ফাঁসির মঞ্চে যিনি গেয়েছিলেন জীবনের জয়গান

শিবব্রত গুহ
5 রেটিং
994 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

” ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ওযে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজান এমন ধারা,
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ, এমন কালো মেঘে,ও তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির
ডাকে জেগে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”

– এই বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গানের কথা আপনাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে?
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই গানটি লিখেছিলেন।
এই গানটি শুনলে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যায়।
অসাধারণ এর সুর, এর কথা। দ্বিজেন্দ্রলাল
রায় খুবই দরদ দিয়ে এই গানটি রচনা করেছিলেন। এই গানটি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।

ভারতবর্ষ আমাদের মাতৃভূমি, এই মাতৃভূমিকে
ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে
আবদ্ধ করে রেখেছিল। ব্রিটিশদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল ভারতবাসী। তাঁরা চেয়েছিল তাঁদের ভারতমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে চিরকালের মতো মুক্ত করতে।
এই অগ্নিযুগে অনেক মহান বিপ্লবীর জন্ম হয়েছিল
আমাদের দেশ ভারতবর্ষে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম
ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু।

তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর,
পশ্চিম মেদিনীপুরে। তাঁর বাবার নাম ছিল ত্রৈলোক্যনাথ বসু। তিনি ছিলেন নাড়াজোলের
তহসিলদার। তাঁর মায়ের নাম ছিল লক্ষ্মীপ্রিয় দেবী। তিনি ছিলেন তাঁর বাবা – মায়ের চতুর্থ সন্তান।

ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, তখন তিনি তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। তার এক বছর পরে,
তাঁর বাবাও পরলোক গমন করেন। তখন তাঁর বড়দিদি অপরূপা তাঁকে, দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায়, তাঁকে, তমলুকের হ্যামিল্টন হাইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।

১৯০২ ও ১৯০৩ সালে,বিখ্যাত বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ
ও ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুরে গিয়েছিলেন।
তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জনসমক্ষে বক্তব্য
ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরেছিলেন ও বিপ্লবী
দলগুলির সাথে গোপনে অধিবেশন করেছিলেন।
তখন কিশোর ছাত্র ক্ষুদিরাম এই সব বিপ্লবী
আলোচনায় সক্রিয়ভাবে করেছিলেন অংশগ্রহণ।

স্পষ্টভাবে তিনি যোগদান করেন অনুশীলন সমিতিতে। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে,
অনুশীলন সমিতির একজন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে উঠেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে, তিনি থানার কাছে
বোমা মজুত করতে থাকেন ও সরকারী আধিকারিকদের আক্রমণ করবেন বলে
মনস্থির করেছিলেন।

১৯০৪ সালে, ক্ষুদিরাম তাঁর দিদি অপরূপার স্বামী
অমৃতলাল রায়ের সাথে তমলুক শহর থেকে মেদিনীপুর শহরে চলে আসেন। তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন।
কোলকাতার চেতলার বাসিন্দা কবি অনিল দাস বলেন, ” ক্ষুদিরাম বোস একজন মহান বিপ্লবী
ছিলেন। দেশ ও দেশবাসীর প্রতি তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়। তিনি দেশকে স্বাধীন করার জন্য যে কষ্ট সহ্য করেছিলেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। “

মেদিনীপুরে, হয়েছিল তাঁর বিপ্লবী জীবনের অভিষেক। তিনি বিপ্লবীদের এক নতুন দলে
যোগ দেন। ১৯০৭ সালে,বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, তাঁর সহযোগী হেমচন্দ্র কানুনগোকে,
ফ্রান্সের প্যারিসে নির্বাসনে থাকা একজনের কাছে, বোমা তৈরির কায়দা শেখার জন্য পাঠান।
বাংলায় ফেরার পরে, হেমচন্দ্র ও বারীন্দ্র কুমার,
ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা
করেছিলেন।

ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য, বিহারের মুজাফফরপুরে এসেছিলেন নতুন নাম নিয়ে।
নাম দুটি ছিল হরেণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র রায়।
তাঁরা কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত
এক দাতব্য সরাইখানায় থাকতে শুরু করেন।
তাঁদের অজ্ঞাতবাসের দিনগুলিতে, এই দুইজন
বিপ্লবী, তাঁদের লক্ষ্য পূরণের জন্য শরীর ও
মনকে প্রস্তুত করতে থাকেন।

১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল,
তাঁদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য, জায়গামতো উপস্থিত হয়েছিলেন।
তাঁরা দুইজনে, স্কুল ছাত্রের ভান করে, মুজাফফরপুর পার্কে, সমীক্ষা করেছিলেন, যে, এটা ব্রিটিশ ক্লাবের উল্টো দিকে, যেখানে কিংসফোর্ড ঘনঘন আসেন, একজন কনস্টেবল তাঁদের কিন্তু দেখে ফেলেছিল।

প্রিঙ্গল কেনেডি নামে, একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারের মেয়ে, স্ত্রীর সাথে কিংসফোর্ড
ও তার স্ত্রী ব্রিজ খেলছিলেন। তারা রাত ৮.৩০
নাগাদ, বাড়ি ফিরবেন বলে মনস্থ করেছিলেন।
কিংসফোর্ড ও তার স্ত্রী একটা গাড়িতে ছিলেন,
যেটা ছিল কেনেডি ও তার পরিবারের গাড়ির মতো দেখতে।

কেনেডি মহিলারা, কিংসফোর্ডের বাড়ির চত্বর থেকেই যাচ্ছিলেন। যখন তাদের গাড়ি, ওই চত্বরের পূর্ব ফটকে পৌঁছায়, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি, গাড়িটার দিকে, দৌড়ে যান ও গাড়িতে
বোমাগুলো ছুড়ে দেন। তখন একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল। গাড়িটা সাথে সাথে কিংসফোর্ডের বাড়িতে আনা হয়েছিল।
বিস্ফোরণে, গাড়িটা যায় ভেঙে। কেনেডি মহিলারা খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। মিস কেনেডি
এক ঘন্টার মধ্যে মারা যান। মিসেস কেনেডি
প্রয়াত হয়েছিলেন গুরুতর আঘাত লেগে ২রা মে।

ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল, নিজেদেরকে রাস্তায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। মধ্যরাতের মধ্যে, সারা
মুজাফফরপুর শহর এই ঘটনার কথা জেনে গিয়েছিল।খুব সকাল থেকেই, সব রেলস্টেশনে
সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।

পুলিশেরা খুবই সতর্কভাবে, প্রত্যেক যাত্রীর দিকে রাখছিল নজর। সকাল অবধি ক্ষুদিরাম ২৫ মাইল
পায়ে হেঁটে, ওয়াইনি নামে, এক স্টেশনে পৌঁছান।
তিনি যখন একটা চায়ের দোকানে, এক গ্লাস জল
চেয়েছিলেন, তখন তিনি ফিতে সিং ও শিউ প্রসাদ সিং, নামে দুইজন কনস্টেবলের হয়েছিলেন মুখোমুখি।

ক্ষুদিরামের ময়লা পা ও বিধ্বস্ত, ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে, তাদের ক্ষুদিরামের ওপরে হয়েছিল সন্দেহ।
তারা ক্ষুদিরামকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল। তাতে তাদের সন্দেহ আরো যায় বেড়ে। তারা ক্ষুদিরামকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বীর ক্ষুদিরাম তাদের দুজনের সাথে শুরু করেছিলেন তুমুল সংগ্রাম।

কিন্তু, শেষ অবধি, তারা ক্ষুদিরামকে পাকড়াও করে ফেলে। এই ওয়াইনি রেলস্টেশনের নাম বর্তমানে বদলে গিয়ে হয়েছে, ক্ষুদিরাম বোস পুসা স্টেশন। ওদিকে, মোকামাঘাট রেলস্টেশনে,
পুলিশ প্রফুল্ল চাকিকে গ্রেপ্তার করতে গেলে,
তিনি, তাঁর কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে, তাঁর নিজের মতো করে যথাসাধ্য লড়াই করেছিলেন
পুলিশের সাথে। কিন্তু, শেষে যখন দেখেন, যে,
রিভলভারে গুলি আছে মাত্র একটি। তখন তিনি
নিজের মুখের মধ্যে সেই গুলি করে দেশের জন্য
হয়েছিলেন শহীদ।

ক্ষুদিরাম বোসের বিচার শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালের ২১ শে মে। বিচারক ছিলেন একজন ব্রিটিশ মি. কর্নডফ ও দুইজন ভারতীয় লাথুনিপ্রসাদ ও জানকীপ্রসাদ। বিচারে ক্ষুদিরামকে ফাঁসির আদেশ শোনানো হয়েছিল।
রায় শোনার পরে, ক্ষুদিরামের মুখে দেখা গিয়েছিল শুধু হাসি। তাঁর বয়স তখন খুবই কম ছিল।

তাই দেখে, বিচারক কর্নডফ ক্ষুদিরামকে প্রশ্ন করেন, “যে, তাঁকে তো ফাঁসিতে মরতে হবে, সেটা কি সে বুঝেছে? “

ক্ষুদিরাম তার উত্তরে আবার মুচকি হাসেন।
তাঁর সম্বন্ধে, হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন,
যে, ক্ষুদিরামের সহজ প্রবৃত্তি ছিল জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে, দুঃসাধ্য কাজ করার। তাঁর স্বভাবে নেশার মতো অত্যন্ত প্রবল ছিল সৎসাহস।
আর তাঁর ছিল অন্যায় অত্যাচারের তীব্র অনুভূতি। সেই অনুভূতির পরিণতি বক্তৃতায়
ছিলনা বৃথা আস্ফালন, অসহ্য দুঃখ – কষ্ট
, বিপদ – আপদ, এমনকি মৃত্যুকে বরণ করে,
প্রতিকার অসম্ভব জেনেও, শুধু সেই অনুভূতির
জ্বালা নিবারণের জন্য, নিজ হাতে অন্যায়ের
প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে প্রতিবিধানের চেষ্টা করবার
ঐকান্তিক প্রবৃত্তি ও সৎসাহস ক্ষুদিরামের চরিত্রের
প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বিচারের রায় ঘোষণার পরে, জীবনের শেষ কয়েকদিন কারাগারে বসে, ক্ষুদিরাম মাৎসিনি,
গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চেয়েছিলেন পড়তে। ফাঁসির আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, দেশকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি বোমা বানাতে জানতেন। তিনি চেয়েছিলেন, সেই বিদ্যা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ দেশের যুবকদের শিখিয়ে দিতে।

ফাঁসির মঞ্চে এসেও ক্ষুদিরামের মনে, ছিল প্রশান্তি, তা সত্যিই ছিল বিস্ময়কর। ১৯০৮ সালের ১১ ই আগস্ট, জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল
১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল
দুটি খুঁটি। তার ওপর একটি মোটা লোহার রড ছিল লাগানো আড়াআড়িভাবে, লাগানো। সেই
রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল।
তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ – ফাঁস।

ক্ষুদিরামকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশ সরকারের চার জন পুলিশ। তাঁদের সামনে ছিলেন নির্ভয় – নির্ভীক ক্ষুদিরাম। গলায় ফাঁসি
পরানো মাত্র জল্লাদকে ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন,
” ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন? ” এটাই ছিল শহীদ ক্ষুদিরামের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। ওইদিনই
, ওনাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। সেইসময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন।

ক্ষুদিরাম বসু, ছিলেন একজন মহান মানুষ। দেশই ছিল তাঁর ধ্যান – জ্ঞান। দেশের জন্য তিনি
ফাঁসিকাঠে নিজের জীবন বলিদান দিয়েছিলেন।
তাঁর আত্মবলিদানের কথা আজো আপামর ভারতবাসী, শ্রদ্ধার সাথে করে স্মরণ। ফাঁসির মঞ্চে যিনি গেয়েছিলেন জীবনের জয়গান,
তিনিই হলেন ভারতমাতার বীর সন্তান, আমাদের সবার গর্ব, শহীদ ক্ষুদিরাম বসু।

( তথ্য সংগৃহীত)

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • নিলয় সরকার August 17, 2020 at 1:56 pm

    ক্ষুদিরামের বিষয়ে এতটা ডিটেইলস এ জানতাম না। ভালো লাগলো

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল