“ সত্যি মিথ্যে জানি না ইন্দ্রজিৎ বাবু , তবে বেটিং নিয়ে যদি কিছু বলতে বলেন তাহলে হলফ করে বলতে পারি বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবে এমন কোনো প্লেয়ার নেই , যে এই সাহসটা দেখাতে পারে । অনেক ইয়ং প্লেয়ার বসে আছে টিমে জায়গা পাবার আশায় । বেটিং এ কেউ ধরা পড়লে সে আর কোনদিনও দলে জায়গা পাবে না । ” … বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ সুবিমল বাবু জানালেন ।
এটা দুদিন পর বিকেলের ঘটনা । এই দুদিন আমরা ক্রিকেট রহস্য মাথা থেকে মুছে দিয়েছিলাম । প্রাণ ভরে শুধু দার্জিলিংকে উপভোগ করেছি । কখনও বা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে , কখনও আবার হোটেল মঞ্জুসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ এসে আলতো স্পর্শে তাদের ভালোবাসা জানিয়ে গেছে । মোটমাট এই দুদিন আমরা যতটা সাইটসিন করা সম্ভব করে নিয়েছি । সুবিমল বাবুর কোয়ার্টার আমাদের হোটেলটা ছাড়িয়ে আর দু তিনটে বাড়ির পরে । তাই বিকেলে ইন্দ্রদার সাথে ওনার বাড়ি এসে পড়েছি । ওনার শরীরখানা রোগা হলেও যেন একেবারে পাথরে কোঁদা , যেমন মজবুত তেমন শক্ত । তবে বুকদুটো তক্তার মত সমতল । ঢলঢলে একটা সাদা গাউন পড়ে ছিলেন , দেখে মনে হচ্ছিল হাড়ের কাঠামোর উপর এগরোলের কাগজের মত সাদা গাউনটা চেপ্টে আছে ।
“ শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবারের ব্যাপারে কিছু জানেন ? ” … ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল ।
“ হোয়াট রাবিশ ! এধরনের কোনো ইনফরমেশন আমার কাছে নেই । ”
“ আপনার টিমের হারার কোনো স্পেশাল রিজন ? ”
“ কে বলেছে আমার টিম সব ম্যাচ হেরেছে ? সেমি পর্যন্ত কোয়ালিফাই করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ । তবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে প্রত্যেকটা ম্যাচ হারার কারন খুঁজে পাইনি । ”
“ বেটার লাক নেক্সট টাইম সুবিমলবাবু , আজ আমরা উঠি । ধন্যবাদ । ”
ওখান থেকে বেরিয়ে আমি আর ইন্দ্রদা ফুটপাথের একটা দোকান থেকে এক প্লেট মোমো কিনে ভাগাভাগি করে খেলাম । এরপর ইন্দ্রদা ওর বন্ধু সুমিতকে একটা ফোন করল । আধ ঘণ্টার মধ্যে সুমিতদা এসে পড়তেই আমরা শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম । আকাশের মেঘগুলো তখন হুঙ্কার ছাড়ছে । ভয়ংকর কিছু একটা হবার আভাস দিচ্ছে তারা । চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালা ছিল । ক্লাবের কাছাকাছি এসে দরজায় টোকা মারলাম । ভেতরে রয়েছেন গনেশ ঘোষ , তপেন গুহ , জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন সৌরভ নাগ আর ক্লাবের সেই ছেলে চারটে । ইন্দ্রদাকে দেখে সৌরভ নাগের মুখে হাসি ফুটল । ইন্দ্রদার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করতে করতে উনি বললেন …
“ আমাদের খেলা কেমন লাগল বলুন ? ”
ইন্দ্রদা প্রত্যুত্তরে জানাল … “ দারুন । তবে কিছুটা মিসটিরিয়াস । ”
কথাটা শুনে সৌরভ নাগের মুখটা এক ঝটকায় কালো হয়ে গেল । সুমিত বিশ্বাস সৌরভ নাগের সঙ্গে কোনো কথা বলছে না ।
তপেন গুহ এবার বললেন … “ আসুন আসুন , আপনাদের জন্যেই ওয়েট করছিলাম । আসুন একসঙ্গে ফাইন্যাল খেলাটা উপভোগ করি । ”
“ যদিও উপভোগ্য নয় । ” … ইন্দ্রদা এরকম ঠোটকাটা কথা বলছিল কেন বুঝতে পারছিলাম না । আমরা চেয়ারে বসলাম । বড় প্রোজেক্টরের পর্দায় ভেসে উঠল ফাইন্যাল খেলা । প্রথমেই দেখা গেল ভি আই পি গেস্টের সিটগুলো । তারপর দেখলাম জয়পুর ক্লাবের বিপক্ষ টিমের প্লেয়াররা চেয়ারে বসে কফি আর টিফিন খাচ্ছে । হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা কথা … ইন্দ্রদা বলেছিল কফিতে নাকি বারবিটন মেশানো আছে , যদিও সেটা প্লেয়ারদের কফিতে নাও থাকতে পারে । কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারলাম না । এইজন্যই কি প্রত্যেক ম্যাচে জয়পুর জিতে যাচ্ছে ? তার মানে কি জয়পুর টিমের কেউ জেনেশুনেই কফিতে বারবিটন মিশিয়েছে ? কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? সামান্য একটু বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ার একদম খেলতেই পারবে না , সেটা কি করে হয় ? নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । প্রোজেক্টর স্ক্রিনের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল , খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছে । আম্পায়াররা চলে এসেছেন , ব্যাটসম্যানও নেমে গেছে ।
খেলা শুরু হবার প্রথম ওভারেই শোনা গেল জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের উল্লাস । প্রথম উইকেট হাতে এসে গেছে । সৌরভ নাগের দিকে একবার চোখ ফেরালাম । খেলার সময় যেমন উল্লসিত হচ্ছিলেন তেমনই তার মনে এখনও উল্লাস রয়েছে । গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছিল , জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন সৌরভ নাগ । ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই ।
কয়েক ওভার শেষ হতেই আমার ভাল লাগছিল না বলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম । বাইরে সন্ধ্যে হয়ে যেতেই শীত ভাবটা একটু একটু করে বাড়ছিল । মাথায় একটা স্পোর্টস ক্যাপ ছিল । ভাবলাম মাফলারটা আনলে ভাল হত । ক্লাবের ঘড়িটা একটা বিচ্ছিরি ঢং ঢং শব্দ করে ছটা বাজিয়ে দিল । আমার সময় কাটছিল না , সুমিত বিশ্বাসকেও দেখলাম উশখুশ করছে । ইন্দ্রদা একমনে খেলা দেখে চলেছে । তবে সৌরভ নাগ লোকটা বেশ মজার । খেলার মাঝে মাঝেই উইকেট পতনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছিলেন ।ইন্দ্রদা কিন্তু গম্ভীর , গালে হাত দিয়ে বসে আছে । বুঝতে পারছিলাম সুমিত বিশ্বাসও বেশ অস্বস্তি ফিল করছে । ইন্দ্রদাকে বলে আমি আর সুমিতদা একটু বাইরে বেরোলাম ।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার । তবে দার্জিলিং শহরের আলোগুলো সেই অন্ধকারকে মুছে দিয়েছে । শিবতলা স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটগুলো এখন না জ্বললেও স্টেডিয়ামের প্রত্যেকটি ব্লকে ব্লকে টিমটিম করে এল ই ডি লাইট দিপদিপ করছিল ।
সুমিতদা বেশ বিরক্তির সুরেই বলল … “ ডিসগাসটিং … ঐ সৌরভ নাগ লোকটার মধ্যে এতটুকু ক্যাপ্টেনসুলভ আচরণ নেই , শুধু পাগলার মত লাফাতেই জানে । ”
“ তা যা বলেছো সুমিতদা । ”
“ আচ্ছা তোমার কি মনে হয় সৌম্য , এই খেলার পেছনে কোনো রহস্যই নেই ? তোমার ইন্দ্রদার তো কোনো সাড়াশব্দ দেখছি না । ”
“ ইন্দ্রদা কি ভাবছে জানি না , তবে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার , ম্যাচ শুরু হবার আগে যে কমপ্লিমেনটারি ব্রেকফাস্ট বা এনারজি ড্রিঙ্কস দেওয়া হয় প্লেয়ারদের , সেই কফির মধ্যে বা ড্রিঙ্কসের মধ্যে বারবিটন নামক এক ওষুধ মেশানো থাকে । ”
কথাটা শোনামাত্রই ইন্দ্রদার বন্ধু চমকে উঠল । পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল …
“ তুমি কি করে জানলে ? ”
“ ইন্দ্রদা বলেছে । ”
“ ওহ মাই গড ! সেই জন্যই খেলার সময় মাঠে নেমে শরীরটা ঝিমঝিম লাগে । মনে হয় যেন চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে । আমি নিজে ব্যাটিং করার সময় ফিল করেছি । আর মাঝে মাঝে চোখের সামনে বিদ্যুতের মত রোদ খেলে যায় বলে মনে হয় । ”
“ এফেক্ট অফ বারবিটন সুমিতদা । ”
এরপর আর ওসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি । মার্কেটে কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন ক্লাবে ফিরে এলাম তখন ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা । ক্লাবের দরজার কাছাকাছি আসতেই চমকে যেতে হল , সেই পাগলাটা নিপুণ কৌশলে ক্লাবের দরজায় উঁকি মারছে । আজ ওর মাথায় টুপি নেই । আমরা চুপি চুপি পাগলটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । সুমিত বিশ্বাস ওর কাঁধে হাত দিতেই পাগলটা চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল …
“ না ছেড়ে দাও , আমি কিছু করিনি , আমি কিছু করিনি । ”
ততক্ষনে চেঁচামেচিতে ক্লাবের ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে । ইন্দ্রদাই এসে পাগলটারহাত ধরে টেনে তুলে ওকে গণধোলাইয়ের থেকে বাঁচাল ।
“ হাই , মিস্টার চোরাকারবার । ধন্যবাদ তোমার সেদিনের ইনফরমেশনের জন্য । তবে আমি আজ এখানে উপস্থিত না থাকলে তোমার গণধোলাই কেউ আটকাতে পারতো না ।পরের বার এরকম কাজ করার আগে ভেবেচিন্তে করবে । ”
ইন্দ্রদার নির্দেশে পাগলটাকে ছেড়ে দেওয়া হল । ক্লাবে আর ঢোকা হল না । ইন্দ্রদা বলল …
“ কাল সকালে আপনারা সবাই থাকছেন তো ? সুমিত তুইও চলে আসিস ? একটা নাটকের যবনিকাপাত হতে চলেছে । ”
“ হ্যাঁ আমরা সবাই থাকবো । পরশু দিনে ফাইন্যাল কাপ দেওয়া হবে তাই একটা মিটিং ও আছে । ”
সৌরভ নাগের দিকে তাকালাম । মুখে দেখলাম গর্বের হাসি । কিন্তু হাসিটা কেমন যেন নৃশংস মনে হল ।
ইন্দ্রদা বলল … “ একবার ফাইন্যালের সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে যেতে পারি কি ? ”
কেউ আপত্তি করলো না । হোটেলে ফিরে এলাম । টাইটান ইন্দ্রদার কথা মত সিডি প্লেয়ার সঠিক সময়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেছে । নটা পনেরো নাগাদ ইন্দ্রদা একবার বাইরে বেরোল । আধ ঘণ্টা কেটে গেল । আমি সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম । ওপরে একটা হলুদ কাগজ সাঁটা রয়েছে , লেখা ছিল ‘ ফাইন্যাল ব্যাটেল ’ । বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা , হোটেল রুমের ভেতরে থেকেও তা টের পাচ্ছিলাম । ইন্দ্রদা প্রায় এক ঘণ্টা পর কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকল ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম … “ কোথায় গিয়েছিলে ? ”
“ এখন শুধু জেনে রাখ , পুলিশ স্টেশন । ”
“ এখন কি তাহলে আবার খেলা দেখা শুরু করবে ? ”
“ ঠিক তাই । ”
“ ডিনার করার পর ? ”
“ হুম । ”
“ কিছু কি সন্দেহজনক মনে হচ্ছে ? ”
“ হ্যাঁ । ” … এই ছোট উত্তরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার চলে এল । খাবার পর ঠিক এগারোটায় ইন্দ্রদা সিডি টা চালাল । একই খেলা বারবার দেখার কোনো মানে হয় না । আমি পাঁচ মিনিট দেখার পরই শুয়ে পড়লাম । ঘুম কিন্তু আসতে চাইছিল না । আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে কাল সকালেই ক্লাবে ইন্দ্রদা ক্রিকেট রহস্য ফাঁস করবে । কে হতে পারে এই রহস্যের নাটের গুরু ? কিই বা তার উদ্দেশ্য ? ঘুম আসার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম ইন্দ্রদা খেলা দেখে চলেছে । মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে … “ শুধুমাত্র বারবিটন খেয়ে যে এটা হতে পারে না সেটা বুঝতে এতটা দেরি হয়ে গেল … ”