গৃহবন্দী

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
0 রেটিং
1093 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

-মা,আজ বেশ তৃপ্তি করে খেলেন মনে হচ্ছে?
– হ্যাঁ,বৌমা। আজ অনেকদিন পর মন ভরে খেলাম। জ্যান্ত মাছের ঝোলটা আজ একটু অন্যরকম লাগল। বেশ সুন্দর রেঁধেছো।
– কিন্তু মা,প্রত্যেকবার তো এরমই রাঁধি! আজ তাহলে…
– তা হবে হয়তো। তবে আজ একটু অন্যরকম লাগল,তাই বললাম..।
– আচ্ছা মা, আপনার যখন ভালো লেগেছে তখন আর একদিন এরকমই করবো।নিন চলুন এবার, শুয়ে পড়ুন। ওদিকে বুবাই আবার জেদ ধরেছে, বিকেলে আপনার সাথে লুকোচুরি খেলবে।বলছি যে, “ঠাম্মির শরীর এখন ভালো নয়, তোকে সামলাতে পারবে না”,তাও শুনছে না।এতো জেদ বাড়ছে না ওর দিনকে-দিন!
– আরে, ওকে বকাঝকা কোরো না, ছোটো তো। ঠিক আছে, আজ বরং ও বিকেলটা আমার সাথেই থাকবে।
– আচ্ছা মা।
  পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি জানান দিচ্ছে, ঘড়িতে তখন দুপুর ২টো। বিভাবরী দেবী আজ আর দুপুরে শুলেন না। রথীন,ওরফে তাঁর স্বামী চলে যাবার পর, তিনি ঘরের সাথে লাগোয়া ঝুল-বারান্দায় রাখা আরামকেদারাটিতে বেশ কিছু সময় কাটিয়েই থাকেন। উত্তর কলকাতার বুকে আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের উপর বনেদি আমলের বাড়ি রথীনবাবুর। ভালো একটি সরকারি স্কুলে চাকরি করতেন তিনি। যৌবনে বেশ দাপটে সংসার,চাকরি সবই একার হাতে সামলে ছিলেন।এখন শেষ বয়সে এসে তার দিন ঘরে বসেই কাটে। শুধু সকালে একটু ফুল তুলতে বেরোন এই যা।স্বামী বছর দুয়েক হলো মারা গেছেন। রথীন বাবু চলে যাবার পর, এক ছেলে, এক মেয়ে, বৌমা এবং নাতিকে নিয়েই সাজানো তাঁর পরিবার।

বাড়ির চারপাশ ঘেরা গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে দুপুরের সূর্যের আলো এসে পড়ছে ঝুল-বারান্দায়। ছোটো ছোটো টুনটুনি,চড়াই দের ডাক আজ পরিষ্কার কানে আসছে। গোটা পাড়া আজ একটু বেশিই নিঝুম। সামনের টেবিলে রাখা গীতবিতানটা তিনি হাতে তুলে নিলেন। তারপর কেদারায় আরাম করে গা-এলিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন। হঠাৎ কখন যে তার চোখ লাগল, তিনি বুঝতে পারেন নি।চোখ খুলল বৌমা সুমিতার  ডাকে।

– মা, ঘুমোচ্ছিলেন?
– নাহ্, এই একটু চোখ লেগে গেছিল। বলো, কিছু বলবে?এসো বসো…।
– না তেমন কিছু নয়। তবে এই দুপুরবেলায় ঘরে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। কেমন যেন একটা লাগছে বাড়িতে বসে থাকতে। আপনার ছেলে তো সেই খেয়ে-দেয়ে নাক ডেকে ঘুম দিয়েছে।কথা বলার লোকই নেই। আসলে এরমভাবে দুপুরটা কাটানোর অভ্যেস নেই, না! কাজের মধ্যে থাকলে কিছুই বুঝতে পারিনা কখন সময় কেটে যায়। তাই ভাবলাম আপনি যদি জেগে থাকেন!
– বসো তাহলে, একটু গল্প করা যাক। এমনি দিনগুলোতে তো কারোর সাথেই কথা বলার অবকাশ পাওয়া যায়না।
– মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
– হ্যাঁ, ই নিশ্চই বলো!
– আজ সকাল থেকেই দেখছি আপনি বেশ খুশি, মনটা বেশ চনমনে। আজ কি কোনো বিশেষ দিন? ব্যাপারটা কি?(মুচকি হেসে বলল বিভা)
– হ্যাঁ, আজ বিশেষ দিনতো বটেই।
– তাই! কি আছে আজ?
– এই যে, তোমরা সবাই বাড়ি আছো।
– …..
– আজ কতদিন পর সবাই একসাথে ওই টেবিলটায় বসে খেলাম। আজ কতদিন পর খাওয়ার সময় মন খুলে কথা বললাম। নাতনির অফিস ছুটি থাকায় আজ সারাবেলা মেয়েটা সেই আগের মতন আমার সাথে সাথে গল্প করে কাটাল। কতদিন পর আজ ছেলের তানপুরাটায় সুর উঠল। তানপুরাটা এতদিন ধুলোয় পরেছিল।বিপিনের বাবা  যখন ছিল, তখন সব ও পরিষ্কার করে রাখত। কিন্তু ও চলে যাবার পর এই গোটা বাড়িটা কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে জানো। তোমরা বেরিয়ে যাও যে যার কাজে, তারপর আমি একা এতো বড়ো বাড়ি আগলে বসে থাকি। কথা বলার কোনো লোক পাইনা। তোমার একদিন থেকে এরম মনে হচ্ছে বৌমা! তাহলে বলো তো, আমার বাকি দিনগুলো কেমন কাটে!
– সবই বুঝি মা। কিন্তু আমরাও তো অপারগ। ভালোভাবে বাঁচার জন্য, এতগুলো এ.এম.আই খরচ সামলে ওঠার জন্য, নিজের শখ পূরণ করার জন্য, এখনকার দিনে এটুকু তো করতেই হয় না বাবা!
– সেইজন্যই আমি তোমাদের কোনো জোর করিনা।
– আপনার রাগ হয়না খুবব আমাদের উপর? অভিমান হয়, না?
– নাহ্, রাগ অভিমান করে আর কি হবে! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এখন এই শেষ বয়সে এসে তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না! কোনো মানুষকেই জোর করে আটকে রাখা যায় না। সবারই নিজের কিছু ইচ্ছে আছে, শখ আছে, তারা সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করবেই।তাদের সেখান থেকে বিরত করলে পরিবর্তে পরিবারে ক্ষোভ বাড়বে। (মৃদু হেসে তিনি বললেন)

– বাহ্, ফুলগাছগুলো তো বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে!
– বাড়িতে একা যখন থাকি, তখন রথীন আর আমার লাগানো এই গাছগুলোকে নিয়েই যে আমার সময় কাটে। তবে জানো তো, আমার একটা বিষয়েই শুধু কষ্ট হয়।
– কি সেই বিষয়?
– বুবাই কে কাছে পাইনা আর আগের মতন।আগে ও স্কুল থেকে ফেরার পর বিকেলটা আমার সাথে খেলতো,গল্প করতো।এখন পড়াশোনার চাপ বাড়ছে ওর ওপর। সময়টাও পাচ্ছে না খেলার। এখনকার পরিস্থিতি বড়োই বাজে। কোনো মানুষকে শান্তি দেয়না।সবাই শুধু ছুটে চলেছে।

কি ভাগ্যিস!! আজকের এই দিনটা এসেছে। তাই একটিদিনের জন্য হলেও মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে, পরিবার তার মানুষগুলোকে ফিরে পেয়েছে, তারা একে-অপরের সাথে একসাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পারছে। মানুষ আশাবাদী, সে সব পারে। তাই দেখো এই ভাইরাস ‘করোনা’ একদিন নির্মূল হবেই। শুধু মানুষের সচতেনাটুকু দরকার। কিন্তু এই দিনটি হয়তো আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে না বা কখনই ফিরবে না। মানুষ আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বাড়িগুলো আবার বোবা হয়ে যাবে। শেষ বয়সে এসে আমাদের মতো মানুষেরা যে শুধু এরম একটি দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে…! এর থেকে বেশি কিই-বা চাওয়া-পাওয়ার আছে আমাদের?!

– ওই দেখুন মনে হয় বুবাই জেগে গেছে! যাই এবার…।আর আপনিও তৈরি হয়ে নিন,আপনাকে জ্বালানোর লোকের ঘুম ভেঙে গেছে।
– হ্যাঁ, নিয়ে এসো ওকে।ঠাম্মি-নাতিতে খুব খেলব আজ। (একমুখ হেসে বললেন বিভাবরী দেবী..)

সুমিতা চলে যাবার পর তিনি রেডিওটার সাউন্ড একটু বাড়ালেন ।তখন ভেসে আসছে-

“অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো
          সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
          সেই তো তোমার ভালো॥”

সত্যিই তো, এই ব্যস্ততার যুগে, চলমান দুরভাষের যুগে আমরা কতখানিই বা সময় দিতে পারি পরিবারকে?! Quantity time তো দূরের কথা, Quality time ও পরিবারের মানুষগুলোর সাথে কাটাতে পারিনা। এতটাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আমরা।এই কারণেই মাঝেমধ্যে মনে হয়, পুরোনো সেই দিনগুলোই ভালো ছিল। আধুনিক মুহূর্ত সঞ্চয় করতেই ভুলে গেছি।তবুও তো-

মুহূর্তগুলো একই থাকে/বদল সময়টায়
গোলকধাঁধায় বেঁচে থাকে/জীবনের অহংকার

সতর্কীকরণ:- বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই ঘরে থাকুন।না বেরোলে নয়, এরম পরিস্থিতিতেই একমাত্র বাড়ি থেকে বেরোন।তাও বলব, যতটা সম্ভব এড়িয়ে যান। কাজ আগামীদিনেও হবে,আগে নিজের পরিবার ও আপনি। সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন, অন্যদেরও সুস্থ রাখুন। আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ,অন্ধকার পেরিয়ে আশার আলো দেখবোই আমরা এই অঙ্গীকার করি চলুন

..©️শঙ্খচিল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল