মুঘলদের ঐশ্বর্য বর্ণনা করতে গিয়ে আদতে স্কটিশ ডারিম্পল সায়েব হয়তো একটু অতিকথন করে ফেলেছেন, ‘নোংরা, ল্যাঙোট পরা ভিখারির জাত ইউরোপীয়রা মসলিন আর রত্নে সুসজ্জিত মুঘলদের দেখে হামলে পড়লো। এই বিপুল সম্পদ আগে কোনোদিন তারা নিজের চোখে দেখেনি, আর তাই ‘মুঘল’ শব্দটাই তাদের কাছে হয়ে উঠলো সম্পদ আর ক্ষমতার প্রতিমূর্তি’।
ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছে এমন সব মুসলমান বংশের মধ্যে বোধহয় মুঘলরা তাদের শাসনব্যবস্থার ‘কোর প্রিন্সিপল’ বা মূলনীতি হিসেবে তাদের শিল্পানুগত্য বা নন্দনতত্বকে সবার আগে স্থান দিয়েছে। মুঘল প্রতিষ্ঠিত স্থাপত্য যেমন হতো ‘লারজার দ্যান লাইফ’, তেমনি দরবার বা প্রাসাদের ভেতর রত্ন ও অলংকারের প্রাচুর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। তাদের সাহিত্য, কবিতা বা ইতিহাসচর্চা, সবই হতো বেশ জাঁকজমক পূর্ণ। আবুল ফজলের কথায়, ‘এই রাজসিক প্রাচুর্যের আয়োজন আসলে ছিল স্বর্গীয় মহিমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন’।
শুধু শিল্প সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ নয়, সাম্রাজ্যের বিস্তারে সেকালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বোধহয় একমাত্র ছিল টার্কির অটোমানরা। দেশের মূল শহরগুলো ছিল প্রাচুর্যে মোড়া, বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। আকবরের রাজত্বকালে এন্টোনিও মনসেরাত নামে এক স্পেনীয় ধর্মযাজকের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আকারে, জনসংখ্যায়, প্রাচুর্যে, বাণিজ্যে এই শহরগুলির তুল্য শহর এশিয়া কেন, ইউরোপেও পাওয়া যাবে না’।
রত্ন সংক্রান্ত ব্যাপারে মুঘলদের চিন্তাধারা ছিল সনাতন ভারতের থেকে আলাদা। তাদের এই চিন্তাধারা ছিল পারস্যের দর্শন, সাহিত্য ও নন্দনতত্ব থেকে প্রভাবিত। হিরে নয়, চুনি ছিল মুঘলদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়, আর তাই সংগ্রহের প্রশ্ন যখন আসে, চুনি পেত প্রাধান্য। পারসিক সাহিত্য ও অধিবিদ্যা অনুযায়ী চুনি ছিল দিব্যশক্তির অধিকারী। পারসিক শিল্পে চুনির সঙ্গে তুলনা টানা হতো সন্ধ্যাকাশের রক্তিম আভা বা ‘শাফাক’-এর সাথে।
গার্সিয়া ডি অর্তোও তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন যে মুঘল আমলে রত্ন সংগ্রহের ব্যাপারে হিরে বিশেষ প্রাধান্য পেত না, যা ইউরোপীয়দের কাছে খানিকটা বিস্ময়কর ছিল বইকি। সঙ্গী ডাক্তার রুয়ানোর সাথে আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, প্লিনি যদিও হিরেকে পান্না, চুনি বা মুক্তোর অনেক ওপরে স্থান দিয়েছেন, এই দেশে একই ওজনের নিখুঁত একটি চুনির দাম হিরের চাইতে বেশি। কিন্তু যেহেতু নিখুঁত চুনির থেকে নিখুঁত হিরে বেশি পাওয়া যায়, হিরে বেশি দামে বিক্রি হয়। অর্তো একটা দামি কথা বলেছেন, রত্নের দাম নির্ভর করে ক্রেতার লিপ্সা ও প্রয়োজনীয়তার ওপর।
আবুল ফজলও তাঁর বর্ণনায় যথেষ্ট গর্বের সঙ্গে আকবরের সংগ্রহে বিভিন্ন স্বচ্ছ লাল চুনি আর লোহিতকের কথা বলে গেছেন। ষোড়শ শতাব্দের শেষে আকবরের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল (এ ব্যাপারে তোদরমল-এর অবদান অনস্বীকার্য) যে তাঁর বারোটি রাজকোষ ছিল; ন’টি ছিল মুদ্রা রাখার জন্য, আর তিনটি ছিল রত্ন, মূল্যবান পাথর আর অলংকার রাখার জন্য। প্রথমটায় থাকতো বিভিন্ন ধরণের চুনি, দ্বিতীয়টায় থাকতো হিরে, পান্না আর নীলকান্ত মনি, আর তৃতীয়টায় থাকতো মুক্তো। আবুল ফজল কথায়, ‘যদি আমাকে সম্রাটের সংগৃহিত রত্নের পরিমাণ আর গুণমান নিয়ে কথা বলতে হয়, তবে বহু সময় ব্যয় হবে’।
১৬১৬ সাল। ভারতে প্রথম ইংরেজ দূত হিসেবে স্যর টমাস রো’র অভিজ্ঞতা হয়েছিল জাহাঙ্গীরের দরবার দেখার। অভিজ্ঞতা না বলে বলা ভালো, সৌভাগ্য। অন্তত ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে লেখা তাঁর চিঠির বয়ান কতকটা সেরকমই ছিল। অবিশ্বাস্য রকমের রাজকীয়তায় তিনি হয়েছিলেন বাকরুদ্ধ। নানা ধরণের বহুমূল্য রত্নখচিত মুকুট ও অলংকারে (আক্ষরিক অর্থেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত) সুসজ্জিত সম্রাটকে দেখে তাঁর মানুষ না, কোনো মূর্তি মনে হয়েছিল। মুকুটে ছিল নানা ধরণের হিরে, গলায় ছিল চুনি ও পান্না খচিত রত্নহার, হাতে ছিল মুক্তোর বাজুবন্ধনী। ‘তিনি নিজেই একটি চলমান রাজকোষাগার’, এই ছিল রো সায়েবের বক্তব্য।
রো জাহাঙ্গীরকে বর্ণিত করেছেন, এক অস্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসু ও বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে। তিনি তাঁর চারপাশের পৃথিবীকে খুব গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতেন, আর তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের যেটা পছন্দ হতো, তা তিনি কিনে ফেলতেন; তা সে, ভেনাশিয়ান তরবারি আর গ্লাভস-জোড়া হোক, বা সাফাবিদ সিল্ক হোক, বা উত্তর মেরুর তিমির দাঁত হোক, বা জেড পাথরের নুড়ি হোক। চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় ছিল তাঁর পান্ডিত্য, আর পশু প্রতিপালনে ছিল তাঁর বিশেষ উৎসাহ। কিন্তু যে ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো, তা হলো বহুমূল্য রত্নের সংগ্রহ আর রত্নশাস্ত্র।
অন্য মুঘল সম্রাটদের মতো জাহাঙ্গীরেরও ছিল সাহিত্যে অনুরাগ। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ছিল তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরি। এই বইতে তিনি রত্নের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা বলে গেছেন। প্রতি বছর নববর্ষ বা ‘নও রোজ’ -এর দিনে দরবারে হতো বিশেষ অনুষ্ঠান। ওইদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিত্তশালী ব্যক্তিরা সম্রাটকে বহুমূল্য রত্ন উপহার দিতেন। সম্রাটের ওজনের সমপরিমাণ সোনা দরবারে উপস্থিত সকল অভ্যাগতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো।
১৬১৬ সালের ‘নও রোজ’ উদযাপনের গল্প জাহাঙ্গীর নিজেই শুনিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। ওই দিন তিনি সব মিলিয়ে সেই সময়কার হিসেব অনুযায়ী দুই লক্ষ টাকার রত্নসমগ্রী উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন ধরণের বহুমূল্য চুনির কথা, যার মধ্যে ছিল পুত্র খুররমের দেওয়া একটি চুনি, যার দাম ছিল আশি হাজার টাকা।আর বলেছিলেন হলুদ রঙের স্বচ্ছ বড় একটি চুনি খচিত খঞ্জরের কথা, যার দাম ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা।এক বছর পর তাঁর আত্মজীবনীতে জাহাঙ্গীর বর্ণিত করেছেন বিহারের শাসক ইব্রাহিম ফত জং-এর দেওয়া উপহারের কথা। বিহারের শাসক তাঁকে ন’টা অবিকৃত বড় হিরে উপহার দেন, যার মধ্যে সব চাইতে বড়টির ওজন ছিল 300 ক্যারেটের মতো; বাবরের সেই হিরের থেকেও যা ছিল আকারে অনেকটাই বড়।
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য :গুগল
Khub sundor