রাত ২টো, ঘুম নেই শ্রীময়ীর চোখে,ও জানে আবার খানিক পরেই বাবান খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে। এরকমই হয়ে আসছে আজ টানা ২টো বছর, জানেনা শ্রীময়ী এরকমটা আর কতদিন হয়ে আসবে। সময় যেন কত তাড়াতাড়ি নৌকার পালে ভর করে নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়। দেখতে দেখতে কেটেও গেছে দুটো বছর। সাত মাসের বাবান আজ দুবছর সাত মাসের, সেই থেকেই একটা দিনও রাত দুটোয় খিলখিলিয়ে হাসিটা বন্ধ হয়নি। আর ওই কয়েকটা আধ ফোটা দাঁত দিয়ে আদো আদো গলায় মা দাদু ঠাম্মা ডাকা। কিন্তু রাত হলেই ওই যে ডাকটা, আদো আদো গলায় হলেও স্পষ্ট শুনতে পায় শ্রীময়ী, হাড় হিম হয়ে আসে তার, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত যেন বয়ে যায়। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এটা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে, কম দিন তো নয় দুটো বছর ধরে প্রতিদিন একটানা একই সময়ে হয়ে আসছে।এই দুটো বছরে শ্রীময়ীর জীবনেও কি কম কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সেই দু’বছর আগের হাবাগোবা অত শত সমাজের জীবনের মারপ্যাঁচ না জানা শ্রীময়ী আজ একটা ছোট চাকরি করে, চাকরির টাকায় তার পুরো সংসারটা চলে, বাপের বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হয় বুড়ো মা বাপের জন্য, বাবানের খাওয়া পড়া সবই বলতে গেলে ওই টাকা দিয়েই চলে। ব্যাঙ্ক থেকেও যে কিছু আসেনা তা নয়, তবে তার অধিকাংশটাই যায় শ্রীময়ীর নিজের হাতে গড়া অনাথ আশ্রম আর লাগোয়া স্কুলটাতে। দুবছর আগে যে থোক টাকাটা একেবারে পেয়েছিল নষ্ট করেনি শ্রীময়ী, একটা অনাথ আশ্রম খুলে বাপ মা হারা ছেলেগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল সেখানে। কত শহীদ বাপের নিঃস্ব সংসারের জন্য লড়েছে শ্রীময়ী, কী যেন একটা অদ্ভুত রোখ চেপে গেছিল শ্রীময়ীর মাথায় ঠিক সেই দিন থেকেই। সব ঠিকঠাকই চলে নিয়মমত, তবু মাঝেমাঝে হাপিয়ে ওঠে শ্রীময়ী।তারপর মনে পড়ে যায় রাত দু’টোর সময় সেই খিল খিল হাসি, খানিকক্ষণের জন্য হলেও যেন অনুভব করে প্রত্যেক শিরায় শিরায়, শরীরের প্রত্যেক প্রকোষ্ঠ দিয়ে যেন তাকে আবার একবার আলিঙ্গন করে নিতে চায়। কিন্তু সে পারে না, ছোট্ট বাবান না বুঝলেও সে নির্মম সত্যিটা জানে, শ্রীময়ী অনেক কষ্টে সত্যিটা স্বীকার করেছে অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে, তবু ব্যাকুল মন বার বার যেন অবলম্বন হাতড়ে বেড়ায়। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে সেদিনের ঘটনাগুলো। তেরঙ্গায় মোড়া কফিন বন্দী দেহটা গাড়িতে করে আসলো ঠিক রাত ২টয়, কান্নায় ভেঙে পড়েছে তার পুরো পরিবার, শ্রীময়ী শোকে পাথর। মাত্র দুবছরের বৈবাহিক জীবন সংসার সব দেশ বাঁচাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলো। সারাটা গ্রামবাসীরও চোখে জল, ঘরের ছেলেকে যে এভাবে বিদেশী বর্বর চীনা সৈনিকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে, তা কেউই মেনে নিতে পারছে না। স্বামীর জন্য গর্ব থাকলেও, তার স্বামী সংসারকে কেড়ে নেওয়ার জন্য দেশের প্রতি চাপা ক্ষোভে মাঝে মাঝেই ফুঁসে ওঠে শ্রীময়ী। তার ভয় হয়, তার বাবানও যদি একই পথে পা বাড়ায়। শ্রীময়ী চাইলেও আটকাতে পারেনা ওই খিলখিলে হাসি, সে বোঝে বাবা যেন সারাটাক্ষণ ছেলের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে। এইসব কথাগুলোই ভাবতে ভাবতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে শ্রীময়ীর। হঠাৎ ভোর রাতে আধো ঘুমে যেন কারোর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করে শ্রীময়ী, ধড়ফড় করে ওঠে, এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকেই খুঁজে পায়না। খানিক পরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে ওঠে, “তুমি চিন্তা করোনা শ্রী, আমি সবসময় তোমাদের পাশেই আছি, সবসময় বাবানকে আগলে রাখবো,বড়ো হয়ে ও আমার মত হবে “। শ্রীময়ী চেঁচিয়ে ওঠে, “না না, তোমার মত না… আমি ওকে তোমার মত হারাতে পারবোনা, তুমি চলে যাও আমাদের জীবন থেকে, ও তোমার মত দেশ সেবা করবেনা, কী হবে করে, কী লাভ!”। আবার কানের কাছে ফিসফিস, “লাভ!হাহাহাহা, শ্রী ওই দেখো বাইরে ওই যে স্বাধীনতার তেরঙ্গা পতাকাটা আজ উঠবে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে, ওই স্বাধীনতা আমাদের মত শহীদদের রক্তের দাগেই এখনো অক্ষুন্ন হয়ে আছে, তুমি যেমন বাবনের মা, ভারত এই দেশ ও বাবানের আরেক মা যে গো।” দুর থেকে বন্দেমাতরম গানটা রেডিওতে ভেসে আসতে থাকে, শ্রীময়ীর চোখ জলে ভিজে আসে।