রহস্যের নাম ক্রিকেট: দ্বিতীয় পর্ব

শান্তনু দাস
5 রেটিং
1881 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

“ নাম ধাম কিছু বলল না , তবে শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবার নিয়ে কিছু একটা বলছিল মনে হল । ”

“ ওসব বাদ দে , পাগল টাগল হবে হয়তো । আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি , তোরা রেডি হয়ে নে । আমাকে আবার টিম মিটিং এ বসতে হবে । ”

সকালে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল আমাদের । সুমিত বিশ্বাসের ফোনটা রাখার পর ইন্দ্রদা চট করে কোটটা পড়ে নিল । আমিও সোয়েটার মাফলারটা গলায় জড়িয়ে নিলাম । মুখ ধুয়ে ফ্রেস হতে প্রায় আটটা বাজতে দশ হয়ে গিয়েছিল । ব্রেকফাস্ট না করেই সোজা আমি আর ইন্দ্রদা একটা জাইলো গাড়িতে করে শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম । বাইরে কুয়াশার ঘনঘটা । তুমুল বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা লাগছিল । গাড়ির কাঁচের বাইরে তখন ধারাজলের আল্পনা আঁকা হচ্ছে । পাহাড়ের বৃষ্টির একটা আলাদা মোহময়ী রূপ আছে । সেই রূপসাগরে ডুব দিতে দিতে গাড়ি হালকা চালে এগোতে লাগলো ।

স্টেডিয়ামে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে আটটা । বৃষ্টি কমে গেলেও গাছের পাতা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে জলের ফোঁটা । দুপাশে সবুজ চা বাগান আর সবুজ পাহাড়ে ঘেরা শিবতলা স্টেডিয়াম । বৃষ্টিস্নাত হয়ে পাহাড়ি সবুজ যেন আরো সতেজ দেখাচ্ছে ।

দূর থেকে মনে হল একজন কেউ হন্তদন্ত হয়ে আসছে । ফিচেল গোছের লোকটা আমাদের কাছে এসে বলল … “ আপনারা সুমিত বিশ্বাসের বন্ধু ? ”

আমরা মাথা নাড়লাম । লোকটার কথায় বুঝতে পারলাম সুমিত বিশ্বাসই তাকে পাঠিয়েছে । যেহেতু সুমিতদা এখন খেলার প্রাকটিসে ব্যস্ত তাই লোকটা আমাদের স্টেডিয়ামের ভি আই পি সিটের কাছে নিয়ে এল ।

ইন্দ্রদা অনেকের সাথে পরিচয় করছিল , সেখানে ইন্দ্রদাকে চেনে এরকম দু তিনজন পরিচিত লোকও বেরিয়ে গেল । আমাদের নিয়ে ভি আই পি সিটে প্রায় পঞ্চাশ জনের মত লোক ছিল । বাকি স্টেডিয়াম ভর্তি । স্টেডিয়ামটা খুব বড় না হলেও মাঠটা বেশ বড় । দক্ষিন দিকটাতে রয়েছে স্কোরবোর্ড , প্রত্যেকটা ব্লকে রয়েছে তিন ফুট লম্বা করে আয়তকার সাউণ্ড বক্স যা থেকে কমেন্টটেটর এর ধারাভাষ্য ভেসে আসছিল । আর আমাদের পাশেই রয়েছে দুটো দলের ড্রেসিংরুম কাম ওয়েটিং রুম । ইতিমধ্যে ইন্দ্রদার সঙ্গে অনেকে দেখা করে গেছে । সুমিত বিশ্বাস যে এখানেও রহস্যভেদী ইন্দ্রদার বেশ গুণগান গেয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ।

প্রথমত ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিত বিশ্বাস । সে আজকে অবশ্য সম্পূর্ণ খেলোয়াড়ের ড্রেসে ছিল । দেখে মনে হল সেই ওপেনিং করবে ।

দ্বিতীয়ত সুমিত বিশ্বাসের বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন সৌরভ নাগ । ইন্দ্রদার সঙ্গে ওর বেশ ভাব আলাপ হল । আমি সৌরভ নাগের চেহারার মোটামুটি বর্ণনা দিচ্ছি । মোটাসোটা , কালো গায়ের রং , হাইট খুব বেশি নয় , আইডিয়াল স্পোর্টসম্যান টাইপ ফিগার নয় , মুখে গোঁফ দাড়ি পরিস্কার করে কামানো , আর সম্পূর্ণ খেলোয়াড়ের ড্রেসে । কথায় কথায় জানতে পারলাম সৌরভ নাগের দলটার নাম জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব এবং সুমিত বিশ্বাসের দলটার নাম বলাকা স্পোর্টিং ক্লাব ।

তৃতীয়ত শিবতলা স্টেডিয়ামের কনভেনার এবং ম্যাচের আম্পায়ার দুজন গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহ । দুজনেরই বয়স চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে , মাথায় সাদা টুপি , পুরো সাদা ড্রেস , বলিষ্ঠ চেহারা , চোখে রেব্যানের অ্যাভিয়েটার সানগ্লাস ও হাতে বড় বড় দুটো স্পেশাল হাতঘড়ি সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছিল । দুজনের মধ্যে একটাই তফাত । গণেশ ঘোষ কথা বলতে বলতে চোখ পিটপিট করেন আর তপেন গুহর কথা বলার সময় চোয়ালটা একটু বাঁদিকে বেঁকে যায় ।

যাই হোক বক্সে শুনতে পেলাম … “ এবার শুরু হচ্ছে বলাকা আর জয়পুরের সেমিফাইন্যাল সংঘর্ষ । ”

ঘড়িটা একবার দেখে নিলাম বাজছে নটা । পাশের এক ভদ্রলোকের কাছে জানতে পারলাম জয়পুর ক্লাব টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের দল আর দুজন আম্পায়ার মাঠে নামল । ইন্দ্রদার বন্ধুর দলের প্লেয়ারগুলো আমাদের থেকে দশ হাত দূরে বসে আছে । ওরা কফি খাচ্ছিল । সকালে ব্রেকফাস্ট করিনি বলে বেশ খিদেই পাচ্ছিল । ইতিমধ্যে আমাদের টিফিন আর কফি ভি আই পি সিটে চলে এল । পাশের এক মোটাসোটা ভদ্রলোক অতিরিক্ত এক্সাইটমেণ্টে হাততালি দিতে লাফিয়ে উঠেছিল বলে ইন্দ্রদার কাপ থেকে কিছুটা কফি ভদ্রলোকের ডেনিম জিন্সে পড়ে গেল । ইন্দ্রদা অবশ্য দোষটা নিজের কাঁধে নিয়েই পকেট থেকে রুমাল বের করে ভদ্রলোকের প্যান্টের কফিটা মুছে দিয়েছিল ।

ওপেনিং করতে নামল সুমিত বিশ্বাস ও আর একজন । খেলা শুরু হল , টোয়েণ্টি টোয়েণ্টি ম্যাচ । টিফিন আর কড়া ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে ইন্দ্রদার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম । মুখ দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না , তবে বেশ গম্ভীর । প্রথম ওভারেই ফিল্ডারদের মধ্যে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম । বলাকা ক্লাবের ওপেনার , ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিত বিশ্বাস বোল্ড আউট । ইন্দ্রদা বেশ গম্ভীর , ও এখন মাঠের দিকে লক্ষ্য করছে না । মাঠের উত্তর দিকে যেখানে স্টেডিয়ামটা শেষ হয়েছে সেখানে তাকিয়ে রয়েছে একদৃষ্টে । পাশের এক ভদ্রলোক দূরবীন নিয়ে খেলা দেখছিল । ইন্দ্রদা “ প্লিজ ” বলে দূরবীনটা একবার চেয়ে নিল । কি এত মন দিয়ে দেখছে তা ইন্দ্রদাই জানে । কিছুক্ষন পর স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি , দশ ওভারে পঁচিশ রান , পাঁচ উইকেট । ইন্দ্রদা ভদ্রলোককে দূরবীনটা ফেরত দিল । আমি তখনই কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না ।

সুমিত বিশ্বাস ইন্দ্রদার পাশে এসে একটা খালি সিটে বসল … “ আজকে আমাদের হার অবধারিত । ”

ইন্দ্রদা বলল … “ ক্যাপ্টেনের মুখে এসব কথা ? ”

“ তুইও আমার জায়গায় থাকলে একই কথা বলতিস । ”

“ মানে ? আমি তো তোকে বেশ পজিটিভ মাইন্ডেড বলেই জানতাম । এখনো খেলার অনেক কিছু বাকি আছে । ”

“ হয় আমাদের ফিটনেসের ঘাটতি আছে , তা না হলে অন্য কিছু … ”

“ কি বলতে চাইছিস বলতো ? ”

“ এখানে নয় , পরে বলবো । ”

“ তাই বলিস । তবে আজ আর ভাল লাগছে না রে সুমিত । বড্ড অলস লাগছে , কাল ফাইন্যালে আসবো । ”

স্কোর বোর্ডে যাবার সময় চোখ পড়ল । বলাকা ক্লাবের অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে , কুড়ি ওভারে সাতচল্লিশ রান , আট উইকেট । এতটা একপেশে ম্যাচ হবে আশা করিনি । এক এক করে বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের সাপোর্টাররা সব স্টেডিয়াম ছাড়ছে । আমরাও চলে এলাম হোটেল মঞ্জুসায় ।

একটানা চুপচাপ বসে থাকলে নাকি ঘুম পায় শুনেছি । অনেকক্ষণ স্টেডিয়ামে বসেছিলাম তাই টায়ার্ড লাগছিল । খাবার রেডি ছিল । লাঞ্চের জন্য হোটেলে ইন্দ্রদা আগেই ফোন করে দিয়েছিল । স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর ইন্দ্রদা শুয়ে পড়লাম । টায়ার্ডনেসে চোখ বুজে যাবার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম ইন্দ্রদা কিছু বলছে …

“ পাগলটার সঙ্গে দেখা হওয়াটা কি নিতান্তই কাকতালীয় বলে মনে হয় তোর সৌম্য ? শিবতলা স্টেডিয়ামের সঙ্গে চোরাকারবারের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ? ”

“ আমার মনে হয় ইন্দ্র , এই খেলার সঙ্গে কিছু গভীর রহস্যের সম্পর্ক আছে ? ”

“ হেরে গেছিস বলে এখন যা তা বকছিস , তাই তো সুমিত ? ”

“ না না , তার জন্য নয় । আমি তোকে কিছু বলতে চাই ইন্দ্র । ”

“ আচ্ছা আগে ঘরে এসে বোস তো ? ”

এক্কেবারে পাক্কা চারটে পর্যন্ত ঘুমোনোর পর আমরা বিকেলে মার্কেটে যাবো বলে বেরোচ্ছিলাম , ঠিক তখনই কলিংবেল বাজলো । ইন্দ্রদা অবশ্য আমার একটু আগে ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে কি একটা কাজ সেরে এসেছে বলল । দেখলাম সুমিত বিশ্বাস এসেছে , ভ্রু যুগলের নিচে একজোড়া গম্ভীর অনুসন্ধানী চোখ । সুমিত বিশ্বাস ব্যালকনির সোফায় উপবেশন করে আবারবলাশুরুকরল …

“ বুঝলি ইন্দ্র , গত দুবছর ধরে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব ফাইন্যাল কাপজিতছে। আর তুই দেখে নিস ইন্দ্র , এবছরেও ওরা জিতবে । তাই বলে প্রত্যেকটা ম্যাচে ওরা ভাল ভাল টিমকে গোহারানে হারিয়ে দেবে , এটা মেনে নেওয়া যায় না । আমার মনে হয় এর পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে । ”

“ বেটিং ? ” … ইন্দ্রদা বলল ।

“ না , না । ওসব কিছু না । আমাদের টিম কখনও এরকম করতে পারে না । মনে হয় অন্য কিছু । তুই একবার নিজে মাঠে যাবি … মানে শিবতলা স্টেডিয়াম ? ”

“ কখন ? ”

“ এখনই চল না , সন্ধ্যের আগে ফিরে আসবো । ”

“ কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি করবোটা কি ? ”

“ ওরা যদি মাঠে গিয়ে কিছু কারসাজি করে রেখে দেয় , তাহলে তোর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না নিশ্চয় । ”

“ কিসব আবোল তাবোল বকছিস , সুমিত ? আর ইউ ম্যাড ? ওদের ক্ষমতা আছে তাই জিতছে । ”

“ না না , এ হতে পারে না ইন্দ্র । পরপর তিনবছর জিতে কাপ নেবার মত দল জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব নয় । ”

কিছুটা জোরপূর্বক আমাকে ও ইন্দ্রদাকে সুমিত বিশ্বাসের সঙ্গে যেতে হল । আমরা তিন মূর্তি যখন শিবতলা স্টেডিয়ামের মাঠে পৌঁছলাম তখন আকাশে আধো আধো আলো ছিল । তর্জনী ও মধ্যমার ফাঁকে কিং সাইজ গোল্ড ফ্লেকটা চেপে ধরে ইন্দ্রদা পিচটা নিখুঁত ভাবে কি লক্ষ্য করছিল তা ও নিজেই জানে । তারপর সুমিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল …

“ আচ্ছা সুমিত , মাঠে নামবার পর থেকে কাউকে তোর সন্দেহজনক বলে মনে হয় না ? যদিও ক্যাপ্টেনসি করতে করতে এ বিষয়টা মাথায় আসার কথা নয় , তবুও জিজ্ঞেস করছি , এনি অকওয়ার্ড সিচুএসন ডু ইউ ফেস ? ”

“ সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না । ”

“ মে বি এনি আনইম্পরট্যান্ট থিংগ । ”

“ যদিও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় তবুও বলছি , প্রথম ম্যাচ যখন খেললাম , তখন আমি জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ম্যাচের দুজন আম্পায়ারের কিছু কথাবার্তা চলছিল সেটা লক্ষ্য করি । সেটা যে শুধুমাত্র মৌখিক ছিল তা নয় , আই কন্টাক্ট চলছিল তাদের মধ্যে প্রায়ই । ”

“ আর অন্য কিছু ? ”

“ নো … নাথিং ইন্দ্র । ”

“ সুমিত , এটা কোনো সন্দেহজনক ব্যাপার বলে তো মনে হচ্ছে না আমার । প্রত্যেক মাচেই কি এই দুজন আম্পায়ারই খেলা পরিচালনা করেন ? ”

“ হ্যাঁ । তবে এনারা খুব অভিজ্ঞ । প্রথম প্রথম সন্দেহ হত ঠিকই , কিন্তু পরে বুঝলাম এনারা তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেন নি । ”

“ তোদের ডে নাইট ম্যাচ হয় ? ”

“ হ্যাঁ ফ্লাড লাইটেও ম্যাচ হয় , তবে কম । ”

“ জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব এই সেশনে কটা ম্যাচ হেরেছে ? ”

“ নট এ সিঙ্গেল ওয়ান , ইন্দ্র । ”

“ ইন্টারেস্টিং । ”

“ দ্যাখ ইন্দ্র , আমি একটা দলের ক্যাপ্টেন । এটুকু বোঝার নিশ্চয় ক্ষমতা আছে যে , কোন দলের উইনিং পাওয়ার কিরকম । কিছু তো একটা গড়বড় হচ্ছেই । ”

( ক্রমশ:)

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল