– – আরে, কেয়া কার রহি হ্যায় তু ইয়াহা? “
চমকে পিছনে ঘুরল রাবিয়া। জাফর যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি সে। রোজকার মতই সন্ধ্যের নমাজ সেরেই সে ছুট্টে এসে দাঁড়িয়ে গেছে পাহাড়ের এই বাঁকটিতে। জাফর কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি ও।
পিছন থেকে সামনে এলো জাফর। রাবিয়ার দৃষ্টি অনুসরন করে সামনে তাকালো সে। চোয়াল হালকা শক্ত হয়ে উঠল তার। নজর এড়ালো না রাবিয়ার।
– – ” সি আর পি”, অস্ফুটে বলে উঠল জাফর।
– – ” কেয়া বোলা?” বুঝতে না পেরে শুধালো রাবিয়া।
সামনে দিয়ে তখন যাচ্ছে ভারতীয় আধা সেনার এক বিশাল কনভয়। রাবিয়ার অবশ্য এখন আর তাতে কোনও আগ্রহ নেই। সে যা দেখতে এসেছিল দেখা হয়ে গেছে। তার দৃষ্টি এখন জাফরের দিকে। কেমন কঠিন হয়ে উঠেছে জাফরের মুখচোখ। নিজের প্রশ্নের কোনও উত্তর পেল না রাবিয়া। তার হাসিখুশি দাদাকে এমনভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয় সে।
– – ” কেয়া বোল রহে হো ভাইয়া? ” ফের জিজ্ঞাসা করল রাবিয়া।
বুঝি সম্বিৎ ফিরল জাফরের। দৃষ্টি ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাল।
– – ” কুছ নেহি। তু এখানে কি করছিস? তু অভি ঘর যা। শাম হো চুকা হ্যায়। আব্বু জান জানলে খাফা হবেন। ”
দাদার এড়িয়ে যাওয়া উত্তর পছন্দ হল না রাবিয়ার। তবে আর তর্কে গেল না। বাড়ির পথ ধরল সে। অনন্তনাগের ভিতরের রাস্তাঘাট যে খুব ভাল বলা যায় না। এবড়োখেবড়ো, পাথুরে। উপরন্তু সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হিজাবে কান ভালো করে ঢেকে সে সাবধানে চলতে লাগল। বুঝতে পারল দাদা আসছে না তার পিছনে।
রাবিয়া জানত আব্বু তাকে কখনোই বকবে না। সে আব্বুর জান। একটু ভয় ছিল আম্মি কে নিয়ে। তবে, আম্মিও কিছু বলল না দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আসলে কাশ্মীরে একদম অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামের ভিতরে মেয়েরা চলাফেরা করেই। আর, রাবিয়াকে কে না চেনে! সবাই স্নেহ করে ওকে। জাফর যাই বলুক, কেউই তাকে বকার নেই।
যদি কেউ বকত ও, তাকে আজ যেতেই হত হাইওয়ে তে, সেনা কনভয়ের সামনে। সে জানত প্রতি মঙ্গল আর শনিবার কনভয় পাস করে ঠিক ওই সময় ওই রাস্তা দিয়ে। গ্রামের লোকেরা ওইসময় বড় একটা ওদিকে যেতে চায় না। যতটা না ভয়ে, তার থেকে বেশি ঘেন্নায়। ” ইন্ডিয়া কি আর্মির মুখ দেখাও পাপ “, বলেন আব্বু। সে নিজেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তারা ভারতীয় সেনার হাতে পরাধীন। মনেপ্রাণে তাদের বিনাশ চায় সে। কিন্তু…….
মাস দুয়েক আগে আব্বুর সাথে শ্রীনগর থেকে ফেরার সময় রাবিয়া প্রথম দেখেছিল তাকে। কনভয়ের প্রথম দিকের একটা জিপেই বন্দুক হাতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে সতর্ক চোখে যাচ্ছিল সেই সেনানী। বিকেলের নরম রোদ পড়ছিল তার মুখে। কাটা কাটা মুখ চোখ, মায়াবী অথচ কঠিন দৃষ্টি, হাওয়ায় এলোমেলো চুল। আলোড়ন তুলেছিল সেই দৃশ্য রাবিয়ার বুকে। এমন এক অনুভূতি কখনও হয়নি তার। এক ঝলক চোখাচখিও হয়েছিল কি? ঠিক বুঝতে পারেনি রাবিয়া।
সেই থেকে প্রতি মঙ্গল আর শনিবার বিকেল হলেই রাবিয়ার বুকে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। সত্যি বলতে কি, সারা সপ্তাহ সে অপেক্ষায় থাকে। মনকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে সে, বুঝিয়েছে ওরা শত্রুপক্ষের লোক, কোনও আকর্ষণ ঠিক নয় ওদের প্রতি। কিন্তু মন কি আর কথা শোনে? প্রতি মঙ্গল আর শনিবার বিকেল হলেই রাবিয়া তাই ছোটে পাহাড়ের সেই বাঁকে। গত দুই মাসে মাত্র দুদিন অনুপস্থিত ছিল সেই সেনানী। বাকি দিনগুলিতে সে প্রাণ ভরে দেখেছে তাকে, মুগ্ধতা আরও বেড়েছে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে জাফরকে দেখল না রাবিয়া। অবাক হল। এত রাতে দাদা কোথায়?
আম্মিকে শুধাল সে, – – ” ভাইয়া কাঁহা হ্যায়, আম্মি? “
– – ” ভাইয়া ফোন করেছিল, থোড়া দের হোগা। তু বৈঠ যা। “
বেশ রাগ হল রাবিয়ার। দাদা কেমন যেন বদলে গেছে। আগেকার সেই হাসিখুশি, দুষ্টু দাদাটা আর নেই। এখন বেশিরভাগ সময়েই চুপচাপ থাকে। ঘরে দরজা বন্ধ করে কি সব করে, প্রায়ই বেরিয়ে যায় যেখানে সেখানে। আব্বু কেন যে মেনে নেয় কে জানে ! কষ্ট হয় রাবিয়ার। বাড়িতে তার একমাত্র বন্ধুটি কেমন যেন পর হয়ে গেছে।
পরের তিনদিন পড়াশোনার চাপ রাবিয়ার মাথা থেকে সব বের করে দিল।
শনিবার আসতেই আবার বুক চঞ্চল তিতলি। আজ আবার আসবে সেই কনভয়। আবার তার দেখা হবে তার স্বপ্ন পুরুষের সাথে। আচ্ছা, সে কি বোঝে না যে তাকে দেখার জন্য এক সুন্দরী কাশ্মীর কি কলি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু তার জন্য? শুধু তার জন্য বিকেলে সব কাজ দূরে সরিয়ে রাখে রাবিয়া। জানবে না সে কোনদিন?
রাবিয়া ঠিক করল আজ হাত নাড়বে, একটু অন্তত সে দেখুক, বুঝুক যে তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে একজন।
বিকেলের নমাজ সেরে বেরোল সে। প্রায় ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে সে। বিকেলের নরম রোদে ভিজে যেন এক উচ্ছল ঝর্না বয়ে যাচ্ছে অনন্তনাগের পাহাড়ি উপত্যকা ধরে।
হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠল রাবিয়ার। ও কিসের আওয়াজ? গুলির না? কাশ্মীরের মেয়ে হবার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই সে শুনছে ওই আওয়াজ। দৌড়ল সে।
দৌড়তে দৌড়তেই হাইওয়ে পর্যন্ত চলে এল সে। এটি সে খুব ভাল করেই জানে যে এখনও কনভয়ের ওই বাঁকটি পর্যন্ত আসার সময় হয়নি। সে আবার দৌড়ল। যেদিক থেকে কনভয়টি আসে, সেইদিকে। প্রায় মিনিট পনের যাওয়ার পর সে দেখতে পেল কনভয় টিকে। যেন এক বিশাল আলোড়ন পড়ে গেছে সেখানে। গুলির আওয়াজ ততক্ষণে থেমে গেছে। কিন্তু সৈন্যরা ছোটাছুটি করছে। রাবিয়ার বিহ্বল চোখ একজনকেই খুঁজছে। কোথায় সে? সামনের দিকেই তো থাকে।
সাবধানে সন্দিগ্ধ চোখে আস্তে আস্তে কনভয়ের সামনে এসে পড়ল রাবিয়া। সামনে রাস্তার ধারে কয়েক টি দেহ রাখা রয়েছে না?
আরও সামনে এগোল রাবিয়া। সে নিশ্চিত যে কনভয়ে জঙ্গি হামলা হয়েছে। আজ থেকে কটা মাস আগে হলেও সে খুব খুশি হত জঙ্গি হামলায় ইন্ডিয়ার সৈন্য মরলে। কিন্তু এখন এক অজানা আশঙ্কায় তোলপাড় হচ্ছে বুকে। তার ওপর বেশি কাছে গেলে সে নিজেও গ্রেফতার হয়ে যেতে পারে।
যা হয় হোক, যেতে তাকে হবেই।
আরও একটু সামনে এগোতেই মৃতদেহ গুলির দিকে চোখ পড়ল তার। গা টা হঠাৎ যেন গুলিয়ে উঠল।
মৃতদেহ গুলির মধ্যে চিরঘুমে শুয়ে রয়েছে কনভয়ের সেই সেনানী এবং তার প্রাণাধিক প্রিয় দাদা জাফর। মুখোমুখি।
মৃত্যুতেও যেন শেষ হয়নি একে অপরের প্রতি তাদের আক্রোশ। রক্তাক্ত দুই শরীর মুখোমুখি, উভয়েরই চোখ খোলা, একে অপরের দিকে তাকিয়ে। প্রাণহীন ঠান্ডা সেই দৃষ্টি।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সংজ্ঞাহীন রাবিয়া।
চিত্র সৌজন্য : গুগল