“ তা পারবো না কেন ? ”
“ কিছু অ্যাডভানস লাগবে কি ? ”
“ কি যে বলেন আপনি স্যার , আপনি কি দার্জিলিঙে প্রথম নাকি ? আগেরবারও তো মিস পামেলার খুনের ব্যাপারে আমার দোকানে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য । আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সারভিস স্যার । ”
“ এই টাকাটা রাখো । যেদিন প্রয়োজন হবে সেদিন এসে নিয়ে যাবো । ”
“ আরে স্যার আমার কার্ডটা রাখুন , একটা ফোন করবেন , দেখবেন বান্দা সি ডি প্লেয়ার নিয়ে হোটেল মঞ্জুসায় হাজির । ”
“ ও বাবা ! হোটেল মঞ্জুসায় উঠেছি সে খবরও রেখেছ দেখছি । এখনও স্যাটেলাইটটা বেশ পাওয়ারফুল আছে দেখছি । ”
“ তা আছে স্যার । এইবারে কি তাহলে আবার কোনো রহস্যের সন্ধানে ? নাহলে দার্জিলিং এসে হোটেলে বসে সিনেমা দেখার লোক তো আপনি নয় স্যার … ”
“ এবারেরটা অন্যরকম । একটু ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছি । ”
শিবতলা স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে সুমিত বিশ্বাস বাড়ি চলে যাবার পর ইন্দ্রদা আর আমি হোটেল মঞ্জুসায় ফিরিনি । তবে সেটা যে দার্জিলিং এর রাতের সৌন্দর্য দেখার কারনে নয় তা ইন্দ্রদার সঙ্গে একটা স্যামসাং এর সারভিস সেন্টারে ঢুকেই বুঝতে পারলাম । যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল , সে একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছোকরা , নাম টাইটান , টেকনিসিয়ানের কাজ করে , বাঙালি নয় কিন্তু বাংলাটা ভালই সড়গড় আছে । আকাশী রঙের গেঞ্জিতে তার গায়ের ফর্সা রং ফুটে বেরোচ্ছিল । আমার সঙ্গে ইন্দ্রদাই আলাপ করে দিল । আগের বার মিস পামেলার খুনের রহস্যের সমাধানের সময় ইন্দ্রদাকে অনেকটা হেল্প করেছিল এই ছেলেটি । যাইহোক একটা সি ডি প্লেয়ার ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা সেই খোঁজেই এসেছিল ইন্দ্রদা । বোঝা গেল ইন্দ্রদার প্রশংসায় গদ্গদ টাইটান । কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সূর্যটাকে তুলে আনতে বললেও হয়তো ইন্দ্রদার জন্য একবার ট্রাই করে দেখতো , এ তো সামান্য একটা সি ডি প্লেয়ার ।
হোটেলে ফিরে রাতের ডিনার সেরে ইন্দ্রদা একটা লবঙ্গ চেবাতে চেবাতে বলল …
“ বুঝলি সমু , রহস্যটা বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াচ্ছে । ”
“ কিন্তু তুমি ফাইন্যালের দিন থাকবে না কেন বললে ? ”
“ থাকবো , কিন্তু ভি আই পি গেস্ট হিসেবে নয় । ”
আমি অবাক হলাম । কিন্তু আমি জানি ইন্দ্রদা এখন মুখ খুলবে না । সময় হলেই সব জানতে পারবো । দার্জিলিঙে এসে যে এভাবে ক্রিকেট রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়বো কক্ষনো ভাবিনি ।
“ একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস সৌম্য , অবশ্য সেটা তোর লক্ষ্য করার কথাও নয় । ”
“ কি ? ” … আমার প্রশ্ন ।
“ আমি যখন ক্লাবঘরের বস্তায় বলগুলো লক্ষ্য করছিলাম তখন দেখলাম বলগুলোর গায়ে পেন্সিলে করে ইংরেজির এইচ অক্ষর লেখা । তবে সবগুলোতে নেই সেটাও লক্ষ্য করেছি । ”
“ তুমি কি এর মধ্যেও জোর করে কিছু রহস্যের গন্ধ পেতে চাইছো । আমার বাপু অতসব মাথায় ঢুকবে না । বলে কি লেখা থাকল না থাকল তার সাথে খেলার হার জিতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ? ”
“ সেটাই তো রহস্য । ”
“তবে একটা জিনিস খটকা লেগেছে । ম্যাচের লিস্টটা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছিলে ইন্দ্রদা ? জয়পুর স্পোর্টিং দলের সবকটা ম্যাচই কিন্তু হয়েছে দিনের বেলায় । ”
“ গুড অ্যান্ড ক্লিন অবজারভেশন সমু । কিন্তু সেখানেও সেই একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে , সেটার সাথে হারা জেতার কি সম্পর্ক ? ”
“ সুমিতদার কথাগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য বলে তোমার মনে হয় ? ”
“ জানি না । মে বি ফ্রম লিটল বিট অফ ফ্রাসট্রেশন । ”
ইন্দ্রদা মুখে কথাটা বললেও , ও যে শুধু সুমিত বিশ্বাসের মন রাখতে শিবতলা স্টেডিয়ামে তদন্ত করতে যায় নি সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি । দিনে একটানা এতটা ঘুমিয়েও আজ সন্ধ্যে থেকেই হাই তুলতে শুরু করে দিয়েছি । অবশ্য ইন্দ্রদাও যে বেশ খানিকটা টায়ার্ড তা ওর হাবভাব দেখে ভালই টের পাচ্ছিলাম ।
“ আজ অনেক ঘুরেছি ইন্দ্রদা , তাই শরীরটাও আর টানছে না । ”
ইন্দ্রদা মুখের লবঙ্গটা জিভের তলায় রেখে বোতল থেকে এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলল … “ একটুখানি বারবিটন খেয়েই এত ঘুম এলে চলে সৌম্য ? ”
“ বারবিটন ? ” … আমি অবাক হয়ে ইন্দ্রদার দিকে চেয়ে রইলাম ।
“ হ্যাঁ , একধরনের সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ , জলে দ্রাব্য , ঘুমের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় । আজ সকালে খেলার স্টেডিয়ামে দেওয়া ব্ল্যাক কফিতে মেশানো ছিল । আমিও অবশ্য খেয়েছি , কিন্তু সহ্য করে নিয়েছি । ”
“ কিন্তু কে মেশালো ? আর তুমি বুঝলেই বা কি করে ? ”
“ কালারলেশ বারবিটনের স্বাদ হালকা তেতো হলেও সেটা ব্ল্যাক কফির স্বাদের সাথে মিশে গেছে । আর যে মিশিয়েছে সেই হল ক্রিকেট রহস্যের নায়ক ।এ ধরনের পদার্থ নিয়ে আমি আগে ক্রিমিনোলজিতে পড়াশুনো করেছি । হালকা সন্দেহ মনে জাগতেই কফির স্যাম্পেল টেস্ট করার জন্য আমার কফিতে ভেজা রুমালটা নিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে গিয়েছিলাম আমি । ”
“ কি সাংঘাতিক ! ” … মুখ দিয়ে আমার কথা বেরোচ্ছিল না ।
“ সাংঘাতিক , মিস্টিরিয়াস , অবিশ্বাস্য যাই বিশেষণ বলিস না কেন সুমিত , আমি কিন্তু এখনও পর্যন্ত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিটি ম্যাচ জেতার মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পায়নি । তবে আর কিছুদিন টাইম দে , আশা করি তোকে নিরাশ হতে হবে না । কারন ইন্দ্র – সৌম্য জুটি নিরাশ হয়ে দার্জিলিং ছাড়বে এমনটা আগে কোনো কেসে হয়নি । ”
সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল , সাতটার সময় । ফাইন্যাল দেখতে যাবো তবে ভি আই পি গেস্ট হিসেবে থাকবো না , এটুকু মাত্র জানি , আর সবই জানে ইন্দ্রদা । ব্রেকফাস্টটা হোটেলেই সারলাম । তারপর রওনা দিলাম শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে । রাস্তায় সুমিত বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হল । বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের হারটা এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সুমিতদা ।
“ কিরে ইন্দ্র , তোর তো আজ ফাইন্যাল দেখতে আসার কথা নয় । ”
“ হঠাৎ মত পরিবর্তন করলাম । চল একসঙ্গেই যাওয়া যাক । ”
মেঘবালিকার দল লম্বা চুলের গুচ্ছ খুলে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে । কখন যে বেরিয়ে শিবতলা স্টেডিয়ামটাকে ঝুপুস জলে স্নান করিয়ে দেবে ভরসা করা যায় না । তবে ওয়েদার রিপোর্ট বলছে আজ ম্যাচ চলাকালীন বৃষ্টি হবার কথা নয় । গোটা স্টেডিয়ামটা আজ লোকে লোকারণ্য । ভি আই পি গেস্টের সিটগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম , কালকে যারা ছিল তারা সবাই রয়েছে । আমরা ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম , এখানে ভিড়টা বেশ কম । সুমিত বিশ্বাসকে অবশ্য ইন্দ্রদা ভি আই পি সিটে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল । ইন্দ্রদার কথায় পরে বুঝতে পারলাম , ও এমন কিছু এখানে লক্ষ্য করতে চায় যেখানে ওর বন্ধুর থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয় । আমি বেশ অবাক হলাম । যেখানটাতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে কোনো চেয়ার নেই , তবে গায়ে সোনালী রোদের স্পর্শ পেয়ে বেশ আরামবোধ করছিলাম । মেঘবালিকার দল তখন সূর্যের চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে ।
যথারীতি খেলা শুরু হল । জয়পুরের বিপক্ষ টিম ব্যাট করছে । কিন্তু পনেরো ওভার পর ওদের অবস্থা গতকালের বলাকা ক্লাবের মতই হল । দর্শকরাও অনেকে তখন পালিয়ে যাচ্ছে । ইন্দ্রদার মনের অবস্থা যে কি বুঝতে পারছি না । মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করছিলাম ক্লাবটার দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে । স্কোর বোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই ইন্দ্রদাকে আর দেখতে পেলাম না । ছুটে গেলাম ক্লাবঘরের দিকে ।
কি মনে হল কি জানি , দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ভেতরে ঢুকলাম । আমরা যে গুদামঘরটায় কাল ঢুকেছিলাম সেই দরজায় আড়ি পেতে কিছু একটা দেখছে ইন্দ্রদা । আমি সন্তর্পণে পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইন্দ্রদা আমাকে গায়ে হাত দিয়ে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিল । আমিও এবার উঁকি মারলাম । দেখলাম সেই পাগলটা ঘরের ভেতরে কিছু একটা খুঁজছে । একবার ব্যাটগুলো তুলে জোরে জোরে নাড়া দিল । উইকেটগুলো একবার হাতে তুলেই ফেলে দিল । আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছিল না ।এবার দেখলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটাতে পাগলাটা একটা ধারালো ছোরা বের করেছে । আলখাল্লার মত জামার পকেটটা থেকে একটা টর্চ লাইট বের করতে দেখলাম । পাগলটা মনে হল এবার বলের বস্তাগুলোর দিকে এগোচ্ছে । টর্চের সামান্য আলোতেই লক্ষ্য করলাম আজ ওর মুখে পাগলামির কোনো চিহ্ন নেই , নিস্পলক চোখে বস্তাগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে ।
এবার ও বস্তার দড়িটা খুলে কতকগুলো বল নেড়ে চেড়ে মাটিতে ড্রফ মেরে দেখল । তারপর অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল , একটা বলকে ছোরা দিয়ে মাঝামাঝি কেটে দু ফালা করে দিল । বুকপকেট থেকে একটা ছেঁড়া ময়লা ছোট ডায়রির মত কি একটা বের করল । লক্ষ্য করলাম ওর কাছে পেনও রয়েছে । পেনে করে ডায়রিতে কিছু একটা লিখল । ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে কিছু একটা আলোর আভাস প্রতিফলিত হচ্ছে । মুখে বিড়বিড় করে বলছে …
“ পি এস … পি এস … পি এস । ”
এবার মুখের ওপর টর্চের আলো পড়তেই চমকে উঠলাম । পাগলটা চিৎকার করে বলছে …
“ কে ? কে ওখানে ? ”
ইন্দ্রদা আমাকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে সোজা ছুটে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এল । আমরা দর্শকদের মাঝে মিশে গেলাম । ইন্দ্রদা বাইরে এসে গুম হয়ে গেছে । স্কোরবোর্ডে দেখলাম খেলার অবস্থা শোচনীয় । ফাইন্যাল কাপ অবধারিত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের হাতে ।
ইন্দ্রদা বলল … “ চল সৌম্য , হোটেলে ফেরা যাক , আর খেলা দেখে কাজ নেই । ”
“ তোমার তদন্ত কতদুর এগোলো ? ”
ইন্দ্রদা হাসল । কিন্তু হাসিটা যেন পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল । ধরা গলায় বলল …
“ সুমিতের কথাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে , এই খেলার পেছনে রয়েছে এক গভীর চক্রান্ত । ”
“ সুমিতদা যে সত্যি বলছে , মনগড়া কথা বলছে না , সেটা এতটা জোর দিয়ে তুমি ভাবছো কি করে ইন্দ্রদা ? ”