নানাভাবে অচেনা সাগর

মৌমিতা মুখোপাধ্যায়
0 রেটিং
1201 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

সব তীর্থ বারবার গঙ্গা সাগর একবার”—-ঠাকুমা -দিদিমার কাছে শোনা কথা।শুনেছি অনেক কষ্ট করে আমার দিদিমা নৌকায় করে গিয়েছিল ওর মধ্যে ই খাওয়া-দাওয়া।মাঝে-মধ্যে চড়ায় একটু বিশ্রাম আবার পথচলা। অনেকেই গেলেও ফিরে আসতে পারত না।মোহনায় সলিল সমাধি হত।তাই প্রচলিত কথাটির সঙ্গে বাস্তবের যথেষ্ট মিল ছিল।গঙ্গা সাগরের নানা গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমার খুব রোমাঞ্চকর মনে হত।আমার মেসোমশাই অনেক লোক নিয়ে গঙ্গাসাগরে এই মেলার সময়ে পুণ্যার্থী দের থাকার জন্য হোগলার ঘর তৈরী করে দিত।পুণ্যার্থী মানুষগুলোর পাশে থাকত।নানা গল্প স্বপ্নের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতো কপিল মুণির আশ্রম,ভেসে উঠতো তিন নদীর সঙ্গম স্থল,নাগা সন্ন্যাসী দের চেহারা,পুণ্যতা অর্জনের তোরজোড় আরও কতো কি।তাই ছোট থেকেই খুব গঙ্গাসাগর এ পুণ্যলগ্নে গঙ্গাস্নান করার প্রবল ইচ্ছে ছিল।সুযোগ ও এসে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি।

Gangasagar Mela 2020: Lakhs of Pilgrims Take Holy Dip on Makar Sankranti |  📰 LatestLY

গঙ্গাসাগরে অনেক বার গেছি।বাবা সরকারের খাস অফিসে বসতো বলে গঙ্গাসাগর মেলার সময়ে মাঝে মধ্যে ডিউটি পড়তো, বাবা আমাদের কখনোই নিত না ভীড়ের জন্য। তবে মেলার সময় বাদ দিয়ে অন্য সময়ে অনেক বারই গেছি।খুব সুন্দর নিলিবিলি,নির্মল পরিবেশ,হালকা ঢেউ গরীব মানুষজন অথচ আন্তরিক। এমনই একবার বাবার কাছে খুব বায়না করলাম। এবার মেলার সময়ে তোমাকে নিয়ে যেতেই হবে।বাবা নারাজ বড্ড ভীড়,বয়স্ক রা যায় তীর্থ করতে ইত্যাদি বলে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাই ছিল।আমিও এককথায় নিজেকে আটকে রাখলাম যে আমি এবার যাব।মা অবশেষে বাবাকে রাজি করালো।জানুয়ারি মাস পরীক্ষাও নেই।আর কে পায়।আরও পরিবারে অনেকে যুক্ত হয়ে গেল।১২ জনকে নিয়ে ১২তারিখ আর্থিক ২দিন আগেই রওনা দিলাম গঙ্গাসাগরের উদ্দেশ্যে।কারণ বাবার দায়িত্ব আছে সব দেখাশোনা করার।বাবার অফিসে গাড়িতে আমাদের বাড়ি থেকে ডালহৌসি নিয়ে গেল।ওখান থেকে স্করপিওতে করে চললাম নামখানা র দিকে।গঙ্গা পেড়োনোর জন্য ছিল অসম্ভব লাইন, হুড়োহুড়ি পরে গেছে।মাইকে বারবার বলছে আপনারা শান্ত হোন কিন্তু কে কার কথা শোনে।আমাদের ১২জনের জন্য অবশ্য আলাদা লঞ্চে ব্যবস্থা ছিল। তাই খুব আনন্দেই সব দেখতে দেখতে চললাম গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর মিলন সাগরে হয়েছে।মোহনা খুব সুন্দর পরিষ্কার জলের মিলন বোঝা যাচ্ছে । তবে মানুষএগুলোর জন্য খুব মন খারাপ লাগছিল। লঞ্চ থেকে নামতেই দেখে গা শিউরে উঠল।পা তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেললাম। একটি যত্রতত্র একি নোংরা অবস্থা। মলমূত্র ভর্তি চারিদিকে। পা ফেলা যাচ্ছে না।বাবা আমার অবস্থা দেখে বলল,” এই জন্যই না করেছিলাম।”আমি বললাম এদের থাকার জায়গা নেই।এভাবে——–বাবা শুনে হেসে বলল -আরে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসে।সবার সামর্থ্য নেই হোগলার ঘরে থাকার এত লোক আসে যে বিনামূল্যে ও সকলের ব্যবস্থা করা যায়না চল ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবি।ওপারে নেমে আবার গাড়ি। প্রায় এক ঘণ্টা। অবশেষে পৌঁছালাম ভারতীয় দের অন্যতম প্রধান তীর্থ ক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। বাবার অফিসে বাংলোয় গিয়ে উঠলাম। অপূর্ব সুন্দর গাছে ঘেরা নিরালা খুব সুন্দর। তবে ঘর মাত্র দুটি পাওয়া গেল।কারণ একজন মন্ত্রী ও তার পরিবারের আসার কথা ছিল।তাদের জন্য বাংলোর অনেক টাই সংরক্ষিত ছিল।যা ভীড় তাতে এটাই যথেষ্ট। মিলিয়ে মিশিয়ে আমাদের দিব্বি হয়ে গেল।

Ganga Sagar Mela should be treated like Kumbh Mela — Puri Shankaracharya! –  Shankara!

আমাদের পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। সবাই ফ্রেস হয়ে গেলাম। গরমা গরম চা-বিস্কুট এসে গেল সঙ্গে সিঙ্গাড়া। খুব আড্ডা হল তারপর সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিকে আলো।বেশ ভীড়। অনেকেই আসতে শুরু করেছে।ভারত সেবাশ্রম এর সন্ধ্যারতি দেখে ফিরে এলাম। সবাই খুব ক্লান্ত তাই ডিনার তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল সকাল উঠে চা -জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খুব আদর যত্ন করেছিল ওখান কার স্টাফেরা।বেড়িয়ে সাগরের মেলার দিকে রওনা দিলাম। নানা ধরণের মানুষ বেশ জমজমাট মেলা প্রাঙ্গন। নাগা সন্ন্যাসী তে ভরে গেছে।ছোট ছোট ঘর তৈরী করে তার মধ্যে এরা বসে আছে।কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ সন্ন্যাসী কে আমার ভালো লাগেনি।এদের অঙ্গভঙ্গি খুবই কুরুচিপূর্ণ। গায়ে কোনো পোশাকের অস্তিত্ব নেই,নেই কোনো ভদ্রতা।মেয়েদের খুব অশ্লীল ভাবে ডাকাডাকি করছিল। ফিরে এলাম। বাবা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বিকেলে খবর আসল পুরীর শঙ্করাচার্য এসেছেন। অত্যন্ত সৌম চেহারা। বুদ্ধি দীপ্ত চোখ।আমি তাকিয়ে রইলাম বহুক্ষণ।পরদিন সকাল ৮-১০এ শুভ সময় স্নানের বললেন।রাতে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সারারাত লোকের আগমণ।সাগরের পাশে খালি আকাশের নিচে বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ওদের কোথাও আশ্রয় মেলেনি।সারা রাত মেলা। কত ধরনের পসরা সাজিয়ে বসেছে নানা মানুষ। কেউ আর রাতে ঘুমাতে যায়নি।মাঝরাতে পরিবহন মন্ত্রী পরিবার নিয়ে আসলেন।

Govardhan Math on Twitter: "Pujya Puri Shankaracharya ji at the Gangasagar  Mela 2020. #InPictures… "

পরদিন সকাল সকাল পৌঁছাতে গেলাম সাগর পাড়ে। ঠিক ৮:১০শঙ্করাচার্য আসলেন। আমরা একি সাথে স্নান করলাম। ছবি তুললেন হাসিমুখে। এই না হলে গুরু।মন ভরে উঠল।মা -মামিমারা সাগরকে পুজো করল।আরতি হল।লোকে লোকারণ্য চারিদিক।এর মধ্যে হঠাৎই একজন দেহাতি এসে পারে বসে মূত্র ত্যাগ করল।না করতে না করতেই সে পালিয়ে গেল।ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন বয়স্ক মহিলা কমণডলে জল নিতে সাগরে না গিয়ে মূত্রের ওই জল ভরতে শুরু করেন।আমরা অনেক চেষ্টা করলেও তারা হিন্দি ভাষা না বুঝে ওই জল নিয়েই চলে গেল।একেই বলে বুঝি ধর্ম। গরুর লেজ ধরে ১০টাকার বিনিময়ে বহু মানুষ বৈতরণী পার হচ্ছে।এতে নাকি স্বর্ণ বাস হবে।১০ টাকার বিনিময়ে স্বর্গে গমণ বাবা যায়। আমরা কোন শতাব্দীতে বাস করি সেই মুহূর্তে ভুলে গেলাম। ধর্মের কি পরিহাস।এরপর কপিলমুণির মন্দিরে পুজো দেওয়ার পালা। সেখানে রীতিমতো ধস্তাধস্তি। ফিরে এলাম। বাবা বলল পরের দিন শান্তি করে দিও।ওই দিন সমস্ত গঙ্গাসাগর এ সকলে নিরামিষ খায়।আমাদের জন্য ভোগের ব্যবস্থা হয়েছিল। সন্ধ্যায় মন্ত্রীমশাইয়ের আমন্ত্রণে ছৌ নাচ দেখতে গেলাম দলবেঁধে। পুরুলিয়া থেকে এসেছে এরা।অপূর্ব শিল্পকলা।রাতে ছিল সেদিন বিশেষ খাওয়া। উৎসব।ভালই কেটে গেল দিনগুলো। পরের দিদি শান্তি করে পুজো দিলাম মন্দিরে ঘুরে ঘুরে সব দেখালেন বাবার সহকারী কাকু।

সত্যি গঙ্গাসাগর কথাটির সঙ্গে অনেক মাহাত্ম্য জড়িয়ে আছে,আছে নানা পৌরাণিক গল্প ।এই তীর্থ ক্ষেত্র সর্বভারতীয় তীর্থ ক্ষেত্র।এখানে প্র তি বছর হাজার হাজার মানুষ ভারতের নানা স্থান থেকে স্নান করতে আসে।কেন আসে এত মানুষ। কিসের টানে আসে।কথিত আছে সাগর রাজার ষাট হাজার পুত্র ছিল।তিনি একবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন।দেবতা ইন্দ্র ঈর্শ্বান্বিত হয়ে যজ্ঞের ঘোড়া টিকে আটক করেন।এদিকে ঘোড়া না পেয়ে সাগর রাজা তার ছেলেদের ঘোড়ার খোঁজে পাঠান।পাতালে তখন মহর্ষি কপিলকে তারা চোর বলে সন্দেহ করলে কপিল মুনির অভিশাপে সকলে ভস্মীভূত হয়ে যায়। বহু বছর পর দিলীপের পুত্র ভগীরথ ব্র ক্ষমার তপস্যা করে গঙ্গা কে পৃথিবীতে এনে তার পিতৃপুরুষের মুক্তি দিতে চাইলে গঙ্গা প্লাবিত হওয়ার ভয় দেখালে তখন ভগীরথ শিবের তপস্যা করলে শিব গঙ্গা কে জটায় আবদ্ধ করে ছোট আকারে মুক্তি দিলে তার পূর্বশর্ত মুক্তি পায়।।তাই এই তিথিতে সাগর স্নান করলে নানা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় পুণ্য অর্জিত হয়।

Sadhu photos, royalty-free images, graphics, vectors & videos | Adobe Stock

এখানে সোলারের মাধ্যমে আলো জ্বলে। তাই সকালে বিদ্যুত্ থাকত না আবার রাত ন টার পর থেকে আলো থাকে না।তবে মেলার ব্যপার আলাদা। এবার ফেরার পালা।মন খারাপ লাগছে আজ বড্ড। সকলকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি তে উঠে বসলাম। জানি না আবার কবে আসবে এই সাগর তীরে।যেখানে আছে শুধু -শান্তি ভালোবাসার হাতছানি। তিনবার এসেছি।তবে এবারের অভিজ্ঞতা বিরল ও দুর্লভ। ‘”বারেবারে আসব ফিরে এই সাগরের তীরে।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল