চিকেন স্যান্ডউইচের কোনায় এক কামড় দিয়ে বিমান কাকু জিজ্ঞাসা করলো “তাহলে এবারের পুজোয় বন্ধুদের সাথে বেরোচ্ছিস নাকি তোরা?”.
হাঁড়িমুখ করে মোহর বললো “কই আর বেরোবো!সবাই তো বেড়াতে চলে যাচ্ছে, আর দাদার তো সেরম একটা বন্ধুও নেই যে বেরোবে।”.
চশমাটা নাকের কাছে তুলে রিকি বললো “সদ্য কলেজে ঢুকেই বন্ধু কিকরে বানাবো?তার জন্যে সময় লাগে”।
মোহর বলতে থাকলো “জানো কাকু রিকিদার তো একটাও মেয়েবন্ধু নেই”।
“এবার হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না”, বিমান কাকু মন্তব্য করলো।
এমন সময় ঘরে ঢুকলো বিদিশা। বিমান কাকু একগাল হেসে বললো “স্যান্ডউইচ দারুন হয়েছে গো বৌদি!” বিদিশা হেসে বললো “থ্যাংকিউ”। তারপর রিকিকে বললো “তোর সাথে দেখা করতে একটা মেয়ে এসেছে.আগে দেখিনি কখনো।তোর কোনো বন্ধু?”
রিকি অবাক।
“আমি তো কোনো মেয়েকে চিনিনা মা,কলেজও কারুর সাথে আলাপ হয়নি”.
মোহর লাফিয়ে উঠলো “তাহলে কি রিকিদার কোনো গার্লফ্রেন্ড একেবারে বাড়ি চলে এলো?”
“তুই থাম তো,বেশি বকবক করিসনা”, রেগে গেল রিকি।
“দাঁড়াও আমি গিয়ে দেখছি কে” এই বলে সে উঠে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।মোহর ও ছুটলো পিছন পিছন ।বিমান কাকু মন্তব্য করলো “সম্ভাবনা দেখছি সত্যি হতে চলেছে।”
**************
“তুমিই রক্তিম সরকার?” রিকিদের বাড়িতে আসা আগন্তুক মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো।
রক্তিম, অর্থাৎ রিকি বললো “হ্যাঁ আমিই রক্তিম,আর এ হচ্ছে আমার বোন মনীষা”.
মোহর সোফায় বসে বললো “তুমি আমাকে মোহর ও বলতে পারো”।
“আচ্ছা তাই”, হেসে বললো মেয়েটি।
“এবার বলো তুমি আমাকে চিনলে কি করে?আমি তো তোমায় চিনিনা?” রক্তিম জিজ্ঞাসা করলো।
মেয়েটি বললো “আমি পৃথা বিশ্বাস,তোমার কলেজেই সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি সাইকোলজি নিয়ে। না যোগাযোগ করেই চলে এসেছি কিছু মনে করোনা,আসলে একটা বিপদে পরেই এসেছি।”
রিকি অবাক।
“কিসের বিপদ?আর আমার কাছেই বা কেন?”.
“আসলে কলেজের মেডেল চুরির ঘটনাটা বেশ সারা ফেলে দিয়েছিলো সবার মধ্যে,আর সেই রহস্যের সমাধান করায় তুমিও বেশ ফেমাস হয়ে গেছ।তাছাড়া তোমার দাদু এই এলাকায় খ্যাতনামা মানুষ” বললো পৃথা।
“আমার ঠাকুরদা পেশাগত গোয়েন্দা ছিল,আমিতো নেশায় করি একটু আধটু।”
“তাহলেও হবে” বললো পৃথা। “ঘটনাটা বলি শোনো, আমার মামার বাড়ি দেবীপুর। আমি ওখানে থেকেই মানুষ আমার মাসি-মেসোর কাছে।ছোটবেলাতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় বাবা মাকে হারিয়েছি। এখানে একটা গার্লস মেসে থেকে পড়াশোনা করি।”
রিকি বললো “হ্যাঁ ,তারপর?”
“আমাদের একটা পৈতৃক বাগানবাড়ি আছে,এতদিন সেটা ফাঁকাই পড়েছিল,কিন্তু এবার মাসি মেসো ভাবছে ওটাতে থাকার পাকাপাকি ব্যবস্থা করবে। সেই থেকেই ব্ল্যাকমেল শুরু। বেনামি চিঠি আসে দুটো ,বক্তব্য হলো-বাড়িতে হাত পড়লে ফলাফল ভালো হবে না। বাড়িটা একটুদূরে এখনকার বাড়ির থেকে। মেসো তো এসবে পাত্তা দিচ্চ্ছেনা কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে,ওরা ছাড়া আমার কেউ নেই”
পৃথার চোখে জল আসে “যদি সত্যিই কিছু হয়? ওদের একটা ছোট্ট ছেলেও আছে। তাই বলছিলাম ভাই তোমরা যদি একটু আমার সাথে যেতে পুজোয় খুব ভালো হতো। আর আমাদের বাড়ির পুজোয় সব আত্মীয়রা আসে, তোমাদের খুব ভালোও লাগবে।”
রিকি বুঝতে পারে যে মোহর বেড়ানোর কথা শুনেই চনমনিয়ে উঠেছে।ও বললো “আমরা ফাঁকাও আছি, কিন্তু কথা দিতে পারছিনা। তোমার নম্বর দিয়ে যাও দিদি,তোমায় ফোন করে জানাবো।”
পৃথা উঠে পড়ে। “ঠিক আছে,কিন্তু আমি তোমাদের দুজনকে পসিটিভ ধরে রাখছি। এখন আসছি,দেরি হলে আবার গার্ড ঝামেলা করবে।” এই বলে বেরিয়ে যায় পৃথা।
**************
“জানো মা,শেষ অব্দি মেয়েটা দাদাকে ‘ভাই’ বলে ডাকলো!” ডাইনিং টেবিলে বক্তব্য রাখলো মোহর।
“আমার থেকে বড়ো হয়,আর কি বলবে বলে তুই ভাবিস? আমিও তো দিদি বললাম”রেগে বলে উঠলো রিকি।
“আহা তোরা ঝামেলা করিস নাতো খেতে বসে” বললো বিদিশা।
“এসব ছেড়ে বল যে তোরা যাচ্ছিস নাকি দেবীপুর?সত্যিই কি বিপদ হবে ওদের?”
“জানি না মা” বললো রিকি, “ঘুরেই আসি না, একটু ঘোরা তো হবে, তাছাড়া পুরো পুজো এই শিবপুরে বসে থেকেই বা কি করবো? মোহরের ও খুব যাবার ইচ্ছা।”
“হ্যাঁ মা ,আর তুমিও ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে মেতে থাকবে,আমরা দুজনে বোর হয়েযাব,তার থেকে ঘুরেই আসি।বেশিদূর তো না ট্রেনেই চলে যাবো” বললো মোহর।
“সে যত কাছেই হোক তোমাদের সাথে বিমানও যাবে।” বললো বিদিশা।
“সে চলুক না, কাকুও হয়তো গিয়ে কিছু স্টোরি পাবে পেপারে ছাপাবার। তাহলে দাদা আমরা কবে বেরোচ্ছি?”
রিকি বললো “সপ্তমীর দিন দুপুরে,তার আগে আমার টিউশন আছে.”,
“কি এতো পড়িস বল তো?”
রিকি হেসে উঠলো “অনার্স নিয়ে সি.ইউ এ ভর্তি হোস,বুঝে যাবি”।
**************
“ওই দেখ দাদা কাশফুল”, গাড়ি থেকে দূরে হাত দেখিয়ে বললো মোহর।
“এদিকে এখনো কাশফুল দেখা যায়” বললো পৃথা। এখন পৃথার সাথে রিকি, মোহর আর বিমান কাকু গাড়িতে ছুটে চলেছে পৃথার মামারবাড়ির দিকে।
দেবীপুর স্টেশন থেকেই ওদের জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো মেসো। তাতেই আশেপাশের পুজো-পুজো পরিবেশ উপভোগ করছে ওরা।
“শহর থেকে দূরে এলে বেশ শান্তি লাগে” বললো বিমান কাকু। কিন্তু ওদের এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হলো না।বাড়ির কাছাকাছি এসেই ওরা দেখতে পায় একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে,তার থেকে নামছে পৃথার মেসো সুধীরবাবু। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যায় পৃথা, রিকিরাও ওর পিছনে যায়।
“কি হয়েছে?অ্যাম্বুলেন্স কেন?মেসো তোমার হাতে ব্যাণ্ডেজ কেন?”এক দমে বলে যায় পৃথা।
“তুই ঘরে যা”, পৃথার মাসি রিতাদেবী বললো পৃথাকে “এই এসেছিস একটু বিশ্রাম নে তারপর শুনবি সব। আর তোর বন্ধুদেরও ঘরে নিয়ে যা। ওরাও এতদূর এসেছে,খাওয়া দাওয়া করুক তারপর শুনিস”।
মাসির আদেশমতো রিকিদের ঘর দেখিয়ে দিলো পৃথা। যাবার আগে বলে গেল “তোমরা আরাম করো। আমি ঘরে খাবার পাঠাতে বলছি মালতিদিকে। তারপর আমি আসবো।” পৃথার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো অতিকষ্টে কান্না চেপে আছে।
বিমান কাকু বললো “পুজোর সময় এইসব আবার কি বলতো,আস্তে না আসতেই একজন এর উপর হামলা!”
রিকি বললো “যতদূর মনে হচ্ছে আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করেছে কেউ। মেসোর মুখে ঝলসানোর দাগ দেখলাম.কিন্তু এবাড়ি একদম অক্ষত আছে। তাই মনে হচ্ছে ওই বাগানবাড়িতে কেউ আগুন ধরিয়েছে। ঘটনাচক্রে মেসো ওখানে ছিলো। কিন্তু আগুন কেন?”
এইসব ভাবতে ভাবতে মোহর এলো পাশের ঘর থেকে,বললো “তোরা ফ্রেশ হয়ে নে,খেয়ে দিয়ে এসব আলোচনা করিস”।
কিন্তু ওদের আর আলোচনায় বসা হয়নি,খেয়েদেয়েই মোহর আর কাকু ঘুমিয়ে পড়লো। রিকি পৃথাকে জানিয়েদিলো যে সন্ধেবেলা ওরা নিচে নামবে। তারপর ও বাড়িতে মাকে জানালো এবং নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।
**************
ওদের ঘুম ভাঙলো ঢাকের বাদ্যিতে।উঠে নিচে যেতেই ওরা দেখলো বাড়ির সব সদস্যরা নাটমন্দিরে জমায়েত হয়েছে। পৃথার মামা-মামী,দাদা-দিদিরা সবাই সুধীরবাবুকে ঘিরে বসে। পৃথা ও মাসিও চিন্তিতও মুখে দাঁড়িয়ে। সুধীরমেসোকে আগের থেকে সুস্থ লাগছে। নাটমন্দিরেই দেবীপ্রতিমা রাখা হয়েছে,বৃদ্ধ পুজারিঠাকুর প্রতিমার সামনে বসে। ওরাও সবার সাথে গিয়ে বসলো।
বাজনা থামতে মেসো বলে উঠলো “আরে বাড়িতে অতিথি এসেছে তার মধ্যে আমায় নিয়ে ব্যস্ত হলে হবে? আমি তো ঠিকই আছি”।
“না মেসো” বললো রিকি “আমরা পৃথাদির অনুরোধে এখানে এসেছি। আগে এলে আশা করি এরম হতনা। আমি রক্তিম,পৃথাদির সাথে এক কলেজে পড়ি,ফার্স্ট ইয়ার জিওগ্রাফি অনার্স। এই আমার বোন মনীষা। ও মাধ্যমিক দেবে সামনের বছর। আর ইনি আমাদের কাকু বিমান ঘোষ। ইনি ‘জন-সমাচার’ পত্রিকার সাংবাদিক”। বিমান কাকু সবাইকে নমস্কার জানালো
“এইসব ব্যাপারে আমাদের একটু ‘ন্যাক’ আছে, তাছাড়া এরম বাড়ির পুজো কোনোদিন দেখিনি,সেজন্যে আমরা চলে এলাম”।
“ভালো করেছো তোমরা”, হাসিমুখে বললো সুধীর মেসো, “পৃথার মুখে তোমার কথা শুনেছিলাম। রজত সরকারের নাতি হওয়ায় তুমিও তো খুদে গোয়েন্দাই। কিন্তু সত্যি সত্যিই যে বিপদ হবে তা আমরা আগে টের পাইনি। আজ সকালে পুজো দেখে ভাবলাম একটু বাগানবাড়ি থেকে ঘুরে আসি,সঙ্গে পিকুকেও নিলাম,আমার ছেলে পিকু কেজি ওয়ানে পরে। ও দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে,একটু ভালো থাকায় ও গেল আমার সঙ্গে। সব ঠিকই ছিল,হঠাৎ ঐবাড়ির মধ্যে কে যেন আমার মাথায় আঘাত করলো। আমি জ্ঞান হারাই। প্রায় আধঘন্টা পর পিকুর চেঁচামেচিতে জ্ঞান ফেরে। উঠে দেখি সারাবাড়িতে আগুন ধরিয়েছে কেউ। আমি আগে পিকুকে জানালা দিয়ে বের করে দি, কিন্তু নিজে আটকে যাই। পিকু ছুটে এসে এবাড়িতে খবর দেয়। ওরাই দমকল অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেয়”।
“পিকু কোথায়?” জিজ্ঞাসা করলো রিকি.
“পিকু নিজের ঘরেই আছে সেই থেকে,এই ঘটনা খুব এফেক্ট করেছে ওকে,ও কারুর সাথে কথাও বলছে না সেই থেকে” জানালো মাসি।
“ঠিক আছে,একটু পর আমরা ওর সাথে দেখা করতে যাবো। আচ্ছা আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”
“এবাড়ির তো কেউ নয় করলে আশেপাশের কেউ করতে পারে” বললো সুধীর মেসো “আমাদের ভাড়াটিয়ারা ৩ জন গত ৫-৬ মাস আগেই এসেছে,হয়তো কিছু উদেশ্য আছে বাড়িটাকে ঘিরে”
একথা শুনে বিমান কাকু জিজ্ঞাসা করলো “ভাড়াটিয়া? তারাও জানতো নাকি ওই বাগানবাড়ির কথা?”
“হ্যাঁ আমরাই তো জানিয়েছি ওনাদের।আমি তো রোজই যাই সন্ধেবেলা ওনাদের সাথে দেখা করতে,ওদের ঘরদোরও তো মালতিই সাফ করে কিনা। তখন কি বুঝেছি এরম ঘটনা ঘটবে? এই বাড়ির পিছনদিকে আছে ভাড়াটিয়াদের ঘর। পিছনে ডানদিকে থাকেন পলাশ হালদার,উনি এসেছেন ৪ মাস আগে। মাঝখানের জায়গাটায় থাকেন শুভ্রজিৎ দত্ত,উনি এসেছেন 3 মাস আগেই। আর একদম বাঁদিকে থাকেন সুরজ সিং,উনিও ওই ৪-৫মাস আগে এসেছেন”
“ওনাদের সাথে কথা বলা যাবে?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই” বললো সুধীর মেসো।
“ঐতো দেখুন না পাড়ার সবাই আসছে এতক্ষনে,এখন আপনারা পুজো উপভোগ করুন,এসব কথা আবার কালকে হবে,কাল ওনাদের ঘরে গিয়ে আপনারা দেখা করে আসবেন কেমন?”
**************
না, ঐদিন আর দেখা করতে পারেনি ওরা পিকুর সাথে,সেই রাতেই পিকুর খুব জ্বর এসেছিলো,সেজন্যে সেই রাতে আর কথা হয়নি, পরদিন সকালে পৃথার ডাকে ওদের ঘুম ভাঙে।
“কিগো নিচে চলো”,ডাকলো পৃথা,
“আজ তো অষ্টমী,নিচে সবাই অঞ্জলি দিচ্ছে। তোমরাও এসো আর চা টিফিনও খেয়ে নাও”।
রিকিরা নিচে নামলো। পূজারিঠাকুর জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করছেন আর সেই মন্ত্রপাঠ করে সব্বাই অঞ্জলি দিচ্ছে। ওরাও অঞ্জলি দিলো.অঞ্জলি মিটলেই চলে এলো চা আর লুচি-আলুর দম। খাওয়া-দাওয়া মিটতেই সুধীর মেসো এলো ওদের কাছে,সাথে এক ভদ্রলোক।
“ইনি হচ্ছেন শুভ্রবাবু,একজন প্রকৃতিবিদ। ওই পিছনদিকে মধ্যিখানের ঘরটায় ভাড়া আছেন উনি, আমার বাড়ির বাগানটাকে ইনি এখন ফুলে ভরানোর চেষ্টা করছেন।”
“কিযে বলেন সুধীরবাবু,” বললেন শুভ্রবাবু। “আমিতো সামান্য দূত মাত্র,সবই ভগবানের ইচ্ছা, উনি চাইলে মরুভূমিতেও ফুল ফোটাতে পারেন”।
রিকিরা একএক করে শুভ্রবাবুর সাথে আলাপ করলো। ভদ্রলোক এমনিতে ভালো,খালি মাঝেমধ্যে একটু ভাবুক হয়ে যান। গতকালের ঘটনায় আফসোস জানালেন খুব, তারপর নিজের ঘরে চলে গেলেন।
রিকিরা গেল পিকুর সাথে কথা বলতে। পিকুর জ্বর নেই এখন আর, কিন্তু কথাও বলছেনা, চুপচাপ শুয়ে আছে।
“এখন ভালো আছো?”জিজ্ঞাসা করলো মোহর “আমরা তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এলাম। করবে আমার সাথে ভাব?”
পিকু নির্বিকার মুখ করে তাকালো মোহরের দিকে,তারপর ঘরের একটা আলমারির দিকে তাকালো। রিকি গিয়ে খুললো আলমারিটা। খুলে দেখলো আলমারি ভর্তি শুধু গাড়ি নানা রকমের, আর হরেকরকম গাড়ির কাটিং জমানো খাতা।
“তোমার গাড়ি ভালোলাগে বুঝি?আমারও খুব ভালো লাগে। তুমি খেলবে?” সুধালো মোহর।
“মা দিচ্ছেনা যে”, রিনরিনে গলায় বললো পিকু। “মা বলে বেশি ছুটোছুটি করলে জ্বর ফিরে আসবে আবার”
“কদিন পরে খেলো কেমন?” বললো রিকি “এবার বলতো কাল কি তোমার খুব লেগেছিলো?”
“পায়ে অল্প লেগেছে” বললো পিকু “আমি তো কাল ভালোই ছিলাম।বাবাই এর সাথে ঘুরতেও গেছিলাম বাগানবাড়িতে। ওই বাড়িতে দুটো শোবার ঘর আছে । একটাতে ঢুকতেই …” এই বলে থেমে গেল পিকু।
“কি দেখলে ঢুকে? তোমার ভয় নেই তুমি বলতে পারো,এঘরে আমরা আর তোমার মা ছাড়া কেউ আসবেনা”
“একটা লোক মারলো বাবাইকে,আমাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো,আমার পায়ে চোট লাগলো..আমি চিনি লোকটাকে। ওই হলুদ লোকটা এরম করেছে! আমি চিনতে পেরেছি হলুদ লোকটাকে!! লোকটা আমাদের ঘরে আটকে দিলো বাইরে থেকে!তারপর..তারপর…..”
এবার পিকু ঘামতে শুরু করলো।ওর মুখের কথা আটকে গেল। ও থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মোহর ওর মাথায় হাত দিয়ে দেখলো। “আবার জ্বর এসেছে.আমি মাসিকে ডেকে দিচ্ছি” বলে মোহর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।রিকি সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো, তারপর বারান্দায় গিয়ে দেখলো,পিকুর বারান্দা থেকে বাড়ির পিছনের অংশটা দেখা যায়, ভাড়াটিয়াদের ঘরও। সেখানে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে কথাও বলছে। মাসি আর মোহর ঘরে আসতে রিকি আর বিমান কাকু বেরিয়ে গেল।
“চল তো বাড়ির পিছনে যাওয়া যাক। লোকদুটোর সাথে আলাপ করে আসি” এই বলে বিমান কাকু কে নিয়ে পিছন দিকে গেল রিকি।
**************
“আপনারা বুঝি এখানেই থাকেন?” হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করলো বিমান কাকু, “আমরা হাওড়া থেকে আসছি,সুধীরবাবুর বন্ধু”।
“হ্যাঁ তো, হামি থাকি একদম বামদিকে,মাইসেলফ সুরজ সিং,নাইস টু মিট ইউ” হ্যান্ডশেক এর ভঙ্গিতে হাত বাড়ালেন অবাঙালি ভদ্রলোক।
“আপনারা সুধীরবাবুর বন্ধু?”
অপর ভদ্রলোক বললেন “কি কান্ড বলুন তো! সুধীরবাবুর উপর কত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল! আর এমন দিনে ঘটলো যেদিন আমি ছিলাম না!”
“কেন আপনার কাজ ছিল বুঝি? কোথায় কাজ করেন আপনি?”
“আমিতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ,কলকাতায় কাজ ছিল। ‘দত্ত এন্ড বোস’ কোম্পানির যে নিউ বিল্ডিংটা হচ্ছে,সেটার কন্সট্রাকশনের কাজ আমি ও আমার টিমই দেখছে।” হাতজোড় করলেন ভদ্রলোক, “নমস্কার আমি পলাশ হালদার। কদিন আগের কাগজে আমার ফটোও বেরিয়েছিল।”
“ও হ্যাঁ তাই ভাবি আপনাকে কেন চেনা চেনা লাগছে”, বললো রিকি “তা কলকাতা থেকে এতদূরে এসে উঠেছেন যে?”
“আসলে আমার একটা কাজ পড়েছে এইদিকে” বললেন পলাশবাবু। “সেইজন্যে ১০-১২ মাসের জন্যে ভাড়া নিয়েছি। আর কি বলুন তো আমিও গ্রামের ছেলে,এইরকম বনেদি বাড়ির পুজো আমাকে টানে খুব,সেজন্যেই এখানে উঠেছি। কাজ পড়লে মাঝে মাঝে কলকাতা যায়”।
“আর আপনি মিস্টার সুরজ?”প্রশ্ন করলো রিকি।
“হামার তো ওনলি বিজনেস পারপাস।কাজ মিটলেই ফিরে যাবো। আজকাল রেন্ট পাওয়াও টাফ। বাট মিস্টার সুধীর ভালো আদমি আছেন,হামাকে বলেছেন যতদিন ইচ্ছা থাকবেন,যবে ইচ্ছা হবে চলে যাবেন।”
এমন সময় রিকিকে ফোন করলো মোহর “কোথায় তোরা জলদি আয়!চান করেনে!দুপুরে খিচুড়ি ভোগ আছে যে!”
“হ্যাঁ যাচ্ছি যাচ্ছি”বলে ফোন রাখলো রিকি।
দুপুরে খিচুড়ি ভোগের পর বিকেল করে পৃথার সাথে ওরা বেরোলো ঠাকুর দেখতে। এখানেও পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর। চোখ-ধাঁধানো নাহলেও,মণ্ডপ ও প্রতিমা সবই বেশ আকর্ষণীয়। বাড়ি ফিরে রাতের মেনু অনুযায়ী খিচুড়ি আর আলুরদম খাওয়া হলো।
ঘরে ফিরে রিকি দেখে,মোহর একটা খাতা হাতে বসে।
“কিরে তুই আজকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর মতো নোটস নিচ্চ্ছিস নাকি?”
“নিচ্ছি তো!” বললো মোহর “আমার তো মেমরি অত ভালো না,তাই নোটসই ভরসা।”
“বললি বলে মনে পড়লো, আচ্ছা পিকুর ঘরেও একটা ডাইরি দেখলাম না?ও কি তাহলে ডাইরি লেখে? শোন,চট করে মাসির কাছে যা, পিকুর ডাইরিটা চেয়ে আন,আজ রাতে বসে পড়ে নেবো। হলুদ লোকের আসল পরিচয় আমাকে জানতেই হবে!”
**************
“আর একবার বল কি কি বললি? বৃষ্টি হলে লাল লোকটা ঘুমায়?সাদা লোকটা কুকুরের পায়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধে?শেষ তিন মাস ধরে হলুদ লোকটা মাটি খোঁড়ে?তার আগে খোঁড়েনি কেন?এসবের মানে কি?কি রে দাদা কিছু বুঝলি?”
মোহরের কথার উত্তর দিতে পারেনা রিকি। আজ নবমী। সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি। বেরোনো মাথায় উঠেছে। আগেরদিন রাতে ডাইরিটা পড়েছে রিকি। গত ৫ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু ঘটনার উল্লেখ নেই। খালি রবিবার গুলোয় এই কথাগুলো লেখা আছে যে-লাল লোকটা বৃষ্টি হলে ঘুমায়,নাহলে জেগে থাকে। সাদা লোকটা কাজে যায়,ফিরে আসে,একদিন কুকুরের পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছে। আর হলুদ লোকটা রোজ রাতে মাটি খোঁড়ে ও বেরিয়ে যায়।একটু আগে ওরা নেমে টিফিনে কচুরি তরকারি খেয়ে এসেছে। পুজো হচ্ছে নিচে,ঢাকের বাজনা কানে আসছে। কিন্তু সেদিকে আর মন নেই রিকিদের।
ওরা এখন এই ধাঁধা সমাধানে ব্যস্ত
। রিকির মাথায় আসছেনা একটা বাচ্চা ছেলে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, রোজ সকালে বেরিয়ে যায়, দুপুরে ফিরে আসে, গাড়ি নিয়ে খেলে, পেপার কাটিং করে ছবি জমায়, আর সন্ধে থেকে রাত অবধি বারান্দায় বসে বসে লোক দেখে। সে কি ভেবে একেকজন কে একেক রং দিয়ে চিহ্নিত করে? কি চলে ওর মাথায়?
“আমি একটা কথা বলবো? আমার মনেহয় পিকু নামের সাথে রং মেলায়।পলাশ ফুল লাল, তাই পলাশবাবু হচ্ছেন ‘লাল লোক’, একই ভাবে শুভ্রজিৎ বাবু হচ্ছেন ‘সাদা লোক’ আর সুরজ মানে সূর্য, সূর্যরশ্মি তো হলদেই হয়। মানে সুরজ বাবুই হচ্ছে ‘হলুদ লোক’,আসল অপরাধী” মোহর বললো।
“আরে নানা” বাধা দিলো রিকি, “একটা কেজি ওয়ানের ইংলিশ মিডিয়াম এর ছেলে জানবে পলাশ ফুল লাল? বা শুভ্র মানে সাদা? ও অন্য কিছু দেখে এইরকম নামকরণ করেছে,কিন্তু সেটা কি?”
“আমারও মনে হয় মোহর ঠিক বলেছে”, বললো বিমান কাকু, “ওই সুরজ লোকটা ব্যবসায়ী। হয়তো কিছু দুনম্বরি কারবার আছে,সেইসব টাকা লুকোয় হয়তো মাটির তলায়। আবার আমাদের প্রকৃতিবিদও সন্দেহজনক। বাড়ি ছেড়ে বেরোন না বেশি। হয়তো বাড়িতেই কিছু লুকোন তাই বেরোতে চান না, পুজোতেই দেখনা খালি এলো,খেল,চলে গেল।”
“হুম, আচ্ছা কাকু তোমার মনে আছে পলাশ বাবুর ছবি কেন কাগজে এসেছিলো?” প্রশ্ন করলো রিকি।
“তা আর থাকবেনা? ওনার কোম্পানির একটা লোক কোম্পানির অনেক টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। লোকটা অবশ্য ধরা পড়েযায় কদিন পর,কিন্তু দোষ শিকার করেনি। পুলিশ হেফাজতে আছে। আর সেই টাকা পয়সার খোঁজও দেয়নি।”
“হুম বুঝলাম,আচ্ছা তোমার কাছে প্রদীপ কাকুর নম্বরটা আছে?”
“হ্যাঁ আছে বৈকি,কিন্তু যোগাযোগ নেই অনেকদিন,শেষ দেখা হয়েছিল তোদের বাবার কাজে।”
“ঠিক আছে একবার নম্বরটা আমাকে দাওতো! আর বৃষ্টি টা কমেছে,আমি একটু নিচ থেকে আসছি কয়েকটা কাজ সেরে।” বলে রিকি ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে গেল।
দুপুরে পোলাও আর কষা মাংস খেয়ে রিকি একবার ফোন করলো প্রদীপ কাকুকে ,মিনিটখানের কথাবার্তা হলো,তারপর ফোন রেখে দিলো।
“কিরে কিছু বুঝলি” প্রশ্ন করলো মোহর।
“হ্যাঁ, রহস্যের জট প্রায় ছাড়িয়ে ফেলেছি, এখন শুধু একটা ফোন কল এর অপেক্ষা।”
“বলিস কিরে! তা আমাকে বলনা কি কি বুঝলি?”
“উহু , এখন না,কাল সকাল অব্দি অপেক্ষা কর,সব জানতে পারবি! এখন ঘুমাই চল,সন্ধেবেলা ধুনুচিনাচ দেখতে যাবি তো?”
**************
“দেখতে দেখতে দশমী চলে এলো ,বলো কাকু”, মোহরের মন খারাপ, “কিছুটা ঘোরা হলেও আনন্দ আর হলো কই,একে তো সবার মন-মেজাজ খারাপ,তার উপর বৃষ্টি।”
“তাও তো তুই পৃথার সাথে ঘুরেছিস,রিকির কথা ভাব,দিনরাত রহস্য আর বাচ্চা ছেলেটার ধাঁধা নিয়েই পড়েছিল।”
“দাদাটা একদম পচা,ও সব বুঝে গেছে ,কিন্তু আমাকেও বলছেনা। আমার খুব রাগ হচ্ছে”
“আচ্ছা অপেক্ষা কর না,চল নিচে যাই। রিকি তো কোন ভোরবেলা উঠে পড়েছে,আমরাও যাই,আজকেই যে ভাসান। কাল আবার ভোরে আমাদের ফিরতেও হবে। আশা করি রিকি কিছু ভাবনা চিন্তা করে রেখেছে।”
আজ খুব ঢাক বাজছে,শেষদিন বলে কথা। সারা পাড়ার লোকেরা এসেছে,জমায়েত হয়েছে নাটমন্দির এ।সারাদিন আড্ডা-গল্প,হই-হুল্লোড় লেগেই আছে। সবচেয়ে বেশি উৎসাহী সুধীর মেসো। দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা যে কদিন আগেই লোকটার উপর দিয়ে মারাত্মক ঝড় গেছে। খালি রিকি খুব চুপচাপ ছিল,মাঝে মাঝে কয়েকটা ফোন করেছে ব্যাস।
সারাদিন এভাবেই কেটে গেলো। দুপুরে পোলাওয়ের সাথে ডাল,আলুভাজা,ছানার ডালনা,চাটনি পাঁপড় সন্দেশ খাওয়াও হলো। তারপর শুরু হলো সিঁদুর খেলা। আস্তেআস্তে ভাসানের সময় উপস্থিত হয়। পাড়ার পাড়ার সবাই ঠাকুর ভাসান দিতে ঘাটে যেতে থাকে। ঘাটে পৌঁছে নাচানাচি ও আনন্দের সঙ্গে হয়েযায় ঠাকুর বিসর্জন।ঘরে ফিরতে থাকে সবাই,মন খারাপের সাথে,আবার এক বছরের প্রতীক্ষা নিয়ে,আর একবুক আশা নিয়ে।
সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে। পূজা মণ্ডপ একেবারে ফাঁকা। সন্ধেবেলায় চায়ের আসর বসে মেসোর ঘরে। রিকি বাড়ির সবাইকে ঘরে জমায়েত করে। “আজ খুব খাটুনি গেল তোমাদের” বললো রিকি।” তোমরা সবাই এখানেই বস ,চা খাও, একজন এইঘরে আসবে এখুনি,আজকের বিশিষ্ট সদস্য”। বলতে না বলতেই মোহরের হাত ধরে ঘরে ঢুকলো পিকু। ও সোজা গিয়ে রিতামাসির কোলে বসে পড়লো,
“পিকুর শরীর ভালো আছে?” সুধীর মেসো প্রশ্ন করলো রিকিকে, “কি ব্যাপার বলতো? তুমি কি কিছু বুঝেছো বাগানবাড়ির ব্যাপারে?”
“পিকু একদম সুস্থ মেসো”, বললো রিকি।
“আর একটু না,আমি বাগানবাড়ির রহস্যের সমাধানও করেছি। এবার তোমাদের একটা গল্প শোনাই। যা ভুলভ্রান্তি হবে পিকু আমাকে ধরিয়ে দেবে,ঠিক বলেছি তো পিকুবাবু?”
পিকু ঘাড় নাড়ে। রিকি বলতে শুরু করে, “যখন আমি প্রথমে কেসটা শুনি,ভাবিনি যে সেটার পিছনে সত্যিই এমন ভয়াবহ কারণ থাকতে পারে। যে ব্যক্তি একটা মানুষ আর একটা বাচ্চাকে পুড়িয়ে মারতেও দ্বিধা করেনা,তার নিশ্চয়ই এর পিছনে বড়ো কোনো কারণ থাকবে। অপরাধী সেইদিন একটা মারাত্মক ভুল করে,পিকুকে ছোট বলে অবজ্ঞা করে,কিন্তু সে জানতনা যে পিকু তাকে চিনতে পেরে গেছে।”
“পিকুর একটা ভালো অভ্যাস আছে,সেটা হলো সারাদিন যাযা দেখা ,সেটা ডাইরিতে লিখে রাখা। ও রোজ সকালে স্কুলে যেত, তাই রোজ ডাইরি লিখতে পারতো না।কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেছি, প্রতি রবিবার ও সকাল থেকেই লিখতো এবং তিনজন লোকের ব্যাপারে লিখতো। একজন ‘লাল’,একজন ‘সাদা’ আর একজন ‘হলুদ’। ওর ঘরের বারান্দা থেকে তিনজন ভাড়াটিয়াকেই দেখা যেত। তো আমরা বুঝতে পারছি এই তিনজনকেই ও এক একটা রং দিয়ে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু কেন?কারণ সারাদিন বাড়ি না থাকায় মাত্র কয়েক মাস আগে আসা ভাড়াটিয়াদের চেনা পিকুর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ও স্কুল ছাড়া বার হতোনা বাড়ি থেকে। ফলে ওর পক্ষে তাদের নাম জানা কিংবা মনে রাখা সম্ভব ছিলো না। তাহলে ও কিসের পরিপ্রেক্ষিতে নাম দিয়েছিলো ওদের?”
“পিকুর গাড়ির কালেকশন দেখতে গিয়ে আর ওর কাটিংয়ের খাতা দেখে বুঝলাম যে পিকু নাম না জানা সত্ত্বেও,ও একএক জনকে একেকটা গাড়ির স্বভাব আর রং হিসাবে নামকরণ করেছিল”
“গাড়ির রং আর স্বভাব?” বিমান কাকু প্রশ্ন করলো “মানেটা বুঝলাম না তো?”
“বোঝাচ্ছি। তার আগে ভাড়াটিয়াদের কথা বলি” রিকি বলতে থাকলো “যদি ভালো করে দেখা যায় তো বোঝা যাবে, তিনজনেরই সময় ও সুযোগ দুটোই ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পরের দিন আমি জানতে পারি যে পিকুর ‘হলুদ’ লোকটাই আগুন লাগিয়েছিল। এই ‘হলুদ’ লোকটাই রাতের বেলা বাগানে খোঁড়াখুঁড়িও করে আর বেরিয়ে যায়। তাহলে ধরে নেয়া যেতেপারে যে লোকটা বাগান থেকে কিছু একটা তুলে বাগানবাড়িতে রেখে আসছে। কিন্তু কেন? আর পিকুর ডাইরিতে দেখলাম এটা লাস্ট ৩ মাস ধরে হচ্ছে। এর কারণ কি?তার আগে কি লোকটা ছিলো না?নাকি অন্য কোনো অসুবিধাই পড়েছিল ‘হলুদ’ ব্যক্তি?”
“তিন মাস আগে আসেন শুভ্রবাবু। উনি প্রকৃতিবিদ, সারাদিন গাছ-গাছালি নিয়ে পড়ে থাকেন, গাছের পরিচর্যা করেন, আজ ভোরবেলা উঠে দেখতে পেলাম উনি সব ফুলগাছে জল দিচ্ছেন আর গাছ বসাচ্ছেন। তখনি ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। পিকু রোজ ভোরবেলা ওঠে আর বারান্দা থেকে দেখতে পাই,একজন জল দিচ্ছে গাছে, সেটা দেখে ওর নিজের এক গাড়ির সাথে তুলনা করে,যে জল স্প্রে করে।”
“দমকল!” চেঁচিয়ে ওঠে পৃথা.
“একদম ঠিক” বললো রিকি,”শুভ্রবাবুর গাছে জল দেওয়া অনেকটা দমকলের আগুন নেভানোর জলদেয়ার মতোই মনে হয় পিকুর। সেজন্যে দমকলের রঙের সাথে মিলিয়ে ও শুভ্রবাবুর নামদেই ‘লাল’লোক। কি ঠিক বলেছি তো পিকু?” পিকু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
“ইস তাহলে তো সবাই বদলে গেল!” বলে ওঠে মোহর ,”তাহলে ‘সাদা’ লোকটা কে?”
“মিস্টার সুরজ” বলে রিকি “কয়েকমাস আগে মিস্টার সুরজ একটা আহত কুকুরের পায় ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেয়,আবার স্থানীয় হাসপাতালেও নিয়ে যায়, হাসপাতালে ফোন করে জানতে পারি আমি যে সুরজ নামের এক ব্যাক্তি একটা কুকুরকে নিয়ে গেছিলো কয়েকমাস আগে। কুকুরকে সেবা সুশ্রষা করা দেখে পিকু ডাক্তার-পেশেন্ট ভেবে নেয় ওদের। সেইজন্যে অ্যাম্বুলেন্সের রঙের সাথে মিলিয়ে মিস্টার সুরজ হয়ে যান ‘সাদা’লোক।”
“বাকি রইলেন একজনই ,পলাশবাবু। গতকাল সকালে পিকুর পেপার কাটিংয়ের খাতায় দেখতে পাই,কাগজে বেরোনো ছবিটায় পলাশবাবু দাড়িয়ে আছেন একটা হলদে রঙের ক্রেন এর সামনে, কাগজে বেরোনো ছবির সাথে মিলিয়ে আর নিজের গাড়ির কালেকশন এর হলুদ ক্রেনের সাথে মিলিয়ে পলাশ বাবু হয়েযান ‘হলদে’লোক,যে বাগানবাড়ির অগ্নিকাণ্ডের একমাত্র ‘মাস্টারমাইন্ড’!”
“কিন্তু কেন?” চেঁচিয়ে ওঠে সুধীর মেসো “কারণ কি এর পিছনে?”
“কারণ আছে” বললো রিকি “মাস ছয়েক আগে ওনার কনস্ট্রাকশন কোম্পানির বেশ কিছু টাকা চুরি হয়.একজন কর্মচারীকে পুলিশ গ্রেফতারও করে, কিন্তু আমার মনে হয় সেসব টাকা পলাশ বাবুই সরিয়েছেন আর দোষ দিয়েছেন অন্য লোকের উপর। কিন্তু এখন এত টাকা সরাবেন কোথায় উনি? কলকাতায় তো প্রায়ই পুলিশ জেরা করছে,বাড়িতে হানা দিচ্ছে। উনি তখন চলে আসেন এই দেবীপুরে। সন্দেহের উদ্রেক না হবার জন্যে এমন একটা বাড়িতে ভাড়া নেন উনি। কিন্তু এত টাকা লোকাবেন কোথায়? বাড়ির মালিক সুধীরবাবু তো মাঝে মধ্যেই আসেন গল্প করতে, উনি একটা বুদ্ধি বের করলেন, ভাড়াটিয়ার ঘরের পিছনের বাগানের মাটির তলায় লুকোতে থাকলেন সব টাকা। আর আমার যতদূর মনেহয় উনি টাকা রাখছিলেন না। এইসব বড়ো বড়ো কোম্পানির টাকা ‘মার্কড’ হয়, ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্যে উনি সব টাকা সোনার বারে চেঞ্জ করে নেন এবং বাগানে পুঁতে রাখেন।”
“সবই ঠিক চলছিল,বাধ সাধলো শুভ্রবাবুর আগমন, উনি আবার রোজ সকালে গাছ পোঁতেন,মাটি খোঁড়েন। যে কোনোদিন ধরা পড়ে যাবেন এবার পলাশ বাবু। ওনার মাথায় বুদ্ধি আসে।মেসোর মুখে শোনা পুরোনো বাগানবাড়িতে রোজ রাতে একটু একটু করে সোনা সরাতে থাকেন। বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারেননা ,কারণ শব্দে বাকি ভাড়াটিয়ারা জেগে যেতে পারেন।হয়তো এই ৬ মাস থেকেই পুজোর পর উনি দেশ ছাড়তেন, কিন্তু তার আগেই মেসো বাড়ি সারাবে বলে মনস্থির করে, উনি হুমকি চিঠি দিতে থাকেন,যাতে পুজো শেষ হওয়া অব্দি বাড়ি মেরামত ঠেকানো যায়। কারণ পুজোর মধ্যে বাড়ির ও আশেপাশের এতো লোকজনের মধ্যে এতো সোনা সরানো সম্ভব না,যে কেউ দেখে ফেলতে পারে।কিন্তু মেসো গা করলো না। সপ্তমীর দিনই হঠাৎ চলে গেলেন বাগানবাড়ি। সেজন্যে ঐদিনই মেসো আর পিকু যেতে উনি মারার প্ল্যান করেন।”
“কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে যে ঐবাড়িতে লুকোনো আছে?” প্রশ্ন করলো মাসি।
“প্রথমত পিকুর কথায় ,যে রোজ রাতে কিছু রাখতে যায় ‘হলুদ’ লোক। আর দ্বিতীয়ত,আঘাত করার আধ ঘন্টা পর আগুন লাগালো কেন? অথবা ঘরের দরজা আটকানোর কারণ কি?কারণ একটাই,আগুন লাগানোর আগে সোনা সরাতে হবে।পলাশ বাবু একটা ব্যাগ ভর্তি করে সব সোনা তুলে নিয়ে বাড়িতে আগুন লাগান। তৃতীয়ত কলকাতায় ফোন করে জানতে পারি যে,’দত্ত এন্ড বোস’ কোম্পানির বিল্ডিংয়ের কাজ গতমাসেই বন্ধ হয়ে গেছে, ঐদিন কোম্পানির কোনো কর্মচারীই পলাশবাবুকে দেখেননি। উনি ভেবেছিলেন যে এতটাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে পারবেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না.”
বাড়ির সবার থমথমে মুখ। নীরবতা ভাঙলো সুধীর মেসোই “এখন কোথায় আছে সে?”
“চিন্তা করবেননা ,আমি আমার পরিচিত এক পুলিশ কাকুকে খবর দিয়ে দিয়েছিলাম। এতক্ষনে হয়তো তারা বাড়ি ঘেরাও ও করে ফেলেছে”
বলতে না বলতেই ফোন আসে রিকির।কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রাখে ও.”পলাশবাবুকে অ্যারেস্ট করেছে পুলিশ” বললো রিকি “ওনাকে সোজা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।এখন এবাড়ির বাগান আর বাগানবাড়িতে তল্লাশি হবে, বিমান কাকু আর মেসো এসো আমার সঙ্গে।” এই বলে ঘরের বাইরে পা বাড়ালো রিকি।
**************
পৃথাদের দুটো বাড়ি থেকে ৩০টা সোনার বার উদ্ধার করে পুলিশ,একেকটার ওজন প্রায় ১০০গ্রাম করে।মেসো-মাসি ভাবতেই পারছেনা যে এই ৫ মাস ওদের বাড়িতে প্রায় ১ কোটি ২০-৩০লাখ টাকার সোনা লুকোনো ছিল।
পরে খোঁজ নিতে জানা গেল যে,শুভ্রবাবু একটি বই লিখছেন গ্রামের প্রকৃতির উপর, তাই উনি ঘর ছেড়ে বেরোননা বেশি, সারাদিনই বসে বসে পড়াশোনা করেন আর লেখেন। আর মিস্টার সুরজকে কুকুরের কথা জিজ্ঞাসা করায় উনি বললেন “এসব হামি হামেশাই করে থাকি, রাস্তায় উন্ডেড পরে থাকতে দেখে নিজের ঘরে নিয়েএসে ব্যাণ্ডেজ করে দিলাম। হাড় জুড়তে টাইম লাগে তো,এখুন হামার এনজিওতেই আছে।মাঝেমধ্যে যাই,দেখা করে আসি। হি ইজ হিলিং ভেরি ফাস্ট.”
পরেরদিনই ফেরার পালা। মেসো-মাসি তো খুবই আফসোস করলো, “তোমরা এতো উপকার করলে,আমরা তোমাদের ভালোকরে যত্নআত্তিও করতে পারলাম না” বললো মাসি “সারা পুজোটা তো ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেলো তোমাদের। আবার এসো কিন্তু তোমরা, এবার হাতে সময় নিয়ে এসো, কত দেখার জায়গা বাকি রয়ে গেল। সব ঘুরতে হবে যে!”
“আমরা আবার আসবো ” বললো মোহর, “ফোন করবো তোমাদের। এখন আসছি আমরা.”
“যাক তোদের দৌলতে একটা ভালো স্টোরি কভার করতে পারলাম” ছুটন্ত ট্রেনে বসে বললো বিমান কাকু “বাড়ি ফিরে লেখাটা শেষ করতে হবে”।
“আবার কবে আসবো রে দাদা এখানে?” জানলা দিয়ে সবুজ মাঠের দিকে দৃষ্টি রেখে বিষন্ন মুখে বললো মোহর “মেসো-মাসি ,পিকু এদের সবাইকে খুব মিস করবো আমি। রোজ পৃথাদির কাছে খবর নেবো”.
“তাই নিস্” বললো রিকি “আসবো রে আবার এখানে.এখন বাড়ি ফেরা যাক,সেখানেও যে মা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে রে !”
**************
চিত্র সৌজন্য : গুগল