29 এপ্রিল রাতে অফিস থেকে অটো এ বাড়ি ফিরছিল অতনু আর সৌমিক, দুজনেই চাকরি করে সেক্টর V এর XYZ ENTERPRISE এ, সেক্টর V এ এদের বিরাট ক্যাম্পাস। তাতে এদের সবকটি সংস্থার ই অফিস আছে, যথা ব্যাংকিং সাপোর্ট , ইনসিওরেন্স, IT, টেক সাপোর্ট ইত্যাদি। অতনু রা আছে ব্যাংকিং এ, অটো য় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল “আর ভালো লাগেনা , মার্চে ইয়ার এন্ডিং ছিল তখনও বাড়ী ফিরতে 11টা বাজতো , এখনো 11 টা বাজছে। একটা দিনও আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারলাম না, ওদিকে ইন্সিওরেন্স এ র ছেলেগুলোকে দেখ আটটার মধ্যে বাড়ি গিয়ে IPL নিয়ে বসে আছে”। সৌমিক বলল ” এরকম বলিস না সেদিনই ইনসিওরেন্স এর তরুণের সাথে কথা হচ্ছিল, বলল রাতে গিয়ে কাস্টমার কে ফোন করতে হয়, নতুন পলিসি করানোর জন্য কনভিন্স করতে হয়, বাড়ি গিয়েও শান্তি নেই ওদের আর ওদের তো স্যলারিও দেয় না ঠিক ঠাক, ব্যাংকিং এ তবু মাসের শেষে স্যলারিটা ঠিকঠাক আছে”। অতনু চিৎকার করে বলল ছাই ঠিক আছে! দুজনের টাকায় 3 জনকে কাজ করাচ্ছে, সকাল 8 টায় বাড়ি থেকে বের হচ্ছি, রাত 11 টায় বাড়ি ফিরছি কি আছে লাইফের,নিজের ছেলেটাকে তো horizontally বড় হতে দেখছি vertically আর দেখতে পাচ্ছি না। আর তাপস কে তো দেখলিই ওতো হসপিটালে এডমিট হয়েছে। কোম্পানি থেকে সস্তায় লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে এখন কোম্পানি ওকে স্লেভ বানিয়ে রেখেছে , নরমাল কাজের সঙ্গে রিকভারি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বও ও কে দিয়েছে, গত সপ্তাহে গেছিল ডিফল্টার দের থেকে পেমেন্ট আনতে, পিটিয়ে হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়েছে। দেখতে গেছিলাম গিয়ে দেখি ওর বৌ কান্নাকাটি করছে সান্তনা দিয়ে চলে এলাম কিন্তু আমাকে কে সান্ত্বনা দেবে।” সৌমিক বলল ” ভাগ্যের পরিহাস কি আর করা যাবে, ওসব ছাড়, আগে বল 1 তারিখ তো ছুটি, মে ডে, চল অ্যাভেঞ্জার টা দেখে আসি “।
অতনু বলল ” টিকিট পাবি? শুধু তো আর আমরা দুজন যাব না, গেলে তো সবাইকে বলতে হবে অন্তত 8-10 জন তো হবেই “। সৌমিক বলল ” চাপ নিস না, দরকারে সকাল 10 টার শো এ যাব, কিন্তু দেখব সবাই মিলেই “। এরমধ্যে অটো উল্টোডাঙা চলে এলো ওরা নামতে অটোওয়ালা বলল ” দাদা 140 টাকা দিন”। ওরা অবাক হয়ে বলল ” একি 35 টাকা করে ভাড়া আর তুমি 70 টাকা করে চাইছো ” ? অটোওয়ালা বলল “দেখুন দাদা রাত 11 টার সময় দামাদামি করবেন না নিয়ে এসেছি তাই বাড়ি যেতে পারছেন, না হলে তো থেকে যেতে হত, জানেন না সাড়ে দশটার পরে ডবল দিতে হয় “। ওরা আর ঝামেলা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিল।
পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে বলতেই অনেকে রাজি হয়ে গেল, মোট 10 জন ঠিক হল। ব্যাংকের অতনু, আশীষ, সৌমিক আর রেবতী, ইনসিওরেন্স এর তরুণ, বিজয়, সুন্দরাম এবং টেক সাপোর্ট এর ইব্রাহিম, সুনিধি ও সুচেতনা সবাই ঠিক করল লাঞ্চ আওয়ারে টিকিট কাটা হবে। ঠিক দুপুর 1 টার সময় HR থেকে mail এল, যে আগামীকাল মে দিবস উপলক্ষে অফিসের ও এলাকার অসংরক্ষিত কর্মীরা একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন এবং সেই অনুষ্ঠানে অফিসে সকলের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ” । অফিসে সকলে যেন ক্ষোভে ফেটে পরলো অতনু ও সৌমিক দৌড়ালো ম্যানেজার প্রশান্ত সেনের কেবিনে, গিয়ে বলল স্যার এটা কি হচ্ছে ? এভাবে ছুটির দিনেও আমাদের আসতে বাধ্য করা হচ্ছে, এটা তো আর ইয়ার এন্ডিং না, তখন আমরা রোববার এও কাজ করে দি, এখন 11th Hour এ এভাবে ডেকে পাঠানো হচ্ছে তাও অফিস বহির্ভূত ব্যাপারে, এটা কি ঠিক হচ্ছে ? আমাদের সবারই পার্সোনাল লাইফ আছে আপনি কিছু একটা করুন, আর তাছাড়া আমরা তো আর লেবার না আমরা কি করবো এই অনুষ্ঠানে ?” প্রশান্ত বললেন “আমি কি করব ভায়া, আমিও তো ফেঁসে গেছি, বউকে বলে রেখেছিলাম কালকে আমরা আউটিং এ যাব, গেল সেই প্ল্যান ভেস্তে, এখন বাড়ি ফিরে ডায়লগ খেতে হবে। আরে বুঝছো না আমাদের MD তো রুলিং পার্টি তে যোগ দিয়েছেন এখন ভোটের আগে কত কি দেখতে হবে কিচ্ছু করার নেই কাল আসতেই হবে সবাইকে ” ।
পরের দিন একটু দেরিতে সকাল 10:30 এ সবাই অফিসে চলে এলো। এসে দেখল পার্কিংয়ে বড় মঞ্চ হয়েছে কোম্পানির কয়েকজন ডাইরেক্টর সেখানে আছেন, লোকাল বিধায়ক ও সাংসদ আছেন এবং অফিসের সব ড্রাইভার, ক্যান্টিনের কর্মী,ইলেকট্রিশিয়ান,ঝাড়ুদার এবং অন্যান্য সাপোর্ট স্টাফ সবাই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ে মঞ্চের এক পাশে বসে আছেন এবং তাদের সঙ্গে আছে এমন কিছু লোক যারা এই অফিসের নয় কিন্তু তাদের অনেককেই সবাই চেনে যেমন উল্টোদিকের হোটেলের হরিপদ দা পানের দোকানের বিল্টু ইত্যাদি আরো অনেকে।
সাড়ে বারোটা অব্দি নেতাদের ভাষণ চলল ও তারপর একে একে নেতারা ও ডাইরেক্টর রা সবাই বিদায় নিল। অতনু রা ভাবল এই হলো সুযোগ, এবার কেটে পড়া যায়, এক ঝলক নেটে দেখে নিল 2:45 এ নেক্সট শো আছে। অতনু প্রশান্ত কে জিজ্ঞেস করল ” স্যার আর কতক্ষণ?” প্রশান্ত বললেন “এইতো আমাদের ড্রাইভার দের ইউনিয়ন লিডার অনুপম কিছু একটা করবে বলবে তারপর খেয়ে দেয়ে বাড়ি”।
বেলা একটা সময় অনুপম স্টেজে উঠলেন সঙ্গে আরো 4-5 জন লোক অনুপম বললেন যে স্যারেরা ও ম্যাডাম রা আজকে আপনারা আমাদের এই অনুষ্ঠানে এসেছেন এতে আমরা খুবই খুশি হয়েছি আমি এই মঞ্চে আছি আমাদের অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের পক্ষ থেকে এবং আমার সঙ্গে আছেন হোটেল এর হরিপদ দা, অটোচালক শম্ভু, উল্টো দিকের দোকানের বিল্টু এবং ড্রাইভার তাপস এরা সবাই মিলে আপনাদের উদ্দেশ্যে একটা লেখা লিখেছে আমি এদের সবার পক্ষ থেকে লেখা টি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি। বলে উনি হাতের কাগজটি থেকে পড়তে শুরু করলেন,” স্যার ম্যাডাম রা আপনারা সবাই এই অফিসে কাজ করেন এবং আপনাদের জন্যই আমাদের রুজি রুটি চলে। আমরা কেউ আপনাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দি, কেউ খাবার বানিয়ে দি, কেউ অটো করে স্টেশনে পৌঁছে দি, কেউবা আপনাদেরকে সিগারেট অথবা কোলড্রিংস এর জোগান দি। আমরা সবাই প্রথম যখন কাজে ঢুকি, তখন ভাবতাম যে ইস আপনাদের মতন এই অফিসে যদি কাজ করতে পারতাম, রোজ সুন্দর পোশাক পড়ে এসি অফিসে কাজ করতাম, কি মজাই না হতো। কিন্তু রোজ বিভিন্ন সময়ে আপনাদের কথাবার্তা শুনে, আমাদের সেই ভুল ভেঙ্গেছে। আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, ভাবেন যে কেউ শোনে না, কিন্তু আমরা ঠিকই শুনতে পাই, দেখতেও পাই। আমরা দেখি কিভাবে আপনারা ভোররাত থেকে মাঝ রাত অফিসেই কাটান, আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি যে, আপনাদের ও তো ঘর সংসার আছে, সেগুলো চলে কিভাবে। আমরা জানি যে এই ভাবে কাজ করার জন্য আপনারা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, রোজ অনেকেই ওষুধ খেয়ে কাজে আসেন কিন্তু কিছু করতে পারেন না । আপনারা আপনাদের প্রাপ্য ছুটি নিতে পারেন না আপনাদের মায়না বাড়াতে হলে কোম্পানি ছেড়ে, অনেক সময় রাজ্য ছেড়ে বাইরে চলে যেতে হয় আমরা অটোয় শুনেছি যে কোন এক দিদিমণি নাকি কাজের চাপে বিয়ের 10 বছর পেরিয়ে গেলেও বাচ্চা নিতে পারেননি। এমন কি এও আমরা শুনেছি যে কেউ কেউ নাকি বাবা মা মারা যাওয়ার পর দাহ করে পরের দিনই অফিসে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এমনই নাকি কাজের চাপ। এগুলো শুনলে সত্যিই আমাদের অবাক লাগে কারণ আপনারা আবার আমাদের ছোটলোক মনে করেন লেবার ভাবেন, আমরা জানি আপনারা যখন এই অনুষ্ঠানের খবর পেয়েছিলেন তখন আমাদের প্রচুর গালমন্দ করেছেন, কিন্তু ভেবে দেখুন আমাদের ঘরে অভাব আছে কিন্তু আপনাদের মত এরকম অবস্থা আমাদের নেই আমরা যারা হোটেল চালাই দেখবেন বিকেল 5 টা বাজলে আমরা দোকান গুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিন যারা অটো চালাই তাদের যদি ইচ্ছে হয় যে আজকে রাতের কাজের জন্য বেশি ভাড়া নেবো তখন আমরা নিতে পারি, যারা গাড়ি চালায় তারা মাঝে মাঝে পার্ট টাইম ড্রাইভারী করে কিছু বাড়তি কামিয়ে নিতে পারে অনেকের তো নিজের গাড়ীও আছে যেটা ভাড়ায় খাটে। আমাদের হয়তো দারিদ্র আছে কিন্তু স্বাধীনতা ও আছে অনেকের হয়তো সেই স্বাধীনতা টাই নেই।
তাই আমাদের মনে হয়েছে এই দিন টা আমাদের থেকে আপনাদের অনেক বেশি দরকার । আসুন আমরা আজ নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে এই দিনটি উদযাপন করি একটু খাওয়া দাওয়া করি কাল থেকে তো আবার যে কে সেই।
অতনু রা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, যে এই লোক গুলো কেমন নিরপেক্ষভাবে তাদের জীবনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। অতনু জানে রেবতীই হল সে যে 10 বছর হয়ে গেলেও কনসিভ করতে পারেনি, সে এই বক্তব্য শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। পেছনদিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো আরো কয়েকজনের চোখ অশ্রুসজল তারপর ঠিক করলো সিনেমাটা আজ থাক। আজকে বরং মে দিবস টাই উদযাপন করা যায়।