‘’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের শুরুতেই হয়ে গিয়েছিলাম বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য। আমাদের সেই দলের অনেকেরই পূর্বে বিশ্বকাপে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম ফ্রেশ ক্রিকেটার হিসেবেই। অস্ট্রেলিয়া সফরের ব্যাপারটা একটু আলাদা। এর আগেও দুবার এসেছি এখানে, দুবারই ফিরে গিয়েছিলাম খালি হাতে। তাই ব্যক্তিগত ভাবে অস্ট্রেলিয়ায় এই টেস্ট সিরিজ জয় আমার কাছে বিশ্বকাপ জেতার থেকেও স্পেশাল।‘’
ক্রিকেটমোদী মাত্রেই ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলির উপরোক্ত বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত। সিরিজ জিতে ওঠার অব্যবহিত পরেই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সাংবাদিক সম্মেলনে করা কোহলির মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক ও কম হয়নি। অনেকেই বলেছেন নিজেদের জয় উদযাপন করতে গিয়ে কোহলি বাড়াবাড়ি রকমের উদ্ধত কথা বলে ফেলেছেন। যদিও অস্ট্রেলিয়া সফরের অভিজ্ঞতা থাকা অনেকেই সমর্থন ও করেছেন অধিনায়ককে। কিন্তু প্রশ্ন টা অন্য জায়গায়। ক্রিকেট হিমালয়ের একাধিক সুউচ্চ শৃঙ্গ জয়ী বিরাট কোহলি কেও কেন আবেগে ভাসিয়ে দিচ্ছে এই অস্ট্রেলিয়া বধ? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে ক্যাঙ্গারু র দেশে? উত্তর আছে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়।
1981 সালের ভারত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। মেলবোর্ন টেস্ট। সবেমাত্র আউট হলেন সুনীল গাভাসকার। গ্যালারি থেকে খালি চোখেই বলে দেওয়া যায় ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। সেসময় ছিল না নিরপেক্ষ আম্পায়ারিং ব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার দের খ্যাতি ছিল দেশপ্রেমিক আম্পায়ারিং এর জন্য। ফল? গাভাসকারের আউট। হতবাক গাভাসকার অবাক হয়ে দেখছেন বিপক্ষ খেলোয়াড়দের উল্লাস, শুনছেন অকথ্য গালিগালাজ। গ্যালারি থেকে চলছে তীব্র ব্যারাকিং। ক্ষোভে ফেটে পড়েন গাভাসকার। দলের অধিনায়ক হিসাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন যে এরকম পরিবেশে ক্রিকেট খেলা অসম্ভব। ঘটে সেই বিখ্যাত ওয়াকআউট। সঙ্গী চেতন চৌহান কে ডেকে নিয়ে সুবিশাল এমসিজির সবুজ গালিচা থেকে বেরিয়ে যান গাভাসকার। কে জানত, সেদিনই জন্ম হল এক বিখ্যাত ক্রিকেটীয় শত্রুতার?
পিছিয়ে যেতে হবে আরেকটু । কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের হাতছানি তে অস্ট্রেলিয়ার তাবড় ক্রিকেটারেরা ছেড়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এমনই অবস্থা যে দশ বছর আগে অবসর নেওয়া ‘বৃদ্ধ’ ববি সিম্পসনকে অধিনায়ক বানিয়ে তাপ্পি মারা দল নামাল অস্ট্রেলিয়া। বিপক্ষে বিষাণ সিং বেদির নেতৃত্বে টগবগে ভারতীয় দল। সবাই জানতেন অস্ট্রেলিয়ার ‘বৃদ্ধ -ছোকরা’একাদশের উড়ে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। হ্যাঁ, উড়ে গেল ঠিকই, তবে অস্ট্রেলিয়া নয়, ভারত। ঐ ভাঙাচোরা দলই সমর্থ হয়েছিল কার্যসিদ্ধিতে। আর ক্রিকেট বিশ্ব বুঝে গেল, এ বড় কঠিন ঠাঁই।
সালটা 2000। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আরেকটা অস্ট্রেলিয়া সফরের। এবারের ভারতীয় দল তারকাখচিত। সচিন অধিনায়ক, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, কুম্বলে শ্রীনাথ কে নেই! এমন সময় বোর্ড সচিব জয়বন্ত লেলে করে বসলেন এক গোলমেলে মন্তব্য ,’’ মনে হচ্ছে আমরা এবারো হারব’’। ফলাফল? সত্যিই আরেকটা হোয়াইট ওয়াশ। বোঝাই গেল সফরের প্রাক্কালে ও সফর চলাকালীন দলের আত্মবিশ্বাসের হাল কেমন ছিল!
এরকমই টুকরো টুকরো ঘটনায় পূর্ণ ভারত অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটীয় বৈরিতার অধ্যায়গুলি। একটা টসগেট, একটা মাঙ্কিগেট সেই পরিপূর্ণ পুস্তকে আরো কয়েকটা অধ্যায় যোগ করে কেবল। শুধুমাত্র ভারত তো নয়, ক্রিকেট বিশ্বের মোটামুটি সব বড় মাথাই একমত, অস্ট্রেলিয়ায় লড়াইটা এক্কেবারে আলাদা। চরম ব্যাটিং শৌর্য বা বোলিংয়ের গুলিগোলা সেখানে নিয়ন্ত্রক নয়, কারণ খেলাটা যতটা না মাঠে, তার থেকে ঢের বেশি হয় মাঠের বাইরে। মাঠে ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ মাথায় এগারো জন প্রতিপক্ষ কেবল নয়, সফরকারী দলের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে দেশাত্মবোধ উদ্বুদ্ধ অস্ট্রেলীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা, দলে না থেকেও ভীষণভাবে যাঁরা দলের অঙ্গ। নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য ও আক্রমণে যাঁরা অতিষ্ঠ করে তোলেন বিপক্ষকে। না, এতেই শেষ নয়। কলোসিয়াম সুলভ বিশাল স্টেডিয়াম গুলির বহুতল গ্যালারি থেকেও চলতে থাকে অসংখ্য মানুষের তীব্র ব্যারাকিং। কেভিন পিটারসেন একবার মজা করে বলেছিলেন যে , অস্ট্রেলিয়ার মাঠে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে গিয়ে তাঁর বিশেষণ ভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। আর এই তীব্র মানসিক চাপ যদি কাটিয়ে ওঠা যায়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার বুমবুম বাউন্সি পিচ এবং বিশ্বমানের ক্রিকেটাররা তো রয়েছেনই বাকি কাজগুলো করে ফেলার জন্য। অস্ট্রেলিয়া সফর তাই একইসাথে একজন ক্রিকেটারের স্কিল এবং টেম্পারামেন্টের চূড়ান্ত পরীক্ষা।
বিরাট কোহলি এবং তাঁর দলের কৃতিত্ব এখানেই যে, এই মানসিক চাপে তাঁরা দুমড়ে তো যান ই নি, উল্টে পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছেন আয়োজকদের উপর। পার্থের বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়িয়ে মেলবোর্ন ও সিডনিতে যেভাবে প্রতিপক্ষ কে গুঁড়িয়ে দিল ভারত, তা দেখার মত। 30/4 অবস্থা থেকে অ্যাডিলেড টেস্ট বের করাও কম রোমাঞ্চকর নয়। স্মিথ ওয়ার্নারের অনুপস্থিতি দোহাই অনেকে দিচ্ছেন, কিন্তু অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি বরাবর দাবি করে এসেছে যে টিমগেম কখনো ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে না। এই সিরিজের ভারতীয় দলের উপর, বিশেষত বিরাটের উপর মানসিক চাপ কায়েম করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া এবং প্রতিবারই ইটের বদলে ভারতীয় শিবির থেকে উড়ে এসেছে পাটকেল। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত ঋষভ পন্থ যিনি বেবিসিটার তকমার জবাব দিয়েছেন স্টার্ক হেজেলউড কে পিটিয়ে শতরান করে। অস্ট্রেলীয় সিস্টেমের কঙ্কাল বের করে এনেছেন তাঁরা। যে অস্ট্রেলিয়া এতদিন অজুহাত দিতে ঘৃণা করত, তাদের সমর্থকদের মধ্যে এখন হাহুতাশ আর অজুহাতে ছড়াছড়ি। বিরাট ও রবি শাস্ত্রী জুটি তাঁদের জন্য উড়ে আসা উপেক্ষা অপমান কেই তাঁদের খেলোয়াড়দের মনে আগুনে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন, যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে একটি ক্রিকেটীয় সাম্রাজ্যের ভাঙচুরের আওয়াজ রীতিমত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন একদিনে আসেনি। বিরাট শাস্ত্রী জুটি ভারতীয় ক্রিকেট সিস্টেমই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আগে যেখানে ফিটনেস ট্রেনিং ছিল নাম কা ওয়াস্তে, এখন সেখানে অধিনায়ক নিজেই দৌড়ান সবার আগে ইয়ো ইয়ো টেস্ট দিতে। কোচ অধিনায়ক গর্ব করে বলতে পারেন যে, ” আমাদের দলে কারোর ঈশ্বর সমান অবস্থান নেই, সিনিয়র জুনিয়র ভেদাভেদ ও নেই। এরা জেতার জন্য সব রকম চেষ্টা করতে পারে।” ভারতের অনুশীলনে এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তরুণ ঋষভ বা হনুমাকে বল ছুঁড়ে প্র্যাকটিস দিচ্ছেন অধিনায়ক বা সহ অধিনায়ক। এত কিছুর যোগফলই এই সাফল্য।
বিরাটরা অস্ট্রেলীয় গর্বে আঘাত হানতে পেরেছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে 71 বছরে কেউ যা পারেনি, বরং বারংবার ভুলুন্ঠিত হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট মর্যাদা। পাশার দান অবশেষে উল্টালো।
সিরিজে ভারতীয় দলের প্রাপ্তি? অনেক। চেতেশ্বর পূজারার চোয়াল শক্ত করা লড়াই, যশপ্রীত বুমরার বোমাবর্ষণ, ঋষভ পন্থের আবির্ভাব, ব্যাটসম্যান কোহলির পাশপাশি অধিনায়ক কোহলির সাবালক হয়ে ওঠা। স্পিনের দেশ থেকে এক দুর্ধর্ষ পেস ইউনিটের উঠে আসা ও কি কম চমকপ্রদ? সিরিজে অভিষেক হওয়া মায়াঙ্ক আগরওয়াল কেই বা ভোলা যাবে কি করে? সিরিজের মাঝপথে ডাক পেয়ে স্টার্ক হেজেলউড কামিন্স কে অবলীলায় আটকে নতুন বলের বিরুদ্ধে রান করে গিয়েছেন তিনি। ভারতীয় রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তি প্রমাণিত হল মায়াঙ্ক এবং রবীন্দ্র জাদেজার সাফল্যের মধ্যে দিয়ে। কেবলমাত্র সিডনি টেস্টে সুযোগ পেয়েই চমকে দিয়েছেন কুলদীপ যাদব। কুলদীপ ও জাদেজা বুঝতেই দেননি কোনও এক রবিচন্দ্রন অশ্বিন নামক স্পিনার চোটের জন্য প্রথম টেস্টের পর আর মাঠেই নামতে পারেননি। স্লেজিংয়ে সেরা অজি দের বাগযুদ্ধে নাস্তানাবুদ করছেন ভারতীয়রা- এই বিরল দৃশ্য ও দেখা গেল। কিন্তু নিছক ক্রিকেটীয় প্রাপ্তির নিরিখে এই জয় ব্যাখা করা যায় না। সেই কবে যেন ডব্লিউ জি গ্রেস বলেছিলেন, ‘’তারা ক্রিকেটের কি বোঝে, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে?’’ আদর্শ উদাহরণ যেন এই সিরিজটি। অস্ট্রেলিয়া জয় যেন ক্রিকেটের মাউন্ট এভারেস্ট, বহু প্রচেষ্টার পর যা জয় করতে সক্ষম হল ভারত। বরাবরের অপমানিত ভারতের কপালে আজ বিজয়ীর মুকুট, শাসক অস্ট্রেলিয়া আজ পদানত। জয়ী ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি তাই হয়তো এত আবেগাপ্লুত। কারণ তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত আজ আর ফাঁকা নয়, সেই হাতে যে ধরা রয়েছে পতপত করে উড়তে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটের আধিপত্যের অদৃশ্য তেরঙা।
বাংলানিউজ