অযান্ত্রিক

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
4 রেটিং
14223 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 2 , গড়ে : 4]

পাঠকদের পছন্দ

আধো ঘুমের মধ্যেও সুনন্দা পরিষ্কার শুনতে পেলো ঢাকের আওয়াজ, জানলার পর্দাটা আলতো সরিয়ে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো সে, আকাশ কী মেঘলা নাকি এখনও ভোর হয়নি পুরো..!  আজ.. আজ মহালয়া না? হ্যাঁ, আজই তো মহালয়া। তবুও কিছু একটা যেন নেই.. খুব কাছের, খুব দরকারী কিছু যেন। বালিশে মুখ গুঁজে অনেক চেষ্টা করেও সুনন্দা কেন যে শুনতে পাচ্ছেনা যা ও শুনতে চাইছে। সুগভীর কণ্ঠস্বরের দেবীবন্দনা, বারবার রেডিও চ্যানেল পাল্টানোর সেই পরিচিত শব্দটাও তো কানে আসছেনা, তবে কী আজ মহালয়া নয়!  কিন্তু ওর নাকে যে ভেসে আসছে সেই সুতীব্র অথচ নির্মল চেনা গন্ধটা।ছোটোবেলায় ওদের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই যে শিউলিগাছটা মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, যার গন্ধে মম করতো ওদের প্রায় গোটা পাড়াটা.. সুনন্দা প্রতিদিন ওর তলা থেকে মুঠো ভরে ছোট্ট সাদাফুলগুলো কুড়িয়ে আনতো নিজের বিছানার পাশে রাখবে বলে। পুরো পূজোর মাস জুড়ে চলতো ওর এই ছেলেমানুষী, আজও যেন বালিশের চারপাশে কেউ মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিয়ে গেছে ওর পছন্দের ফুলগুলো। আচ্ছা, দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে না? সেইযে সেবার ও, বাবা মা আর ভাইয়ের সাথে শিলং বেড়াতে গিয়েছিল পূজোর ছুটিতে, সেই মেঘ আর কুয়াশায় জড়িয়ে থাকা পাহাড়টার মতো ..! বাবাকে সেবার সুনন্দা বলেছিল ও শিলং -এই থেকে যাবে, ফিরবে না আর।
বাবা, মা, ভাই তো আজও বেরোয় একসাথে আগের মতো, শুধু ওরই আর সঙ্গে যাওয়া হয় না। ছোটোবেলার কেমন যেন একটা গন্ধ থাকে.. ভেজা ভেজা ধূলোর গন্ধ, সুনন্দা সেই গন্ধটা পেতে চায় ভীষন, পায় না আর…. তবে কী সে খুব বড়ো হয়ে গেছে?
কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায় ওর.. ঘুমের, গন্ধের, ঢাকের আওয়াজের। ওর মনে হলো, মা এখনই এসে ওকে ডাকবে.. অথচ বাইরেটা কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে আছে, অন্ধকার ভাবটা কাটতেই চাইছেনা- কেমন একটা মনখারাপের সুর। এমন তো হওয়ার কথা নয়, মা কী ওকে ডাকবে না? এতো দেরী হচ্ছে কেন তবে!  সুনন্দার মনে হলো, পাহাড়টার ধোঁয়াটে গা থেকে কী একটা বিশ্রী শব্দ সবকিছু ছিঁড়েখুঁড়ে দেওয়ার জন্য ভেসে আসছে। শব্দটা ক্রমে তীব্র হতে থাকলো, যেন বাইরের ওই আধো অন্ধকারটাকে তীরের ফলার মতো চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে.. আরো… আরো দ্রুতগতিতে আছড়ে পড়লে যেন…

ধড়মড় করে উঠে বসলো সুনন্দা খাটের ওপর, অ্যালার্ম ক্লকটা তীক্ষ্ণস্বরে বেজে চলেছে। দুহাতে মুখ ঢাকলো সে, তবে কী স্বপ্ন..!! কোনোরকমে ওটা বন্ধ করে বিছানা ছাড়লো ধীরপায়ে উঠে বাথরুমে ঢুকলো.. চোখেমুখে ভালো করে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ফিরে এলো নিজের ঘরে।
সুনন্দার হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতে মা’র সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল,  মা’ই বললো আগামী পরশু মহালয়া। পাড়ার প্যান্ডেলটার কাজ এখনও অনেকটাই বাকী, সেই নিয়ে নাকি রোজ ঝামেলা চলছে ওদের নিজেদের মধ্যে.. কাজের মাসি এবার আর শাড়ী না, টাকা ধরে দিতে বলেছে.. ভাইয়ের এবার শুধু অষ্টমীতেই অফিস ছুটি, বাকী পূজোর দিনগুলোতে যেতে হবে ওকে..। আসলে… আসলে সুনন্দার গত ছয় বছর ধরে হয়ে আসা মনখারাপের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে.. পূজো এসে গেছে।
সুনন্দাদের অ্যাসোসিয়েশনের পূজো এবারও দেশের পূজো শেষ হয়ে যাওয়ারও এক সপ্তাহ পরে শুরু হচ্ছে। যে দেশে যদাচার। মার্কিনমুলুকে বসে অক্টোবর মাসের কোনো একটা উইকেন্ড খালি পাওয়াই অনেক, তিথি মেনে পূজোটা জাস্ট ভাগ্যের ব্যাপার.. তার উপর মহালয়া বা পূজোর আমেজ !
মনে মনে হাসতে গিয়েও থমকালো সুনন্দা। কদিন থেকেই কেমন একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছে ওর ভিতর, নয়তো মায়ের ফোনতো আর নতুন কিছু নয়, আর এই কবছরে বারবারই এই পুজো, মহালয়া, মনখারাপকরা গুলো ফিরে ফিরে এসেছে, আবার সময়ের নিয়মেই সব মিলিয়েও গেছে।
কিন্তু এবারেরটা একটু বেশিই ভাবাচ্ছে ওকে, একটু বেশিই অশান্ত করে রেখেছে ওকে।

আসলে সুনন্দার ভিতর কেমন একটা ভয় কাজ করছে। শিকড়ছেঁড়ার ভয়। প্রবাসের এই বছরগুলোতে অনেক কিছুর সাথেই মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। এটাই ভেবেছিল.. আরতো কিছুসময়, তারপরই বাব্বা ফিরে যাবো কলকাতায়। প্রথম প্রথম সবকিছু নতুন হিসাবে ভালোলাগলেও দুই আড়াই বছর কাটার পর থেকেই কেমন যেন একটা একঘেয়েমি গ্রাস করতে লাগল ওকে। আর দিন সময় যত এগিয়েছে পাল্লা দিয়ে দেশে ফেরার তাগিদটা একটু একটু করে বেড়েছে। শেষ একবছরে বহুবার রাহুলকে জিজ্ঞাসা করেছে ও.. “ আমরা ফিরে যাবো না?” ..
“আমরা কবে ফিরবো কলকাতায় ? “ কিংবা.. “ তুমি যে বলেছিলে তোমার প্রজেক্টের কাজ শেষের মুখে, তবে কী সব গুছাবো একটু একটু করে এবার ?”
কেমন একটা অস্হিরতা কাজ করে ওর ভিতর এগুলো বলার সময় , কারন প্রশ্নগুলো যতবার সামনে এসেছে রাহুল ততবার এটা সেটা বলে এড়িয়ে গেছে।
সেদিন অফিস থেকে রাহুল বাড়ি ফিরেছিল হাতে একটা দামী ওয়াইনের বোতল আর একতোড়া ফুল নিয়ে। সুনন্দা প্রথমটায় বুঝে ওঠে নি। আজ তো কোনো স্পেশাল দিন নয়, তবে এসব কেন! অনেক হেয়ালীর পর খোলসা করেছিল, রাহুল এখানকার অফিসে পারমানেন্ট এমপ্লয়ি হিসাবে সিলেক্টেড হয়ে গেছে। এখন থেকে ও সরাসরি আমেরিকান কোং -র মাইনে করা চাকুরে। ছয় বছরের পরিশ্রম, লাগাতার কর্মোদ্যোগ আজ এসে স্বার্থক হলো ওর। খুশি, আনন্দ, সাফল্যে জ্বলজ্বল করছিল ওর চোখমুখ। সুনন্দা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। ছুটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকেছিল। একরাশ কালো রং যেন কেউ ওর মুখে লেপে দিয়েছিল। ডুকরে কেঁদে উঠেছিল নন্দা।
সেদিনের পর থেকে রাহুলকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যদি সিদ্ধান্তটা পালটানো যায়। পারে নি। তাই কালরাতে মায়ের ফোনটা পাওয়ার পর থেকে সুনন্দার বুকের কাছে দলাপাকানো কষ্টটা আরও জমাট বেঁধেছিল।
মায়ের বাড়ি, ওর পাড়া , মোড়ের মাথার ছোটো মুদি দোকানটা, গলিগুলো, ফেলা আসা স্কুলকলেজের দিনগুলো, বাবা মা ভাই আর সবশেষে বছরের এই বিশেষ কটাদিনে আলোর মালায় সেজে ওঠা সুন্দরী তিলোত্তমা।

কলকাতার পূজোও অবশ্য এখন অনেক পাল্টে গেছে। ওদেশ ছাড়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে থিমপূজোর রমরমা, আর এখনতো সেটা ছাড়া কিছু ভাবার প্রশ্নই ওঠে না। বিগবাজেটের পূজোগুলোর পাশাপাশি ক্রমে মেজো, সেজো, এমনকী পাড়ার নেহাত রাস্তা জুড়ে পাণ্ডেল বানিয়ে এতবছরের চলে আসা একচালার পূজোগুলোতেও কিছু খড় লতাপাতা আর মাথার উপর ঘুড়ি বা লাটাই আটকে থিমপূজো চালু হয়ে গেছে। বেদীর উপর উপবিষ্ট মা দূর্গাই জানেন হয়তো কোন থিমের মুখ তিনি। সুনন্দার এইসব দেখনদারী চকচকে পূজোগুলো কোনোকালেই বিশেষ পছন্দের ছিল না। মায়ের সামনে যাওয়া তো দূর, চারিদিক থেকে পেল্লায় সাইজের ফ্যানগুলোর ঝড়ের গতিতে বইতে থাকা হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল আর শাড়ীর আঁচলে নাজেহাল হতে হতে মুখ তুলে দেখার আগেই ভিড়ের ঠেলায় প্যাণ্ডেলের বাইরে এসে পড়ে।  যদিওবা প্রতিমার মুখ কোনোক্রমে দেখার সৌভাগ্য হয়, আশেপাশ থেকে দশ বিশটা হাত ফোটো তোলার জন্যে এসে পড়ে। এসব পূজোয় ভিড় আছে, লোকেলোকারণ্য আছে, থিম আছে, দামী প্যাণ্ডেল- এ বলে আমায় দ্যাখ, তো ও বলে আমায়.., নতুনত্বও আছে, কিন্তু কোথাও যেন সেই প্রাণটা সুনন্দা আর খুঁজে পায় না। সেই কৌলিন্য, সেই আভিজাত্য যা ও ওর ছোটোবেলায় দেশের বাড়ীর পূজোতে পেতো। ঠাকুমার কোলের এক্কেবারে পাশটিতে গা ঘেঁষে বসে পূজো দেখা.. ধূনোর গন্ধ , ভোগের গন্ধ , কলাপাতার গন্ধ.. সেজোকাকুর চোখ বন্ধ অথচ কী নিঁখুত ভঙ্গিমায় করা সন্ধ্যারতি কিংবা, গুরুগম্ভীর স্বরে মন্ত্রচারণ, চণ্ডীপাঠ … উফ্, আজও সুনন্দার গায়ে কাঁটা দেয়।

এ’কয়টা বছরতো সুনন্দার পূজো কয়েকহাজার মাইল দূরের এই পরবাসেই কেটে গেলো। দেশের মতো উপচে পড়া ভিড় নেই, কোলাহল নেই, শব্দ নেই। কঠোর নিয়ম আর রুটিনের বেড়াজালে আটকা এ’পূজোয় কান পাতলে শুধু ফিসফাস, দামী শাড়ী গয়নার খসখস আর অসংখ্য DSLR -র ক্লিক ক্লিক শব্দ। দুদিনের পূজোতে প্রথমদিনেই যা কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান .. ব্যস্, ঐটুকুই। বাকীটা…. বাকীটা যে কী, সত্যি সুনন্দা ভেবে পেলো না। প্রাণহীন নৈ:শব্দ, যা তাকে হাঁফিয়ে তোলে এতলোকের মাঝেও। মনে মনে ভাবে, একটা সোনার কাঠি যদি পাওয়া যেত.. ও ছুট্টে গিয়ে এই মেকি দেখনদারী যাকিছু তার গায়ে  ছুঁইয়ে দিয়ে আবার সবকিছু আগের মতো প্রাণবন্ত করে দিতো। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর।

সুনন্দা খেয়াল করলো ফুলের গন্ধটা কেমন যেন ফিকে হয়ে আসছে ওর ঘ্রাণ থেকে, মনের এক কোন থেকে অন্যকোনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঢাকের আওয়াজের রেশটুকুও। আজ মঙ্গলবার, ঘড়ির সময় জানিয়ে দিচ্ছে আর একটু বাদেই শুরু হয়ে যাবে দৈনন্দিন ব্যস্ততা। যন্ত্রের মতো কিছু কাজ করে যাবে সারাটাদিন ধরে। হয়তো কোনো এক মুহুর্তে ওর নিজেরই দীর্ঘশ্বাস জমাটবাঁধা নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে একাকীত্বকে প্রকট করবে। আজও রাহুল ফিরলে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথাটা বলবে বলে স্হির করলো ও। রাহুলের উত্তর তার জানা,  তাও শেষ চেষ্টাটা করতে চায় সুনন্দা। ও জানে রোদ যত চড়া হবে স্বপ্নের রেশ, গন্ধ, ছেলেবেলার ফেলে আসা সেই পূজোর আমেজ রামধনুর সাতরঙ’এর মতো রঙীন করে রাখা সুনন্দার আকাশ থেকে মিলিয়ে যাবে। রূপকথা ধীরে ধীরে বাস্তবের মুখোশ পরবে। একরাশ মনখারাপ এই শরতের আকাশেও ঈশানকোনে জড়ো হওয়া হঠাৎ একটুকরো ঘন কালো মেঘের মতো এসে জমা হলো। সুনন্দা জানে, এর থেকে আজ আর ও বেরোতে পারবেনা, এ মেঘ জমতে জমতে হয়তো রাতের কোনো এক মুহুর্তে অঝোরে ঝড়ে পড়বে নরম বালিশে।হয়তো ওর অশান্ত মন আবারও ডুব দেবে স্মৃতির অতলে…
দৈনন্দিন যান্ত্রিকতার জীবনে অযান্ত্রিক চাওয়া পাওয়াগুলোর মূল্য কখনও আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।

সুনন্দার মতো কারো কারো হয়তো সব পেয়েছির দেশেও কিছু হারানোর যন্ত্রনাটা অনেক বেশী থাকে..!!

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Sudip Kr Das October 8, 2018 at 1:43 am

    Splendid

  • সজ্জ্বল দত্ত April 1, 2019 at 7:14 pm

    অনুভূতির গভীর থেকে তুলে আনা লেখা । লেখার স্বতঃস্ফূর্ততা , কয়েকটি অনুষঙ্গভিত্তিক রূপকের প্রয়োগ ভীষণভাবে টানল । নামকরণ অতুলনীয় । সবমিলিয়ে খুবই সুন্দর ! …. লক্ষ্য রাখব ভবিষ্যতে এই লেখিকার গল্পের ওপর ।

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল