রহস্যের নাম ক্রিকেট: ষষ্ঠ পর্ব

শান্তনু দাস
5 রেটিং
1041 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

প্রথম পর্বের লিংক:
https://www.saabdik.com/rohosyer-nam-cricket/
দ্বিতীয় পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/rohosyer-nam-cricket-2/
তৃতীয় পর্বের লিংক:
https://www.saabdik.com/rohosyer-nam-cricket-3/
চতুর্থ পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/rohosyer-nam-cricket-4/
পঞ্চম পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/rohosyer-nam-cricket-5/

“ কিছুই দেরি হয়নি সৌরভ বাবু , আসুন । আমিও এই পনেরো মিনিট হল এসেছি । ” … ইন্দ্রদা সৌরভ নাগের উদ্দেশ্যে বলল ।

          পরের দিন সকাল নটার মধ্যে আমরা ক্লাবঘরে পৌঁছে গেলাম । তবে ভেতরে না ঢুকে আমরা বাইরে একটা দেবদারু গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলাম সবাই । কালকের তুলনায় আজকে ঠাণ্ডা অনেকটা কম ছিল , কুয়াশাও ছিল বেশ । আমাদের প্রত্যেকের হাতে মাটির ভাঁড়ে ছিল গরম গরম দার্জিলিং চা । ইন্দ্রদা সি ডি ক্যাসেটটা ফেরত দিয়ে বলতে শুরু করল …

          “ সুমিতকে দেখছি না তো ? ”

          গণেশ ঘোষ বললেন … “ এখনই এসে পড়বেন । ”

          তপেন গুহ জিজ্ঞেস করলেন … “ খেলা কেমন দেখলেন ইন্দ্রজিৎ বাবু ? আমার তো বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে । ”

          “ খেলাটা দেখলাম বটে কিন্তু মনের মত হল না । মনে হচ্ছিল মাঝে একটু আকাশ মেঘলা থাকলে ভাল হত বা বৃষ্টি হলে খেলাটা আরো জমে যেত ।তাই নয় কি সৌরভ বাবু ? ”

          সৌরভ নাগের ডান পা টা সামান্য কেঁপে উঠল ।

          গনেশ ঘোষ বললেন … “ তা আপনি কি বলতে চাইছেন খোলসা করে একটু বলুন তো ? ”

          “ আমি কি বলতে চাইছি সেটা সৌরভ বাবু ভালই বুঝতে পারছেন । ”

          দেবদারু গাছটার পেছনে একটা চেনা গলা শুনতে পেলাম । সুমিত বিশ্বাস চলে এসেছে । একটি অবাঙালি ছেলে সবাইকে মাটির ভাঁড়ে আবার একবার করে চা দিয়ে গেল ।

ইন্দ্রদা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল … “ সৌরভ নাগ আপনি ভেবেছিলেন সবার চোখে ধুলো দিয়ে ফাইন্যাল কাপ নেবেন ? কিন্তু সে আশায় যে আমি জল ঢালতে বাধ্য হচ্ছি সৌরভ বাবু । ”

          সৌরভ নাগের হাতে চায়ের ভাঁড়টা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে ।

          “ আপনি কি বলতে চাইছেন ইন্দ্রজিৎবাবু ? ”

          “ আপনি এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন ? আমি জানি আপনার একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয় । ”

          চারপাশেএকটি পাহাড়ি ময়নার ডাক ছাড়া একদম পিন পড়া নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । তার ফলে ইন্দ্রদার গলার স্বর পাথরের মত কঠিন । সুমিত বিশ্বাসও ফ্যাকাসে মেরে গেছে ।

          “ সৌরভ বাবু আপনি ভেবেছিলেন প্লেয়ারদের কফিতে আর এনার্জি ড্রিঙ্কসে বারবিটন মিশিয়ে দেবেন , আর কেউ সেটা জানতেও পারবে না ? ”

          “ আ … আমি কিন্তু … ”

          “ আপনি একটা ভুল করেছেন কফিটা আমাকে খেতে দিয়ে । তা না হলে হয়তো এই রহস্যের সমাধান এতটা তাড়াতাড়ি হত না । বারবিটন এমনই একটা ড্রাগস যেটা খেলে যেকোনো শক্তিশালী মানুষ নিমেষের মধ্যে অলস ও অবসন্ন হয়ে পড়ে উইদআউট এনি আদার সাইড এফেক্ট । ”

          “ আর আপনি বলতে চাইছেন তার জন্যই প্রত্যেকটা ম্যাচ জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব জিতে যাচ্ছে ? আপনি পারেনও মশাই । ” … হা হা হা করে হেসে উঠলেন তপেনবাবু ও গনেশবাবু ।

          সুমিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও রাগে ফুঁসছে । ইন্দ্রদার পরের কথাগুলো সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল …

          “ ঠিকই বলেছেন আপনারা , একটুখানি বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ারকে অবসন্ন করা যায় , কিন্তু একেবারে না খেলার যোগ্য করে দেওয়া যায় না । তাই আমিও চিন্তায় পড়ে যাই কিভাবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব , মানে সৌরভ বাবুর টিম অত সহজে প্রত্যেকটা ম্যাচ জিতে যাচ্ছে । আর সেটার কারনও বুঝতে পারি ভিডিও ক্যাসেটটা দেখে । আমি প্রথম দিনই ম্যাচের দুজন আম্পায়ার মানে আপনাদের হাতে বিশেষ বড় বড় ঘড়ি লক্ষ্য করেছিলাম । সূর্যের আলো পড়ে ঘড়ির ওপরের মিরর প্লেটগুলো চকচক করছিল । তখন কিছু বুঝতে পারিনি । পরে যখন ভিডিও দেখলাম তখন আমি ম্যাচের দুজন আম্পায়ারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম । জয়পুর টিমের বোলার বল করার সাথে সাথেই আম্পায়ার ঘড়ির ওপর সূর্যের আলোর ছটা প্রতিফলন করে ব্যাটসম্যানের চোখে ফেলছেন । আর বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা তখন বারবিটন খেয়ে নেশাগ্রস্ত । নেশাগ্রস্ত চোখকে ফাঁকি দেওয়া আপনাদের পক্ষে কঠিন ব্যাপার ছিল না গণেশ বাবু ও তপেন বাবু । ”

          তাচ্ছিল্যের সুরে তপেন বাবু বলে উঠলেন … “ বলে যান , বলে যান ইন্দ্রজিৎ বাবু । আমরাও খুব এনজয় করছি গল্পটা । ”

          হঠাৎ সুমিত বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে গণেশ ঘোষ , তপেন গুহ , সৌরভ নাগকে কঠোরভাবে গালাগালি দিতে শুরু করল । ইন্দ্রদাই সুমিতদাকে সামলালো । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসার পর ইন্দ্রদা আবার কথা বলা শুরু করল …

          “ আমার প্রথম সন্দেহ তখন জাগে যখন আমি ম্যাচের লিস্টটা দেখি । লক্ষ্য করেছিলাম জয়পুর টিমের সঙ্গে প্রত্যেকটা ম্যাচ দিনের বেলায় হয়েছে কারন সূর্যকে তো কাজে লাগাতে হবে । সূর্যদেবই আপনাদের মত ভীরু কাপুরুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন কারন আকাশ মেঘলা থাকলে আম্পায়ারের হাতের ঘড়ি থেকে আলো প্রতিফলন করা সম্ভব হত না । ”

          সৌরভ নাগের মুখ নিচু । ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন … “আমার ভুল হয়ে গেছে । ফাইন্যাল কাপ জিতে হ্যাটট্রিক করার আশায় টাকা দিয়ে এনাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম । আমাকে ক্ষমা করে দিন । আমি কথা দিচ্ছি আবার নতুন করে টুরনামেণ্ট হবে । ”

          “ সে তো আপনাকে প্রেস কনফারেন্স করে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে । কিন্তু সৌরভ বাবু আপনাকে ক্ষমা করা গেলেও গনেশবাবু ও তপেনবাবুকে ক্ষমা করা যাবে না । কারন আইনের চোখে এনারা আরো অপরাধী । ”

          তপেন গুহ হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন … “ আপনি কি আমাদের পুলিশে দেবেন নাকি মশাই ? ”

          ইন্দ্রদার গলার স্বর আরো ধারালো হয়ে গেছে … “ দরকার হলে তাই করবো । ”

          গণেশ ঘোষ আবার হেসে উঠলেন … “ কেন , আমরা কি খুন করেছি , না চুরি করেছি যে আমাদের পুলিশে দেবেন ? ”

          কঠোর গলায় ইন্দ্রদার উত্তর এল … “ আপনারা খুনও করেননি , চুরিও করেননি , কিন্তু করেছেন চোরাই মালের ব্যবসা । ”

          “ আপনার কাছে কি প্রমান আছে তার ? ”

          “ শুধু আমার কাছেই নয় , পুলিশের কাছেও প্রমান আছে । আপনার গুদাম ঘরের মধ্যেই রয়েছে চোরাই মাল । খুব সম্ভবত সেগুলো কর্কের বলের মধ্যেই রয়েছে । ”

          দুজনেই এবার চমকে উঠলেন । অস্ফুটে কথা বেরোল গণেশ ঘোষের মুখ থেকে …

          “আপনি জানলেন কিভাবে ? ”

          “ দৃষ্টিশক্তি । দৃষ্টিশক্তি থাকলে সবকিছুই বোঝা সম্ভব । আমি যেদিন গুদামঘরটা দেখতে ঢুকি সেদিনই লক্ষ্য করি বস্তার বলগুলো , কয়েকটার গায়ে এইচ লেখা । তবে সব বলগুলোতে ছিল না । তখন অতটা মাথায় আসেনি । কিন্তু পরে যখন একটা পাগলাকে আপনাদের ক্লাবঘরে ঢুকতে দেখলাম … ”

তপেন গুহ চেঁচিয়ে উঠলেন … “ কি ! পাগলাটা আমাদের ক্লাবঘরে ঢুকেছিল ? ঐ ব্যাটা আপনাকে সব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে । আর একটা পাগলের কথা বিশ্বাস করে আপনি কিনা … ”

          ইন্দ্রদা কথাটা শেষ হতে না দিয়েই বলল … “ সাট আপ মিস্টার গুহ । যাই হোক যেটা বলছিলাম , পাগলটা ক্লাবঘরের ভেতরে একটা বলকে ছুরি দিয়ে কাটল । টর্চের আলোয় দেখলাম বল থেকে বেরিয়ে এল সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ । আমি নিশ্চিত হলাম ওটা হেরোইন ছাড়া কিছু হতে পারে না । ”

          এবার সুমিত বিশ্বাসের প্রশ্ন … “ কিন্তু পাগলটা ক্লাবঘরে কেন ঢুকতে গেল ? ”

          “ চোরাই মালের ব্যবসা সত্যিই আছে কিনা দেখবার জন্য । যে বলগুলোর গায়ে এইচ লেখা ছিল সেগুলোতেইকেবলমাত্র হেরোইন ভর্তি ছিল । হেরোইন ভর্তি বলগুলোকে আপনারা এইচ অক্ষর দিয়ে সনাক্ত করতেন , তাই নয় কি ? তা কোথায় কোথায় আপনাদের শাখা প্রশাখা গজিয়ে উঠেছে এবারঠাণ্ডা ঘরে গিয়েই জবাব দেবেন চলুন । ”

          ইন্দ্রদা বারবারই আড়চোখে দেবদারু গাছটার পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল । এবার বাঁ হাতটা তুলে ইশারা করে বলল … “ বিপ্লববাবু এবারে ভেতরে আসুন । হাতকড়া এনেছেন তো ? ”

          আমাদের সামনে এবার যে আসলো তার চেহারা দেখে তো আমার চোখ কপালে উঠে গেল । এ যে সেই পাগলটা , সম্পূর্ণ পুলিশ অফিসারের ড্রেসে ।

          ইন্দ্রদা বলল … “ পাগল নয় । ইনি দার্জিলিং পুলিশ স্টেশনের ওসি বিপ্লব সান্যাল । সত্যিই চোরাই মালের ব্যবসা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য এনাকে পাগলার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল । ”

          বিপ্লববাবু গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহর হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে বলল … “ বাঃ মানিকজোড়কে ভালই মানিয়েছে তো হাতে গয়না পড়ে ।কিন্তু ইন্দ্রজিৎ বাবু আপনি বুঝলেন কি করে আমি পুলিশের লোক ? আমি তো প্রথম দিন আপনার সাথে দেখা করে আমার পরিচয় আত্মগোপন করেছিলাম আপনাকে ভড়কে দেবার জন্যই । ”

          ইন্দ্রদা বলল … “ সেদিন আপনি ক্লাবঘরে যখন ছিলেন তখন আপনাকে একটা ছোট্ট ডায়রি ও পেন বের করতে দেখেছিলাম । তাতে লেখা ছিল দার্জিলিং পি এস । পি এস আসলে পুলিশ স্টেশন । এরপর আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি ? ”

          মানিকজোড়কে জিপে তুলে দিয়ে শিবতলা স্টেডিয়াম পেছনে ফেলে আমরা হোটেল মঞ্জুসার দিকে পা বাড়ালাম । কুয়াশার চাদরে ঢাকা দার্জিলিং শহর তখন অনেকটা স্নিগ্ধ ও সতেজ ।

( সমাপ্ত )

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল