মহেন্দ্র সিং ধোনি: স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে শিখিয়েছিলেন যিনি

প্রোজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায়
5 রেটিং
1470 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

আপনি কি ক্রিকেটভক্ত? মানে সোজা বাংলায়, ক্রিকেট ম্যাচের জন্য অফিস কামাই করতে পারেন? রাত জাগতে পারেন? আর পাঁচটা মানুষের মতই মহেন্দ্র সিং ধোনির হঠাৎ অবসরে চমকিত? 

ধুর মশাই, আপনি ক্রিকেট ভক্ত হতে পারেন, কিন্তু খেলাটাকে মোটেই বোঝেন না। মহেন্দ্র সিং ধোনি চমক দিচ্ছেন, এতে আবার চমকে যাওয়ার কি আছে? চমক দেওয়ার দক্ষতাটি তো এমএসডি সমগ্র কেরিয়ার ধরেই দেখিয়ে এসেছেন। এমএস কোনও চমক না দিলে সেটাই হবে চমক। 

বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন এ আবার কোন ক্রিকেট পণ্ডিত? বেশ, ধোনির ক্রিকেট কেরিয়ারে নজর দিন একবার। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিষেক সিরিজে পারফরম্যান্স রীতিমত ম্যাড়ম্যাড়ে। পরের পাকিস্তান সিরিজের প্রথম ম্যাচে ফের ব্যর্থ। বিশাখাপত্তনমে পরের ম্যাচে হঠাৎ বিস্ফোরণে ১৪৮! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের শুরুর দিকে টপ অর্ডারে ব্যাট করে ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর, নিজে অধিনায়ক হয়ে উল্টে নিজেকেই পিছিয়ে দেন ব্যাটিং অর্ডারে। ২০০৭ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ভয়ঙ্কর মিসবা উল হকের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে অনামী যোগিন্দর শর্মাকে বল তুলে দিয়ে বাজিমাত করা, ফর্মের তুঙ্গে থাকাকালীনই আচমকা টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়া,  প্রতিভাবান রোহিত শর্মাকে ইনিংস ওপেন করতে পাঠিয়ে দেওয়া, ধোনির দেওয়া চমকের তো শেষ নেই! আদতে তাঁর ক্রিকেট জীবনটাই তো সবথেকে বড় চমক!

ধোনি যখন প্রথম ভারতীয় দলে সুযোগ পান, তখন তাঁর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, তাতে আবার ছিল লালচে আভা। তাঁর বাসস্থান রাঁচি শুনে বিজ্ঞ বাঙালিরা রায় দিয়েছিলেন, ‘ ছেলেটা পাক্কা বখাটে বিহারী !’ ধোনি অবশ্যই সেই এলিটিস্ট মানুষদের কাছেও চমক হিসেবেই হাজির হয়ে গেছেন। শুধু যে তিনি রত্নখচিত ক্রিকেট জীবনের অধিকারী তাই তো শুধু নয়, ঠান্ডা মাথার জন্য তিনি সর্বত্র সম্মানিত। অর্থাৎ, তিনি বখাটে তো ননই, আদতে রীতিমত বিপরীত। তাঁর কেরিয়ারের শুরুতে বহু প্রাক্তন ক্রিকেটার মনে করতেন, কপিবুক টেকনিক না থাকার জন্য ব্যাটসম্যান এবং কিপার, দুই ভূমিকাতেই তাঁর সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমই। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনি কেরিয়ার শেষ করলেন নীল জার্সিতে বেশিরভাগ সময়ে ছয় নম্বরে ব্যাট করে ৫০+ গড় রেখেই, বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফিনিশারের তকমা নিয়ে। কিপিং? ধোনির ক্যাচ গলানো বা স্ট্যাম্পিং মিসের জন্য ভারতকে হারতে হয়েছে এরকম নিদর্শন প্রায় নেই। বরং উইকেট না দেখেই থ্রো করে ব্যাটসম্যানকে চমকে দিয়ে রান আউট করার মত অভিনব পদ্ধতি তাঁর হেলিকপ্টার শটের মতই জনপ্রিয়। এমএসডি প্রমাণ করেছেন খেলাটা আসলে বইয়ের পাতায় নয়, হয় সবুজ মাঠে। 

মহেন্দ্র সিং ধোনি আসলে একজন স্বপ্ন পূরণের কারিগরের নাম। যে সকল ভারতীয় বিরাট অংশের সাধারণ মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে পারেন, ধোনি তাঁদের মধ্যে অবশ্যই থাকবেন। রাঁচির মত সাধারণ শহর থেকে উঠে এসে যে ভারতীয় ক্রিকেটে রাজ করা যায়, এ স্বপ্ন ধোনি না থাকলে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ কিভাবে দেখতেন? ২০০৪ সাল অবধি যে মানুষটি খড়গপুর স্টেশনে টিকিট কালেক্টরের কাজ করতেন, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় খেপ খেলতে বাধ্য হতেন, মাত্র সাত বছরের মাথায় ২০১১ সালের ২ রা এপ্রিল তাঁকেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দেখা গিয়েছিল বিশ্বকাপ হাতে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার নামই হল মহেন্দ্র সিং ধোনি। খেলোয়াড় হিসেবে, অধিনায়ক হিসেবে ভারতকে কি দিয়েছেন? বলা ভাল কি দেননি? টেস্ট ক্রিকেটে এক নম্বর স্থান, একটি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, একটি একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ধোনির আমলে এমন কোনও শৃঙ্গ নেই যা ভারত ছোঁয়নি। প্রাক্তন ইংরেজ অধিনায়ক নাসের হুসেন বলেছিলেন, “Everything he touches turns into gold”। পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাঁর ধারেকাছে সত্যিই কেউ নেই। 

ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে বলা হয়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে ভারত সত্যিকারের কোনও নেতা পায়নি। সৌরভ টিম ইন্ডিয়ার জনক। ক্রিকেটীয় দিক থেকে বিচার করলে একদমই ঠিক। সৌরভ টিম গেম খেলতে শিখিয়েছিলেন ভারতকে, ধোনি শেখালেন ট্রফি জিততে। কঠিন ম্যাচে কিভাবে স্নায়ুর চাপ রাখতে হয়, কিভাবে ছিনিয়ে আনতে হয় শিরোপা, ধোনির থেকে ভাল কেউ সম্ভবত জানেন না। সৌরভের মতই বিভিন্ন সময়ে ধোনিও পাশে দাঁড়িয়েছেন তরুণ ক্রিকেটারদের। টানা দুইবছর ব্যর্থ হবার পর যখন সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন রোহিত শর্মা, তখনও তাঁকে ক্রমাগত গাইড করে গেছেন অধিনায়ক, তুলে এনেছেন ওপেনিং স্লটে। এখন? রোহিত বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম। যে সুরেশ রায়নাকে দলে সুযোগ দেওয়ার জন্য কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি তাঁর অধিনায়ককে, ২০১১ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছিলেন রায়না। স্বয়ং বিরাট কোহলিকে যখন টেস্ট টিম থেকে বাদ দেওয়ার জন্য মিডিয়া মরিয়া, ধোনি দলে রেখে দেন তাঁকে। ফল আমরা দেখতেই পাচ্ছি। যে ভারতীয় পেস ব্যাটারিকে নিয়ে আজ ধন্য ধন্য করছে ক্রিকেট মহল, তাদের মধ্যে জসপ্রিত বুমরা, উমেশ যাদব, মহম্মদ শামি, সকলকেই আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় তুলে এনেছেন ধোনিই‌। রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, যুজবেন্দ্র চাহাল, কুলদীপ যাদব, হার্দিক পান্ডিয়া, কে এল রাহুলের মত একঝাঁক তরুণ প্রতিভাকে বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনিই। ধোনি ভারতকে কেবল একটা ভাল দলে পরিণত করেননি, ভারতের ক্রিকেট সিস্টেমটাই বদলে দিয়েছেন, যে সিস্টেমে ফিটনেসের সঙ্গে কোনও আপস করা হয় না। যেভাবে তিনি পরবর্তী অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলিকে ধীরে ধীরে তৈরি করলেন, সেটাও দেখার মত। অস্ট্রেলীয় মডেল অনুযায়ী বর্তমান অধিনায়ককে পরবর্তী নেতা হিসেবে কোনও তরুণ ক্রিকেটারকে গ্রুম করতে হয়। ক্রিকেট বিশ্ব জানে কিভাবে তরুণ মাইকেল ক্লার্ক কে অধিনায়ক হিসেবে তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন দুইবারের বিশ্বজয়ী অধিনায়ক রিকি পন্টিং। সেই মডেল মেনেই বিরাটকে তৈরি করেছেন এমএস। যেটা বিরাট বহুবার প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। তিন ফরম্যাটেই অধিনায়ক হবার পর বিরাট বলেছিলেন, “Maybe today I am the captain, but you will always be my captain”. ধোনির কাছে এর থেকে বড় সার্টিফিকেট সম্ভবত আর হতে পারত না। 

দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে বিতর্ক কি আসেনি? এসেছে। সবথেকে বড় বিতর্ক এসেছিল যখন তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও রাহুল দ্রাবিড়কে একদিনের দল থেকে ছেঁটে ফেলতে উদ্যোগী হন। সৌরভকে বাদ দেওয়াতে বাংলা জুড়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, ধোনির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা একারণেই সম্ভব নয় যে, তাঁর দেওয়া বিকল্প পরিকল্পনা সফল হয়। সৌরভের জায়গায় গৌতম গম্ভীরকে খেলিয়ে, বা দ্রাবিড়ের জায়গায় রোহিত শর্মা কে খেলিয়ে একমাসের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়াকে তাদের দেশের মাটিতেই হারিয়ে ভিবি সিরিজ জেতে ভারত। একই দল নিয়ে তিনবছর পর জেতে বিশ্বকাপ। অর্থাৎ, অধিনায়ক ধোনির সাফল্য এখানেই যে, তাঁর সিদ্ধান্ত যে ব্যর্থ, অন্তত সেক্ষেত্রে এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তিনি দেননি তাঁর দলের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে। এটাও বলা হয় যে, টেস্ট ক্রিকেটে ধোনি সফল নন। যদিও ইতিহাস বলছে, ধোনির আমলেই প্রথম বিশ্বের একনম্বর টেস্ট টিম হয় ভারত। অবশ্য এটা ঠিক যে, টানা আটটি টেস্ট হারের মত লজ্জার স্বাদও ভারতকে পেতে হয় তাঁর আমলেই। তবে, যদি পাঠকেরা মনে রাখেন যে, সেই সময়ে ভারতের একনম্বর স্ট্রাইক বোলার ছিলেন প্রবীণ কুমার (যাঁর বলের গতিবেগ ছিল গড়ে ঘণ্টায় ১২০ কিমি), টানা ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। বস্তুত, ওই টানা ব্যর্থতার পরেই বোলিং এর খোলনলচে বদলানো শুরু হয় ভারতীয় ক্রিকেটে। অবশ্য একটা অনুযোগ রয়েই যায়। শোয়েব আখতার কে পিটিয়ে ফয়সলাবাদের ১৪৮ বা লর্ডসের ম্যাচ বাঁচানো ৭২ নট আউট বা চেন্নাইয়ে অস্ট্রেলীয় বোলিংকে ধবংস করে ডাবল সেঞ্চুরির মত মণি মুক্তো তাঁর টেস্ট কেরিয়ারে আরও থাকতে পারত। বড় তাড়াতাড়ি লাল বলকে আলবিদা জানিয়েছিলেন এমএস। সম্ভবত সাদা বলের ক্রিকেটের মত লাল বল অতটা প্রিয় ছিল না তাঁর কাছে।

কখন শেষ করলেন? যখন করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব সকলকেই গৃহবন্দী করে রেখেছে। গতবছর বিশ্বকাপের পরেই জল্পনা জোরদার হয়েছিল তাঁর অবসরের। সেরা সময় পিছনে ফেলে এসেছেন, বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু আমি আপনি যা ভাবছি, তিনি যদি সেটাই করেন, তাহলে আর তিনি ধোনি কেন হবেন? সেই সময় অবসর নিলেন না তিনি। নিলেন কখন? না যখন আইপিএলের ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে, ধোনির অবসরের জল্পনা যখন পিছনের সারিতে চলে গেছে। তারিখটা? বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দেশকে জেতাতে না পারার যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে যে মানুষটি সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় শ্রম দান করতে ডামাডোলের কাশ্মীরে একমাসের উপর স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে পারেন, তিনি যে ১৫ই আগস্ট তারিখটি নিজের ‘ গেম ওভার ‘ এর জন্য বেছে নেবেন তাতে চমক থাকলেও অস্বাভাবিকত্ব নেই। ৭:২৯? খটকা রয়ে গেল। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল আইসিসির রেকর্ড অনুযায়ী শেষ হয়েছিল ওই সন্ধ্যে ৭:২৯ মিনিটেই। ধোনি কি ঘুরিয়ে সেদিনের জন্য তাঁর যন্ত্রণাই ব্যক্ত করলেন? সঠিক উত্তর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। ভারতীয় ক্রিকেটে ধোনির যা অবদান, চাইলেই ফেয়ারওয়েল ম্যাচ পেতে পারতেন তিনি, হাজারো জনতার অঞ্জলি পায়ে নিয়ে শেষবারের মত খুলে রাখতে পারতেন নীল জার্সি। কিন্তু সেটা হলে আর ধোনিসুলভ হত কোথায়! টেস্টের মতই সাদা বলের ক্রিকেটকেও বিদায় জানালেন আচমকাই, প্রচারের আলোর বাইরে থেকেই, সারাজীবন যা করে এসেছেন!

বলতেই হচ্ছে, ” Dhoni finishes off in style!”

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • RocK StaR BaPi May 23, 2021 at 11:07 pm

    Very nice

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল