ভ
( ১ )
আলো দেওয়ালে টানানো অর্ধবৃত্তাকার কাঠের ফ্রেমের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো । অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ , যেন অন্য কোনো এক অপরিচিতা তরুণীকে দেখছে । পরনে মরচে রঙের তাঁতের শাড়ি , কপালে নীল টিপ , আর তার নিচে একজোড়া তন্দ্রালু চোখ বাইরে চাঁদের আলোয় টিমটিম করছে । এলোমেলো চুলের ফাঁকে অচেনা মুখটাতে একরাশ বিস্ময় মাখানো । আয়নার জটিল প্রতিবিম্বটার ফাঁকে আলো খুঁজতে থাকে তার সেই হারিয়ে যাওয়া অতীত । নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পাবার পর একটা বছর যেন একটা তারার মত মনের আকাশ থেকে খসে গেছে । কিন্তু আলো নিজেকে কখনও অমন করে দেখেনি , দেখার চেষ্টাও করেনি । সে তো ভালই আছে আশ্রমের ঐ ফুলের মত ছোট ছোট শিশুগুলোর সাথে । সকাল হলেই একরাশ মাতাপিতাহীন কচি কচি মুখ তার দিকে “ আলো আনটি আলো আনটি ” বলে ছুটে আসে । কিন্তু কালকে ঐ ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হবার পর তার মনে যে কি হল সেই কথায় বারবার চিন্তা করতে থাকে আলো ।
রাত বারোটা , একটা স্বপ্ন দেখে আলোর ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে । আয়না থেকে জানলার কাছে সরে এল সে । আকাশে আধফালি চাঁদ থেকে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলোর ওপর । সারাদিন বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বড়দিনের মেজাজ কাটানোর পর আজ একটু যেন ক্লান্তিই লাগছিল তার । আলো কাঁচের জানলা দিয়ে রাতের আকাশ দেখছিল , ছোট বড় নক্ষত্র ঝিকমিক করছে … এরোপ্লেনের সাঁ সাঁ শব্দ … তারই মধ্যে থেকে কেউ যেন ওকে বলে ওঠে “ আলো আনটি ” । আলো চমকে ওঠে … এ গলা আশ্রমের কোনো শিশুর নয় … কিন্তু খুব চেনা , যেন বহুবছর আগে শোনা এক মিষ্টি গলার স্বর , আজ রাতে স্বপ্নে যাকে সে দেখেছিল । আলোর কিছু ভাল লাগছে না । বহুবছর আগের কোনো ঘটনার যোগবিয়োগ ওর মাথাকে যেন চেপে ধরেছে ।
কফিমগ থেকে এক গ্লাস কফি ঢেলে সে নিমেষের মধ্যে শেষ করে ফেলে সেটা । আজ কেন যেন তার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে সে এই আশ্রমে এল কিভাবে ? নার্সিং হোমে তার কি হয়েছিল ? আলো গায়ে কোটটা চাপিয়ে মাফলারটা জড়িয়ে বাইরে আসে । দার্জিলিঙের ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা আর চাঁদনী রাতের অপরূপ সৌন্দর্য আজ তার দৃষ্টি প্রত্যক্ষতায় এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেনি । আশ্রমের গেটের বাইরে কারুকার্যপূর্ণ সুনীল দেওয়ালটা কুয়াশার মোড়কে মোড়া । আলো শ্লথ পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সবুজ গাছপালার খাঁজে ভাঁজে হিমের থমথমে সাদা ছবি , মস্ত বড় ঝাঁকড়া জলপাই গাছটার মাথায় সাদা তুষার , আর পেছনে কালো মেঘের ছায়া দেখতে থাকে । মন প্রাণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে আজ আলো রাতকে দেখতে থাকে । খুঁজতে থাকে আবছা স্মৃতি । অনুভূতি দিয়ে গন্ধ উপভোগ করতে থাকে । কান দিয়ে নৈশব্দের গুঞ্জন শুনতে শুনতে আলো আশ্রম ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে চলে । সেই গভীর খাদটার সামনে চলে আসে সে । রাত্রির অন্ধকারে উড়ে যায় প্যাঁচা । মনে হ্য় আকাশের একফালি চাঁদের বিষণ্ণ আলোতে এক পোচ কালি ঢেলে উড়ে যায় । আর ভয়ংকর এক কর্কশধ্বনি সেই খাদটার চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয় । অন্ধকার আর কুয়াশার মাঝে খাদটার গভীরতা আন্দাজ করতে পারে না আলো । জায়গাটা কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগে । চোখ বন্ধ করলেই আলো যেন দেখতে পায় চারটে মুখোশধারী লোক তাকে ঐ অন্ধকার কূপে ঠেলে দিচ্ছে । আলোর মনে পড়ে যায় কাল সকালের সেই ঘটনার কথা ………
( ২ )
আলো সবুজ ঘাসের গালিচায় পাতা এক আরামকেদারায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে । বাইরে ডিসেম্বরের নরম কুয়াশার পাউডার , খুনে রঙ মাটির ওপর অফুরান সবুজের বন্যা । দূরে পাহাড়ের কপালে জঙ্গলের ঘোমটায় লাল টিপের মত সূর্য ।
“ আলো ভালো আছিস ? ”…… এক অপরিচিত গলার স্বর শুনে আলো মুখ তুলে তাকায় ।
“ চিনতে পারলি না ? আমি চন্দ্রা রে । চন্দ্রানী বসু । ”
আলো আগতা নারীটির দিকে তাকিয়ে নিখুঁত জরিপ সেরে নেয় । ছোটখাটো চেহারা , গোল চাপা মুখ , পরনে শীত পোশাক , আর কপালে বেশ বড় করে সিঁদুরের টিপ ।
“ জানতাম ভাই চিনতে পারবি না । আমি তোর বান্ধবী রে । চন্দ্রাকেও ভুলে গেলি ? তোকে নার্সিংহোমে এসে প্রত্যেকদিন দেখে যেতাম । তুই পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছিলি … মাথার পেছনে আঘাত লেগেছিল … তোর কি কিছুই মনে পড়ছে না ? ” …… আলো অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে চন্দ্রার দিকে … চন্দ্রাকে সে সত্যিই চিনতে পারেনি । মনে মনে ভাবে নার্সিংহোমে জ্ঞান ফেরার পর প্রথম সে চন্দ্রাকেই দেখেছিল । তার কি বাবা মা কেউ নেই ? খুব জানতে ইচ্ছে করে আলোর , কিন্তু কিছু মনে পড়ে না ।
সেদিন আলো চন্দ্রার ফ্ল্যাটে যায় । চন্দ্রা একটা এ্যালবাম বের করে আলোকে দেখায় । আলোর বাবা মায়ের একটা ফটো ছিল … পাশে আলো দাড়িয়ে । আলো ছবিতে নিজেকে ছাড়া কাউকে চিনতে পারে না ।
“ আমার বাবা মা কোথায় ? ” …… নিস্পলক চোখে তাকায় আলো ।
“ তোর মা একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় । আর বাবার ব্রেন টিউমার হয়েছিল । অপারেশনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দরকার ছিল । তুই আমার কাছে চেয়েছিলি । দিতে পারিনি ভাই ক্ষমা করিস । তার জন্যই …… ”
আলোর চোখটা ছলছল করে ওঠে । কোনো কথা বলে না সে । একমনে এ্যালবামের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থামে । পাঁচ ছয় বছরের একটা ফুটফুটে ছেলের ছবি । আলোর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে । সেই পুরনো চেনা গলার স্বর আবার তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুরণিত হতে থাকে …… “ আলো আনটি … ও আলো আনটি … মিস ইউ আলো আনটি । ” এক পলকে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে ।
চন্দ্রা বলে ওঠে …… “ আমার ছেলে দীপ । ”
“ কোথায় ? ” …… আলো জিজ্ঞেস করে ।
“ সে আজ আমার কাছে নেই রে ভাই । তুই কি সব ভুলে গেছিস আলো ? দীপের সাথে তুই না কত খেলা করতিস । তোর সাথে ছাড়া ও নার্সারি স্কুলে যেত না … তোকে আনটি বলতো … তোর কিছু মনে পড়ছে না ? একদিন কয়েকজন গুন্ডা দীপকে তুলে নিয়ে গেল । এক লাখ টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল করতে থাকল । কিন্তু বিশ্বাস কর তখন দীপের বাবার কাছে একসঙ্গে এতগুলো টাকা ছিল না রে । তোর বাবার তখন ব্রেন টিউমার । তোর কাছেই বা কি করে হাত পাতবো । তোকেও তো কিছু হেল্প করতে পারিনি আমি । তখন বুঝেছিলাম জানিস একটা মানুষের কাছে টাকার কত মুল্য । সেদিন মনে হয়েছিল তোর বাবার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী । পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলেও আমরা দীপকে ফেরত পেতাম রে … কিন্তু ওরা কোনো সময় দিল না । ” …… চন্দ্রা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে ।
আলো একদম পাথরের মত বসে আছে । আবছা স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে কাটাকুটি খেলছে ।
“ ওরা দীপকে পাহাড় থেকে খাদে ফেলে দিয়েছিল । তোর মনে নেই তুই কত কেঁদেছিলি ? তার পরের দিনেই তুইও তো পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে যাস । ”
আলোর মাথাটা দপদপ করে , কান দুটো গরম হয়ে আসে । সেই ডাকটা “ আলো আনটি … আলো আনটি ” কানের সামনে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে । দুহাত দিয়ে কান চেপে আলো চিৎকার করে ওঠে ।
(৩)
আলো ভাবনার জগত ছেড়ে বাস্তবে ফিরে আসে । রাত ঘনায়মান । কালো খাদটার নিচে মুঠো মুঠো কুয়াশামাখা নরম মেঘ । আকাশের চাঁদ ভেঙে চারদিক ভেসে গেছে আইভরি জ্যোৎস্নায় । মাধবীর গন্ধবিধুর শৈলজগতের সেই রাতে কোনো এক শৈশব স্বর আলোকে হাতছানি দেয় । কুয়াশার ফাঁকে শঙ্খচিলের বিশ্লথ ডানা দেখতে দেখতে আলো যেন বর্তমানের কথা ভুলে যায় …… এক ঝটকায় ওর মনে পড়ে যায় সব কথা । গভীর খাদটার বুকে আলো দেখতে পায় তার বাবার মুখ … চন্দ্রার কথা মনে পড়ে … দীপের কথা মনে পড়ে … এক এক করে সব মনে পড়ে যায় তার ।
বাবার অপারেশনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা আলো কোথাও না পেয়ে চন্দ্রার কাছে যায় । চন্দ্রাও ওকে ফিরিয়ে দেয় । টাকা যোগাড় করতে আলো পথে পথে ঘোরে … কিন্তু কে দেবে এতগুলো টাকা ? হাতে এসে যায় একটা সুযোগ । কাজটা করতে পারলেই ষাট হাজার । আগে পিছে কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না তার । বাবাকে যেকোনো উপায়ে বাঁচাতে হবে । তাই চারটে গুণ্ডার কথামত দীপকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করে আলো । ভেবেছিল চন্দ্রা ছেলেকে ফিরে পেতে ওদের প্রাপ্য এক লাখ টাকা দিতে বাধ্য হবে । আর কমিশনের ষাট হাজার টাকায় বাবার অপারেশন হয়ে যাবে … দীপকেও ফিরে পাবে চন্দ্রা । কিন্তু সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যায় । একেবারে এতগুলো টাকা চন্দ্রা ওদের দিতে পারেনি । দীপকে ওরা মেরে ফেলার হুমকি দেয় । আলো তা মনে প্রানে কখনও চায় নি । অনেক চেষ্টা করেছিল দীপকে বাঁচাতে । ওদের বলেছিল দীপের কিছু হলে আলো পুলিশের কাছে সব কথা বলে দেবে … নিজের ভবিষ্যতের পরোয়া ছিল না তার । এধরনের কথা ওরা কানেই নেয়নি । তাই দীপকে পাহাড় থেকে ফেলে দেবার পরের দিনই আলোকেও ওরা পাহাড়ের খাদে ঠেলে দিয়েছিল । তারপর বেঁচে ফিরলেও আলোর স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায় । নার্সিংহোম থেকে রিলিজ নেবার পর চন্দ্রাই আলোকে ঐ আশ্রমের সন্ধান দেয় ।
আলো ভাবতে ভাবতে খাদটার অনেক কাছে চলে আসে । সারা দার্জিলিং শহর তখন ঘুমে আচ্ছন্ন । সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃতবৎ নির্জন খাদটার দিকে চেয়ে থাকে আলো একপলকে । শরীরটা পালকের মত হালকা মনে হয় । উত্তুরে শীতল হাওয়া কালো শীতল হাত হয়ে আলোকে মরণ কূপে ঠেলে দেয় । আলো নিভে যায় অন্ধকারের মাঝে । আকাশের ভাঙ্গা চাঁদের আলোটাকে গিলে ফেলে একটা প্রকাণ্ড কালো মেঘ ।
শান্তনু দাস