হোটেল মঞ্জুসার নীল কাচ দিয়ে তুষারাবৃত হিমালয়ের রূপ দেখছিলাম । দার্জিলিঙে এসে হিমালয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতি মুহূর্তে । চা বাগান ঘেরা , পাখির কূজন ভরা , ফুলের রঙ্গিন গন্ধে মাতোয়ারা দার্জিলিং এসেছি সেই ছোটবেলায় । কিন্তু এবারে শুধু আমি আর ইন্দ্রদা । পাহাড়ের খাদের ধারে বড় বড় পাইন গাছ মাথা নাড়ছে । মাঝখানে পাতার ফাঁকের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ঝলমলে রোদ্দুর । কোলকাতার ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে হাঁফিয়ে উঠেছিল মন । তাই দুজনে বেরিয়ে পড়েছি এবার মানুষের দৈনন্দিন কোলাহল ও দূষণ থেকে বহুদূরে ।
ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল … “ কিরে কেমন লাগছে দার্জিলিং ? ”
“ ভাল । ”
“ শুধু ভাল ? ”
“ হ্যাঁ শুধুই ভাল । তুমি তো যেখানেই যাও সেখানেই রহস্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে । কই এবারে তো আর তেমন কিছু হল না ? ”
“ ওহো এই ব্যাপার , তা দার্জিলিঙে এসে হিমালয়ের থেকে আর বেশি কি রহস্যময় তুই আশা করিস ? ”
যাইহোক আমাদের কথার মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠল । আমিই গিয়ে দরজা খুললাম । এক অপরিচিত ব্যক্তি , বয়স ইন্দ্রদার মতই সাতাশ আঠাস হবে , বেশ লম্বা চওড়া , গৌরবর্ণ , মাথাভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল , চোখে ফাসট্র্যাকের সানগ্লাস , কপালে ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ ।
ভদ্রলোক বললেন … “ ইন্দ্রজিৎ আছে ? ” ততক্ষনে ইন্দ্রদা উঠে এসেছে । ওরা কিছুক্ষণ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল । তারপর ইন্দ্রদাই প্রথম কথা শুরু করল …
“ আরে সুমিত না ? কেমন আছিস ? ”
“ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস , তুই কেমন আছিস ? ”
“ ভাল । তা তুই এখন কি করছিস ? শুনেছি নাকি একটা ক্রিকেট দলের পরিচালনা করিস ? ”
“ ঠিকই শুনেছিস , একটা ছোটখাটো ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন । আর তুই তো এখন বেশ নামকরা ডিটেকটিভ … দার্জিলিঙেও তো তোর নাম ছড়িয়ে গেছে রে সেবারে কি একটা রহস্যের কিনারা করে । ”
“ হ্যাঁ ঐ আর কি । ”
“ আমি কালকেই জানতে পারলাম তোরা দার্জিলিং বেড়াতে এসেছিস , তাই দেখা করতে চলে এলাম । তা তোর সঙ্গে এটি কে ? তোর সেই বিখ্যাত অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌম্য বুঝি ? ”
আমার সঙ্গে পরিচয়ের পালাটা শেষ হতেই ইন্দ্রদা হোটেলে তিনটে কফির অর্ডার দিল । ততক্ষনে হালকা এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে । পাথুরে মাটির সোঁদা গন্ধে সে এক আলাদা আমেজ ।
অনেকদিন পর দুই বন্ধুর রিইউনিয়ন খোশমেজাজেই চলছিল । তারপর একসময় ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিতদা বলে উঠল …
“ তোরা কোলকাতা কবে ফিরছিস ? ”
“ আপাতত চার পাঁচদিন তো এখানে আছিই । ”
“ তাহলে সৌম্যকে নিয়ে কাল সকাল আটটা নাগাদ একবার শিবতলা স্টেডিয়ামে চলে আয় না ? ”
“ কেন ? ”
“ কাল সেমি ফাইন্যাল ম্যাচ , আর পরশু ফাইন্যাল । আমরা সেমি ফাইন্যালে উঠেছি । তোদেরকে ভি আই পি গেস্ট হিসেবে থাকতে হবে । আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । ”
“ কিন্তু … ”
“ দার্জিলিঙের সাইটসিনগুলো অন্য দিন করে নিস । কোনো কিন্তু শুনতে চাই না । কাল আর পরশু আমাদের সঙ্গে থাকতেই হবে । এতদিন পর দেখা , এত সহজে তোকে ছেড়ে দেবো ভাবলি কি করে ? আমি কাল গাড়ি পাঠিয়ে দেবো । ”
ইন্দ্রদার বন্ধু চলে গেল । পরে ইন্দ্রদার কাছে সুমিতদার পরিচয় জানলাম । নাম সুমিত বিশ্বাস , একসময় ক্লাসের সেরা ক্রিকেট প্লেয়ার ছিল সে । যেমন ব্রিলিয়াণ্ট স্টুডেন্ট , তেমন তুখোড় ক্রিকেট প্লেয়ার । এখানে একটা কথা বলে রাখি , ইন্দ্রদার একটা পরিচয় পাঠক পাঠিকারা সবাই জানে না । একদিকে ও যেমন একজন নামকরা ডিটেকটিভ , অন্যদিকে ক্রিকেটারও বটে , যদিও খুব নামকরা নয় । ইন্দ্রদার কাছে আজই জানলাম , প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ইন্দ্রদা আর সুমিত বিশ্বাস দুজনেই ছিল ওপেনিং জুটি । মাইক্রোবায়োলজি তে মাস্টার্স করে ইন্দ্রদা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে রিসার্চ শুরু করে দিল , তারপর থেকে দুই বন্ধু দুইদিকে । ইন্দ্রজিৎ সান্যাল জয়েন করল ক্রাইম ব্রাঞ্চে । ক্রিকেটটা আস্তে আস্তে ইন্দ্রদার জীবন থেকে জলছবির মত মুছে গেল । বদলে ইন্দ্রদার গ্রিন পিচে বাউন্সারের মত আবির্ভাব হল এক মিষ্টি মেয়ে ঝিলিক সেনগুপ্ত । পেশায় ফটোগ্রাফার , ইন্দ্রদার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট । কথায় আছে না , প্রত্যেকটি সাকসেসফুল পুরুষের সাফল্যের পেছনে একজন নারীর অবদান আছে । ইন্দ্রদার ক্ষেত্রেও তেমন এই ঝিলিক সেনগুপ্ত । গল্পের প্রয়োজন ছাড়া ইন্দ্রদা অপ্রাসঙ্গিক মানুষের বিবরণ দেওয়া একদম পছন্দ করে না । তাই ইন্দ্রজিৎ সান্যাল ও ঝিলিক সেনগুপ্তের প্রেমপর্বটি একান্তই ব্যক্তিগত ভেবে বিষয়টির ইতি টানলাম এখানেই । অনেকটা অফ স্ট্যাম্পের বল কাট না মেরে সেফলিলিভ করা , কারন বয়েসে ইন্দ্রদার থেকে অনেকটা ছোট হওয়ায় ওর কাছে এল বি ডবলু হবার ভয় আমার আছে ।
বাইরে কালো মেঘের অবগুণ্ঠন মোচন করে সূর্যদেব উঁকি মারছেন আকাশ থেকে । সূর্যের আলোটা পাহাড়ের বরফের উপর পড়ে চমৎকার দেখাচ্ছে । আর সেই মলিন আলোয় মিশে যাচ্ছে গোটা চা বাগান লাগোয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চল । ঘন পাইন ফার ওক বনের পরতে পরতে যেন কোনো রহস্য উঁকিঝুঁকি মারছে । গলার মাফলারটা বিছানাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগ থেকে দার্জিলিং জমজমাট বইটা এনে পাতা ওলটাতে লাগলাম । পরশু টাইগার হিল দেখতে গিয়েছিলাম তাই আজকের দিনটা দার্জিলিং ঘুরে দেখার জন্য স্থির রইল ।
বিকেলে একটু মেঘলা মেঘলা ছিল । ইন্দ্রদা তবুও ঝিলিকদির দেওয়া হ্যান্ডিক্যামটা আনতে ভোলেনি । ঘন চা বাগানের মধ্যে দিয়ে নানা পাখির কলতান শুনতে শুনতে ঘন সবুজে চোখ ভিজিয়ে একটা পাহাড়ের খাদের ধারে এসে পড়লাম । ধীরে ধীরে সূর্য পাহাড়ের বুকে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । এই নিস্তব্ধতার মাঝেও এক আলাদা রোমাঞ্চ খুঁজে পাচ্ছিলাম আমি । ডিঊল্যান্ড পার্কে এসে বসেছি , মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন আমাদের ফলো করছে । প্রথমটা অতটা না বুঝলেও আমরা যখন পার্কের সিংহদ্বারটার কাছাকাছি তখন ইন্দ্রদা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল … “ কে তুমি ? ”
এবার যাকে দেখলাম তার চেহারার বর্ণনা দেওয়াটা বেশ হাস্যকর । দেখে মনে হল বদ্ধ পাগল , পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট , ছেঁড়া কালি লাগা একটা টি শার্ট , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি , জামার পকেটটা বেশ ভারী , মনে হয় অনেককিছু ভরা আছে , মাথায় একটা সাদা টুপি , দাঁতগুলো অদ্ভুত রকমের বড় , বয়স বড়জোর ত্রিশ বত্রিশ । প্রথমেই লোকটা এসে সোজা ইন্দ্রদার কাছে গড়গড় করে কথাগুলো বলল ইন্দ্রদাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে …
“ আপনার নাম ইন্দ্রজিৎ সান্যাল , তাই না ? হ্যাঁ আমি জানি তো আপনার নাম । কিন্তু আপনি কালকে যাবেন না , একদম যাবেন না ওখানে । তাহলে ওইসব বেআইনি চোরাকারবারের সাথে আপনিও যুক্ত হয়ে যাবেন । ও হ্যাঁ , কোথায় যাবেন না , তাই তো ? খেলার মাঠে , শিবতলা , শিবতলা স্টেডিয়াম । সত্যি বলছি ইন্দ্রজিৎ স্যার । পাগলা ভাবছেন ? আমাকে সবাই তাই ভাবে । আমি কিন্তু পাগলা নই । ”
এবার ইন্দ্রদার প্রশ্ন … “ কিন্তু তুমি কে ? ”
লোকটা অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে নিমেষের মধ্যে ছুটে চলে গেল । আমরা কিছুক্ষন ওইদিকে চেয়ে রইলাম ।
“ রহস্য যখন গজায় , তখন এমনি ভাবেই শুরু হয় সৌম্য । তোর কথাটা মিলে যাচ্ছে । দার্জিলিঙে এসেও রহস্য পিছু ছাড়বে না মনে হচ্ছে । ”
“ তাহলে তুমি বলতে চাইছো স্টেডিয়ামে কিছু একটা রহস্য রয়েছে ? ”
“ সেটা তো না গেলে বোঝা যাবে না । তবে রহস্যকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে ক্রিকেটকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম , এবারে তো দেখছি দার্জিলিঙের পাটা পিচেও রহস্যের বল সুইং করবে মনে হচ্ছে । ”
“ ক্রিকেট রহস্য ? ”
“ না সৌম্য , রহস্যের নাম ক্রিকেট । ”
( ক্রমশ:)