রুনঝুন শব্দটা শোনা যাচ্ছে দূর থেকে, পাশে পৌলমী গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। শোভন আসতে করে ঠেলে বললো
–এই শুনছো, ওঠো না..
ঘুম চোখে পৌলমী বললো
–কিসের শব্দ?
— নূপুরের রুনঝুন শব্দ, আর হালকা চন্দনের গন্ধ?
শোভনের গলাটা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। চোখ কচলে আধো ঘুমে তাকালো পৌলমী, জড়ানো গলায় বললো
—নাহ তো, কই? তোমার মনের ভুল।
নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় যেন রহস্যময় এক পরিবেশ। রাতের অখন্ড নীরবতা ভেদ করে সে শুনতে পাচ্ছে,ঐ তো রুনঝুন শব্দ ! দূরে কোথাও রাতচরা পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকে গেল শোভন, সব শব্দগুলো যেন তার কানে, বেশ জোরে লাগছে, পালস রেটটা বেড়েছে, এই রাতেও দরদর করে ঘামছে।
শোভনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম , বিছানায় বসে পৌলমী জড়ানো গলাতেই বললো
–কি হয়েছে, শরীর খারাপ?
–নাহ!
শোভনের হাতটা ধরে, ঘুম জড়ানো গলায় সে বলে,
–চলো ডাক্তারের কাছে যাই।
শোভন বিছানা থেকে পা ফেলে নামতে গিয়েই মাথার চুলগুলো খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলো। পৌলমী তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালাতেই, শোভন তাকে জড়িয়ে ধরে বলে
—রক্ত !
–কোথায় রক্ত? নেলপালিশটা পড়ে গেছিল, ভালো করে দেখ, কেন ভয় পাচ্ছ? আমি মলয়কে ফোন করি?
–প্লিজ, মলয়কে বোলো না, বিজনেসটায় একটু ঝামেলা চলছে, মলয় ওর পড়াশোনা নিয়ে থাক। মাথাটা খুব ভার হয়ে গেছে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করলো শোভন। ঝরঝর করে ঠান্ডা জল গায়ে পড়ছে তার, টাটকা চন্দনের গন্ধ, আর নুপূরের শব্দে বড্ডো ভয় , মনে হয় এই মা এসে বলবে
–টুকি!
আতঙ্কে চোখটা বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে, অ্যাক্সিডেন্টের পরেই মায়ের সেই মৃদু হাসি মাখা রক্তাক্ত দেহটা ,পায়ে রূপার নুপুরটা তখনো ছিল, মাথার কাছেই চন্দনের ধূপটা জ্বালানো। মন হচ্ছিল মা এখুনি উঠেই বলবে
–শুভ আয় !
ঐ অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই তাড়া করে বেড়ায় এই ভয়টা।
বোতলের ঢাকা খুলে ঢকঢক করে জলটা খেল শোভন। অনেক বার ভুলতে চেয়েছে, সে পারে নি।
সকালে পৌলমী উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— সাইকোলজিস্টের সাথে নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে ? আগের থেকে কমলেও, এখনতো কষ্ট পাচ্ছ। আজ মা এর শরীর ভালো নেই, ও বাড়ি যেতেই হবে, মলয়কে বলি তোমার কাছে থাকুক। এখন একা থাকা ঠিক নয় ।
–নাহ, প্রয়োজন নেই। তুমি যাও।
শীতের অলস রোদ্দুর গায়ে মেখে শোভন উত্তরটা দিল।
ঘুমটা ভাঙতেই অবাক হলো, চারিদিকে কি অন্ধকার! ফোনটা অন করতে গিয়েই দেখে একটুও চার্জ নেই, হাতড়ে হাতড়ে আলোটা জ্বালাতেই দেখে কারেন্ট নেই।
–ধুরর, ভাল লাগে না!
কোনমতে মোমবাতি জ্বালালো সে। কি চাপ চাপ অন্ধকার, মোমবাতির মায়াবী নরম আলোয় ঘরটা ভরে গেছে।মোমবাতির শিখাটা কেমন কেঁপে উঠলো না, যাহ তার পালস রেট বাড়ছে কেন, এ কি, আবার সেই চন্দনের গন্ধ, শব্দটাওতো শোনা যাচ্ছে। গন্ধের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথেই খুব ভয় লাগছে তার, বড্ডো ভয়, গলাটাও শুকিয়ে গেছে। অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেছে, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, দরজার কাছেই, ভয়টা চেপে ধরেছে তাকে।
পরের দিন পৌলমীর আর্ত চিৎকারে সকলে এসে দেখেন, শোভনবাবুর মৃতদেহ।কেঁদে কেঁদে পৌলমীর চোখ মুখ ফুলে গেছে।
সন্ধ্যায় সকলে চলে যাবার পরে মলয় পৌলমীর হাত ধরে বলে
— আর কোন বাধা নেই? কাল ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়াই অন্ধকারে, ব্যস তাতেই কেল্লা ফতে।
–কিন্তু ও ভয় কেন পেত মলয়?
–মা আমাকে বেশী ভালবাসতো, তাই হিংসের চোটে সেদিন ব্রেকটা কেটে দিয়েছিল, আমি যে তার সাক্ষী।
( সমাপ্ত )
চিত্র সৌজন্য : গুগল