প্রিয় যুবি,
দিনটা তাহলে অবশেষে এসেই গেল। অবশ্য তা পেশার বিভিন্নতা সত্ত্বেও প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে। থামতেই হয় একদিন না একদিন। এতে অস্বাভাবিক কিছু খোঁজার উপায় নেই। কিন্তু এমন ভাগ্যবান মানুষ কমই আছেন, যাঁদের বিদায় দিতে অন্যদের মন চায় না। যাঁরা হয়ে ওঠেন রোজকার পথ চলার সাথী। আপনি সেই বিরল মানুষদের অন্যতম, যুবি। আপনাকে নিয়ে কিছু বলতে বসলেই অবধারিতভাবে এসে যায় ক্যান্সার প্রসঙ্গ। সেই প্রসঙ্গ তো এই পত্রলেখক ও টানবে, কিন্তু তার আগেও তো কত কথা বলার। আচ্ছা যুবি, নিরপেক্ষভাবেই বলুন, কি আছে আপনার কেরিয়ারে? আপনার ব্যাটিং রেকর্ড সচিন বা বিরাটের ধারেকাছেও নয়, দ্রাবিড়ের মত নির্ভরযোগ্যতা ও কোনদিন অর্জন করতে পারেননি। ওয়ান ডে ক্রিকেটে ৩৬ এবং টেস্টে ৩৩ গড় রাখা একজন ব্যাটসম্যান আপনি, যাঁকে পরিসংখ্যানের নিরিখে নিছক মধ্যবিত্ত ক্রিকেট গৃহস্থের বেশি কোনও সম্মান ই দেওয়া যায় না। তবে কেন আপনাকে নিয়ে এত আবেগের বিস্ফোরণ? রহস্যটা কি, যুবি পাজি?
রহস্যের উত্তর কি লুকিয়ে আছে ২০০০ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নাইরোবির মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আপনার আবির্ভাবের মুহূর্তেই যেখানে খেলে এসেছিলেন এক ম্যাচ জেতানো ইনিংস? উত্তরটা কি সত্যিই আপনি দিয়ে আসেননি ২০০২ সালের লর্ডসের সেই বিখ্যাত দুপুরে যখন মহম্মদ কাইফকে সঙ্গী করে ইংল্যান্ডের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে দেশকে আপনি দিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে ট্রফি জয়ের স্বাদ? উত্তরটা কি পাওয়া যায় না ২০০৭ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্টুয়ার্ট ব্রড কে হাঁকানো আপনার ছয় ছক্কায়? এবং, ২০১১ বিশ্বকাপে যখন কার্যত একার হাতে পুরো টুর্নামেন্টে রাজ করে দেশের স্বপ্ন পূরণ করে, মুম্বাই এর সেই অলৌকিক সন্ধ্যেয় যখন ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্টের ট্রফিটা হাতে নিয়ে চোখের জলে ভিজিয়ে দিচ্ছেন সতীর্থের জার্সি, উত্তরটা কি তখন সত্যিই অস্পষ্ট থাকে? আপনি যে লড়াইয়ের প্রতীক। আপনি যে জীবনের প্রতীক। আপনি যে স্পর্ধার প্রতীক। যে স্পর্ধা হারতে জানে না। হারতে শেখে নি। একটা গোটা প্রজন্ম কে যে স্পর্ধা স্বপ্ন দেখতে শেখায়। শেখায় কি করে লর্ডসের বুকে ইংরেজ অহংকার চূর্ণ করে তেরঙ্গা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শেখায় অভিষেকেই কিভাবে ম্যাকগ্রা, ওয়ার্নের দুর্দমনীয় অজি বোলিংকে পিটিয়ে দেশকে জেতাতে হয়। শেখায় কিভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে হয়, শেখায় যদি তার জন্য এক ওভারে ছয় ছক্কার প্রয়োজন হয়, সেই লক্ষ্যেই ছুটতে হবে।
আর, যুবি, আপনিই তো দেখিয়েছেন মার্চ এপ্রিলের অসহ্য গরমের মধ্যে কিভাবে ক্যান্সার রোগের জীবাণু শরীরে ধারণ করে, ব্যাট আর বল দুই বিভাগেই রাজ করে দাপটের সাথে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হয় ক্যাপ্টেনের হাতে সেই বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দিয়ে। ২০১১ সালের ২ রা এপ্রিল, সেই অলৌকিক রাতে, যখন মাঠ জুড়ে বাজছে বন্দেমাতরম, যখন ক্রিকেট সাম্রাজ্যের মুকুট আমাদের এই সমস্যা দীর্ণ ভারতমাতার উন্নত মস্তকে, যখন আমাদের সবার বুকের মধ্যে বেজে চলা জনগণমন ভিজিয়ে দিচ্ছিল পুরো দেশের হৃদয়, আপনি তখন অঝোরে কেঁদে চলেছেন আপনার সতীর্থদের বুকে মুখ গুঁজে। আপনার চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল আমাদের চোখ ও, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি, কি মারণ রোগ বুকে রেখে আপনি এনে দিলেন ২৮ বছরের সাধনার ধন। কল্পনার বাইরে ছিল যে, পাঁচ মাসের মধ্যেই বস্টন ক্যান্সার সেন্টারে কেমোথেরাপির জ্বালায় ছট্ফট করবেন আপনি। আবার সেই দিনটা যখন সত্যিই এলো, কোনোদিনই ভাবিনি যে ক্যানসারকে হারিয়ে আপনি আবার ফিরে আসবেন সবুজ ঘাসে, আপনার প্রিয় স্থানে। আবার জায়গা করে নেবেন ভারতীয় দলে। খেলবেন আইসিসি টুর্নামেন্টেও। আজ ফিরে তাকালে মনে হয়, কেন ভাবিনি? আপনি যে যুবরাজ, অসম্ভবকে সম্ভব করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে যে আপনি সিদ্ধহস্ত। আপনার ক্রিকেটীয় কেরিয়ারকে কোনও অবস্থা তেই অসাধারণ বলা চলে না, কিন্তু আপনি নিজেও কি জানেন আপনার বিশেষত্ব? অস্ট্রেলিয়া যেমন বিশ্বাস করত, যেদিন কেউ খেলবে না, খেলবে স্টিভ ওয়া, ভারতের ক্ষেত্রেও সেই স্থানটি নিয়েছিলেন আপনি। ২০০২ NatWest ফাইনালে ১৪৫ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাবার পর ৩২৫ রান তাড়া করে অসম্ভবকে সম্ভব করে ব্রিটিশ দর্পকে চূর্ণ করতে পেরেছিল ভারত আপনার অসাধারণ দক্ষতায় ভর করে। ২০০৭ সালের টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে যখন ভারত খেলতে যায়, ভারতের ঝুলিতে ছিল সাকুল্যে ২টি কুড়ি ওভারের ম্যাচের অভিজ্ঞতা। ভারতকে সফল হতে হলে আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে, জানতেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ছয় ছক্কা বা অস্ট্রেলিয়াকে পিটিয়ে ৩০ বলে ৭০ হাঁকিয়ে সেই চাহিদার যোগ্য নিবৃত্তির ব্যবস্থা ও করলেন। ২০১১ তো রূপকথা। ফর্মে না থাকা আপনাকে কেন টিমে রাখা হল, তাই নিয়েই বিশ্বকাপের আগে সরব ছিল ক্রিকেট জনতা। সেই আপনিই ২ এপ্রিল নিয়ে গেলেন সিরিজ সেরার ট্রফি। আচ্ছা যুবি, সত্যি বলুন তো, লোককে বোকা বানাতে আপনার ভালো লাগে, তাই না? নাহলে এতবার অলৌকিক কাণ্ডকারখানা আপনার কাছ থেকে আসে কি করে? আপনি বলবেন যে, ক্যানসারকে যে হারাতে পারে, তার কাছে এসব আর কি এমন? সত্যিই হয়ত এমন কিছু না।
কিন্তু ভারতকে ক্রিকেট বিশ্বের রাজা বানাতে যুবরাজের ভূমিকার কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। আসলে আপনি একজন যোদ্ধা। পাঞ্জাব কা পুত্তর আপনি, লড়াই আপনার রক্তে এটা ঠিকই। ছোটবেলা থেকে অশান্তির পরিবারে বড় হতে হতে, বাবা যোগরাজের ইচ্ছেপূরণ করতে করতে আপনি ক্লান্ত হন, আবার লড়াই করে বেঁচে থাকার রসদ ও সংগ্রহ করেন। পরবর্তীকালে বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর লড়াই চালাতে চালাতেও ক্রিকেট জীবনের লড়াই এর রসদ জোগাড় করে নিয়েছিলেন, তাই তো চোখ ধাঁধানো সব ভারতীয় সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে যান আপনি। বিরাট বা সচিন সবাই হন না, কিন্তু সেই বিরাট বা সচিন পরবর্তীকালে নিজেদের দলে আপনাকে দেখতে মুখিয়ে থাকেন। যুবি, এখানেই আপনি অনন্য। অনুপ্রেরণা আপনি, যুবি পাজি। আমাদের সবার। কিন্তু অনুযোগ ও থাকল কিছু। সবথেকে বড় অনুযোগ, লাল বলের ক্রিকেট টা বখাটে রাজপুত্রের মতই খেললেন। সৌরভ থেকে ধোনি, গুরু গ্রেগ থেকে গুরু রবি, সবাই বিশ্বাস করেন টেস্ট ক্রিকেটেও দলের সম্পদ হতে পারতেন আপনি। কিন্তু আপনি সাদা বলের ক্রিকেটে যতটা দেশকে দিলেন, লাল বলের ক্রিকেটে না।
তার মধ্যেও চোখে ভাসে করাচির সবুজ পিচে শোয়েব আখতার কে তুলোধোনা করে আপনার শতরান। ওরকম ইনিংস বেশি পাওয়া গেল না, ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে ক্রিকেটার যুবরাজের কাছে আক্ষেপ রয়েই গেল। ক্যান্সার পরবর্তী সময়ে পুরনো যুবি আর ফিরে এল না, আক্ষেপ থাকলেও পরিস্থিতি বিচার করলে এটা অস্বাভাবিক মনে হয় না। তার মধ্যেও বার্মিংহামে মহম্মদ আমিরকে সামলে আপনার ম্যাচ জেতানো ইনিংস বা ঢাকায় অস্ট্রেলিয় বোলিংকে ছাতু করে ভারতকে ম্যাচ জেতানো ভুলব না। সম্ভবত শারীরিক কারণেই পুরোনো যুবরাজকে আর পাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ অনুযোগটি একেবারেই ব্যক্তিগত। ছাড়তে কি সত্যিই একটু বেশিই দেরি করলেন না? সদ্য শেষ হওয়া আইপিএলের নিলামে আপনাকে দলে নিয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের তরফে আকাশ আম্বানি বলেছিলেন, এটা আপনার প্রতি শ্রদ্ধা। না, যুবি, না। আপনি তো ভারতীয় ক্রিকেটের যুবরাজ। আম্বানিদের করুণার পাত্র তো নন। খেললে পারফরম্যান্স দিয়েই খেলবেন, যেটা করে এসেছেন। কারোর দয়ার দান কেন নেবেন আপনি? হয়ত ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এতদূর টেনে নিয়ে এলো আপনাকে। কিন্তু মানতেই হবে, ক্রিকেট আপনাকে যা দিল, তার থেকে ঢের বেশি ক্রিকেটকে দিলেন আপনি। এই ছোটখাটো অনুযোগ গুলো আপনাকে নিয়ে মুগ্ধতার তুলনায় কিছুই নয়।
লড়াকু, যোদ্ধা, হার না মানা মানসিকতার মূর্ত প্রতীক যুবরাজ সিং! অনেক অনেক ধন্যবাদ, উনিশ বছর ধরে দেওয়া বিনোদনের জন্য, লড়তে শেখানোর জন্য, ভারতবাসী হিসেবে মাথা উঁচু করে দেওয়া মুহূর্ত এনে দেওয়ার জন্য। জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসেও দেখা যাবে চোয়াল চাপা যুবি ম্যাজিক, নিশ্চিত। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন। ইতি, কোটি কোটি ভক্তের এক মুগ্ধ প্রতিনিধি