এই এক বদভ্যাস হয়েছে তিতলির। ঘুম ভাঙলেই সবার আগে হাত যায় মোবাইল টার দিকে। স্বভাবসিদ্ধ ভাবে আজও মোবাইল হাতড়ে ফেসবুক চেক করে আবিষ্কার করলো একটা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। নাম আবির দত্ত। নিজস্ব কোনো ছবি নেই প্রোফাইলে। তার বদলে দোলের গোলাপি ও হলুদ রঙের আবিরের ছবি লাগানো। অন্যসময় হলে সাথে সাথে রিকোয়েস্ট টা ডিলিট করতো। এরকম অচেনা লোকজন তার ওপর ছবিহীন, এসব রিকোয়েস্ট ও কখনও একসেপ্ট করেনা। কিন্তু আজ থমকে গেছে। থমকে গেছে নাম টা দেখে। বছর সাতেক আগে যখন কলেজ পাশ করে বেরিয়েছে, তখন ফেসবুকের এত রমরমা ছিল না। তাই আবির দা কে ফেসবুকে খোঁজার কোনো তাগিদ ওর ছিল না। অবশ্য ফেসবুক তখন থাকলেও যে ও আবির দা কে কতটা খোঁজার চেষ্টা করতো সেটাও প্রশ্ন। বেচারা কে বড্ডো কঠোর ভাবে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিল তিতলি। আবির দার ও আক্কেলজ্ঞান বলিহারি ! ওরকম একমাথা ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, দেখে মনে হয় উকুনের বাসা, কালো মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ার এর চশমা, দেখে মনে হয় 50 বছরের লোক একটা, আর ওরকম হলুদ ছোপওয়ালা না মাজা দাঁত কেলিয়ে যদি কেউ প্রপোজ করতে আসে, কোন মেয়ে রাজি হবে শুনি !! তিতলির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। চটপটে ছটফটে সুন্দরী এবং ওদের ব্যাচ এর সেরা ছাত্রী। যদিও আবির দা তিতলির আগের ব্যাচের সেরা ছাত্র, এক বছর এর সিনিয়র। তাতে কি?? ভাল্লাগেনি, না বলে দিয়েছে।
তিতলি বেশ টের পাচ্ছিল এতদিন পরেও শুধুমাত্র নাম টা দেখেই ওর মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। আসলে একটা সময় নোটস এর ব্যাপারে প্রাকটিক্যাল এর ব্যাপারে ভালো স্যার খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে অনেক হেল্প করেছিল আবির দা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিতলি। যাক যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। এখন এই আবির দত্ত টি কে সেটা জানতে হবে।
প্রোফাইলে খুব বেশি কিছু লেখা নেই, তবে ফ্রেন্ড লিস্ট ঘেঁটে বোঝা গেল ইনি সেই আবির দত্তই। দোনমনো করে নিয়েই নিলো তিতলি রিকোয়েস্ট টা। দেখাই যাক না কি বলতে চায় ছেলেটা এতদিন পরে। তেমন হলে তিতলি ক্ষমা চেয়ে নেবে বছর সাত আগের সেদিনের ওই রূঢ় ব্যবহারের জন্য।
রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার ঠিক একদিন পর মেসেন্জারে মেসেজ পেলো তিতলি।
“কি রে কেমন আছিস?”
তিতলি একটু চুপ থেকে তারপর উত্তর দিলো।
“ভালো। তুমি?’”
“ভালো। কি করছিস এখন?”
“পড়াচ্ছি। স্কুলে। তুমি কি করছো?”
“বলতে পারি। আগে বল হাসবি না।”
“ওমা হাসবো কেন?”
“নাঃ সবাই শুনলেই হাসে ।তাই বললাম”
“না না প্রমিস হাসবো না। বল”
“আমার একটা নিজস্ব ফ্যাক্টরি আছে। ছোট ফ্যাক্টরি। আমি সেখানে আবির বানাই”
“মানে! মানে তুমি আবির বানাও? মানে আবির দা আবির বানায়!!! হাহাহাহা”
“দেখলি তো। তুই আজও কথা রাখতে শিখলি না”
ফস করে অফলাইন হয়ে গেল আবির দা। তিতলি লজ্জিত হলো। সত্যি ওর হাসা উচিত হয়নি। মনে পরে গেল লাস্ট নোটস তা দেয়ার সময় আবির দা বলেছিল, “এইযে তোকে এত নোটস দি, তার বদলে আমি কি পাবো?” তিতলি বোকার মতো বলেছিল, “কি চাই বোলো , দেব”। আবির দা যে গোটা তিতলিকেই চেয়ে বসবে এই কল্পনা তিতলি ভুলেও করতে পারেনি।
এইসব ভাবতে ভাবতে কম্পিউটার এর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আবির দার নাম। আবার ফিরে এসেছে।
ঝাড়বে নাকি রে বাবা!! তিতলি নড়েচড়ে বসলো।
“শোন, খুব তো হাসলি, বিশ্বাস না হয়, একদিন দেখে যা। কেমিস্ট্রি নিয়ে পরে কিছু যদি আবিষ্কার ই করতে না পারলাম, তাহলে আর কি করলাম। সেতো সেলাই শিখলেও স্কুলের টিচার হওয়া যায়”।
লাস্টের কথা টা খুব গায়ে লাগলো তিতলির। আবির দা কি মনে করে কি নিজেকে !! স্কুল টিচার রা ফেলনা নাকি! নিজে তো বানিয়েছে ওই 4 টে রং..তাতে এত্ত অহংকার !
আবির বলেই চলেছে। “কিরে এবার উত্তর নেই কেন? ভয় পেয়ে গেলি নাকি?”
“ভয় পাওয়ার কি আছে?” খুব রেগে গিয়ে বললো তিতলি।
“ ভয় না পেলে চলে আয়। অনেক নতুন কাজ দেখতে পাবি । আমি প্রকৃতি ছেঁচে রং বানাই পাগলী । ফুল পাতা এসবের থেকে তৈরী হয় আমার আবির। তোর ভালো লাগবে”।
আবির দার কথা গুলোর মধ্যে কি জানি একটা ব্যাপার ছিল। তিতলি না বলতে পারলো না।
4 দিন পর কথা মতো ঠিক সময়ে মিরপুর বাসস্টপ এ পৌঁছে গেল তিতলি। মা কে মিথ্যে বলে বেরিয়েছে। আর দুমাস পর তিতলির বিয়ে। বিয়ের আগে এই রবিবার গুলো মা তিতলি কে কাছছাড়া করতে চায় না। আর বিয়ের কথা সে আবির দা কে জানায়নি। জানালে হয়তো আর কাজ টা দেখাই হবে না তিতলির। আবির দার কাজ টা খুব দেখার ইচ্ছে তিতলির। যতই যাই হোক, ছেলেটা কিছু আবিষ্কার তো করছে।
নাঃ, আবির দা বদলায় নি। একইরকম, খ্যাপা ফকিরের মতোই আছে। ফ্যাক্টরি টা একেতেই গ্রামে। তারওপর বেশ ভেতরের দিকে, একটু জনবসতি কম এমন জায়গায়।
“বুঝতেই পারছিস, লোকজন ফ্যাক্টরির কাজ কেমিক্যাল এসব নিয়ে আপত্তি করে। পেছনে বাঁশ দেয়ার লোকের তো অভাব নেই। তাই একটু লোকালয় থেকে দূরেই ফ্যাক্টরি টা বানাতে হলো।”
একেবারে ছোট নয় যতটা তিতলি ভেবেছিল। কাজ করছে দশ বারো জন মতো। তিনটে বড় ঘর রয়েছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার জন্য। ঘুরে ঘুরে দেখার পর আবির দার অফিসে এসে বসলো তিতলি। বেশ ভালো লেগেছে ওর। আবির দা বোধহয় বুঝতে পেরেই একটা মুচকি মুচকি গর্বিত হাসি হাসছে। আতিথেয়তায় ত্রুটি করেনি আবির দা। অদ্ভুত সুন্দর গন্ধওয়ালা একটা শরবত খাইয়েছে তিতলি কে। একগ্লাস খেয়ে তিতলির মনে হচ্ছে আরো একগ্লাস পেলে মন্দ হতো না। অফিস টা ছোট। কিন্তু সুন্দর করে সাজানো। টেবিলের কাঁচের ফুলদানি টার দিকে চোখ গেল তিতলির। সরু ফুলদানি তে ইয়া বড়ো একটা ডালিয়া ফুল তার পাতা সমেত শোভা বর্ধন করছে। ফুল টা দেখা মাত্রই মনে পড়লো তিতলির। আবির দা কে প্রশ্ন টা করেই ফেললো।
“ডালিয়া দি পল্লব দা দুজনেই কি এখন টেক্সাসে? বিয়ে হয়ে গেছে ওদের?”
আবির দার মুখের হাসি টা যেন নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
“কেন? ওদের কথা জিগ্যেস করলি কেন? আমি ওদের খবর জানিনা।‘”
‘না.. তোমার ফ্রেন্ড লিস্ট এ আছে দেখলাম তাই ভাবলাম জানো নিশ্চয় ই। আসলে ওদের দুজনের প্রেম কলেজে ফেমাস ছিল তো। তাই…’
“তুই কি মনে করিস টেক্সাসে গিয়ে রিসার্চ করলেই সে সবথেকে সাকসেসফুল??? আর আমার মতো যারা দেশের মাটিতে বসে গবেষণা করছে, তাদের কোনো দাম নেই??? আর আমি যতদুর জানি ওরা একসাথেই থাকে”।
খেপে গেছে আবির দা। কেমন তেড়ে এসেছে। ভয় লাগলো তিতলির।
“না না আমি তাই বললাম নাকি?? তুমি তো নো ডাউট খুব ভালো কাজ করছো। আমার তো রীতিমতো গর্ব হচ্ছে তোমাকে নিয়ে”।
আবির দা কে শান্ত করতে একটু বাড়িয়েই বললো তিতলি। তার পরেই একটা অভাবনীয় কান্ড করে বসলো আবির দা।
লাফ দিয়ে তিতলির পায়ের কাছে হাটু গেরে বসে পড়লো আবির দা।
“সত্যি বলছিস? সত্যি তোর আমাকে নিয়ে গর্ব হয়?”
তিতলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঢোক গিলে বললো
“হ্যাঁ হয় তো”।
“তাহলে এবার তো রাজি হয়ে যা তিতলি”।
রীতিমতো অস্বস্তি লাগছে তিতলির। কিন্তু আবির দা এগিয়ে না দিলে ও বাসস্টপ অবধি যেতেই পারবে না। এই রাস্তা টায় আগে কোনোদিন আসেনি। কেন যে এলো আজ!! নিজের ওপরেই নিজের রাগ হচ্ছে ওর।
আবির দা বলে চলেছে।
“দেখ..তুই তো দেখলি আমি কতটা সফল আমার কাজে। আর তুই তো জানিসই না আমি আরো একটা জিনিস বানাতে পারি। একদিন সেটার জন্য আমি নোবেল পাবো। তাও তুই রাজি হবি না আমাকে বিয়ে করতে???”
তিতলির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আবির দা যে পুরো পাগল হয়ে গেছে এটা তো ও আন্দাজ ও করতে পারেনি।
“আবির দা আমি বাড়ি যাবো”।
“যাবি তো। এত তাড়া কিসের? জানতে চাইলি না তো আমি আর কি বানাতে পারি?”
“আমি আরেকদিন আসবো। আজ যাই।”
“উহু..আরে শুনেই যা না। তুই ডালিয়া আর পল্লবের কথা বলছিলি না?? এই দেখ” -বলে আবির দা ডালিয়া ফুল টার দিকে আঙ্গুল দেখালো।
“কি দেখবো??”
“গাধা নাকি তুই??দেখতে পাচ্ছিস না আমি ওদের কেমন সার্থকনামা বানিয়ে দিয়েছি”।
তুতলে গেল তিতলি। কি বলতে চাইছে পাগল টা??
“এ..এ..এটা ডালিয়া দি আর পল্লব দা??”
“হ্যাঁ রে পাগলী। টেক্সাস থেকে ফিরে দুজনে একসাথেই বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেছিল আমাকে। আমিও দেখিয়ে দিলাম ..হুঁ হুঁ ..আমিও কিছু কম যাই না তোদের থেকে। কষ্ট কি।।একসাথেই তো আছে দিব্বি। আমার অফিস ঘরের শোভা বাড়াচ্ছে”।
আর বসে থাকলে চলবে না। তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে তিতলি। খোলা দরজা দিয়ে এক ছুটে উঠোন পেরিয়ে দে দৌড়। পেছন থেকে আবির দা চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে।আর দাঁড়ায় !! পাগল নাকি !!দৌড়তে দৌড়তে তিতলি বেশ বুঝতে পারলো ওর পা দুটোর আর দরকার পড়ছে না। কারণ ততক্ষনে ওর দুটো রঙ্গিন পাখনা গজিয়ে গেছে।
khub bhalo.
বেশ ভালো।