আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখভার । আসলে বৃষ্টিটা কাল থেকেই শুরু হয়েছে। শহরে নাকি একটা ঝড় আসতে চলেছে.. সবাই দুদিন ধরে শুধু সেটা নিয়েই আলোচনা করছে। রান্নার গীতামাসি থেকে শুরু করে ঋষিদের স্কুলের দারোয়ানকাকু … সকলেই কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব নিয়ে রয়েছে। কালরাতে অফিস থেকে ফেরার পর বাবাকেও দেখলো টিভিতে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝড়টার ব্যাপারেই নিউজ শুনে গেলো। এমনকি রাতে ডিনার টেবিলে মাকে বলতেও শুনলো “ প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগবে লিস্ট করে রেখো, নিয়ে আসবো.. কখন কি হয়, বলা যায় না ..।” ঝড় তো এর আগেও কত হয়েছে, তবুও এটা নিয়েই সবার এত চিন্তা .. ঋষি কেমন যেন চুপসে গেল।
আসলে ওর রোদ ভালোলাগে। ঝকঝকে সকালের একটা ঝলমলে দিন । ঋষিদের আবাসনটা বিশাল.. তারই সাততলা একটা বিল্ডিং এর চারতলায় সুজয়নীল আর মালিনী রায়ের সাজানো গোছানো ফ্লাট। ঋষি মানে আকাশনীল ওদের একমাত্র সন্তান। ছোট থেকেই শান্ত ধীর স্বভাবের ঋষি ওর বয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে একটু আলাদা। পড়াশুনা আর বাকি সব এক্টিভিটির বাইরে রং তুলি আর স্কেচবুকএর মায়াজগতটাই ওর নিজের দুনিয়া। ছুটির দিন হলেই বসে পরে আঁকার খাতা নিয়ে। রং দিয়ে ভরিয়ে তোলে একের পর এক পাহাড়, নদী, সবুজ উপত্যকা। তবে সব কিছুতেই সূয্যিমামা মাস্ট । সকালের মিঠে রোদ্দুর যখন ব্যালকনির ফাঁক গলে ওর ঘরে এসে ঢোকে, সেই সময়টা থাকে ওর সবচেয়ে প্রিয় সময়। সকালটুকু তাই ও একদমই মিস করতে চায়না। সেই যেবার ওরা আসানসোলে পিসিদিদার বাড়িতে দুরাত কাটিয়ে কলকাতায় ফিরছিল, ঋষি তখন অনেকটাই ছোট .. তবুও মনে আছে ওর, সেদিন ভীষণ ঝড় উঠেছিল .. আর তারসাথে তুমুল বৃষ্টি। ঝড়ের এলোপাথাড়ি হওয়া আর বৃষ্টির চোটে কলকাতা আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল.। সারারাত ওদের স্টেশনে কাটাতে হয়েছিল। সকাল হতে যখন বাড়ি পৌছালো, ঋষির তখন ধুমজ্বর । সেই জ্বর কমতে সময় নিয়েছিল প্রায় দু তিন সপ্তাহ। আজও ঘুমের ঘোরে মাকে জড়িয়ে ধরে ও… ।
স্কুলের জিওগ্রাফি ক্লাসে আজ সোমা মিস বোর্ডে এঁকে ওদের বুঝিয়ে দিয়েছে ঝড় তৈরি হয় কিভাবে । কিভাবে শক্তি পায় .. ঘন্টায় কত কিমি বেগে আসলে কত ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ক্লাসে প্রজেক্টর লাগিয়ে নানারকমের টর্নেডো, সাইক্লোন এর ছবি, ভিডিও এসবও দেখিয়েছেন । ক্লাসের শেষেও আজ সারাদিন চললো এই নিয়ে। আর ভালো লাগছে না ঋষির এসব । টিফিনের পর বাকি ক্লাসগুলো আর হলো না। হেডস্যার বাইরের অবস্থা দেখে ছুটি দিয়ে দিলেন। ঋষিদের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে স্কুলের সামনেই থাকে, তাই আচমকা ছুটিতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ওর কোনো অসুবিধাও হলোনা। বাড়ি আসার সময় ও দেখলো, গতরাতের বৃষ্টির তোড়ে রাস্তার অনেক জায়গাতেই জল জমে গেছে এরমধ্যেই। দমকা হওয়ায় বেশ কয়েকটা হোর্ডিং ব্যানারও রাস্তার ওপর ছিঁড়ে নেমে এসেছে। কয়েকটা বড়ো গাছও একদিকে কাত হয়ে পড়েছে দেখলো । আকাশের রংটাও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কেমন বিচ্ছিরি হয়ে আসছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আবাসনের বিশাল গেটটার মধ্যে দিয়ে ওর গাড়িটা ঢোকার সময়েই আচমকা ঋষি দেখলো ওকে ।
গেটের ঠিক মুখেই উস্কোখুস্কো চেহারার , নোংরা ছেঁড়া জামা আর ততোধিক ময়লা লুঙ্গি মতো কিছু একটা পরে এক বুড়ো জড়োসড়ো হয়ে বসে। মাঝেমাঝে ভয়ার্তমুখে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর মাথাটা অল্প অল্প নাড়ছে। ভালোকরে দেখার আগেই হুশ করে গাড়িটা ঢুকে গিয়ে দাঁড়ায় ওদের গ্যারেজের সামনে।
আজ বাড়িতে সবাই খুব ব্যস্ত। বাবাও অফিস থেকে চলে এসেছে তাড়াতাড়ি। কালও অফিসে যাবে না , ঋষিদের স্কুলেও ছুটি দিয়ে দিয়েছে। বেশ একটা ছুটি ছুটি আমেজ। মাকে বলতে শুনলো, কাল বেশ জমিয়ে রান্নাবান্না হবে। একটা ছুটির দিন এক্সট্রা পাওয়া গেছে, তাই । গীতামাসিও আজ ওদের গেস্টরুমেই থেকে যাবে, এই বাজে ওয়েদারে আজ আর ফিরবেনা। ঋষি স্কুলের ড্রেস ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। বারান্দার গ্রিল জড়িয়ে বেড়ে ওঠা বোগেনভেলিয়ার ডালগুলো ভীষণভাবে দুলছে। ঋষি আনমনে কিছু একটা ভাবছিল, হঠাৎ গাছের ডাল,পাতা, ফুল পেরিয়ে মেইনগেট এর দিকে ওর নজর আটকে গেল। “ আরে সেই বুড়ো না .. ফেরার পথে যাকে দেখেছিল! ও এখনো এখানে কি করছে ..”
একবার যেন মনে হলো, আবাসনের ভিতরে আসতে চাইছিল, কিন্তু গেটের দারোয়ান এর ধমক খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো। আবার ঢোকার চেষ্টা করলো.. আবারও পিছু হটতে হলো…। হঠাৎ চড়চড় শব্দে বাজ পড়লো কাছে কোথাও। ঋষি ভীষণ ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। তুমুল বৃষ্টিটা শুরু হয় গেল আর সাথে এলোপাথাড়ি হওয়া.. মা কিচেন থেকে মুখ বার করে ডাকলো.. “ ভিতরে এসো বাবান, ঝড় উঠে গেছে ।” ব্যালকনি থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ানোর মুহূর্তে ঋষি দেখতে পেলো গেটের বাইরে বুড়োমানুষটা অসহায়ের মতো এদিক ওদিক করছে.. দারওয়ানকাকু ওর ঘরে ঢুকে গেছে হয়তো ।
আবারও একটা জোরে বাজ পড়লো। চারিদিক কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন … মনে হলো আকাশটা বুঝি এক্ষুনি হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ে এসে পড়বে। ও একছুটে ড্রইংরুমে এসে দাঁড়ালো । মালিনীও ততক্ষণে রান্নাঘর এর কাজ মিটিয়ে সোফায় এসে বসেছে। ঋষি দেখলো, বাবা আর মা কালকেও এই দুর্যোগ না কমলে কিভাবে কি করা যায়, সেই আলোচনায় ব্যস্ত। ও সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে বললো.. “ ওকে আমাদের এখানে নিয়ে আনা যায় না?” নবছরের ছেলের মুখে মাথামুণ্ডুহীন এই প্রশ্ন শুনে মালিনী অবাক হলো.. “ কাকে আনা যায় না বাবান?… কার কথা বলছিস রে?” ঋষি তবুও বাবার দিকে স্থির তাকিয়ে আবার বললো, “ ওকে প্লিজ নিয়ে এসো এখানে, আমার ভীষণ ভয় করছে ।” সুজয়নীল ধীরে ধীরে ছেলেকে কোলে টেনে নিয়ে বললো “ বেশতো , নিয়ে আসাই যায়, কিন্তু ওর ময়লা জামাকাপড়, ধুলোলাগা গা দেখে তোমার অসুবিধা হবে নাতো?” তীব্রভাবে মাথা নাড়লো ঋষি “ না না .. একটুও হবে না.. তুমি নিয়ে এসো দাদুটাকে প্লিজ।” মালিনীর হতবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে সুজয় একটু হাসলো ..। আসলে, অফিস থেকে ফেরার পথে ও নিজেও ওই আধময়লা বুড়ো মানুষটাকে দেখতে পেয়েছিল। মফস্বলে বড়ো হওয়া যে সুজয়নীল সকলের আপদে বিপদে পাশে দাঁড়াতো, আজ ভিতর থেকে সেই আটপৌরে ছেলেটা একবার হলেও বলে উঠেছিল.. “ একে যদি আজরাতটুকুর জন্য আশ্রয় দেওয়া যেত কোনোভাবে ..” কিন্তু ভীষণ শৌখিন আর আপাদমস্তক স্বাচ্ছন্দ্যে মোড়া লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত মালিনী বা ঋষি যদি নাক কুঁচকে ওঠে, তাই চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল । এখন সন্তানের মুখ থেকে নিজের মনের কথা শুনে ও আর দেরি করলো না । সোজা নিচে নেমে দারোয়ানের ঘরে গিয়ে বললো..
“ বিনয়, মেইনগেটের লকটা খুলে দাও.. জরুরি দরকার।”
আজ দুদিন হলো ঝড় থেমে গেছে। আকাশটাও ঝলমল করছে .. ঠিক ঋষির মনের মতো। কিন্তু ওর মনটা কেমন যেন একটু ভারী হয়ে আছে। ঝড়দাদু আজ চলে যাবে.. ঋষি ওর নাম রেখেছে ঝড়দাদু। বাবা অফিসে যাওয়ার পথে ঝড়দাদুকে স্টেশন এর বস্তিটায় ছেড়ে দিয়ে আসবে। এই দুদিন বাবা , ও আর ঝড়দাদু মিলে একটা দল হয়ে গিয়েছিল.. মা যদিও মুখ ব্যাজার করেই ছিল .. তবে তাতে ওদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি । এই দুদিন কত্ত গল্প করেছে ওরা তিনজন … এমনকি বাবাও অফিসে থেকে ফিরে বসে পড়তো ওদের সাথে। লুডো খেলা থেকে শুরু করে তাসের ম্যাজিক , সবেতেই দারুন মজা করেছে। অনেক গল্প করেছে ও দাদুর সাথে .. কোথায় থাকে, কি করে .. বুড়োর একটা নেড়ি ছাড়া নিজের বলতে কেউ নেই। রাত হলে দাদুটা চোখে দেখতে পায় না..। একবার তো একটা লরির সামনে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল কোনোরকমে। এইরকম নানান গল্প, খেলা আর মজাতে কেটে গিয়েছিল দুটো দিন। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ সুজয়নীল ওনাকে নিয়ে গন্তব্যে রওনা হয়ে গেল। ঋষি ব্যালকনি থেকে দেখলো ওদের চলে যাওয়াটা.. । তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে আঁকার খাতা আর রংতুলি নিয়ে বসলো আজ প্রায় তিনদিন পর। আজ সে বৃষ্টির ছবি আঁকবে, ঝড়ের ছবি.. । রোদ্দুর ঝলমলে দিনগুলোর পাশাপাশি বৃষ্টিভেজা একটা দিনও যে কখনো কখনো দরকার হয়, ঋষি বুঝলো।
সব ভয়ের শেষেই কোথাও না কোথাও ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। ঋষি আজ সেটাকেই যেন জয় করলো।
সুদেষ্ণা চক্রবর্তী