আকবর আগ্রায় আমন্ত্রণ জানালেন পর্তুগিজ জেসুইটদের, তারা স্থাপন করলো ক্যাথলিক চার্চ। সেই সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে ভারতবর্ষে পা রাখলেন জন মিলডেনহল।ভারতবর্ষের অর্থনীতির সে বড়ো সুসময়। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়রাও আসতে আরম্ভ করেছে।তাদের কেউ ইস্ফাহান থেকে, কেউ বা টার্কির, কেউ আরব, কেউ আর্মেনিয়া থেকে।
আজ থেকে চারশো বছর আগের আগ্রা আজকের আগ্রা থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। সেই সময়ে আগ্রা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যশক্তির কেন্দ্রবিন্দু। মুঘল শাহেনশাহের দরবার সেখানেই। দরবারের ওমরাহরা, সেনাবাহিনীর প্রধানেরা থাকতেন সেখানেই, যমুনার ধারে ‘আলিশান’ বাংলোয়। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক চুক্তি, লেনদেনও সেখানেই হতো। শুধু সম্ভ্রান্ত ভারতীয় বা পাঠানরা নয়, আগ্রায় তখন পশ্চিম এশিয়ার নানা মানুষের, বিশেষত ব্যবসায়ীদের ভিড়;তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় গোড়াপত্তনের সময়েই তিনি ভারতবর্ষে পা রাখেন জন মিলডেনহল।তিনিই প্রথম ইংরেজ কিনা জানা নেই,তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় গোড়াপত্তনের সময়েই তিনি ভারতবর্ষে পা রাখেন। ভদ্রলোকের জন্ম ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে লিটল বেডউইন নামের ছোট একটি গ্রামে। তিনি ভূমধ্যসাগরীয় পশ্চিম এশিয়ায় কোম্পানির মালপত্তর বেচার বরাত পেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে স্থলপথে পূর্ব ইউরোপ, টার্কি অতিক্রম করে পৌঁছন সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে। সেখানে বছর তিনেক কাটানোর পর তাঁর ইচ্ছে জাগে ভারতবর্ষ আসার। কোম্পানির অনুমতি ছাড়াই তিনি মালপত্তর নিয়ে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান-পারস্য হয়ে পৌঁছন লাহোরে। সেখান থেকে ১৬০৪ সালে আসেন আগ্রা। দেখা করেন মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন সংক্রান্ত আলোচনা সারতে। বিনা অনুমতিতে এই ধরণের কাজে কোম্পানি সন্তুষ্ট ছিল না, তাই আইনি ঝামেলায় তিনি জড়িয়ে পড়েন। পরে তিনি ফিরে যান ইংল্যান্ডে। ধারণা করা হয়, ভারতে থাকাকালীন সময়ে তিনি এক ভারতীয় নারীকে বিবাহ করেন ও তাঁদের দুই সন্তানও হয়।
মিলডেনহল সাহেবের মন কিন্তু পড়ে ছিল ভারতেই। তিনি আবার স্থলপথে ভারতবর্ষ এলেন, ১৬১৩-১৪ সাল নাগাদ। এবারে তাঁর সফর সঙ্গী বোর্দো’র তরুণ ফরাসি কারিগর অগাস্টিন হিরিআর্ত। সেইসময় মুঘলদের কাছে ইউরোপীয়দের কদর ছিল দুটো বিষয়ে দক্ষতার জন্য – এক, সামরিক প্রযুক্তি ও যুদ্ধে কামান-বন্দুকের ব্যবহার, আর দুই, রত্ন ও অলংকার শিল্প। মনে করা হয় হিরিআর্ত এ কথা ভালোভাবেই জানতেন। ইংরেজ-ফরাসি জুটি পৌঁছলেন লাহোর। এদিকে মিলডেনহল সায়েব হয়ে পড়লেন শয্যাশায়ী, কোনো এক মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে। হিরিআর্তকে দিলেন তাঁর সঙ্গে থাকা সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি, পরিবর্তে তাঁকে অনুরোধ করলেন তাঁর ভারতীয় কন্যাসন্তানকে বিয়ে করতে। সে বিয়ে হয়েছিল কিনা তা জানা নেই, তবে মনে করা হয় হিরিআর্ত সতী হতে যাওয়া এক ভারতীয় নারীকে বিবাহ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের দুই সন্তানও হয়। আজমের হয়ে তাঁরা পৌঁছলেন আগ্রায়, আর সেখানেই ১৬১৪ সালে মিলডেনহলের মৃত্যু হয়। আগ্রার রোমান ক্যাথলিক সিমেট্রিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ভারতবর্ষের মাটিতে সমাহিত প্রথম ইংরেজ হিসেবে তাঁকেই মানা হয়।
এদিকে হিরিআর্ত খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছলেন। এর কারণ হলো, রত্নবিদ্যা ও সামরিক প্রযুক্তি, দুই ক্ষেত্রেই তাঁর গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। তবে তার থেকেও যে কারণে তিনি মুঘলদের আরো কাছে আসতে পেরেছিলেন, তা হলো তাঁর ইউরোপীয় ঘরানার শিল্পবোধ না ভুলেও ভারতবর্ষকে ভালোবেসে, ভারতীয়ত্বে ডুবে থেকে মুঘল শিল্প ঘরানাকে সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করা, যা পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন শিল্পধারার – এতে পাশ্চাত্যের যন্ত্র নির্ভর ‘প্রেসিশন’-এর সাথে ছিল প্রাচ্যের শিল্প-সুষমা। তখন মুঘল সম্রাট ছিলেন জাহাঙ্গীর। তিনি গুণীর কদর করতেন। তাঁর আদেশে হিরিআর্ত বানালেন সোনা-রুপোর তৈরী রত্নখচিত একটা সিংহাসন, যার নিচের অংশে রয়েছে বাঘের আদল। এই সিংহাসনের সৌন্দর্যে খুশি হয়ে জাহাঙ্গীর এই কারিগরের নাম রাখলেন ‘হুনারমান্দ’, পার্সি ভাষায় যার মানে ‘দক্ষ’; আর দিলেন একটি ঘোড়া, একটি হাতি ও পনেরশ টাকা (সে’আমলে পনেরশ টাকা ছিল অনেক)। নিজের গুণের জন্য সময়ে সময়ে এরকম বহু উপহার তিনি পেতে থাকলেন সম্রাটের কাছ থেকে। তখনকার দিনে আগ্রায় ইউরোপীয়রা সঞ্চয়ের উদ্দেশে কৃচ্ছসাধন করতো। আর সেই জায়গায় হিরিআর্ত-এর ছিল একবারে বিলাস-বহুল জীবনযাত্রা। সেই সময়ে আগ্রায় তাঁর বাড়ির দাম ছিল আট হাজার লিভর (ফরাসি পাউন্ড)। বাড়িতেই ছিল বিভিন্ন বন্য জন্তু নিয়ে বিশাল চিড়িয়াখানা। এদেশে তিনি মোগলাই খানাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। মুঘলদের বেতনভুক কারিগর হিসেবে ১৬৩০ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন। ক্ষমতার সিঁড়িতেও তিনি ধাপে ধাপে ওপরে ওঠেন বলে মনে করা হয়। শোনা যায় কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোচিনে মুঘল ও পর্তুগিজদের মধ্যে একটা বাদানুবাদের মীমাংসা করতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়েন; সেখানে কারাগারে বন্দি অবস্থায় বিষপ্রয়োগে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে বিশেষ তথ্য আর পাওয়া যায় না। তাঁর বংশধরদেরও কোনো খবর আর পাওয়া যায়নি, কে জানে, হয়তো এখনও আগ্রাতে কোনো জায়গায় তাঁর বংশের লোকেরা বাস করে?
কথা ছিলো ময়ূর সিংহাসন নিয়ে বলার, আর সেখানে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ বহির্ভূত ভাবে এই ফরাসির কথা বলছি কেন? উদ্দেশ্য একটাই। ময়ূর সিংহাসনের একেবারে গোড়ার কথা বলা। একটু ধান ভাঙতে শিবের গীত হয়ে গেলো,যদিও হিরিআর্তের চরিত্র ভালো লাগার তাই যে তা না লিখে পারলাম না।
সালটা ১৬২৮। শাহ জাহানের রত্নাসক্তি পৌঁছলো চরমে। পরিকল্পনা করলেন ময়ূর সিংহাসনের। সিংহাসনটি যেন কোরানে বর্ণিত রাজা সলোমনের সিংহাসনের মতো দেখতে হয়। মুঘলরা অতি সযত্নে এমন একটি পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করতেন যাতে তা সাধারণ মানুষের মনে কোরান বা প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত রাজা বা রাজত্বের সাথে সাদৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুঘলদের প্রচ্ছন্ন বিশ্বাস ছিল, দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত মুঘল শাসনের হাত ধরেই সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধির আবহ তৈরী হবে। বিশেষ করে শাহ জাহানের কাছে রাজা সলোমন ছিলেন একজন ‘রোল মডেল’, তাঁর সভাকবিরাও তাঁকে সেই পৌরাণিক রাজার সাথে তুলনা করেছেন সময়ে সময়ে।
শাহ জাহানের সভাসদ আহমদ শাহ লাহোরী পাদশাহনামা গ্রন্থে ময়ূর সিংহাসনের শুরুর কথা লিখে গেছেন। বংশানুক্রমে রাজকোষাগারে বিবিধ আকারের ও গুণমানের চুনি, হিরে, মুক্তো ও পান্না জমা হয়েছে। শাহজাহানের সময়ে সেই সব রত্নের সামগ্রিক মূল্য ছিল ২ কোটি টাকার মতো (সেই সময়ের অর্থমূল্য অনুযায়ী)। দূরদর্শী সম্রাটের ভাবনা, এতো সুন্দর সব মণি-মুক্তোর যথার্থ উপযোগিতা হবে যদি এগুলো দিয়ে একটা রত্ন-সিংহাসন বানানো যায়। যে এই রত্ন-সিংহাসন দেখবে, সে শুধু বিস্ময়ে হতবাক হবে না, মুখের কথায় এই প্রাচুর্যের দ্যুতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেবে, আর সাম্রাজ্যের মহিমাও রত্নের ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হবে, এমনকি বহুযুগ পরেও। তিনি তাঁর রত্নভাণ্ডার থেকে অতি সযত্নে নিজে বেছে নিলেন পঞ্চাশ হাজার মিস্কাল (১ মিস্কাল = ৪.২৫ গ্রাম) ওজনের বহুমূল্য রত্ন, আর সেই রত্ন জমা করলেন স্বর্ণকার বিভাগের প্রধান বেবাদল খানের জিম্মায়। কারিগর হিসেবে হিরিআর্ত তখনও সুপ্রতিষ্ঠিত, তাই স্বাভাবিক ভাবেই ময়ূর সিংহাসন নির্মাণের ভার ন্যস্ত হলো এই ফরাসি শিল্পীর ওপরেই। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ১৬৩০ সালে হিরিআর্ত মুঘলদের চাকরি ছেড়ে চলে যান গোয়ায়। তাই দায়িত্ব এসে পড়ে সেই সময়কার আর একজন নামী পার্সি শিল্পী সৈয়দ গিলানির স্কন্ধে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ক্যালিগ্রাফার, স্বর্ণকার ও রত্নবিশারদ। জ্যোতিষ মত অনুযায়ী, ১৬৩৫ সালের বসন্তের এক পুণ্যদিনে সিংহাসনটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করা হয় – ওইদিন ছিল ইদলফিতর, আবার পার্সি নববর্ষ নও রোজও। সম্রাট সবে কাশ্মীরে ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন। তবে জ্যোতিষীরা সম্রাটকে এর তিনদিন পর সিংহাসন আরোহনের অনুমতি দেন। আদতে সিংহাসনটির নাম ছিল তখ্ত-মুরাসা বা রত্ন-সিংহাসন। পুরস্কার স্বরূপ সম্রাট সৈয়দ গিলানিকে তাঁর ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করেন। সাত বছর ধরে নির্মিত এই রত্ন-সিংহাসনের দাম ছিল তখনকার নিরিখে ১ কোটি টাকা।
যে ব্যক্তি কোরান জানেন, সিংহাসনটি দেখে রাজা সলোমনের সিংহাসনের কথা তাঁর স্মরণে আসতে বাধ্য। এর বারোটি স্তম্ভ। যার ওপরে রয়েছে মিনা-করা রত্নের শামিয়ানা। সারা শামিয়ানার ভেতর ও বাইরে জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রত্নের সূক্ষ্ম কাজ – গাছ ও পাখির প্রতিকৃতি। একেবারে চূড়ায় রয়েছে দুটি রত্নখচিত ময়ূরের প্রতিকৃতি। সিংহাসনে আরোহন করবার জন্যে আছে তিন ধাপ রত্নখচিত সিঁড়ি। সোনার তৈরী এই সিংহাসনে রাজকবি মোহাম্মদ কুদসী’র কুড়িটি কবিতা রত্ন দিয়ে খোদাই করা আছে।
ময়ূর সিংহাসনে ব্যবহৃত যে রত্নটির বিশেষ উল্লেখ আছে পাদশাহনামায়, তা কিন্তু একটি হিরে নয়, চুনি ছিল। মুঘল বংশে ছিল হিরের তুলনায় চুনির বিশেষ কদর, তাই ব্যাপারটা ছিল যথেষ্টই অভিপ্রেত। এই বিশেষ চুনিটি পারস্যের শাহ আব্বাস জাহাঙ্গীরকে উপহার দিয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর জাহাঙ্গীর এই চুনিটি শাহ জাহানকে প্রদান করেন। এই চুনির ওপরে তিমুর, মীর শাহ রুখ ও উলুঘ বেগ, এই তিন তিমুরিয় শাসকের নাম খোদাই করা আছে। শাহ আব্বাস তাঁর নিজের নামও খোদাই করেন চুনিটির ওপর। আর যখন রত্নটি জাহাঙ্গীরের জিম্মায় আসে, ওতে বসে যায় আকবর ও জাহাঙ্গীরের নাম। ময়ূর সিংহাসনে যখন রত্নটি স্থান পায়, তখন সেখানে খোদাই করা হয় শাহ জাহানের নামও। সেই সময়ে এই রত্নটির দাম ছিল এক লক্ষ টাকা।
এই চুনিটির অনেক নাম ছিল – তিমুর রুবি, আইন-আল-হুর, হুরির চোখ, ফাখরাজ। খ্যাতিতে সেই সময় এই চুনি কোহিনূরের দ্যুতিকে ম্লান করে দিয়েছিলো বহুলাংশে। কোহিনূরের দ্যুতি বা সৌন্দর্যের খ্যাতি অনেকটাই হাল আমলের। মাত্রই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রশংসকের নজর চুনি থেকে ঘুরে যায় হিরের দিকে। কিভাবে? সে প্রসঙ্গে ধীরে ধীরে পরবর্তী পর্বগুলোতে জানা যাবে..
©️শঙ্খচিল
[ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত]
[…] ৫. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-5/ […]