তিন সপ্তাহের দীর্ঘ লকডাউন। উপায়ও নেই। বাইরে ওত পেতে বসে আছে অজানা অচেনা শত্রু করোনা, যাকে কেউ চেনে না। অতঃপর আপাতত গৃহবন্দী। দীর্ঘ এই সময়ে আসুন হাতে তুলে নিই বই, হঠাৎ প্রাপ্ত অবসরে ডুব দিই বাংলা সাহিত্যের চিরচেনা অমৃত সাগরে। শাব্দিক হাজির করল বাংলা সাহিত্যের বেস্টসেলার চিরসবুজ এগারোটি অমর উপন্যাসকে। যদি এদের সাথে আপনার ইতিমধ্যেই পরিচয় হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে স্মৃতির সরণি বেয়ে আরেকটিবার পৌঁছে যান সাহিত্যের এই রত্নরাজির গুহা অভ্যন্তরে। আর যাঁরা পরিচিত নন, তাঁরা শাব্দিকের হাত ধরে সেরে নিন প্রাথমিক পরিচয়টুকু।
১। প্রথম আলো :- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি এই সত্যাশ্রয়ী উপন্যাসটি দুই খন্ডে বিভক্ত। ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতকের প্রথমদিকের কলকাতা তথা ভারতবর্ষের বিখ্যাত কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র হেঁটে চলে বেড়ান এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে লর্ড কার্জন, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে মহাত্মা গান্ধী, সুনীলের অনবদ্য লেখনী শৈলীর গুণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রতিটি চরিত্র। আমার আপনার মত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য রয়েছে ভরত বা দ্বারিকানাথ বা ভূমিসুতার মত সাধারণ মানুষেরাও। উপন্যাসটি যাতে ইতিহাসের ভারে নুয়ে না পড়ে, সাহিত্যগুন যাতে ষোল আনা বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করেছে সুনীলের অনবদ্য লেখনী। বাঙালির নবজাগরণের উপর রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবেই পরিগণিত এই উপন্যাস। সুনীল নিজেই উপন্যাসটির ভূমিকায় স্বীকার করেছেন যে, এই উপন্যাসটির তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁকে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে পর্যন্ত হানা দিতে হয়েছিল। তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ, তাঁদের কার্যকলাপ, ইংরেজ শাসকদের মনোভাব, রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের বিবিধ সামাজিক, ধর্মীয় এবং অবশ্যই সাহিত্যিক কার্যকলাপ, গিরিশচন্দ্র ঘোষের অনবদ্য প্রতিভার ফলস্বরূপ বাংলা নাটকের উত্থান ও স্টার থিয়েটারের আদিযুগ, স্বামী বিবেকানন্দ ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কার্যাবলী ও বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠা, ভগিনী নিবেদিতা ও বিবেকানন্দের যৌথ সামাজিক আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বেলুড়ের সাথে বিচ্ছেদ, বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট, তরুণ মহাত্মা গান্ধী – সুনীলের অনবদ্য লেখনী ছুঁয়ে গেছে প্রতিটি কোণ। নিজেদের শিকড়ের খোঁজ করলে পড়তেই হবে এই ক্লাসিক।
২।পথের পাঁচালি এবং অপরাজিত:- আবেগী বাঙালির খুব কাছের এই উপন্যাসদ্বয়। একত্রে এই দুই উপন্যাসকে উল্লেখ করার কারণ, একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত, একটিকে ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব ভাবা যায় না। অমর ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিরকালীন সৃষ্টি অপু এবং তার কাহিনী। শিশু অপু, তার বড় হয়ে ওঠা, দারিদ্র্যের সাথে মরিয়া লড়াই, সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করা এবং কালক্রমে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতিলাভ, অপুর জীবনের এই পুরো জার্নির সঙ্গী নিজের অজান্তেই যেন হয়ে যাই আমরা। টুকরো টুকরো ঘটনা অঙ্কনে বিভূতিভূষণ সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সেরার স্থান অধিকার করবেন। গল্প বলার এমন অনবদ্য নিদর্শন খুব কমই দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে কিছু অমর দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে এই দুই উপন্যাস। বালক অপু ও তার দিদির আম কুড়ানোর দৃশ্য, তাদের একত্রে ট্রেন দেখার ঘটনা পাঠক হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারবেন না। ঠিক তেমনই দিদি দুর্গার মৃত্যু, নিশ্চিন্দিপুর ত্যাগ করার সময় মৃতা দিদির জন্য অপুর বুক ফাটা অনুভূতির কাহিনী পড়তে পড়তে চোখ আর্দ্র হয়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পরবর্তীকালে টিকে থাকার দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই, অপুর স্ত্রী অপর্ণার অকালমৃত্যু, পুত্র কাজলের মধ্যে অপুর নিজের শৈশবকে খুঁজে পাওয়া – প্রত্যেকটা ঘটনাই যেন পাঠককে সম্পৃক্ত করে দেয় চরিত্রগুলির সাথে। বাংলা সাহিত্যের রূপ রস গন্ধের খোঁজ পেতে চাইলে ঝটপট পড়ে ফেলুন এই দুই উপন্যাস।
৩।পুতুলনাচের ইতিকথা:- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত এই উপন্যাসটি একেবারেই আলাদা কারণ, অন্য উপন্যাস বা সাহিত্যকর্মের সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বজ্রাঘাতে মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি রয়েছে একাধিক চমক, টুইস্ট এবং জটিলতা। গ্রামের নাস্তিক ও আধুনিক মনস্ক ডাক্তার শশী, তার কন্যা কুসুম সহ একাধিক চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, জটিল সামাজিকতা, গ্রাম্য দলাদলি তাঁর বামপন্থী মানসিকতা থেকে বিচার করেছেন মানিক। পরকীয়া প্রেমের উল্লেখ রয়েছে এই উপন্যাসে, যদিও তার পরিবেশন অনবদ্য। ” শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম? “, এই উক্তিটি তো প্রবাদবাক্য হিসেবে এখন পরিগণিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা এই উপন্যাস।
৪। আরণ্যক:- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি সম্পর্কে বলা হয় যে, সম্পূর্ণ বিশ্ব সাহিত্যে এই উপন্যাসটি অনন্য। সেই অর্থে এই উপন্যাসে কোনও নায়ক নেই, প্রকৃতি স্বয়ং এখানে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এক শহুরে যুবকের একরাশ বিরক্তি সহ কর্মসূত্রে জঙ্গলমহলে আগমন, এবং কালক্রমে প্রকৃতির প্রেমে কর্মক্ষেত্র কেই আপন করে নেওয়ার অসাধারন কাহিনী একটি অবশ্যপাঠ্য। বিভূতিভূষণের নিজস্ব অভিজ্ঞতার অসামান্য প্রভাব আছে এই উপন্যাসে। অরণ্য ও তার সন্তানদের কাহিনীই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক সাহচর্যের এমন জীবন্ত দলিল আর দেখা যায় না। রাজু পাঁড়ে, সত্যচরণ, মটুকনাথ, দোবরু পান্নার মত চরিত্রগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ঘটনা বর্ণনা করতে বিভূতিভূষণের জুড়ি নেই। এই উপন্যাসেও একাধিক ঘটনা পাঠকের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ পূর্ণিমার রাতের চন্দ্রালোকে ভেসে যাওয়া অরণ্য প্রান্তরের মধ্য দিয়ে অশ্বারোহণের বর্ণনাকে উল্লেখ করা যায়। প্রকৃতির সাথে রোম্যান্সের এই কাহিনী জানতে হলে ঝটপট পড়ে ফেলুন এই উপন্যাস।
৫। পদ্মানদীর মাঝি :- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভবত সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রায় সব ভারতীয় প্রধান আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অন্য কোনও বাংলা সাহিত্যকর্ম এত বেশি ভাষায় অনূদিত হয় নি। উপন্যাসটির মধ্যে এক রোমান্টিক রহস্যময়তা আছে। পূর্ববঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত এই কাহিনীতে শুধু যে পদ্মানদী কেন্দ্রিক মৎস্যজীবীদের কাহিনী বর্ণিত আছে তাই নয়, তাদের কাছে জীবনের কি অর্থ, তাই নিয়ে বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিতে এক অনবদ্য পরিবেশনা বলা যেতে পারে উপন্যাসটিকে। মূল চরিত্র কুবেরের একইসাথে পরিবারের প্রতি ভালবাসা ও কপিলার প্রতি এক আদিম আকর্ষণ মনস্তত্ত্বের জটিলতাকে হাজির করেছে। হোসেন মিয়ার নিষিদ্ধ দ্বীপ, যেখানে কুবের ও কপিলা খুঁজে পায় তাদের জীবনের সার্থকতা, যেন এক শ্রেণীহীন ও বন্ধনহীন সমাজের প্রতিচ্ছবি। মানিকের বামপন্থার তীব্রতম প্রকাশ এই সৃষ্টি, যেখানে পরকীয়া প্রেমের মধ্য দিয়ে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে শ্রেণীহীন সমাজে মুক্তির স্বাদ অর্জনের আখ্যান বর্ণিত।
৬।চাঁদের পাহাড়:- বাঙালির অ্যাডভেঞ্চার রোমান্টিকতার শেষ কথা বিভূতিভূষণের এই অমর সৃষ্টি। বাঙালি যুবা মাত্রই তার পায়ের তলায় সর্ষে, আর শঙ্কর এই বাঙালি যুব সমাজের সার্থক প্রতিনিধি। পরাধীন ভারতে, যখন ভারতীয়দের পায়ে শৃঙ্খল, বিভূতিভূষণ তখন শঙ্করকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ দুর্গম কালাহারি মরুভূমি। ভারতের বাইরে কোনোদিন পা না রাখা বিভূতিভূষণের এই উপন্যাসে তথ্যগত বিভ্রান্তি আছে ঠিকই, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের সুনিপুণ পরিবেশনা শঙ্করকে কখন যেন করে তোলে পাসের বাড়ির ছেলে, যার বিপদে আমরা শঙ্কিত হই আর যার সাফল্যে আমরা উদ্বেলিত হই। বুনিপ নামক কাল্পনিক জন্তুর বিরুদ্ধে শঙ্করের লড়াই তো বাংলা সাহিত্যের লোকগাথা তে পরিণত হয়েছে। দিয়েগো আলভারেজ নামক চরিত্রটিও এক অনবদ্য সৃষ্টি। অ্যাডভেঞ্চারের সাথে সাথে দেশ ভ্রমণের তৃপ্তিও পাঠককে দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। দিয়েছেন অজানা অচেনা জায়গায় কর্মলাভের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। বরাবরের বেস্টসেলার এই উপন্যাস বাঙালির হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের।
৭।শ্রীকান্ত: ম্যারাথন এই উপন্যাসটি অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেরা বলেই বিবেচিত। আত্মজীবনী মূলক এই উপন্যাসটি চার খন্ডে বিভক্ত এবং এটি শ্রীকান্ত নামে এক যুবকের, যে চরিত্রটি স্বয়ং ঔপন্যাসিকের ছায়া বলে পরিচিত, জীবন আখ্যান। বাংলা থেকে রেঙ্গুন, এক বিশাল ভৌগোলিক এলাকা জুড়ে এই উপন্যাসের ব্যাপ্তি। সময়ে সময়ে শ্রীকান্তের জীবনে এসেছে ইন্দ্রনাথের মত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার, অভয়া অথবা রাজলক্ষ্মীর মত নারী চরিত্রের স্পর্শ পেয়েছে সে। শরৎচন্দ্র বরাবরই নারী চরিত্রের অনবদ্য বুননের জন্য বিখ্যাত, এই উপন্যাসে তা পূর্ণতা পায়। নারী পুরুষের সম্পর্কের অজস্র ঘাত প্রতিঘাত, জটিলতা সামনে এনে দিয়েছে এই উপন্যাস। প্রাক স্বাধীনতা যুগের আর্থ সামাজিক জীবন ভীষণভাবে উপস্থিত এই উপন্যাসে। শ্রীকান্তের সঙ্গী হয়ে একটি যুগের সাক্ষী হতে চাইলে পড়ে ফেলুন এই অমর সৃষ্টি।
৮। রাজসিংহ: বাংলা উপন্যাস যাঁর হাত ধরে বিকশিত হয়, সেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম সেরা এই উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে প্রথম দশে জায়গা করে নেওয়ার উপযুক্ত। বঙ্কিমচন্দ্রের কঠিন ভাষার জন্য অনেকে এই উপন্যাসে হাত দিতে ইতস্তত করেন বটে, কিন্তু এটি না পড়লে বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের শিকড়ের পরিচয় পাওয়া থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মেবারের রাজপুত রানা রাজসিংহের দ্বৈরথ নিয়ে এই উপন্যাস। মুঘলদের বৈবাহিক রাজনীতি, অন্দরমহলের অশান্তি, দরবারি কুটিলতা সুনিপুণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন বঙ্কিম। একইসাথে রাজপুত শিবিরের অন্দরমহল, তাদের রক্ষণশীলতা, রাজপুত কন্যার মুঘল বেগম হবার অনীহা, মেবার এর সাথে মুঘলের দ্বন্দ্ব, সবই উঠে এসেছে এই দুর্ধর্ষ কাহিনীতে। মোবারক, দরিয়া, মানিকলালের মত ছোট চরিত্রগুলি ও এই উপন্যাসের সম্পদ। শিকড়ে ফিরতে চাইলে পড়তেই পারেন এই ক্লাসিক।
৯।শেষের কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্য উপন্যাসগুলো কে ছাপিয়ে এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে পাঠকের বড় কাছের। নাম শুনে অনেকেই হয়তো ভাববেন এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। আজ্ঞে না পাঠক, কবিতা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে খন। আলোচ্য সৃষ্টি টি শুধু যে একটি উপন্যাস তাইই নয়, এটি হল বাংলা ভাষায় রচিত সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রেম আখ্যান। অমিত লাবণ্যের এই কাহিনী বাজারচলতি অন্যান্য প্রেমকাহিনীর থেকে এতটাই আলাদা যে, অনায়াসে ক্লাসিকের স্থান পেতে পারে শিলং ভ্রমণের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটি। প্রেমের প্রকৃত রূপ ও শর্তহীনতা অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসার প্রচলিত ধারণায় বিশ্বাস ছিল না রবির, তাই প্রকৃত প্রেম ও যে আধ্যাত্মিকতার সমার্থক হতে পারে, তিনি অমিত ও লাবণ্যের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা। শিলংয়ের অসামান্য প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে দুই বঙ্গ নরনারীর মানসিক আদানপ্রদান অসামান্য রোমান্টিকতায় মুড়ে রবি উপস্থিত করেছেন পাঠকদের সামনে। উপন্যাসের অন্তিম অংশের বিদায় কাব্যটি এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে এই উপন্যাসে। রোমান্টিকতা পছন্দ করলে আপনার অবশ্যপাঠ্য এই উপন্যাস কারণ রোমান্টিকতার চূড়ান্ত পাঠ নেয় এই উপন্যাস।
১০। তুঙ্গভদ্রার তীরে: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশের স্রষ্টা হিসেবেই পরিচিতি লাভ করলেও তাঁর অপর একটি পরিচয় হল যে, তিনি বাংলা ভাষায় অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক। নাম শুনেই এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বোঝা যায়। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, মধ্যযুগের বিজয়নগর সাম্রাজ্য। রাজা দেবরায়ের সাথে কলিঙ্গ রাজকন্যা বিদ্যুন্মালার বিবাহ স্থির হওয়া ও পথিমধ্যে নৌকাডুবি, অর্জুনবর্মা কর্তৃক জীবন রক্ষা, কালক্রমে তাদের মধ্যে প্রেম সম্পর্কের উৎপত্তি, রাজার সাথে বিরোধ, মণিকঙ্কনার সাথে রাজার সম্পর্ক – বিশাল এক ব্যাপ্তি এবং একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে নারী পুরুষ সম্পর্ক কে তুলে ধরেছেন শরদিন্দু। একইসাথে তৎকালীন বিজয়নগরের দাপট, রাজার সুনিপুণ নেতৃত্ব, মধ্যযুগীয় সামাজিক জীবন, দেবদাসী প্রথা, পিস্তলের ব্যবহার, বাহমনি সাম্রাজ্যের সাথে সংঘাত, রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা, বহুবিবাহ প্রথা – হেন বিষয় নেই যা শরদিন্দু স্পর্শ করেননি এই অসাধারণ সৃষ্টিতে। বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত সর্বসেরা এই ঐতিহাসিক উপন্যাস তাই আপনার অবশ্যপাঠ্য।
১১। কালবেলা: উপন্যাস একাদশের মধ্যে সাম্প্রতিকতম হল সমরেশ মজুমদারের এই বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসের মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অনিমেষ মাধবীলতা খ্যাত এই উপন্যাস। সত্তরের উত্তাল সময়ে সদ্য কলকাতায় আগত ছাত্র অনিমেষের বাম ও পরবর্তীকালের অতিবাম ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং বিপ্লবের নেশায় মত্ত হয়ে সবশেষে করুন পরিণতির গল্প শোনায় এই উপন্যাস। কিন্তু, এই উপন্যাস হতাশার নয়, এই কাহিনী হেরেও জিতে যাওয়ার। সৌজন্যে মাধবীলতা। অনিমেষের এই প্রিয়তমা নারী রাজনীতিতে পটু নয়, সে শুধু জানে ভালোবাসতে তার প্রিয় অনিকে। অনির জন্যই তার পরিবার ত্যাগ, অনির জন্যই তার স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ, পরিশেষে পঙ্গু অনির আশ্রয়দাতা ও সে ই। আদর্শ ভঙ্গের হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ ভেসে ওঠে আবার, যখন সে বোঝে ” বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা “। হ্যাঁ, মাধবীলতার জীবন একটি বিপ্লব এবং সফল বিপ্লব। অশান্ত সেই দশককে দুই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরে অসাধারন এক আখ্যানের জন্ম দিয়েছেন সমরেশ। রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে এটি অনন্য।
অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্য হিসেবে খ্যাত বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যের ভান্ডার থেকে এগারোটি সেরা উপন্যাস বাছাই করার কাজ অতি দুরূহ। আলোচ্য একাদশের বাইরেও বহু উপন্যাস আছে যেগুলি এই আলোচনায় স্থান পাওয়ার যোগ্য। পরবর্তী ক্ষেত্রে শাব্দিক অবশ্যই উপস্থাপন করবে অন্যান্য সাহিত্যকর্মের বিশেষত্ব কেও। আপাতত লকডাউনের একুশটি দিনে আপন করে নিন এই উপন্যাস একাদশকে আর সমৃদ্ধ করুন নিজেকে।
চিত্র সৌজন্য :গুগল ,photocollage.com
আমি অনেকটাই একমত।
ভালো লাগল