প্রিম্যাচিওর

হৃষিকেশ বাগচী
5 রেটিং
2635 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 3 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

(১)

  সকালবেলা প্রতিদিন  যেমন বর্ধমান যাব বলে বেরোই সেদিনও বেরিয়েছি। সবে নৈহাটি লোকাল ব্যারাকপুর থেকে শ্যামনগর পৌঁছেছে। এমন সময় দেখি বনানীদির ফোন।

  বনানীদি সম্পর্কে আমার বউয়ের জেঠুর মেয়ে।বয়সে আমার থেকে ছোট। তবে সম্পর্কগত কারণে দিদি বলে ডাকি।

  ফোন এসেই কেটে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের পাশের কামরায় বসায় কিছু শুনতেও পাচ্ছি না। নৈহাটি স্টেশনে নেমে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে মা তারা এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রিং ব্যাক করলাম।

  হ্যাঁ, দিদি বলুন। ফোন করেছিলেন?

  অনির্বান, খুব দরকারে পড়ে তোমাকে ফোন করেছি। তুমি এখন কোথায় আছ?

  তারপর বানানীদি যা বললেন তার সারবত্তা মোটামুটি এইঃ দিদির যে বাচ্চা মেয়েটা হয়েছে ও প্রিম্যাচিওর। সাতমাসেই হয়ে গেছে। জন্মের পর দেখা গেছে ওর হার্টে ফুটো। নেওটিয়ায় ভর্তি ছিল। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন কিছু করার নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দিদি মেয়েকে পৃথিবীতে এনেছেন। সে ঘটনা আমি জানি। তাই তারপর ওরা দিল্লির এইমস-এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করায় ওরা বলে বাচ্চাকে নিয়ে দিল্লি আসতে। ওরা জরুরি ভিত্তিতে প্লেনের টিকিট বুক করেছে। বাচ্চাকে অক্সিজেন দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই একজন ডাক্তারবাবু সঙ্গে গেলে প্লেনে কর্তৃপক্ষ অ্যালাউ করবে। আমার কথা হঠাৎ করে মনে পড়ায় সকালবেলায় ফোন।

  আমার সোমবার হাসপাতালে অনেক কাজ থাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু বনানীদি এমন কাঁদো-কাঁদো গলায় ফোন করলেন যে কি বলব ভেবে পেলাম না। রাজি না হয়ে উপায় কি? আমারও নতুন বিয়ে হয়েছে। নতুন শ্বশুরবাড়ি। নতুন কুটুম্বিতা। তারপর আমার মেয়েটাও ক’দিন আগেই হয়েছে। ওও আটমাসে হয়েছে। একমাস আগেই হয়েছে। যাহোক, এখন ভাল আছে। পুচুর মুখটা মনে পড়ল। মনে বুঝলাম কিছু হবার নয়। এতটুকু বাচ্চাকে ওপেন হার্ট সার্জারি করে বাঁচিয়ে তোলা মুখের কথা নয়। তবু ওরা আশায় বুক বেঁধে আছে। জানিয়ে দিলাম আসছি।

  কয়েকদিন আগেই আমার বউ দীপা বনানীদির কথা বলছিল। দিদির বিয়ে হয়েছে অনেকদিন কিন্তু বাচ্চা হচ্ছিল না।  অনেক টাকা খরচ করে ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা করিয়ে এই বাচ্চাটা পেটে আসে। তাই এই মেয়েটা অসম্ভব কাঙ্খিত। দিদি নিজেও ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। প্রেগন্যান্সির সময় বেশি ছুটি নিতে পারেননি। ভাড়া গাড়িতে অফিসে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ছ’মাসের পর থেকেই অল্প-অল্প জল ভাঙতে শুরু করে। অনেক চেষ্টা করেও একমাসের বেশি আটকে রাখা যায়নি। সাতমাসেই লেবার পেন উঠে যায়।

  দিদি মেয়ে হবার আগেই একমাস নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। একমাস ঠায় শুয়েছিলেন বেডে। বেডের পায়ের দিক ওঠানো ছিল। বাথরুম পর্যন্ত যাননি। এত কষ্ট করে এই মেয়েকে পৃথিবীতে এনেছেন। তাই আশায় বুক বেঁধেছেন। যদি কিছু করা যায়।

(২)

  আমার বউ দীপা বাচ্চা হবার পর এখনও বাপের বাড়িতেই আছে। বাড়ি ফিরে জামাকাপড় গোছগাছ করতে শুরু করলাম। আমার কাজটুকু শুধু পৌঁছে দেওয়া। কালকের মধ্যে আমাকে ফিরতেই হবে। জামাকাপড় প্রায় কিছুই নিলাম না।

  কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করতে হয়। তোরও তো এমন হতে পারত। মা বলল।

  হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো রাজি হলাম।

  বাচ্চাটা বাঁচবে তো রে?

  কি করে বলব? তবে এত ছোট বাচ্চার হার্ট সার্জারি সবসময় রিস্কের।

  কি হয়েছে মেয়েটার? হার্টে এই বয়েসে কিভাবে ফুটো হয়? মা সাধারণভাবে জানতে চাইল।

  আমাদের ডাক্তারদের এইসব প্রশ্নের উত্তর সারাজীবনে বহুবার দিতে হয়।

  সবটা জানি না। তবে বাচ্চারা সময়ের আগে জন্মালে জন্মগত ত্রুটির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত থাকার চেষ্টা করলাম।

  পৌঁছেই আমাকে ফোন করিস। তোর বউও বাড়িতে নেই। চিন্তায় থাকব।

  হঠাৎ মোবাইল বাজল। দেখি বউ।

  তুমি যাচ্ছ তো? এইমাত্র জেঠু ফোন করেছিল। ফোনে খুব কান্নাকাটি করছে। বাচ্চাটা বাঁচবে তো গো? অবধারিত সেই প্রশ্ন।

  চেষ্টা তো করবে। যতক্ষণ বেঁচে আছে ফেলে তো দিতে পারে না!

  তুমি পৌঁছে ফোন কোরো। আর শোন, এ.টি.এম. কার্ডটা মনে করে নিয়ে যেও। না মনে করিয়ে দিলে তো নির্ঘাত ভুলে যাবে।

  আমি আবার স্নান করে নিলাম। সারাদিন কোথায় থাকব কে জানে? ঘড়িতে সাড়ে দশটা মানে আর আধঘন্টার মধ্যে বেরোলেই হবে। মাকে বললাম ভাত চাপাতে। সেদ্ধ ভাত খেয়েই বেরোব। পুচুটা কেমন আছে কে জানে? তাড়াহুড়োতে দীপাকে জিজ্ঞাসা করাই হল না। পুচুর জন্মের সময় দু’কেজি ওজন ছিল। দশদিন ইনকিউবেটরে ছিল। এখন বেশ কান্নায় জোর এসেছে। কোলে নিলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং তুলে এনেছি। সময় পেলে বসে দেখি। প্রচন্ড শীতে হয়েছে। ডিসেম্বরের বারো। বিছানার পাশে সারারাত রুম হিটার জ্বালিয়ে রাখা হয়। ঠান্ডা আর ইনফেকশন এই প্রিটার্ম বাচ্চাদের যম। বাইরের লোকদেরও আদর করতে মানা করেছিলাম। দীপা আর ওর  বাড়ির লোকেরা অনেক কষ্ট করে আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। এখন পুচুকে একটু মানুষের বাচ্চা বলে মনে হয়। ওর যেটা ভাল তা হল মায়ের বুকের দুধটা টেনে খায়। তাই ওজনটাও ভালোই বাড়ছে।

  স্নান সেরে নিলাম। হালকা হাফ সোয়েটার নিলাম। কে জানে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে ঠান্ডা কেমন থাকবে।

  বিধাননগরের হাডকো মোড় থেকে এ.সি. বাসে চেপে এয়ারপোর্ট রওনা দিলাম। মনে কেমন একটা আশঙ্কা হচ্ছিল। রাস্তাঘাটে কিছু হবে না তো?  বাচ্চাটাকে অক্সিজেন দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে তো? প্লেন ওপরে ওঠা বা নিচে নামার সময় বায়ুরচাপের পরিবর্তন হয়। সিলিন্ডারটা বিগড়াবে না তো?

  আমার কর্তব্য যে কি সেটাও পরিষ্কার করে বুঝতে পারছি না। মেয়েটার আকাশে মাঝপথে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আমিই বা কী করব? আমার অবস্থাটা অনেকটা সর্দার নিধিরামের মত। যা হোক এসেই যখন পড়েছি ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বাইরের দিকে তাকালাম। সারা কলকাতা পাগলের মত ছুটে চলেছে। কারোর জন্য অন্যের একফোঁটা সময়ের অবকাশ নেই। এসবই তো জীবনের অঙ্গ। সবই তো জীবনের জন্য। নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে কি বিপুল সমস্যা মানুষের। কত সংকীর্ণ এই ভালোথাকা আর খারাপ থাকার মধ্যবর্তী গলিপথ। বেঁচে থাকাটাই যেন আশ্চর্যের।

(৩)

  বাসটা এয়ারপোর্টের সামনেই নামিয়ে দিল। গিয়ে দেখলাম বনানীদিরা কেউ আসেনি। আমি ফাঁকা সিট দেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম।  প্রায় আধঘন্টা ধরে বসে আছি। দিদিকে বিয়ের সময়তো একবারই দেখেছি। দেখে চিনতে পারব তো? মোবাইলে ফোন করব ভাবছি এমন সময় দেখি একজন দূরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আরে তিমিরদা না! হ্যাঁ, তাইতো। এগিয়ে গেলাম অ্যাম্বুলেন্সের দিকে।

  তিমিরদা বনানীদির বর। ফ্যাকাসে হেসে আমাকে ধন্যবাদ জানাল। আমিও হাসি বিনিময় করলাম। চোখ-মুখ দেখেই বুঝলাম কি ঝড় বয়ে গেছে এই কয়দিনে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর উঁকি দিলাম। বনানীদি বসে আছে। পাশে ওদের বাড়ির কাজের দিদি। দিদির কোলে চোদ্দদিনের মেয়ে। মুখে অক্সিজেনের মাস্ক। নাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাইলস টিউব লাগান। বাচ্চাটা যে বেঁচে আছে তা বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ বাদেবাদে বুকটা একটু নড়ছে। শ্বাস নিচ্ছে। চোখদুটো বন্ধ। দেখে মনে হল খুব বেশি হলে দেড়কেজি ওজন। পাতলা ন্যাকড়া আর টাওয়েল দিয়ে জড়ানো। দিদি বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ঠায় বসা। সুন্দরী। মা হবার পর একটু মোটা হয়ে গেছেন। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে আর পারছেন না। তবু শেষ আশায় একবার অন্তিম লড়াইটা লড়তে চান।

  অনির্বান বাচ্চাটাকে একটু খাইয়ে দেবে?

  অনুরোধটা আমাকে করা। আমি অ্যাম্বুলেন্সে উঠে হাত ধুয়ে সিরিঞ্জ দিয়ে ব্রেস্ট মিল্ক খাইয়ে দিলাম। তখনই বাচ্চাটাকে সামনে থেকে দেখলাম। মেয়েটা দিদির মতই সুন্দর হয়েছে। ধবধবে ফর্সা, টুকটুকে লাল ঠোঁট, মাথায় কুচকুচে কালো চুল। কী অসম্ভব পরনির্ভরশীল! মুখ থেকে অক্সিজেনের মাস্কটা খুলে নিলেই মারা যাবে। জন্মের পর থেকে এটাই ওর বেঁচে থাকার জিওনকাঠি। প্রশান্ত সুন্দর শিশুর মুখ। এত অসহায় একটা শিশু জন্মের একমাস আগে থেকে আজ চোদ্দ দিন বয়স পর্যন্ত কতগুলো মানুষকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিচ্ছে। শুধু ওকে ঘিরেই বাড়ির পরিবেশ ঢেউয়ের মত একবার উঠছে আবার নামছে। অথচ নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত শিশুটি। সে যেন পৃথিবীর লোকেদের মজা দেখতেই জন্মেছে। চোখেমুখে মৃতের প্রশান্তি। জীবন্ত শব হয়ে বেঁচে আছে।

(৪)

  তিমিরদার সঙ্গে অনেকে এসেছে। তিমিরদার দাদা, জেঠুর ছেলের বন্ধু। বন্ধুটা একটু বারফট্টাই ধরণের। তবে শুনলাম সেই নাকি এতসব ব্যবস্থা এই অল্প সময়ে করেছে। বিরোধীপক্ষের কিছু বড়সড় নেতার সাথে ওর নাকি ভাল যোগাযোগ আছে। দিল্লিতে বড় একজন মন্ত্রীর সুপারিশে এইমস-এর নিওনেটলেজি বিভাগে একটা বেড আজ সকালেই ফাঁকা করে হয়েছে। ওখানে কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের ডাক্তারবাবুরা কাল সকালে দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন অপারেশন করা যাবে কিনা। ভদ্রলোকের বিমানবন্দরের একজন বড় মাপের উচ্চপদস্থ মহিলার সাথেও যোগাযোগ আছে। ওনার মাধ্যমেই এমারজেন্সি কোটায় প্লেনের টিকিট বুক করা হয়েছে। স্পেশাল পারমিশন আদায় করা হয়েছে মরাণাপন্ন শিশুটিকে নিয়ে যাবার জন্য। সামান্য কিছু ফরমালিটিস করতে হয়েছে তার জন্য। তাদের মধ্যে একটির কারণেই আমার আগমন। অন্য একটি নিয়ে গোল বাঁধল বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষের সাথে।

  কোন রুগিকে প্লেনে নিয়ে যেতে হলে ডাক্তারের মেডিকেল সার্টিফিকেট লাগে। তিমিরদা ওদের পাড়ার শিশুবিশেষজ্ঞের থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাতে ভাষাগত সমস্যা দেখা দিল। প্রভাবশালী ওই মহিলার সুপারিশে একজন বয়স্কা বিমানবন্দরের কর্মী সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিল। উনি ওনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন।

  আপনাদের কিভাবে অ্যালাউ করি বলুন তো? মেডিকেল সার্টিফিকেটে লেখার কথা “ফিট টু ফ্লাই” আর উনি লিখেছেন “এবল টু ফ্লাই”। দুটো কথা কি এক হল? পরে কোন অসুবিধা হলে তো আমরা ফাঁসব।

  ডাক্তাররা আবার ইংরেজি জানে নাকি? সব বাংলা মিডিয়ম থেকে পাশ করা। পাশের থেকে একজন অফিসার ফুট কাটলেন।

  সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। তাই গালাগালিটা গায়ে মাখলাম না। যা হোক আমরা শেষ পর্যন্ত ম্যাডামের কাছের লোক বলে উতরে গেলাম।

  এদিকে প্লেন ছাড়তে আর মাত্র আধঘন্টা বাকি। বয়স্কা মহিলা আমাদের তাড়া লাগাচ্ছেন। তিমিরদাকে লাগেজ নিয়ে উনি আগে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। লাগেজ চেকিং হবে। তিমিরদা আগে প্লেনে উঠে যাবে। আমি আর বনানীদি অ্যাম্বুলেন্স করে একটু পরে প্লেনের কাছে যাব। একটা মেডিকেল ফর্ম ফিলআপ করে দিলাম। তিমিরদা ফর্ম আর দুটো লাগেজ নিয়ে চলে গেল।

  আপনি তো ডাক্তারবাবু তাই না?

  হ্যাঁ। আপনি তো তিমিরদার বন্ধু, না?

  আর বলবেন না দাদা কাল রাত থেকে যা চলছে! ম্যাডামকে ধরে সব তো ম্যানেজ হল। এখন বাচ্চাটাকে নিয়ে আপনারা পৌঁছালে শান্তি।

  কিন্তু এতবড় অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে ওরা কি প্লেনে উঠতে দেবে?

  আরে না না। ওর জন্য কাল রাতে ব্যাঙ্গালোর থেকে স্পেশাল অক্সিজেনের সিলিন্ডার আনানো হয়েছে। কলকাতায় পাওয়া যায় না। প্লেনে গেলে ওই অক্সিজেন নিয়েই যেতে হয়।

  বাবা আপনার তো বিরাট কানেকশন মশাই।

  ওসব ঝান্ডাবাজি করলে আপনারও হয়ে যাবে। দুজনেই হেসে উঠলাম। ভদ্রলোককে আপাতভাবে যতটা স্থূল বলে ভাবছিলাম কথা বলে তা মনে হল না। বেশ ভালই লাগল। পরোপকারী, এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারোর উপকার পেতে হলে যদি বিশেষ রঙের আবির মুখে লাগাতে হয় তাতে অসুবিধে কোথায়?

  প্লেন ছাড়তে আর মিনিট কুড়ি। এয়ারপোর্টের অ্যাম্বুলেন্স এল। বনানীদি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স থেকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। অক্সিজেন মাস্ক পালটে দিলাম। হাসপাতালে অক্সিজেন বা এয়ারপোর্টের অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেনে বাচ্চাটার কোন অসুবিধে হতে দেখলাম না। আমার ব্রিফকেসটা আর দিদির বাচ্চার সামগ্রী নেওয়া ছোট ব্যাগটা চেকিং হল না। ওগুলো সঙ্গে নিয়েই অ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। এয়ারপোর্টের অ্যাম্বুলেন্স আমাদের পেছনের গেট দিয়ে প্লেনের কাছে নিয়ে যাবে এমনই কথা হল।

  সমস্যা বাঁধল অ্যাম্বুলেন্স যখন এমারজেন্সি গেটের কাছে এল। ওই চেকপোস্টে সব আর্মির লোক। তারা কিছুতেই বোর্ডিং পাস ছাড়া আমাদের যাবার অনুমতি দেবে না। সমানে ওয়াকি টকিতে আর বয়স্কা মহিলার মোবাইলে কথার আদান প্রদান হতে থাকল। আমরা অসহায়ের মত অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর বসে আছি। প্লেন ছাড়তে আর মিনিট পনর। আমাদের ছাড়া বাকিদের বোর্ডিং হয়ত কমপ্লিট হয়ে গেছে।

  অবেশেষে একজন সুটেড বুটেড অফিসার এলেন। আমাকে নেমে যেতে বললেন। দিদিকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে গেল। উনি আমাকে এয়ারপোর্টের গাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে চললেন। ভদ্রলোক নিজের হাতে আমার ব্রিফকেস নিয়ে দৌড়চ্ছেন। আমি পেছন পেছন দৌড়চ্ছি। সিকিউরিটি গেটে গিয়ে দেখি সবার ব্যাগ খুলে চেকিং হচ্ছে। জলের বোতল, কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। আমার ব্রিফকেসে দুটো জলের বোতল ছিল। ওসব চেকিং হল না। ভদ্রলোক নিজে সিকিউরিটি ট্যাগ লাগিয়ে আমাকে পাশের গেট দিয়ে নিয়ে গেলেন।

  অ্যাম্বুলেন্স দেখি এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি উঠে বসলাম। একজন ছোট ছোট হলুদ রঙের তিনটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এল। আমি ডাক্তার হতে পারি কিন্তু অমন অক্সিজেন সিলিন্ডার আমিও জীবনে দেখি নি। সিলিন্ডারটা সেট করে বাচ্চাটার মুখে পরাতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ! এর সঙ্গে যে মাস্ক দেওয়া আছে সেটা তো অ্যাডাল্ট মাস্ক। বেবি মাস্ক তো আলাদা। যেই না সেই মাস্কটা বাচ্চাটার মুখে পরালাম বাচ্চাটা অস্থির হয়ে উঠল। এই প্রথমবার ঠোঁটের কাছটা, নাকের ডগা নীল হয়ে উঠল দেখতে পেলাম। বুঝলাম এই কয়েক সেকেন্ডের অক্সিজেন ডিস্যাচুরেশনেই ওর সায়ানোসিস শুরু হয়ে গেছে। মেয়েটা চিঁচিঁ করে উঠল। কান্নার জোরও নেই বাচ্চাটার। এই প্রথম ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। অক্সিজেন লিক্‌ করছে।

  বুঝলাম ভুল করে ব্যাঙ্গালোর থেকে এই সিলিন্ডার পাঠিয়েছে। অথবা এত ছোট বাচ্চার কোন অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যাবস্থাই হয়ত নেই।  যাই হোক আমি ওকে তাড়াতাড়ি করে আবার পুরনো মাস্কটাই পরিয়ে দিলাম। কিন্তু সে আগের মত আর সুস্থির থাকল না। বুঝতে পারলাম সামান্য কয়েক সেকেন্ডের অক্সিজেন ঘাটতিই ওর শরীরে যথেষ্ট বিষ ঢেলে দিয়েছে।

    আমাদের দেরি হচ্ছে দেখে তিমিরদাও লাগেজ নিয়ে প্লেন থেকে নেমে এসেছে। এদিকে প্লেন ছাড়ার সময় পার হয়ে গেছে। আরও দু-তিনজন অফিসিয়াল নেমে এসেছেন। তাদের মধ্যে পাইলটও আছেন। এয়ারপোর্টের মেডিকেল অফিসারও এসেছেন। কিন্তু কিছুই করা গেল না। বাচ্চাটা যে ক্রমশ খারাপ হচ্ছে তা বুঝতে পারছি। শ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। ঠিক হল আমরা বাচ্চাটাকে একটু সুস্থ করে পরের ফ্লাইটে যাব। কিন্তু যাবই বা কি করে? এই সিলিন্ডার দিয়ে তো আর বাচ্চাকে ম্যানেজ করা যাবে না। আর বড় সিলিন্ডার প্লেনে অ্যালাউ করবে না। প্লেন ছেড়ে দিল। বাচ্চাটাকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি না করলেই নয়। আবার ম্যাডামের ফোন এল। এয়ারপোর্টের অ্যাম্বুলেন্স আমাদের কাছাকাছি কোন নার্সিং হোমে পৌঁছে দেবে। আমি মেয়েটাকে আবার টিউব দিয়ে খাইয়ে দিলাম। ঠোঁটের চারিদিকে নীলচে ভাবটা কমলেও এখনো যায় নি। কপালটা কুঁচকে রেখেছে মেয়েটা।

(৫)

  ভি.আই.পি. দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলল। প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি দাঁড়াচ্ছে আর চলছে। বেলা তিনটের ট্রাফিক। এমন সময় প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি। আমি আর তিমিরদা প্রায় হুমড়ি খেয়ে বনানীদির গায়ের ওপর পড়লাম। মেয়েটার ওপর প্রবল চাপ পড়ল। বনানীদি আর্ত চিৎকার করে উঠলেন। বাচ্চাটা দ্বিতীয়বার একটু চিঁচিঁ করে উঠল। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলাম, না বেঁচে আছে।

  দাদা কী করছেন, সাবধানে গাড়ি চালান!

  কী করব দাদা, একটা লোক বাইক নিয়ে হঠাৎ করে সামনে চলে এল। তাই জোরে ব্রেক মারতে হল।

  বাচ্চাটাকে নিয়ে ভি.আই.পি.র ওপর একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল। নার্সিং হোমের আর.এম.ও কে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। ও পালস অক্সিমিটার দিয়ে দেখল স্যাচুরেশন মাত্র সিক্সটি পারসেন্ট। হাই ফ্লো অক্সিজেন দিয়ে রাখা হল। ফ্লুইড চালান হল। পেডিয়াট্রিশিয়ানকে ফোন করা হল। উনি জানালেন আসছেন।

  এর মধ্যে খবর পেয়ে তিমিরদার দুই দাদা নার্সিং হোমে এলেন। ওনাদের রাজধানীতে টিকিট কাটা ছিল দিল্লি যাবার। খবর পেয়ে স্টেশন থেকে সরাসরি এসেছেন। টিকিট ক্যান্সেল করারও সময় পান নি। এয়ারপোর্ট থেকে আবার সেই অফিসিয়াল এলেন। সহানুভূতির সাথে বললেন, ম্যাডাম ফোন করেছিলেন। আবার দিল্লি যাবার ব্যবস্থা হলে ওনারা প্লেনের টিকিটের ভাড়াটা অ্যাডজাস্ট করে দেবেন।

  তিমিরদা ওপরে এন.আই.সি.ইউ. এর কাছে গেল। আমি নীচে চেয়ারে বসলাম। শীতকালে দিন ছোট। প্রায় পাঁচটা বাজে। সারাদিনের ধকলে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সমস্ত দিনের ঘটনাপ্রবাহ মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছিল। বিজনদার কথা মনে পড়ল। কয়েকদিন আগে ওনার বৌকে দেখতে যখন হাসপাতালে গেলাম উনি বলছিলেন, জান অনির্বাণ বনবাসের সময় পান্ডবেরা যখন প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত যুধিষ্ঠীর সহদেব থেকে শুরু করে সব ভাইদের পাশের সরোবর থেকে জল আনতে পাঠালেন। সবাই একে একে গেল কিন্তু কেউ ফিরে না আসায় তিনি নিজে গেলেন। তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন তার সব ভাইরা মৃত। বকরূপী ধর্ম তাকে বলল, তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জলপান করলে তারও ওই একই দশা হবে।

  যুধিষ্ঠীর সম্মত হলে বকরূপী ধর্ম তাকে অনেক প্রশ্ন করলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্য কী? যুধিষ্ঠীর বললেন, জীবনে এত প্রতিকূলতা সত্তেও পৃথিবীতে যে আমরা বেঁচে আছি ও বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করি এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের।

  বিজনদা এরকম বলেন। বানিয়েও বলেন অনেকসময়। এই প্রশ্নটা সত্যিই ধর্ম করেছিল কিনা তাও আমি জানি না। কিন্তু আজকের দিনে এই প্রশ্নটাকে খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। এসব ভাবতে ভাবতে চোখটা যখন লেগে আসছে তখন তিমিরদার দাদা বললেন, অনির্বাণ তুমি আর তিমির কিছু খেয়ে এস। সেই সকাল থেকেই তো না খাওয়া।

  না দাদা ঠিক আছে আমার অসুবিধে হচ্ছে না।

  আরে অনির্বান চল, চা খেয়ে আসি। তিমিরদাও জোর করল।

  পিডিয়াট্রিশিয়ান এখনও আসেন নি। আমরা ভি.আই.পি.র পাশে একটা চায়ের দোকানে হাতে ভাঁড় নিয়ে দাঁড়ালাম। 

  বুঝলে অনির্বাণ, আমি এই কয়দিনে অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি।

  তিমিরদার মুখে বেদনার হাসি। এই ক’দিনে কতবার যে আশায় নেচে উঠেছি আবার পরক্ষণেই হতাশায় ডুবে গেছি তার ইয়ত্তা নেই।

  বাচ্চাটাকে ভেন্টিলেটর থেকে কবে নামান গেল?

  চার কি পাঁচদিন আগে। শুধু অক্সিজেনে কোন অসুবিধে হচ্ছিল না। তাই কাল রাতে যখন সুযোগটা এল ভাবলাম যদি বাঁচাতে পারি। এত কিছু করেও শেষরক্ষা হল না।

  নেওটিয়ায় তো তোমার অনেক খরচা হয়ে গেছে তাই না?

  এই ক’দিনে কত যে খরচ হয়েছে তা তো এখনও হিসেবই করি নি।

  তিমিরদার দাদা এসে ডাকলেন, ডাক্তারবাবু এসেছেন।

  দেখুন বেবি দু’ঘন্টা পরেও স্যাচুরেশন মেন্টেইন করছে না মানে ভেন্টিলেটরে ওঠানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই।  নাহলে সার্ভাইভ করবে না। এখানে কোন নিওনেটাল ভেন্টিলেটর নেই। আপনারা অন্য কোথাও নিয়ে যান। ডাক্তারবাবু বলে চলে গেলেন।

  তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে চল তিমির আমি আর পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি সবাই বলছে কিছু করার নেই। শুধু শুধু চেষ্টা করে আর কোনো লাভ নেই। বনানীদির গলায় কোন দুঃখ নেই। সত্যিই যেন এর থেকে অব্যাহতি চাইছেন গত চোদ্দ দিন আর তার আগের একমাসে দুঃসহ শারীরিক ও মানসিক কষ্ট থেকে।

  বাচ্চাটাকে ওরা আবার নেওটিয়ায় নিয়ে গেল। আমি আর গেলাম না। পরপর পাঁচটা অফিস টাইমের আপলোকাল ছেড়ে বিধাননগর থেকে ভিড় সাঁতরে বাড়ি ফিরলাম।

(৬)

  তারপর আর যোগাযোগ নেই। ফোন করতেও খারাপ লাগে যদি মৃত্যুসংবাদ পাই। তিনদিন পর দীপা ফোনে জানাল যে বাচ্চাটা মারা গেছে। ওরা হাসপাতালের খরচ আর চালাতে পারছিল না। বাচ্চাটা বাড়িতেই মারা যায়।

  একটা সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু তার সতের দিনের জীবনে ওর চারপাশের জগৎটাকে তীব্রভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে চলে গেল। এই ক’দিনের জন্য পৃথিবীতে না এলেই বা তার কি এমন খারাপ হত? আর কি আশ্চর্য ও মায়ের কোল আলো করে এসেছিল ঠিকই কিন্তু অন্ধকার করে কি চলে গেল? ওর মৃত্যুটাও কি কখনও প্রচন্ড কাঙ্খিত হয়ে ওঠে নি? আর ভগবানের এরকম প্রিম্যাচিওর বাচ্চা সৃষ্টি করেই বা কী লাভ? এতে সৃষ্টির কোন নিয়ম রক্ষিত হয়?

  শেষ প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়ত ধর্মরাজ দিতে পারতেন।

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল