“Blurred past evaporating from teardrops
Unending dreams carving an arc of smile
And a fleeting life,
Negotiating between the two”
নিজের জীবনের শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্টটি যখন করছেন সুশান্ত সিং রাজপুত, কি ভাবছিলেন তিনি? চোখের জলে নিজের প্রয়াত মায়ের সাথে পরপারে দেখা হবার জন্য সময় গুনছিলেন? নাকি নিজের চিত্রায়িত মহেন্দ্র সিং ধোনির চরিত্রের মতই ফিনিশিং এর মুখেও ছিলেন শান্ত ও অবিচল? উত্তরটা জানা যাবে না কোনোদিনই। এও হয় তো জানা যাবে না, তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের সবকিছু কেন একলহমায় অতীত করে দেওয়ার বেপরোয়া পদক্ষেপ নিতে পারলেন চৌত্রিশ বছরের যুবক!
জীবন সত্যিই বড় অদ্ভুত। ১৪ই জুন, ২০২০ সেটা আরও একবার প্রমাণ করল। অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ্য করলাম, যে ভারতে একের পর এক কৃষক অনাহারে, ঋণে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, সেই একই দেশে তুমুল জনপ্রিয় চিত্রতারকা ও একই পথের পথিক হতে পারেন। ঠিক কেন সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মঘাতী হলেন, কিভাবে সব পাওয়ার আড়ালে লুকিয়ে ছিল কোনও প্রাণঘাতী না পাওয়া, নাকি এসব ছাপিয়ে আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনও অভাবনীয় রহস্য, তা আমরা এখনো জানি না, হয় তো কখনোই জানা যাবে না উত্তরগুলো। যে সুশান্ত তাঁর সাম্প্রতিক ছবি চিচোরে তে আত্মহত্যা বিরোধী বার্তা দেন, সেই তিনিই যখন এই চরম পথ বেছে নেন, বোঝার সময় এসে গেছে অবসাদ বা ডিপ্রেশনের মত রোগটির নেতিবাচক গুরুত্ব।
সুশান্তের সাফল্যে মোড়া বলিউড কেরিয়ারের কথা তো প্রত্যেকেই জানেন। বাস্তব হল এই যে, সুশান্ত যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অধিকার থেকে ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে প্রথম স্থান, স্মিত হাসির সদ্য প্রয়াত যুবকের প্রতিভার ছাপ সর্বত্র। দিল্লিতে পড়তে শুরু করেছিলেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংও, যদিও রুপোলি পর্দার কেরিয়ার শুরু হয়ে যাওয়ার পর সেই পর্বে দাঁড়ি টানতেই হয় তাঁকে। টিনসেল টাউনের সঙ্গে জড়িত বহু সাংবাদিক বিশ্বাস করেন, সরকারি বা বেসরকারি উচ্চপদে চাকরি করার মত প্রতিভা সুশান্তের অবশ্যই ছিল। কিন্তু, অন্য ধাতুতে গড়া ছেলেটির গতানুগতিক জীবন ভাল লাগেনি। ভাগ্যিস লাগেনি! নাটক দিয়ে হাতেখড়ি, তারপর টিভি সিরিয়াল এবং সবশেষে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। বাকিটা ইতিহাস।
আপাতদৃষ্টিতে ঝকঝকে, সদা হাসিখুশি প্রাণবন্ত, জীবনের একাধিক মাঠে সাফল্যের সঙ্গে জয়ের পথে এগিয়ে যাওয়া সুশান্তের জীবনে অবসাদ? চোখ ধাঁধানো ছাত্রজীবন, বলিউডের মত ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন প্রজন্মের অন্যতম সেরা অভিনেতার সুনাম, ঝুলিতে কাই পো চে, শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স, ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী, এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি, কেদারনাথ, রাবটা- একের পর এক বিগ বাজেট ছবি, মহেন্দ্র সিং ধোনি বা ব্যোমকেশ বক্সীর মত আইকনিক চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ও সাফল্য, কোটি ভক্তের প্রিয় নায়ক, হাজারো তরুণীর স্বপ্নের পুরুষ এই সুদর্শন তরুণের জীবন মাড়িয়ে দিয়ে কিভাবে চলে যেতে পারে অবসাদের রোড রোলার? ঘটনা হল, পারে! অন্তর্মুখী এই অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবন? সেটি কি খুব সুখের ছিল? সম্ভবত নয়, নিবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত ইনস্টাগ্রাম পোস্টেই তার প্রমাণ আছে। নিজ পরিবারে যে মানুষটির উপর সবথেকে ভরসা করতেন তিনি, সেই মায়ের জীবনাবসান যখন ঘটে, তখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। প্রিয় মানুষটি নিজের পুত্রের তুমুল জনপ্রিয়তা আর দেখতে পেলেন কই! সুশান্ত বহুবার আক্ষেপ করেছেন নিজের অকালে মৃতা মায়ের স্মৃতিচারণ করে, কারণ তিনি মনে করতেন জীবন খুবই কম সময়ের জন্য তাঁকে মাতৃসঙ্গ দিয়েছে, যা যথেষ্ট ছিল না। সেই যে একাকিত্বে ভোগা শুরু করলেন তিনি, সমস্যাটির শেষ আর খুঁজে পেলেন না। জীবনে এল একাধিক সম্পর্ক। কখনও বা সিরিয়াল সহ অভিনেত্রী অঙ্কিতা লোখান্ডে, কখনও নায়িকা কৃতি সানোন বা দিশা পাটানির সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাঁর, সাম্প্রতিকতম সময়ে বাঙালি বংশোদ্ভুত অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে বহু নিউজপ্রিন্ট খরচ করেছে মিডিয়া। সুশান্তের দুর্ভাগ্য, মায়ের কাছ থেকে যে মানসিক শান্তি ও সুরক্ষা তিনি পেতেন, বহু চেষ্টা করেও সেই স্থিতি তিনি আর পেলেন না। ছাত্রজীবনের শেষ থেকে মৃত্যু, পুরো সময়টাই একাকিত্বে ভুগেছেন ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার জয়ী এই প্রতিভাশালী অভিনেতা। মুম্বইয়ের গ্ল্যামার জগতেও নিজেকে খুব ভালভাবে মিশিয়ে দিতে পারেননি তিনি। কোনও গডফাদার ছাড়াই নিজের স্ট্রাগলের জোরেই মুম্বইয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছিলেন সুশান্ত, কিন্তু ফিল্মি দুনিয়ায় যে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তা বলা চলে না। বলিউডে তাঁর বন্ধু সংখ্যা হাতে গোনা, শান্ত স্বভাবের এই যুবকের মুম্বইয়ের পার্টি কালচারে ও রুচি ছিল না। অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন নিজের প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়েনকে, যিনি মাত্র পাঁচদিন আগেই মুম্বইয়ের বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে আরো ভেঙে পড়েন বহু আগে থেকেই অবসাদের চিকিৎসার আওতায় থাকা সুশান্ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র শোক উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। কি অদ্ভুত, তার ঠিক পাঁচদিন পরেই একইভাবে পৃথিবীকে আলবিদা জানালেন অভিনেতা নিজেই। দুই ঘটনার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্ক আছে বলেই মনে হলেও, সম্পূর্ণ বিষয়টি পুলিশি তদন্তের পরেই জানা সম্ভব। কিন্তু এটুকু তো বোঝাই যায় যে, ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাসে, মাকে হারানোর মধ্যে দিয়ে যে ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের খেলা শুরু হয়েছিল তরুণ অভিনেতার জীবনে, সেই খেলার প্রাবল্য দিনের পর দিন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, এবং চরম পরিণতি লাভ করে এই অভিশপ্ত দিনেই, যেদিন মায়ের সঙ্গে কাটানো জীবনের সোনালী দিনগুলির স্মৃতি রোমন্থন করে, দড়ির ফাঁসে নিজের গলাটি ঢুকিয়ে দিতে আর দ্বিধা করলেন না তিনি।
সুশান্ত সিং রাজপুত আর আমাদের মাঝে নেই, চলে গেছেন অগণিত ভক্ত, গুণমুগ্ধ কে কাঁদিয়ে। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি? নিঃসন্দেহে অপূরণীয়। ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে মহেন্দ্র সিং ধোনির ছক্কা মেরে বিশ্বজয়ের দৃশ্যে অনবদ্য অভিনয় করে লাখো মানুষকে কাঁদিয়েছিলেন সুশান্ত। সেই নিখুঁত ফিনিশিং এর দৃশ্যে জমাটি অভিনয়ের দ্বারা সুশান্তের অভিনয়জীবনের নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছিল। নিজের জীবনের ফিনিশিংয়ে টাইমিংটা ঠিক হল কি? ফাঁসটি গলায় জড়ানোর সময় সুশান্ত হয়তো ভেবেছেন আরো একবার অনবদ্য টাইমিংয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ এই ফিনিশিংটি তিনি ঠিকঠাক করতে চলেছেন, কিন্তু ঘটনা হল, এক্ষেত্রে তিনি ফিনিশিং এর সময়টিই ভুল বেছে ফেললেন। ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও কিন্তু ক্রিজে ছিলেন সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি, ম্যাচ ফিনিশের অত্যন্ত কাছে পৌঁছে ও মুহূর্তের ভুলে রান আউট হয়ে চোখের জল সামলাতে সামলাতে ফিরে যান তিনি, তরী ডুবে যায় ভারতের ও। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফিনিশার ব্যর্থ হন দেশকে ফিনিশিং লাইন পার করে দিতে। ঘটনাচক্রে রিল লাইফের ধোনি ও জীবনের ফিনিশিং লাইনটা পার করতে বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেললেন, আরও একটু সময় কি নিতে পারতেন না? বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তাড়াহুড়ো না করে পুরো পঞ্চাশ ওভার ক্রিজে থাকলে ধোনি যে ভারতকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়তেন, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তেমনই, জীবনের চৌত্রিশতম বছরটিকেই ফিনিশিং এর জন্য বেছে না নিলে জীবনের ইনিংসটা আরও দীর্ঘায়িত করতে পারতেন তিনি!
ধৈর্য ধরলে কিছুদিন পরেই হয়তো আবিষ্কার করতেন যে, ২০১১ বিশ্বকাপের মহেন্দ্র সিং ধোনির মতই চরম সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন! সে সময়টুকু আর নিজেকে দিলেন না পর্দার মাহি!
কেন এমন হলো 😟