আজ সকাল থেকে দম ফেলার সময় নেই বিকাশ বাবুর। মর্নিং ওয়াকে না গিয়ে সকাল সকাল স্নান সেরে রেডী।সরকারী চাকরী থেকে অবসর নেবার পর নিজের একটা বাসা একদম নিজের তার বহুদিনের শখ। আজ সেই দিন। তার বাড়ীর গৃহপ্রবেশ। একটু পরেই পুরোহিত মশাই আসবেন। পুজো শুরু হবে। আত্মীয়পরিজন বন্ধুরা সবাই আসবে।কিন্তু সুমনা কোথায় গেল। এখনও কি করছে ও।বিকাশ বাবু ডেকে উঠলেন একতলা থেকে-কিগো হলো তোমার?
সুমনা তখনি নামছিলেন সিড়ি দিয়ে।অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন বিকাশ। বাইশ বছর বিয়ে হয়েছে কিন্তু সুমনা সেই আগের মতোই সুন্দরী। পরিপূর্ণতার একটা আভা ছড়িয়ে তার সারা মুখে।কখন যে নেমে এসেছে সুমনা খেয়াল করেননি বিকাশ।চমক ভাঙল সুমনার কথায় – হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন।পুরোহিত মশাই এসেছেন কি?
বিকাশ -তার আগে বল তোমার ছেলে উঠেছে ঘুম থেকে।
-শুধু ওঠেনি অলরেডি তার জগিং থেকে আসবার টাইম ও হয়ে গেছে।
সুমনার কথায় একটু বিরক্ত হয় বিকাশ। একদিন জগিং এ না গিয়ে বাবার সাথে থেকে এদিক গুলো একটু দেখলে বাবুর কি মান চলে যেত।একটু পরেই সবাই আসতে শুরু করবে।গজগজ করতে করতে ভিতরের দিকে গেলেন বিকাশ।সুমনা ও একটু হেসে পুজোর জায়গায় এগিয়ে গেল।তখনি দরজার বাইরে থেকে শোনা গেল আওয়াজ – বিকাশ বাবু আছেন?
বিকাশ বাবু এগিয়ে যান দরজার দিকে।অবাক হয়ে দেখেন যে বাইরে একজন পুলিশ অফিসার আর একজন কনস্টেবল দাড়িয়ে।
বিকাশ-কি ব্যাপার বলুন। আমি বিকাশ দত্ত।
অফিসার-সরি বিকাশ বাবু। আসলে আপনার ছেলে মানে ঋসভ দত্ত কে একটু আগে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।ওর বিরুদ্ধ একটা খুনের অভিযোগ রয়েছে।আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে।
বিকাশ বাবুর মুখ দিয়ে কিছুখন কোনো কথা বেরোয় না।এ কি শুনছেন তিনি সকাল বেলায় আজকের দিনে।তখুনি ভিতর থেকে সুমনার গলা শোনা যায়- হ্যা গো কে এসেছে? এগিয়ে আসতে থাকে সুমনা।
———————————————————-
রুবেল। আনিসুর রুবেল। ছবির জগতে এই নামটা এখন খুবই জনপ্রিয়। ল্যান্ডস্কেপ ড্রয়িং এ এই সময় তার জুড়ি মেলা ভার।প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য কে ড্রইং পেপার এ জীবন্ত করে তুলতে পারে রুবেল।গত কয়েক মাস ধরে এই শহরতলি তেই চুপচাপ থাকছিলেন একটা বাড়ী ভাড়া নিয়ে।আর এখানে থাকতে থাকতেই ঋষভ এর সাথে তার পরিচয়।যৌবন পেরিয়ে আসা রুবেল এর সাথে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ঋষভ এর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল একটাই কারনে যে ঋষভ প্রকৃতি কে ভালবাসত প্রান ভরে।রুবেলের তুলির টানে সমগ্র প্রকৃতি জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখে সে শিহরিত হতো।ঋষভ এর বন্ধুরাও ঋষভের সাথে আসত রুবেল এর কাছে।অবাধ যাতায়াত ছিল তাদের সবার প্রিয় রুবি আংকলের কাছে।
তাই সেদিন যখন কল্যান, মনোজ, বিপাশাদের কানে এল যে রুবেল মারা গেছে আর তার জন্য ঋষভকে খুনী সন্দেহে পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে সেদিন তারা আর থাকতে পারেনি।সবাই ছুটে এসেছে থানায়।
সেখানে তখন বিকাশ বাবু অফিসারের সাথে কথা বলছিলেন আর একটু দূরে বসে সুমনা শূন্য দৃষ্টিতে লক আপের দিকে চেয়ে আছে।বিপাশা আসতে আসতে সুমনার কাছে যায়। পাশে বসে ডাকে- কাকিমা ও কাকিমা।
বিহ্বল দৃষ্টি মেলে সুমনা তাকায়।
“এসব কি কাকিমা।কেন এরা ঋষভকে ধরেছে?”
“ওরা বলছে আমার বাবাই নাকি খুন করেছে।ওর রুবি আংকলকে ও নাকি মেরে ফেলেছে।”
চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পরে সুমনার।আর কথা বলতে পারেনা ও।
মনোজ এগিয়ে এসে বলে-যা খুশি বললেই তো হলো না।কি প্রমাণ আছে পুলিশের কাছে?
পুলিশের সাথে কথা বলে কখন যে বিকাশ বাবু ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ওরা খেয়াল করেনি।
“মিঃ রুবেলের চাকর বাবাইকে রুবেল এর ঘর থেকে বেরোতে দেখেছে আজ ভোরে আর পুলিশের সন্দেহ খুনটা ওই সময় হয়েছে।”
চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ সুমনা-এসব মিথ্যা।বাবাই এই কাজ করতে পারেনা।
বিকাশ-সেতো আমিও জানি সুমনা কিন্তু তোমার ছেলে তো চুপ করে আছে।ভেতরে তো ঢুকতে দেবেনা কিন্তু বাইরে থেকে তো কথা বলতে পারবে।তুমি একবার যাও সুমনা।দেখো কিছু বলে কিনা।
এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন বিকাশ বাবু।
লকআপে চুপচাপ বসে থাকা ঋষভ মার ডাক শুনে এগিয়ে এল।কাঁদতে থাকা সুমনার হাত ধরে শুধু বলল-মা শুধু এটুকু বলতে পারি আমি খুন করিনি।আমি যখন যাই অলরেডি আংকল …
ইতিমধ্যে অফিসার এগিয়ে এসছেন।
মি:বিকাশ কাল আমরা ঋষভকে আদালতে নিয়ে যাব।এরমধ্যে যে ছুরি দিয়ে রুবেলকে মারা হয়েছে,যেটা রুবেলের বডির পাশেই পড়েছিল সেটার ফরেনসিক রিপোর্ট ও এসে যাবে।বডির পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট ও আমরা পেয়ে যাব।
বিপাশা মনোজদের দিকে তাকিয়ে অফিসার বলেন- তোমরা কেউ থানার অনুমতি ছাড়া শহর ছেড়ে বাইরে যাবেনা।মিঃ রুবেলের বাড়ীতে তোমরাও যে নিয়মিত যেতে এবং কাল ও যে গিয়ে অনেক রাত অবধি ছিলে সেই খবর আমি জানি।
মনোজরা চুপচাপ গিয়ে বিকাশ বাবুর পাশে দাঁড়ায়।বিকাশ কাঁদতে থাকা সুমনার কাঁধে হাত দিয়ে বলে- চলো।অনেক কাজ এখন।বাবাই এর জন্য একজন ভালো উকিল ঠিক করতে হবে।আমাদের এখন শক্ত হতে হবে সুমি।
———————————————————-
অধীর সামন্ত বিকাশ বাবুর পুরোনো বন্ধু। ডুসেলডর্ফে দীর্ঘদিন বড় বড় কোম্পানির লীগাল অ্যাডভাইসার হিসাবে কাজ করেছেন।এখন এই শহরেই অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন।এই চরম বিপদের দিনে বিকাশ ও সুমনা অধীরের কাছেই গেল।সব শুনে অধীর বাবু বললেন- ক্রিমিনাল ল’ইয়ার হয়েও সারাজীবন শুধু কোম্পানির লীগাল অ্যাডভাইসার হয়ে কাটিয়ে দিলাম।আর আজ সেই সুযোগ এল তাও সেটা প্রিয় বন্ধুর ছেলের কেস।
বিকাশ – তুই আমাদের ফেরাস না।তাহলে আমরা বড় অসহায় ফিল করব।
অধীর -আমি লড়ব বিকাশ আর শোন ঋষভের বন্ধুদের ঠিকানা দে।সবার সাথে আলাদা করে কথা বলতে হবে আর ঋষভের সাথেও কথা বলব।মিঃ রুবেলের চাকর অনুকূল এর সাথেও কথা বলতে হবে।হি ইজ আ ভেরী ইম্পর্ট্যান্ট পার্সেন ইন দিস কেস।
সুমনা শুধু একটাই কথা বলল- ঠাকুরপো আমার বাবাই কে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।আমি জানি ও খুন করেনি।
বিকাশ ও সুমনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরদিন থেকেই অধীর কাজে নেমে পড়লেন।প্রথমেই থানায় গিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলে ঋষভের সাথে দেখা করলেন।এও জানলেন যে যে ছুরি দিয়ে রুবেলকে মারা হয়েছে তাতে ঋষভের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।এরপর মনোজ, কল্যান, বিপাশা প্রত্যেকের সাথে আলাদা ভাবে কথা বললেন।কথা বললেন চাকর অনুকূলের সাথেও।
অধীর- অনুকূল ঠিক কি হয়েছিল ওই দিন সকালে আমায় বলো তো।
অনুকূল- পুলিশকে তো সবই বলেছি বাবু।
অধীর-আর একবার আমায় বলো।
অনুকূল- বাবু ওইদিন প্রায় ১১টা অবদি রাতে ঋষভ বাবুরা ছিল।তারপর বাবু আঁকতে বসে।আমিও জেগে ছিলাম অনেকক্ষণ।
বাবু কে বারবার চা করে দিতে হয় তো।প্রায় ভোরের দিকে বাবুর আঁকা শেষ হয় আর বাবু শুতে যায় আর আমিও একটু গড়িয়ে নিতে আমার ঘরে যাই।
বাবুর হঠাৎ বিকট চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে যায়। আমি দৌড়ে বাবুর ঘরে আসতে গিয়ে ওই ঋষভ বাবুর সাথে ধাক্কা লাগে।উনি কখন এসেছিলেন আমি জানিনা।আমায় দেখেই ওই বাবু দৌড়ে পালায় আর আমি বাবুর ঘরে গিয়ে দেখি যে আমার বাবু বিছানায়….
আর বলতে পারে না অনুকূল।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
অধীর বাবু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে পড়েন আর বলেন- ঠিক আছে অনুকূল।সাবধানে থেকো।পরে প্রয়োজন হলে আমি আবার আসব।
অনুকূল- বাবু এই সব কোর্ট এর ঝামেলা শেষ হলেই আমি আমার দেশের বাড়ী চলে যাব।
বাড়ী ফিরে অধীর বাবু চুপ করে বসে সবার কথা গুলো ভাবছিলেন।কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে ঠিক ধরতে পারছেন না।তলিয়ে ভাবতে লাগলেন ঋষভ, মনোজ, বিপাশা, কল্যান, অনুকূলের বলা কথাগুলো আর তখনই অসংগতি টা বুঝতে পারলেন।ঝট করে উঠে পড়লেন।এখনই বেরোতে হবে একবার।কাল প্রথম শুনানির আগেই এই খুনের রহস্যের জট খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
———————————————————-
মানুষের মনের তল পাওয়া যে কত কঠিন সেটা আরও একবার টের পেলেন অধীর বাবু।যেটা জানলেন সেটা বোধহয় না জানলেই ভালো হত।ঋষভ নির্দোষ সেটা তার সাথে কথা বলে আইডিয়া করেছিলেন কিন্তু রুবেল খুনের মোটিভ টা কি সেটা বুঝতে পারছিলেন না।বাইরের কোনো অজানা শত্রু যে কাজটা করেনি সেটা বুঝেছিলেন কারন রুবেলের সেরকম কোনো শত্রু ছিল না।খুনীকে শনাক্ত করতে পারলেও মোটিভ টা এখনও ধোঁয়াশা।বিকাশের বাড়ীর সামনে গাড়ী থেকে নেমে কিছুখন চুপচাপ দাঁড়ালেন অধীর বাবু।একমাত্র ছেলে খুনের অভিযোগে হাজতে।বাবা মার সামনে কিভাবে সত্যটা উদঘাটন করবেন সেটা মনে মনে একটু গুছিয়ে প্রবেশ করলেন বাড়ীতে।ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন বিকাশ ও সুমনা।সুমনার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যিই খারাপ লাগলো অধীরের।এত শুকনো এতটা অসহায় লাগলো যে মনটা খারাপ হয়ে গেল অধীর বাবুর।অধীরকে দেখেই এগিয়ে এল দুজনে।
সুমনা-ঠাকুরপো কি খবর গো? আমার বাবাই ছাড়া পাবে তো?
সুমনার এই প্রশ্ন শুনে অধীর তাকালেন বিকাশের দিকে।কোনরকম ভনিতা না করে বললেন- সেটা সবচেয়ে ভালো তোমার স্বামীই বলতে পারবে।
চমকে তাকালেন বিকাশ। আর সুমনা একবার বিকাশ একবার অধীরের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি কিছু বুঝলাম না।ও কি করে জানবে।
অধীর-ওই তো জানবে সুমনা।পুরো দাবার ছকটা তো ওরই তৈরী করা।
কঠোর হয়ে উঠল অধীর এর গলা।
বিকাশ-কি সব যাতা বলছিস তুই।কিসের ছক!! আ..আমি কি করে জানব।
একটু যেন কেঁপে গেল বিকাশের গলা।
অধীর-হ্যাঁ তুই।চমৎকার সাজিয়েছিলিস সবকিছু।সাকরেদটাও বেশ জোগাড় করেছিস কিন্তু পুরো ঘটনাটায় নিজের ছেলেকে কেন জড়ালি সেটাই শুধু জানতে চাই।
সুমনা অবাক দৃষ্টিতে বিকাশের দিকে চেয়ে বলে- এসব কি বলছে ঠাকুরপো।তুমি..তুমি এসব কেন করবে।চুপ করে আছ কেনো তুমি।
হাহাকারের মতো শোনায় সুমনার কথাগুলো।
অধীর- ও বলবে সুমনা।সব বলতে হবে আজ ওকে।চুপ করে না থেকে এবার ছিপি টা খোল বিকাশ।বাবাই.. তোদের সন্তান..তোদের একমাত্র অবলম্বন.. সে আজ গারদের আড়ালে..শুধু তোর জন্য!! আর তুই এখনও..
বিস্ফোরিত হয় বিকাশ-
কে আমার ছেলে!! ও মোটেও আমার ছেলে নয়।কেও নয় ও আমার।একটা দগদগে ঘা যা আজ বাইশ বছর ধরে নিজের অজান্তে আমি বয়ে বেরিয়েছি!
হতবাক দৃষ্টিতে বিকাশের দিকে চেয়ে রইল অধীর।এ কাকে দেখছে ও।একটা হিংস্র আক্রোশ ফেটে বেরোচ্ছে বিকাশের চোখ মুুখ থেকে।ক্রোধে ফুলে উঠছে সারা শরীর।আর সুমনা! চাপা আর্তনাদ করে মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে সুমনা।
অধীর ছুটে গেল বিকাশের কাছে।
-কি বলছিস তুই? তোর কোথাও নিশ্চয় ভুল হয়েছে।বল আমাকে সব খুলে বল।তাকিয়ে দ্যাখ একবার তোর এই আচরনে সুমনার কি অবস্থা।
আরও গর্জে ওঠে বিকাশ-কিছুই হয়নি ওর।ঠকিয়েছে ও আমায় এত বছর ধরে।জানিস.. জানিস তুই, বাবাই যে বাবাইকে বুকের রক্ত দিয়ে ছোট থেকে বড়ো করলাম সে আসলে আমার কেউ নয়।সে ওই রুবেলের ছেলে।রুবেল ওর বাবা।
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা চমকে উঠতেন না অধীরবাবু।
কোন কথা বলতে পারেন না তিনি।এইরকম একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে সেটা তিনি ধারনা করতে পারেননি।
ইতিমধ্যে সোফায় বসে থাকা সুমনা উঠে দাঁড়িয়েছে।চোখটা মুছে এগিয়ে এল সামনে।
অদ্ভুত শান্ত ভাবে বলল- ঠাকুরপো ও ঠিকই বলেছে।এবার বিকাশের দিকে ফিরে বলল
– এত যদি রাগ, এত আক্রোশ তোমার তো আমি ছিলাম।আমাকে শাস্তি দিতে।বাবাই তো কোন দোষ করেনি।
অধীর- প্লীজ সুমনা তোমরা আমায় সব খুলে বল।…
———————————————————-
কলেজে পড়ার সময় রুবেলের সাথে আলাপ সুমনার।সুন্দর ছিপছিপে এবং আঁকার হাত দারুণ ব্যাস আর কি।কলেজের অনেক মেয়ের মত সুমনাও…রুবেল কিন্তু ঝুঁকল সুমনার দিকেই।সুমনা শুধু সুন্দরী বলে নয় আসলে সুন্দর একটা মন ছিল তার।বন্ধু থেকে প্রেম আর সেই প্রেম শুধু হাত ধরে ঘোরা সিনেমা দেখা আর গল্প করাতেই আটকে ছিল না।ছিল অনেক গভীর।আর সেই গভীরতার টানেই হয়ত ভাসিয়ে নিয়ে গেল দুজনকে।কলেজ ট্যুর থেকে ফেরার কিছুদিন পরেই টের পেল সুমনা যে সে অন্তস্বত্বা।সুমনার বাবা মাও জানল সব।গোঁড়া কায়স্থ সুমনার বাবা মুসলিম ছেলের সাথে সুমনার সম্পর্ক মেনে নেবেন না এটাই স্বাভাবিক। বিকাশ দত্তর সাথে একমাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল তার।সবকিছু গোপন রাখার জন্য সুমনার মা তাকে নিজের দিব্যি দিল আর বাবা দিল আত্মহত্যার হুমকি।বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলেও শেষ অবধি বাবা মার দুর্বলতার কাছে হার মানে সে।কিন্তু বিয়ের পর ধীরে ধীরে হলেও বিকাশকেই নিজের জীবনের সবচেয়ে কাছের জায়গা দেয় সুমনা।ফিকে হতে থাকে রুবেলের স্মৃতি। শুধু বাবাইকে দেখলে মাঝে মাঝে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠত সুমনার।প্রেমে ব্যর্থ রুবেলও হারিয়ে গেল সুমনার স্মৃতি বুকে নিয়ে।
সবই চলছিল ঠিক আজ বাইশ বছর ধরে।তারপর যেন ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে এই শহরে এল রুবেল।শুধু শহরে নয় তার ছেলের হাত ধরে তার বাড়ীতেও এল।সুমনার চাপা দেওয়া স্মৃতিকে উসকে দিল সে।যদিও রুবেল জানত না যে ঋষভ তার সন্তান কিন্তু ঋষভের জন্মদিনের পার্টিতে এক নির্জন সময়ে সুমনা তাকে জানায় সত্য।বিহ্বল হয়ে যায় রুবেল।এতদিন সে সুমনাকে বড়লোকের খেয়ালী মেয়ে বলে ভেবেছিল।আঁকড়ে ধরতে চায় সে ঋষভকে।যদিও সুমনাকে কথা দিয়েছিল বলে সবই গোপন রাখে সে।কিন্তু তাদের এই গোপনতা একজনের কানে যায় আর সে হল বিকাশ।যে বাবাই ছিল তার প্রান তার শরীরে অন্য রক্ত! ভালবাসা বদলে যায় ঘৃনায়।স্নেহ বদলে যায় প্রতিশোধ স্পৃহায়।
তখন থেকেই চলতে থাকে পরিকল্পনা। রুবেলকে শেষ করবে বিকাশ আর ঘর থেকে দূর করবে তার রক্তকেও।কিন্তু কিভাবে কিভাবে!!
এল সুযোগ।নিজের বাড়ীর জন্য একটা কাজের লোক খুঁজে দিতে বিকাশকেই বলল রুবেল।রুবেলের বাড়ীতে এল বিকাশেরই ঠিক করা অনুকূল।ধীরে ধীরে পরিকল্পনা বাস্তব রূপের দিকে এগোল।
এল সেইদিন।রুবেলের জন্মদিনের সন্ধ্যায় তার বাড়ীতে এল ঋষভ আর তার বন্ধুরা।হল উৎসব খাওয়াদাওয়া।চালাকি করে অনুকূল ঋষভকে দিয়ে ফল কাটাল এবং সরিয়ে রাখল ঋষভের আঙুলের ছাপ যুক্ত ছুরি।ভোরবেলায় ঘুমন্ত রুবেলের বুকে আমূল বসিয়ে দিল সেই ছুরি বিকাশ বাবুর প্ল্যান মত।ফোন করে রুবেলের নাম করে ডেকে পাঠায় ঋষভকে। মেন গেট খুলেই রাখে সে।ঘরে এসে লাশ দেখে ঋষভ ঘাবড়ে গিয়ে বেরিয়ে যায় অনুকূলের সামনে দিয়ে।এরপরের ঘটনা সবারই জানা।এই কাজের জন্য বিকাশ বাবুর কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পায় অনুকূল। টাকাটা বিকাশ বাবুর কাছেই রাখা।প্ল্যান ছিল আদালতে অনুকূলের বয়ানে ঋষভের শাস্তি হবার পর ওই টাকা নিয়ে অনুকূল তার দেশে চলে যাবে।
শুধু একটাই ভুল সে করে।অধীর বাবুর প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছিল যে বাড়ীর কোলাপশিবল গেটের দুটো চাবিই তার কাছেই থাকে।ওইদিন রাতে ঋষভরা চলে যাবার পর সে নিজে দরজায় তালা দিয়েছিল অথচ সকালে ঋষভ কিভাবে ঢুকল বাড়ীতে।কারন অনুকূল নিজেই বলেছিল যে সে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।রুবেলের চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে।জবানবন্দীর এই অসঙ্গতি অধীর বাবুকে খুনী কে চিন্হিত করতে সাহায্য করে।অধীর ও পুলিশের জোরালো জেরায় ভেঙে পড়ে অনুকূল।
আর তারপরই অধীর আসে বিকাশের বাড়ী।
আদালতে বিকাশের জবানবন্দীতে মুক্তি পায় ঋষভ।সাজা হয় বিকাশ ও অনুকূলের।
সুমনার কাছে ফিরে আসে বাবাই।
শূন্য বুকে বাবাই ওরফে রুবেলের সন্তানকে আঁকড়ে ধরে সুমনা বাকি জীবনের জন্য। বিষন্ন হৃদয়ে ফিরে যান অধীর সামন্ত।
(সমাপ্ত)
চিত্র সৌজন্য : গুগল
খুব ভালো