাবরের হিরে বেশিদিন ভারতবর্ষে থাকেনি। ভারতে মুঘল শাসন কায়েমের মাত্র চার বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় তাঁর। বাদশাহ হলেন হুমায়ুন। বংশধারায় বাবরের কাছ থেকে হুমায়ুন পেয়েছিলেন সাহিত্যানুরাগ ও শিল্পানুরাগ। দিনের বেশির ভাগ সময় তাঁর কাটতো পড়াশোনা আর লেখাজোখায়। কিন্তু পিতার উদ্যম বা রণকৌশলের কণামাত্র তিনি পাননি। মাত্র দশ বছরের মধ্যে শের শাহের কাছে সিংহাসন খুইয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয় পারস্যে। নিজের স্ত্রী ও পুত্র আকবরকে ভারতবর্ষে ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও সঙ্গে রেখেছিলেন অমূল্য সম্পদ, কোষাগারের বেশ কিছু রত্ন, যার মধ্যে ছিল বাবরের সেই বিখ্যাত হিরেও। কানাঘুষোয় তা শুনে যোধপুরের রাজা মলদেবের এক সেনা বণিকের ছদ্মবেশে সেই হিরে কিনতে চেয়েছিলেন। শোনা যায়, হুমায়ুন বলেছিলেন, ‘এই রত্ন অমূল্য, এ কেনা যায়না। হয় তরবারির সাহায্যে ছিনিয়ে নিতে হয়, নয় কোনো মহামহিম সম্রাটের কাছে দান হিসেবে পেতে হয়’। আবুল ফজলের লেখা আকবরনামা গ্রন্থে রয়েছে এই ঘটনার বিবরণ।
বাবরের হিরে সহ এই রত্নের সংগ্রহ পারস্যে থাকাকালীন তাঁর কাজে এসেছিলো। এই ছিল তাঁর অজ্ঞাতবাসে একমাত্র সম্বল। মজার ব্যাপার, তা সত্ত্বেও হুমায়ুন এই রত্ন রক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী ছিলেন না। চমকে দেবার মতো তাঁর একটা অন্যমনস্কতার গল্প আছে। পারস্যে পলায়নরত হুমায়ুনের বাহিনীতে জোহর বলে তাঁর সব সময়ের সাহায্যের জন্য একটি অল্পবয়স্ক ছেলে ছিল। সেই ছেলে বড় হয়ে হুমায়ুনের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার গল্প লেখে পার্সি ভাষায়, যা পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয় ‘দ্য প্রাইভেট মেমোয়ার্স অফ দ্য এম্পেরর হুমায়ুন’ নামে একটি বইতে। সেখানে যে গল্পটি আছে সেটি কতকটা এই রকম: সম্রাট বেশ কিছু মূল্যবান রত্ন সবুজ রঙের একটি বটুয়ার মধ্যে রাখতেন যেটি সবসময় তাঁর সঙ্গে তাঁর পোশাকের মধ্যেই রাখা থাকতো। একদিন প্রার্থনার আগে অযু করবার সময় তিনি বটুয়াটি পোশাক থেকে বের করে পাশে রেখে দেন। প্রার্থনা শেষে জোহর যখন তাঁকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করছে তখন বটুয়াটি তার চোখে পরে। সে তৎক্ষণাৎ বটুয়াটি নিয়ে এসে সম্রাটের হাতে দেয়। অত্যন্ত খুশি হয়ে সম্রাট তখন বলেন, ‘বালক, তুমি যে আমার কী উপকার করলে তা তুমি বুঝতেও পারলে না। এ জিনিস হারিয়ে গেলে পারস্যের সম্রাটের কাছে আমার সমস্ত সাহায্য প্রার্থনা বিফলে যেত। ভবিষ্যতে তুমিই এ জিনিস সামলে রেখো’।
কালক্রমে এই রত্নগুলি তাঁর সহায় হয়েছিল। ১৫৪৪ -এর শরতে সুন্নি সম্রাট হুমায়ুন যখন পারস্যের শিয়া শাহ তাহমাসপ-এর সাহায্যপ্রার্থী হলেন, তখন শুরুতে পেয়েছিলেন শীতল অভ্যর্থনা। তবে হুমায়ুনের পাঠানো হিরের ভেট তাঁকে উল্লসিত করেছিল যথেষ্ট, আর তখন তিনি হুমায়ুনের দিকে বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। জোহরের জবানিতে: ‘আমাদের তখন মৃগয়া-ক্ষেত্রের শিবিরে বেশ কিছুদিন রাখা হয়েছিল। একদিন সম্রাট আদেশ দিলেন তাঁর রত্নের সংগ্রহ নিয়ে আসতে। সেখান থেকে তিনি বেছে নিলেন সবচাইতে বড় হিরেটি। সেটি রাখলেন একটি মুক্ত-খচিত বাক্সে। তুলে নিলেন আরও বেশ কিছু হিরে আর চুনি। সব সাজিয়ে দিলেন একটি রেকাবিতে। বয়রাম বেগকে আদেশ দিলেন সেই রেকাবি শাহের দরবারে পৌঁছে দিতে। সঙ্গে দিলেন তাঁর ব্যক্তিগত উপহার-পত্র – ‘মহামান্য শাহের জন্য হিন্দুস্তান থেকে বিশেষভাবে তাঁরই জন্য নিয়ে আসা সামান্য উপহার’। শাহ আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন রত্নের দ্যুতিতে। পরখ করতে পাঠালেন জহুরির কাছে। জহুরি নিদান দিলেন, এ’সব অমূল্য।’
হুমায়ুন যখন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন, পারস্যের শাহ তাঁকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলেন সেনাবাহিনী দিয়ে, পরবর্তীকালে হুমায়ুন দিল্লির মসনদও পুনরুদ্ধার করতে পারেন সেই বাহিনীর সাহায্যে।মজার কথা, বাবরের সেই হিরে কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ফিরে এলো ভারতবর্ষে। ১৫৪৭ সালে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পারস্যের শাহ সেই হিরেটিকে উপহার হিসেবে পাঠালেন দাক্ষিণাত্যের শিয়া শাসক আহমদনগরের সুলতানকে। সেই সময় শাহের দরবারে ছিলেন গোলকুণ্ডার সুলতানের দূত খুর শাহ। তাঁর বক্তব্য ছিল কতকটা এইরকম – ‘এটা সর্বজনবিদিত ছিল যে রত্নের ব্যাপারে সমঝদার এক ব্যক্তি এই হিরের মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন এই বলে যে এর মূল্য সমগ্র পৃথিবীর আড়াই দিনের খাবার খরচের সমান। আকারে এই হিরে ১২০ ক্যারেটের মতো। তবে শাহের চোখে এ হিরে হঠাৎ কেন যে মূল্যহীন মনে হয়েছে তা বোঝা গেলো না। তিনি এ হিরে উপহার হিসেবে তাঁর দূত মেহতার জামালের হাত দিয়ে পাঠালেন আহমদনগরের শাসক নিজাম শাহের কাছে’। তবে বেশ কিছু তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এই দূত আহমদনগরে গিয়ে সব কিছু হস্তান্তরিত করলেও হিরেটি দিতে পারেনি। বহু চেষ্টা করেও পারস্যের শাহ সেই দূতের নাগাল আর পাননি।
বাবরের হিরে হঠাৎ হারিয়ে গেলো ইতিহাসের দলিল থেকে। হয়তো সে সযত্নে রক্ষিত ছিল কোনো বণিকের সিন্দুকে, বা দাক্ষিণাত্যের কোনো শাসকের রত্নপেটিকায়। এই কী গার্সিয়া ডি ওরতো বর্ণিত আহমদনগরের সেই ‘এক আস্ত মুরগির ডিমের আকারের হিরে’? এই প্রশ্নের সমাধান করা এক কথায় অসম্ভব। এই হিরেই কী কোহিনূর? এই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বের করা অসম্ভব। আর যদি বাবরের হিরেই কোহিনূর হয়, তাহলে তা মুঘল বাদশাহের তোষাখানায় কখন আর কিভাবে আবার ফিরে আসে?
তবে এটা বোঝা যায় যায় যে হিরেটি যদি সত্যিই মুঘল বাদশাহের তোষাখানায় ফিরে আসে, তাকে অন্তত এক পুরুষ অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। আকবরের পরম সুহৃদ, তাঁর নবরত্নের এক রত্ন, আবুল ফজল আকবরনামা গ্রন্থে আকবরের রত্নের সংগ্রহের কথা লিখতে গিয়ে সব থেকে বড় যে হিরের উল্লেখ করেছেন, তার আকার ছিল বাবরের হিরের থেকে অনেক কম। তবে বেশিদিন না, অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাবরের হিরের সমান আকারের একটি হিরে প্রবেশ করলো মুঘল বাদশাহের রত্নপেটিকায়।
তবে এই কি বাবরের হিরে? বা কোহিনূর? জানবো,পরের পর্বে…। সাথে থাকুন,পড়তে থাকুন আর জানাতে থাকুন কেমন লাগছে? আপনাদের ‘কোহিনুর রহস্য’..
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য : গুগল
[…] বিগত পর্বের লিঙ্ক :- ১. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-1২. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-2 […]