মুম্বইয়ের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে টিভিটা বেশ জোরেই চলছিল তখন। লকডাউনের সময় সারা বিশ্বের মতই এই অ্যাপার্টমেন্টে ও ওভারটাইম খাটুনি যাচ্ছে মোবাইল, টিভি ও ল্যাপটপের। বিভিন্ন চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে রিমোট অবশেষে থামল নিউজ চ্যানেলটিকে টিভির স্ক্রিনে হাজির করে। রিমোট ধরা হাতটাও একটু কেঁপে উঠল কি?
পর্দায় ততক্ষণে ভেসে উঠছে মর্মান্তিক সব দৃশ্য। মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদ সংলগ্ন রেললাইনে পণ্যবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন গরীব পরিযায়ী শ্রমিকদের চাপ চাপ রক্ত তখনও স্পষ্ট দৃশ্যমান। হতভাগ্য মানুষগুলোর শেষ সম্বল রুটিগুলো ও ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। ঘোষিকা বলে চলেন, কিভাবে যানবাহনের অভাবে হেঁটেই মধ্যপ্রদেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন কপর্দকশূন্য মানুষগুলো। ট্রেন চলাচল বন্ধ জেনে রেলের লাইনকেই বালিশ বানিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে শোয়া এবং……
টিভির দিকে তাকিয়েই, ছলছলে চোখেই আনমনা হয়ে গেলেন অভিনেতা সোনু সুদ। হারিয়ে গেলেন নিজের অতীতে। এঁদের মত এতটা অসহায় না হলেও একদিন যে তাঁর জীবনটা প্রায় একই ধাঁচের ছিল। পিঠে ব্যাগ নিয়ে সেই যে পাঞ্জাবের মোগার পৈতৃক বাড়ি থেকে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, পাকাপাকিভাবে কোনোদিনই ফেরা হয়নি আর। প্রথমে নাগপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া, তারপর মায়ানগরী মুম্বইতে রুপোলি পর্দায় নিজেকে আবিষ্কার করার উদগ্র বাসনা। অতীত টা কোনদিনই ভুলবেন না সোনু। তখনো তিনি বিখ্যাত হননি, তেলুগু ছবির সেরা ভিলেন এবং সেরা চরিত্রাভিনেতার পুরষ্কার তখনও পাননি। ‘ যোধা আকবর ‘ ছবিতে সুজামলের চরিত্রের অফার তখনও দূর অস্ত, মুম্বইয়ের অভিজাত এই অ্যাপার্টমেন্ট তো তখন দূরের কোনও নক্ষত্র। সেই সময় তাঁর রোজনামচা ছিল একেবারেই উল্টো। দিনের পর দিন কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ফাইল নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে হত্যে দেওয়া, অবজ্ঞা – অপমান সহ্য করা! কখনও বা পুরো দিনটা কেটে যেত মায়ানগরীর সমুদ্রতীরের কোনও বেঞ্চেই। রিজার্ভেশন ব্যতীত ট্রেনের সাধারন বগিতে চড়ে যাতায়াত করতে হত তাঁকে, ঘন ঘন রিজার্ভেশন করানোর মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না যে! কখনও কখনও তো রাত কেটে যেত রেল বগির শৌচাগারের পাশের ছোট্ট দুর্গন্ধযুক্ত জায়গাতেই। আক্ষরিক অর্থে শ্রমিক না হয়েও এই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মতই তিনি নিজেও ছিলেন পরিযায়ী।
টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তাঁর, এরকম ঘটনা আর ঘটতে দেওয়া যায় না!
যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ! অভিনেতা ঘোষনা করলেন ‘ ঘর ভেজো’ প্রোজেক্ট। দ্রুত হেল্পলাইন নম্বর বানিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়া। বাসে করে ৩৫০ জন শ্রমিককে কর্নাটকে নিজেদের এলাকায় ফেরানো থেকে শুরু। তারপর কেরালা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, আরো অনেক রাজ্য থেকেই ফোন পেয়েছেন সোনু ও তাঁর টিম এবং তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাস দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীকালে ট্রেন, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট ও ভাড়ার গাড়ি, সবকিছুর সাহায্য নিয়েই তিনি তাঁর কর্মসূচী চালিয়ে গেছেন। এখনো অবধি আঠেরো হাজার পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরতে পেরেছেন এই সহৃদয় অভিনেতার সহায়তায়। শুধু যানবাহনের ব্যবস্থা করেই থেমে থাকেননি তিনি, শ্রমিকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন খাবার ও জল। আর, শুধু পরিযায়ী শ্রমিকরা নন, সোনুর সহৃদয়তা ছুঁয়ে গেছে মুম্বই শহরে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের ও। সারাদিনের খাটুনির পর তাঁরা যাতে বিশ্রাম নিতে পারেন সেজন্য সোনু ছেড়ে দিয়েছেন জুহুতে অবস্থিত তাঁর হোটেলটি ও।
সোনুর দিদি মালবিকা অবশ্য একেবারেই অবাক নন ভাইয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে। ভাইয়ের জন্য গর্বিত দিদি জানাচ্ছেন, “আমরা পাঞ্জাবি, পরোপকার আমাদের রক্তে। আমাদের প্রয়াত বাবা মা আমাদের শিখিয়েছিলেন আর্তের পাশে দাঁড়াতে, ভাই ঠিক সেটাই করেছে।” ভুল বলেননি মালবিকা। তাঁদের প্রয়াত মা ছিলেন এক অধ্যাপক, যিনি বিনামূল্যে দরিদ্র ছাত্র ছাত্রীদের পড়াতেন, যাঁর কথা মনে করলে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায় মোগা বাসীদের। মালবিকা এও জানাচ্ছেন যে, বর্তমানে মুম্বই বাসী হওয়া সত্ত্বেও মোগা বাজারে অবস্থিত তাঁদের বস্ত্র বিপণি ‘ বম্বে ক্লথ হাউজ ‘ এবং তার পনেরোজন কর্মচারীর দেখভাল করেন সোনু স্বয়ং। দোকানের কর্মচারীরাও জানাচ্ছেন, প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রাখেন, সুখদুঃখের খবর নেন। নিজের শিকড় তিনি আদৌ ভুলে যান নি। গত বছরেই মোগায় এসে দরিদ্রদের সাইকেল ও বস্ত্র বিতরন করেছিলেন অভিনেতা নিজেই।
” কি বলুন তো, কোনও গডফাদার ছাড়াই নিজেকে স্ট্রাগল করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে, পরিযায়ী জীবনের মধ্য দিয়েও আমায় যেতে হয়েছে! ওদের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই,নিজের অতীতকে খুঁজে পাই। প্রত্যেকটা পরিযায়ী শ্রমিককে ঘরে ফিরিয়ে তবেই আমার ছুটি!”, বলছেন একাধিক ভাষার ছবিতে সাবলীলভাবে অভিনয় করা মানুষটি। এও জানাচ্ছেন যে, তিনি চান না মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে শ্রমিক পরিবারগুলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ুক। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় তরফ থেকেই সরকারি সাহায্য জোটেনি কিছুই। কিন্তু তাতে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। নিজের কাজটুকু করতে পারলেই তিনি খুশি। এখনও তাঁর চোখের কোল চিকচিক করে ওঠে প্রয়াত বাবা মায়ের কথা ভাবলেই। “আমি যা করছি, সবই আমার বাবা মায়ের আশীর্বাদে, ওনাদের শেখানো রাস্তায়। নিশ্চয়ই ওনারা খুশি হবেন”, স্বগতোক্তি করছেন এই মহান হৃদয় সেলিব্রিটি। প্রচারের আলো এক্ষেত্রে কোনোদিনই চাননি তিনি। এখনও মিডিয়াকে এড়িয়েই চলেন। তিনি অনুসরন করেন তাঁর মায়ের উপদেশ, ‘ প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য আর্তের সেবা করা’। তিনি বিশ্বাস করেন যে, তিনি ঠিক সেটাই করেছেন, বাড়তি কিছু নয়। মানুষ তাঁকে ভালোবাসলেই তিনি খুশি, এবং সেটা তিনি পাচ্ছেন ও। এক পরিযায়ী দম্পতি তাঁদের সদ্যজাত পুত্রের নামকরণ করেছেন সোনু সুদ শ্রীবাস্তব। সোনুর মতে, এই ভালবাসা তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা উপহার।
প্রয়াত পিতার নামে সদ্য খোলা ‘ শক্তি সাগর প্রোডাকশন হাউজ ‘ নামক ছবি প্রযোজনা সংস্থার মালিক সোনু সুদ ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী সোনালী ও দুই পুত্রকে নিয়ে সুখী সংসারী। সমাজসেবার কারণে খ্যাতি অর্জিত হতেই এসেছে রাজনৈতিক দলের অফার। যদিও তা পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছেন সোনু। সংবাদসংস্থা কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, ” হ্যাঁ আমার কাছে রাজনৈতিক অফার আছে, কিন্তু রাজনীতি আমার মাঠ নয়। আমি অভিনেতা হিসেবেই খুশি ও তৃপ্ত। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। রাজনীতিতে যোগ না দিয়েই সমাজসেবা করা যায়”। বরাবরের সোজাসাপ্টা তিনি এও বিশ্বাস করেন, তাঁদের মত যাঁরা তথাকথিত সেলিব্রিটি, যাঁদের আর্থিক ক্ষমতা ও সামাজিক পরিচিতি আছে, তাঁদের অবশ্যই সংকটের সময় স্রেফ অর্থসাহায্য করে থেমে যাওয়া উচিত নয়। আরও প্রত্যক্ষ উপায়েই দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, মনে করেন অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের তরফে সেরা ভিলেন হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত এই মানুষটি, যিনি এখন হাজার হাজার অসহায় মানুষের কাছে দেবদূত, রিয়াল লাইফ হিরো।
বলিউডি সুপারহিরোরা শুনছেন?
সূত্র:
১। উইকিপিডিয়া
২। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া
৩। দ্য হিন্দুস্তান টাইমস
৪। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
চিত্র সৌজন্য : গুগল