সাদাত খানের পরামর্শে মুঘল সম্রাটের ওপর নাদির শাহ ধার্য করেছিলেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ। মুঘল সম্রাট শেষ পর্যন্ত এই বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ মেনে নেন আর সেই শর্তেই কার্নালের যুদ্ধ থেমে যায়। তবে মনে করা হয় যে সাদাত নাদিরকে খোদ দিল্লি আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছিলেন মুঘল ঐশ্বর্যর ওপর সম্পূর্ণ অধিকার কায়েম করতে। কে জানে, নাদিরের কার্নাল থেকে দিল্লি আগমনের পেছনে সেটাই হয়তো কারণ ছিল!
১৭৩৯ এর একুশে মার্চ নও রোজ (পার্সি নববর্ষের দিন) -এর দিন নাদির পৌঁছলেন শাহজাহানাবাদে। সঙ্গে ছিল তাঁর পঞ্চাশ হাজার সেনা। সেই সেনা ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। একসঙ্গে এতো জনসমাগমে বাজারে খাবারের মূল্যবৃদ্ধি হলো তৎক্ষণাৎ। জায়গায় জায়গায় ওই রাত্তিরেই হলো সাধারণ মানুষের সাথে নাদিরের সেনার বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়ে যায় যে, এক মহিলা গুপ্তঘাতকের হাতে নাদিরের মৃত্যু হয়েছে। এই সুযোগে দিল্লির সাধারণ মানুষেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলে নাদিরের ৯০০ জন সেনাকে হত্যা করে। খবর দ্রুত পৌঁছে যায় নাদিরের কানে।
সকাল হতেই নাদির তাঁর বাহিনীকে দিল্লির সমস্ত নিরস্ত্র নাগরিককে সরাসরি আক্রমণ করে হত্যা করবার আদেশ দিলেন। যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে কোষমুক্ত তরবারি হাতে তিনি নিজে লাল কেল্লার অদূরে রোশান-উদ-দৌলার স্বর্ণ-মসজিদে চলে গেলেন, সেখান থেকে তাঁর বাহিনীর প্রতিশোধস্পৃহার সরেজমিন তদারকি করতে। হত্যালীলা আরম্ভ হলো ঠিক সকাল ন’টায়। লাল কেল্লার সন্নিহিত অঞ্চল, চাঁদনী চক, দারিবা আর জামা মসজিদের আশেপাশে ছিল অবস্থাপন্ন আর দর্শনধারী দোকানপাট, অলংকার ও রত্ন-বিপনী। প্রতিশোধ নেওয়া আরম্ভ হলো এখান থেকেই। ‘নাদিরের বাহিনী নির্মমভাবে বাড়ির পর বাড়ি চালালো হত্যালীলা, সঙ্গে চললো লুন্ঠনও, আর নারী ও শিশুদের করলো বন্দি। বহু বাড়িতে ধরিয়ে দেওয়া হলো আগুন। রাস্তায়, বাড়িতে, প্রান্তরে পরে রইলো লাশ, দিনের পর দিন, দুর্গন্ধে নগরের বাতাস হয়ে উঠলো কলুষিত’, ঐতিহাসিক গুলাম হুসেন খানের বিবরণে এভাবেই ধরা পরে হত্যালীলার চিত্র।
ধরা হয়, প্রায় তিরিশ হাজার নিরস্ত্র নাগরিক নাদিরের বাহিনীর এই নৃশংস প্রাণঘাতী হামলায় প্রাণ দেয়। দশ হাজার মহিলা ও শিশুকে বন্দি করা হয় ক্রীতদাস হিসেবে। আনন্দ রাম মুলখিস এর বিবরণও গুলাম হুসেন খানের বিবরণের মতোই, ‘উদ্যানের পথে পরে থাকা শুকনো ফুল-পাতার মতো দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় লাশের অভাব ছিল না দীর্ঘদিন’। Mattheus van Leypsigh নামে এক ডাচ প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়, ‘সেদিন যেন দিল্লির মাটিতে রক্ত-বৃষ্টি হয়েছিল, নালা-নর্দমা দিয়ে অবিরত বয়ে চলেছিল রক্তস্রোত। পারসিক সেনাদের আচরণ ছিল পাশবিক, বর্বরোচিত’।
শেষ পর্যন্ত নিজাম-উল-মুল্ক আবেদন জানালেন সাদাত খানকে, তিনি যেন নাদির শাহকে অনুরোধ করেন এই হত্যালীলা শেষ করতে। শোনা যায়, এই ভয়ঙ্কর হত্যালীলায় সাদাত খান মানসিক ভাবে পীড়িত হয়ে নিজেকেই এর কারণ মনে করে ওই রাতেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে এ’নিয়ে ভিন্নমতও আছে। কারোর মতে তিনি ছিলেন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল সেই কারণেই। এই অবস্থায় নিজাম নাকি পাগড়ি খুলে তা দিয়ে তাঁর দুই করতল বেঁধে নাদির শাহের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন আর অনুরোধ করেন এই হত্যালীলা থামাতে। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘হত্যালীলা যদি এখনো চালাতেই হয়, তবে নাদির যেন আগে মৃত মানুষদের প্রাণসঞ্চার করেন, কারণ, নগরে আর একটি প্রাণীও বেঁচে নেই’। এই বক্তব্যে নাদির তাঁর উন্মুক্ত তরবারি কোষবন্দি করেন। আর তাঁর বাহিনীও প্রতিশোধস্পৃহা সংবরণ করে সঙ্গে সঙ্গে। তবে এবারে নাদিরের দাবি, দিল্লি ছাড়ার আগে মুঘলদের একশো কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। Leypsigh আরো লিখেছিলেন, ‘ছিনতাই, লুঠতরাজ আর অত্যাচার চালু রইলো। তবে, সৌভাগ্যক্রমে, হত্যালীলা বন্ধ হলো’। আনন্দ রাম মুখলিসের কলমে ধরা পরে, ‘গোটা দিল্লি পাঁচ ভাগে ভাগ করে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ের জন্যে চালানো হলো ব্যাপক লুঠতরাজ। যে কজন জীবিত ছিল, যন্ত্রনা না সইতে পেরে তারা নিজেরাই নিজেদের জীবন শেষ করে দিল, হয় বিষপান করে, নয় ছুরির আঘাতে। কত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো চিরতরে। এক কথায়, ৩৪৮ বছরের উপার্জিত ধন-দৌলত মুহূর্তে হয়ে গেলো হস্তান্তরিত’।
নাদিরের হাতে মুঘল সম্রাট তুলে দিলেন তাঁর কোষাগারের চাবি। নাদির তাঁর স্বপ্নেও মাপতে পারেননি মুঘল ঐশ্বর্যের গভীরতা। নাদিরের সভা-ঐতিহাসিক মির্জা মাহ্দী অস্ত্রাবাদীর জবানিতে, ‘এ যেন মুক্তো আর প্রবালের সমুদ্র; রত্ন, সোনা আর রুপোর খনি; অলংকার আর মূল্যবান দ্রব্যে ভরপুর সমস্ত কোষাগারের হিসাব করতে হবে বলে বোধহয় কোন হিসাবরক্ষক তাঁর আদিমতম স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেননি’। অস্ত্রাবাদী আরও লিখেছেন:
‘সমস্ত স্বতন্ত্রীকৃত সামগ্রীর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ময়ূর সিংহাসন, যার রাজসিক রত্নরাজি ছিল তুলনাহীন, সুপ্রাচীন রাজশক্তির বৈভবময় ধনরাশিকেও হার মানিয়ে দেবে। সেই আমলে দু’কোটি টাকার রত্ন খোদিত হয়েছিল এই সিংহাসনের শরীরে। বিরল লোহিতক আর চুনি, অনিন্দ্যসুন্দর হিরে, আর প্রাচীন-বর্তমান সমস্ত সাম্রাজ্যের সাথে তুলনাহীন অমূল্য সব রত্নরাজি নাদির শাহের হেফাজতে চলে এলো। দিল্লির সেই সাময়িক আবাসকালে রাজ-কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা কব্জা করা হয়। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিক, দরবারের নেতৃবৃন্দ, রাজধানীর মাননীয় বিশিষ্টজন, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্বতন্ত্র রাজা, ধনী আঞ্চলিক শাসনকর্তা – প্রত্যেকে কোটি কোটি টাকার অর্থমূল্যের মুদ্রা, সোনা-রুপোর বাট, রত্নরাজি, রত্নখচিত রাজদণ্ড আর বিরল রত্নখচিত পাত্র উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতে থাকলেন।’
প্রায় এক মাস ধরে শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক কাজে লাগানো হলো, সমস্ত সোনা ও রুপোর সামগ্রীকে গলিয়ে বহনযোগ্য মাপের ছোট ছোট বাটে পরিণত করতে। নাদিরের কাছে এখন রত্নের অসীম প্রাচুর্য; তিনি তাই তাঁর অস্ত্র, লাগাম, হাওদা সবকিছু আদেশ করলেন রত্নখচিত করে তুলতে। এমনকি তাঁর তাঁবুও অলংকৃত করে তোলা হলো। শোনা যায়, পারস্যে ফিরে নাদির নাকি দু’বছরের জন্য সাধারণ মানুষের সমস্ত কর মকুব করে দিয়েছিলেন।
যখন এইভাবে সম্পদের হস্তান্তর চলছে, নাদির আপাতভাবে মুঘল সম্রাটের সাথে বজায় রাখলেন ভদ্র ও নম্র সম্পর্ক। আর নাদির শাহের প্রতি মোহাম্মদ শাহের আচরণ ছিল একজন পার্শ্ব অনুচরের মতো। দু’জনে অনেক সময়েই একসাথে দরবারে আসতেন। অবশেষে একদিন, এক সাধারণ মেষপালকের সন্তান নাদির তাঁর ছেলের বিয়ে দিলেন ময়ূর সিংহাসনের নির্মাতা সম্রাট শাহ জাহানের প্রো-প্রো-পৌত্রীর সাথে। যমুনার তীরে হলো বাজি আর আলোর রোশনাই; দুই শতাব্দী প্রাচীন মুঘল রাজবংশের সামনে মেষপালকের সন্তান নাদির বক্তব্য রাখলেন উত্তম শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর। আর কনের চাচা মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ভবিষ্যতে মারাঠা আক্রমণ সহ যে কোনো বিপদের সময় নাদির ও তাঁর বাহিনীকে সম্রাট পাশে পাবেন। এক মাস পর এক গ্রীষ্মের দিনে বিশেষ দরবারের আয়োজন করে আনুষ্ঠানিকভাবে মাথায় মুকুট পরিয়ে হিন্দুস্তানের শাসনভার মহম্মদ শাহের ওপর পুনর্ন্যস্ত করলেন। তবে সিন্ধুর পশ্চিমপাড়ের অংশ তিনি পারস্যের সঙ্গে সংযুক্ত করলেন।
থিও মেটকাফের প্রসঙ্গ আলগা করে ছুঁয়েছিলাম প্রথম দিকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কোহিনূর হস্তান্তরিত হবার পর লর্ড ডালহৌসি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্তা এই মেটকাফকেই দায়িত্ব দেন কোহিনুরের ইতিহাস নথিবদ্ধ করতে; যদিও মেটকাফের নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তাঁর আহরিত তথ্য ছিল দিল্লির ‘বাজারি গল্পগাছা’। নাদিরের এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গেই মেটকাফ মহম্মদ শাহের কাছ থেকে নাদির শাহের কোহিনূর হস্তগত করবার গল্পের অবতারণা করেন। বেশ কয়েক পর্ব আগে আমি সেই আমলের ‘সেলিব্রিটি’ বাইজি নূর বাঈ এর কথা বলেছিলাম, যাঁর সঙ্গলাভের আশায় অভিজাত পুরুষেরা বহু অর্থব্যয় করতেন। মেটকাফের ধারণা অনুযায়ী, এই নূর বাঈ এর কাছ থেকেই নাদির শাহ জানতে পারেন যে মহম্মদ শাহ কোহিনূর রত্ন ধারণ করেন তাঁর পাগড়িতে। হিন্দুস্তান-পারস্যের ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হিসেবে নাদির প্রস্তাব দিলেন দুই শাসকের পাগড়ি বদলের। আর এইভাবেই নাকি কোহিনূর এসেছিল দিল্লির সাধারণ মানুষের রক্তে রাঙা নাদিরের হাতে। আর থিও’র বর্ণনা অনুযায়ী, রত্নটি হাতে নিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট নাদির রত্নটির নামকরণ করেন ‘কোহ-ই-নূর’ বা ‘আলোর পর্বত’। তবে, গল্পটি সুন্দর হলেও, সমসাময়িক কোনো ঐতিহাসিক বা লেখকের বিবরণে গল্পটির স্থান হয়নি। গল্পটি প্রচলিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে। তাই, এমন আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের পরিবর্তে মনে করা হয়, ময়ূর সিংহাসনের মাধ্যমেই কোহিনূর নাদিরের হস্তগত হয়।
নূর বাঈ এর প্রসঙ্গ যখন এলো, আজকের পর্ব শেষ করি নূর-নাদিরের একটি টক-ঝাল গল্প দিয়ে। নাদিরের বাহিনীতে আব্দুল করিম নামের এক কাশ্মীরি যোদ্ধা ছিল, যার বর্ণনা অনুযায়ী নাদির ছিলেন নূর বাঈ এর নৃত্যকলা ও সৌন্দর্যের একনিষ্ঠ ভক্ত। একবার দরবারে নৃত্য-গীতের পর নাদির নূরকে প্রস্তাব দিলেন তাঁর সঙ্গে পারস্যে যাবার, বিনিময়ে তিনি ভারতবর্ষ থেকে আহরিত সম্পদের অর্ধেক ভাগ দিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন। নূর নাকি সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতার অভিনয় করে দিল্লি ত্যাগ করেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেন করা হয় কেন তিনি হেলায় এই অমূল্য সুযোগ হারালেন, তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘আমার ফুলের মতো যোনি নাদিরের মতো একজন গণহত্যাকারীর সংস্পর্শে কলুষিত করতে পারিনা’।