এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে—
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।
এই মিলনের সত্য সমস্ত মানুষের চরম সত্য, এই সত্যকে আমাদের ইতিহাসের অংশ করতে হবে। এই কবিতায় ভারত বোধের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি, তা গভীর, ব্যাপক এবং বিশ্বমৈত্রীর আরেক উদাহরণ। ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের সঙ্গীতে এতটা ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য আছে বলে মনে না হলেও এই স্বদেশ পর্যায়েরই সঙ্গীত ভারততীর্থ।
রবীন্দ্রনাথ যেমন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ছিলেন তেমনই অপরদিকে ছিলেন জাতীয়তাবাদের সমর্থক। সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারত ও ইংরেজ শাসনকেও সমন্বয়ের দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছিলেন, উন্নত ও আধুনিক ভারতবর্ষ পুনর্নির্মাণে ইংরেজ ভূমিকা নেবে-তিনি দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাসই লালন করেছিলেন।তাঁর লেখা একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশিত হয়েছে।তাঁর ‘পূর্ব-পশ্চিম'(১৯০৮) প্রবন্ধটিতে তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে প্রত্যাশী। কিন্তু এখানে পশ্চিম বলতে মূলত ইংরেজ এর কথা বোঝানো হয়েছে।তাই তিনি বলেছেন,ইংরেজ এর সঙ্গে আমাদের মিলন সার্থক করিতে হইবে। তবে কোথাও তিনি সতর্ক ছিলেন যে,উপনিবেশবাদী শোষক কখনও উপনিবেশ কে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না যে কারণে শোষক, অত্যাচারী, নিষ্ঠুর,হিংস্র শাসক ইংরেজ মূর্তিকে লক্ষ করে তিনি ‘ছোট ইংরেজ বড়ো ইংরেজ’ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত শাসিত হয় যে ইংরেজ দ্বারা,যারা অন্যায়-অত্যাচার এর মাধ্যমে ভারতে শাসন করেছে,তাদেরকে ছোট ইংরেজ বলে উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথ। এদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য রেখেছেন,একের পর এক নিবন্ধে।অপরদিকে বিলেতে অবস্থানরত বড় ইংরেজদের ভারত বিষয়ক হিতব্রতা রূপ তাঁর চোখে বড় হয়ে ওঠে।এখানে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা মূলত সমাজভাবনার রূপ নিয়ে প্রতিফলিত হয়।তাঁর ভাষায় ‘মধ্যযুগে পড়ে থাকা’ গ্রামের সর্বতোমুখী উন্নয়ন ও পল্লি পুনর্গঠন প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
কিন্তু তার ‘স্বদেশী সমাজ’ ভাবনায় স্ফুলিঙ্গ পাত ঘটে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের দুর্বুদ্ধিজাত বঙ্গভঙ্গের কারণে।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে রাখিকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন তিনি।এই বছরের ২০ জুলাই ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করে। বলা হয়, এই আইন কার্যকরী হবে ১৯০৫ এর ১৬ই অক্টোবর,বাংলায় ৩০ আশ্বিন।সেই সময় ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় মানুষ সামিল হয়।ঠিক করা হয় এই দিনটিকে পালন করা হবে মিলন দিবস হিসেবে।ওইদিন বাংলার সমস্ত মানুষ পরস্পরের হাতে বেঁধে দেবে হলুদ সুতো,এই রাখির মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানবিকতা,সম্প্রীতি ও একতা।বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌভাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এই রাখিবন্ধন উৎসব নিয়ে গান লিখেছিলেন,’বাংলার মাটি,বাংলার জল,বাংলায় বায়ু,বাংলার ফল/ পুন্য হউক,পুন্য হউক,হে ভগবান।’ এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বৃহৎ বঙ্গের অধিবাসী বাঙ্গালী হিন্দু মুসলিমের চেতনায় জগতে আলোড়ন সৃষ্টির জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য দেশাত্মবোধক সংগীত রচনা করেন।এরপর সরকার বিরোধী তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথ এর বক্তৃতা ও ভাষণ চলতে থাকে এক নাগারে অন্তত দুমাস।যার মূল বক্তব্য ছিল জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন ও আন্দোলনে হিন্দু মুসলিমের ঐক্য প্রচেষ্টা।এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য রেখেছেন,’ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে।রবীন্দ্রনাথ এর ‘বড় ইংরেজ ছোট ইংরেজ’ ধারণা সত্ত্বেও স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে শব্দধ্বনির দামামা বাজাতে কার্পণ্য করেননি তিনি।বিপ্লবপন্থী কবি নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকার জন্য ‘আর্শীবাণী’ (১৯২২) কবিতা পাঠাতে দ্বিধা করেননি।রবীন্দ্রনাথ যদিও জানতেন এ পত্রিকা বিপ্লব পন্থার মুখপত্র।স্বদেশীকতায় সচেতন করে তোলার পক্ষে উপযুক্ত ছত্র দুটো হলো- “জাগিয়ে দেরে চমক মেরও,আছে যারা অদ্ধচেতন।” অর্ধচেতনদের সচেতন করে তোলার আহ্বান জানিয়ে লেখা কবিতার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেন নজরুল,ফলে শাসক বিরোধী কবিতার জন্য জেলে যেতে হয় নজরুলকে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ নজরুল কে উদ্দেশ্য করেই লেখেন বসন্ত নাটকটি।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। 1919 সালে 13 ই এপ্রিল তারিখে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক বিগ্রেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। গনহত্যার সময় ঠাকুর ছিলেন ‘স্যার’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( 1915 সালে নাইটহুড কে ভূষিত হয়েছিল) এবং ছয় বছর ধরে তিনি নোবেলবিজয়ী ছিলেন। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ সম্পর্কে সংবাদ পেয়ে তিনি কলকাতায় একটি বিক্ষোভের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন এবং শেষ পর্যন্ত 30 শে মে, 1919 এর ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড কে প্রত্যাখ্যানের চিঠি দিয়ে নাইটহুড কে বিক্ষোভের নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য’ ও গান ‘একলা চলো রে’ রাজনৈতিক রচনা হিসেবে জনমানসের জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘একলা চলো রে’ গানটি গান্ধীজীর বিশেষ প্রিয় ছিল। এরপরও গান্ধীজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। অস্পৃশ্য দের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কে কেন্দ্র করে গান্ধিজী ও আম্বেদকর এর মধ্যে যে বিরোধের সূত্রপাত হয় তার সমাধানেও রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধিজীও তার আমরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেন।
1937 সালে ‘প্রচলিত দন্ডবিধি’ তে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসকের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেন- “দন্ড প্রয়োগের অধিকৃত রূপকে আমি বর্বরতা বলি” শাসকশ্রেণীকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে বলেন যে, এ হিংস্রতার অবসান না ঘটলে তিনি ‘নিজে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবেন।’ স্বভাবতই এ রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব দানবের সাথে সংগ্রামের ডাক দেওয়া ‘দামামা ওই বাজে/ দিনবদলের পালা এলো গোড়া যুগের মাঝে।’ সর্বোপরি বলা যায়, স্বদেশ পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাবনা ও কর্মতৎপরতা প্রতিবাদী, সে পথ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আবেদন-নিবেদনের নয়,আপসবাদিতার নয়, সে-পথ আন্দোলনের প্রতিবাদের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের এতোগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের আন্তর্জাতিকতাবাদ সফল হয়নি । সফল হয়নি মানবতার মুক্তির স্বপ্ন। মৃত্যুর পূর্ব – মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে মানবাত্মার বিজয়গাথার স্বপ্ন দেখেছিলেন , তার আজকের সময়ে আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতার বাড়বৃদ্ধিতে। তাই নাহ্ কি?এই স্বাধীনতার কথাই কি বলেছিলেন রবি ঠাকুর? নাকি এটা স্বাধীনতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতা র বীজ বপন করে চলেছি আমরা?
==========
©️শঙ্খচিল
অসাধারণ লাগল 🧡🤍💚
অসাধারণ
লেখাটা আমায় খুব সমৃদ্ধ করলো।