এক
অরুণাচল প্রদেশের মিয়াও বাজার দিয়ে হনহন করে হাঁটছেন মংলু পানজি। ছেলেটাকে ধরতেই হবে, একবার বেরিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। বাসস্ট্যান্ড এর দিকে এগোতেই কানে এলো তিনসুকিয়া-তিনসুকিয়া। মংলু আশ্বস্ত হলেন, যাক বাসটা বেরিয়ে যায় নি। কাছে যেতে দেখা গেলো পাসাং বাসে হেলান দিয়ে মাস্ক নামিয়ে বিড়ি টানছে, মংলুকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলো ” আরে চাচা এতো দেরি করলে, নেহাত টায়ার পাংচার হয়েছিল নাহলে বাস কখন বেরিয়ে যেত, আমায় সর্দার বলেছিলো যে তুমি কি আনতে দেবে, তাই আমিও অপেক্ষা করছি, কই কি দেবে তাড়াতাড়ি দাও”। মংলু বললো ” জানিসই তো আমাদের ওখান থেকে আসতে সপ্তাহখানেক লেগে যায়, আমার পরশু থেকে হোটেল এ শিফট, তোর জন্যই দুদিন আগে এলাম, যাইহোক এই প্যাকেটে 2500 টাকা আছে, আমার জন্য একটা মোবাইল ফোন নিবি তিনসুকিয়া থেকে,সরকারি সিম সহ, জানিসই তো এখন লকডাউনে এখানকার দোকান সব বন্ধ । শুনলাম তোদের ওখানে এই দামে ক্যামেরা ফোন হয়ে যাবে “। পাসাং বললো আরে কাকা ফোন কিনছো, বাহ্ বাহ্ , কিন্তু কেন ? মালিক ফোন করতে দিচ্ছে না দিচ্ছে না ? মংলু বললো আর বলিস না হোটেলের ল্যান্ডলাইন তো বেশিরভাগ সময়েই ডেড থাকে। এমন সময়ে বাস হর্ন দিয়ে দিলো, পাসাং বললো ঠিক আছে চাচা আমি বেরোই, 1 মাস বাদে ফিরবো, স্টেশনে এখন কাজের চাপ আছে, মাসখানেক আগে ফেরা যাবে না। মংলু বললো চিন্তার কিছু নেই আমি মাস দুই আগে বাড়ি ফিরছি না, তুই সাবধানে ঘুরে আয়।
তারপর প্রায় 45 দিন কেটে গেছে, এখনো পাসাং ফেরে নি। মিয়াও এর ফরেস্ট গেস্ট হাউসে মংলুর দিন যেন আর কাটছিলো না। সে এই গেস্ট হাউসের একজন আর্দালি, কিন্তু মাঝে মধ্যে রাঁধুনি বাড়ি গেলে তাকে রসুই এর কাজও সামলাতে হয়, লোকে বলে তার মত রোস্ট আর কাবাব কম লোকই বানাতে পারে। ছেলে শিবুম কে সব রান্না তো ওই শিখিয়েছে, গেস্ট হাউসে তাই সে খুবই জনপ্রিয় কিন্তু এখন মংলুর কোনো কিছুতে মন নেই, একে তো এই সময়ে সেরকম কোনো লোক নেই হোটেলে, আবার এমাসের শেষে তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে, কিন্তু ছেলেটাতো এখনো ফিরলো না, কোনো কি দুর্ঘটনা হলো ? এভাবেই আর দিনদশেক কাটলো, এমন সময় হঠাৎ একদিন পাসাং হাসিমুখে হাতে বাক্স নিয়ে গেস্ট হাউসে এসে হাজির। বললো যে এখন তো মালগাড়ি আর স্টাফ স্পেশাল ছাড়া আর কোনো ট্রেন চলছে না, তাই ওপরওয়ালা বলছিলো অনেককে বসিয়ে দেবে সেই নিয়ে, ইউনিয়ন স্ট্রাইক ডাকায়, বেশ কয়েকদিন কাজ বন্ধ ছিল তাই ফিরতে দেরি হলো। মংলু ফোনটা বাক্স থেকে বের করে দেখতে দেখতে বললো তুই তো আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, পরের সপ্তাহে বাড়ি ফিরছি, এর মধ্যে ফোনটা না পেলে, আমার কাজটাই হতো না। পাসাং বললো তোমার বাড়িতে ফোনের কি দরকার, জঙ্গলে ঢুকলেই তো আর টাওয়ার পাবে না, সে যাই হোক আমি আসি, বাড়ি ঢুকিনি এখনো বাস থেকে নেমে সোজা তোমার কাছে চলে এলাম, তা ফোন তো নিলে চালাতে জানো তো ? মংলু বললো আরে হ্যাঁ, আমাদের হোটেলের লোকেদের ফোন থেকে কম ফোন করেছি নাকি, তুই যা, অনেক উপকার করলি বাবা। পাসাং বলল একথা বলে লজ্জা দিও না চাচা, আমি উঠি বিলটা যত্ন করে রেখো ছমাসের গ্যারান্টি আছে।
পরের রবিবার মালিকের কাছ থেকে একমাসের ছুটি নিয়ে মংলু বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, তার বাড়ি হলো অরুণাচল প্রদেশের চ্যাংল্যাং জেলায় যা মিয়াও থেকে প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দূরে, জেলাটি বিজয়নরের অন্তর্গত , সেখানে পৌঁছানো সহজ ব্যাপার নয়, দুর্গম নামদাফা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে, পাহাড়ের ঢাল বরাবর নিরন্তর চড়াই-উৎরাই করে ৭ দিন সময় লাগে মায়ানমারের সীমান্তবর্তী মংলুর গ্রামে পৌঁছতে। আর্মির বাবুরা অবশ্য মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টারে করে যাতায়াত করেন, এখন টুরিস্ট দের জন্যও সেই ব্যবস্থা চালু হয়েছে, কিন্তু মংলুর মত সাধারণ লোকের জন্য এই দুর্গম জঙ্গল ও পাহাড় পেরোনো ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। মংলুর সাথে আরো কয়েকজন ছিল, একা এই পথে যাতায়াত করা ঠিক নয়। জঙ্গলে শুয়ে প্রথম রাত্রে পকেট থেকে নতুন কেনা ফোনটা বের করে মংলু দেখলো সত্যিই কোনো টাওয়ার নেই। বুকের মধ্যে এক অজানা আশংকা নিয়ে মংলু শুয়ে পড়লো।
সহযাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও মংলুর চোখে ঘুম নেই, অবশ্য এই জঙ্গলে ঢুকলে সে ঘুমোতেও পারেনা, এই জঙ্গল তার বৌকে খেয়েছে, তার বড় মেয়েকে খেয়েছে। বছর পাঁচেক আগে তার বৌ মাথা ঘুরে পরে যায়, মাথা ফেটে গিয়ে বৌ অচৈতন্য হয়ে পরে। গ্রামের ডাক্তার শহরে নিয়ে গিয়ে XRay করতে বলেন, কিন্তু এই রাস্তা পার করার আগেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। তার মেয়েরও প্রায় একই অবস্থা, বাচ্চা হতে গিয়ে খুব রক্ত বেরোচ্ছিল, আবার গ্রামের ডাক্তারবাবু বলেন শহরে না নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুর্গম রাস্তা তার মেয়েও পার করতে পারেনি। তাদের জেলায় প্রায় 4400 জন লোক থাকেন প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে এই রাস্তায় কোন না কোন প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তারা। এসব ভাবতে ভাবতেই একসময়ে মংলুর চোখ জুড়িয়ে আসে। পরেরদিন সকালে উঠে আবার তারা গ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়।
ছয়দিন পর মংলু বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ি পৌঁছে দেখে বাড়িতে খুবই ব্যস্ততা, আসলে তার পুত্রবধূ সিমি সন্তানসম্ভবা, দুয়েক দিনের মধ্যেই বাচ্চা হওয়ার কথা, বাড়িতে তাই মংলুর ছোটমেয়ে, বোন, শালী সবাই রয়েছে বেশ একটা হৈহৈ ব্যাপার। স্নান খাওয়া সেরে মংলু এক কোনায় গিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে চার্জে বসালো। চার্জ শেষে অন করতে দেখা গেলো 1-2 টো টাওয়ার এসেছে, আনন্দে মংলুর চোখে জল এসে গেলো। কিন্তু এখনই কাউকে কিছু জানালো না।
আগের বার কাজে গিয়েই মংলু শুনেছিলো, যে সরকার এতদিন বাদে বিজয়নগরে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছে যাতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাথে সেনাবাহিনী সহজেই যোগাযোগ করতে পারে ও এর ফলে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও ভারত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন চ্যাংল্যাং এও পৌচচ্ছে BSNL এর 2G মোবাইল পরিষেবা এবং এই August মাসেই। তিনদিন বাদে দুপরে সিমির প্রসববেদনা উঠলো, কিছু সময় পরে মেয়ে এসে জানালো ছেলে হয়েছে। সন্ধ্যায় সবাই একসাথে বসে রয়েছে, সিমির ও জ্ঞান ফিরেছে, দাইমা জানিয়েছে ভয়ের কিছু নেই সব স্বাভাবিক। এমন সময়ে মংলু পকেট থেকে ফোন টা বের করলো সবাই অবাক হতে মংলু বললো ওরে তোরা জানিস না আমাদের গ্রামেও মোবাইল পরিষেবা চালু হয়েছে, তাইত বাবুর থেকে ধার করে ফোনটা কিনেছি, খোকাকে সুসংবাদটা জানাতে হবে না।
দুই
দার্জিলিং এর Hotel Hill Mist এর শেফ শিবুম অন্যান্য স্টাফেদের সাথে ফাঁকা ডাইনিং রুমে বসে তাস খেলছিল, এমনিই এই বর্ষায় এখানে অফ সিজন, তার ওপর এই লকডাউনের জন্য কোনো টুরিস্ট নেই। ওরা প্রায় সবাই বাড়ি ফিরতে চায়, কারণ এই মুহূর্তে হোটেলের সেরকম কোনো আয় নেই, মালিক ভালোমানুষ তাই কারো খাওয়া থাকার কোনো অভাব নেই কিন্তু কাউকেই পুরো মায়না দিতে পারছেন না, কিন্তু পাহাড়ে হাতে গোনা কিছু গাড়ি চলছে কিন্তু তার আকাশছোঁয়া ভাড়া তাই এখানে পরে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হোটেলে এই মুহূর্তে আছেন প্রৌঢ় মালিক সমীরণ ঘোষ ও একটা রুমে রয়েছেন তার বন্ধু ও পাশের একটি স্কুলের গেম্স্ টিচার রণদীপ হালদার। শিবুম এর অবশ্য পয়সার চিন্তা নেই কারণ ও যেহেতু মালিকের রান্না করে, তাই ওর পয়সা ও ঠিকঠাক পেয়ে যাচ্ছে আর তাছাড়া ও গেল বছরের শেষেই বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে, আবার দিওয়ালির ছুটি মিটে গেলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা হবে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু শিবুম শুনেছে ওর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, দিন পনের আগে ওর বাবা ফোনে জানিয়েছিল। শিবুম জানে যে, ওর বাবা একবার গ্রামে চলে গেলে আর কোনো কথা হবে না তাই সারাক্ষন মনের মধ্যে একটা দোলাচল কাজ করছে।
হঠাৎ সশব্দে হোটেলের ফোনটা বেজে উঠলো, শিবুম ই পাশে ছিল, গিয়ে হ্যালো বলতেই ওকে চমকে দিয়ে ওপাশ থেকে পরিচিত গলায় আওয়াজ এলো কে শিবুম ? ও আশ্চর্য হয়ে হ্যাঁ বলতেই ওপাশ থেকে মংলু বললো অভিনন্দন খোকা তুই বাবা হয়ে গেছিস, তোর ছেলে হয়েছে। শিবুম যেন বিশ্বাস করতে পারছিলো না, বললো কিন্তু তুমি যে বললে গ্রামে ফিরছো, মিয়াও এ আবার কবে এলে ? মংলু বললো আরে আমি বাড়ি থেকেই বলছি, এই মাস থেকেই আমাদের গ্রামে মোবাইল সার্ভিস চালু হয়েছে রে, এখন তুই যখন খুশি বাড়িতে কথা বলতে পারবি, নে নে বৌমার সাথে কথা বল। শিবুম যেন নিজের কানকেই ভরসা করতে পারছিলো না, যে তাদের ওই প্রত্যন্ত গ্রামে যা ভারতের শেষ সীমানায় অবস্থিত সেখানে মোবাইল সার্ভিস চালু হয়েছে ও সে এতদিন বাদে নিজের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারবে। হঠাৎ ফোনে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এল, শিবুম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো, সবাই ছুটে এলো।
তিন
ম্যালের পেছন দিয়ে রাজভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে হাত ধরে হাঁটছেন দুই প্রৌঢ় রণদীপ ও সমীরণ। রণদীপ বলছেন এই করোনার জন্য অন্যরা অনলাইনে পড়াচ্ছে, স্কুলও অনলাইনে ফিজ নিচ্ছে। আমরা গেম্স্ টিচাররা পড়েছি সমস্যায় আমরা তো আর অনলাইনে খেলাতে পারি না, তাই চাকরি না গেলেও আমাদের স্যালারিতে পড়েছে কোপ। আমি ব্যাচেলার মানুষ তার ওপর তোর কল্যানে বাড়িভাড়াটাও আর লাগেনা তাই চলে যাচ্ছে, কিন্তু অন্যদের অবস্থা খুবই খারাপ। সমীরণ হেসে বললেন, তোর ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না, তোর চাকরি গেলে আমার হোটেলের ম্যানেজার হয়ে যাবি, এতো বছর বাদে তোকে পেয়েছি, আর তোকে আমি ছাড়ি ? কাবেরীকেও সব জানিয়েছি, সত্যি কথা বলতে ও খুশিই হয়েছে, বলেছে লকডাউন মিটলে তোর সাথে দেখা করতে আসবে। রণদীপ একটু লজ্জ্বা পেয়ে বললেন কি যে বলিস, এর মধ্যে ওকে আবার কেন ? সমীরণ বললেন দেখ আমার আর ওর মধ্যে স্বামী স্ত্রীর থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কই বেশি, কলেজে অবশ্য তোর সাথেই ওর বেশি বন্ধুত্ব ছিল, তুই জানিস ও তখন থেকেই অনিমেষ কে ভালোবাসতো বাবার চাপে আমাদের বিয়ে করতে হয়,ওর বাবার আমার বাবার কাছে অনেক দেনা ছিল তাই ও না করতে পারেনি আমিও ওকে আমার সমস্যা আগেই জানিয়েছিলাম, তাই প্রথম দিন থেকেই আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো। যাই হোক এখন ও অনেকদিনই অনিমেষ এর সঙ্গে লিভ ইন এ রয়েছে, আমাদের ডিভোর্স অবশ্য হয়নি কারণ প্রয়োজনও হয়নি, অনিমেষ ও আমাদের ব্যাপার সব জানে তাই তোকে ইতস্তত করতে হবেনা। রণদীপ বললেন কিন্তু তোর ছেলে মেয়ে ? সমীরণ একটু ভেবে বললেন হয়ত প্রথম দিকে মানতে একটু অসুবিধা হবে কিন্তু ওরা আধুনিক সব ঠিক হয়ে যাবে, আরে ফেসবুকে তো ছেলেই আমার account খুলে দিয়েছে, খুলে বললো বাবা এখানে তুমি তোমার সব বন্ধুকে খুঁজে পাবে, আমার প্রথমেই তোর নামটা মুখে এলো, ওমা টাইপ করতেই দেখি তোর মুখটা জ্বলজ্বল করছে, অবশ্য একমাথা টাক এর জন্য প্রথমে একটু সন্দেহ হচ্ছিলো। রণদীপ বললেন সত্যি দুদুটো বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে তোরা যেভাবে মানুষ করেছিস সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। সমীরণ বললেন দেখ ওভাবে বলিস না, আমার কাবেরির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক সম্ভব ছিল না কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমরা বাবা মা হতে পারবো না। একথা বলতে বলতে ওনারা ম্যালের মুক্তমঞ্চে চলে এসেছিলেন। সমীরণ বললেন তুই ওখানে বোস আমি একটু wine শপ এর থেকে ঘুরে আসি, যা ঠান্ডা পড়েছে।
ম্যালের চেয়ারে বসে রণদীপ পুরোনো কথা ভাবতে লাগলেন, কমার্স কলেজের 80 এর ব্যাচের ছাত্র ছিলেন দুজনে, কিন্তু সমীরণ কলেজ মাতিয়ে দিতেন নিজের অসাধারণ গান ও আবৃত্তিতে, ও রণদীপ ফুটবলে মাতাতেন ময়দান, সবাই বলতো রণদীপের বড় ক্লাবে খেলা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কলেজের সহপাঠীরা দুজনকেই একটু ঈর্ষার চোখে দেখতো, ভাবতো যেকোন মেয়েকে বশ করা এদের কাছে কিছুই না। কিন্তু রণদীপ ও সমীরণ ভালোবেসেছিলেন একে অপরকে। কিন্তু সমাজ এই সম্পর্ককে মেনে নেয়নি, ওদের ব্যাচের একজন ওদেরকে একদিন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে প্রিন্সিপাল কে রিপোর্ট করে দেয়। প্রিন্সিপাল সাথে সাথে দুজনের বাড়িতে কমপ্লেন করেন, সেই সময়ে সমকামীতা বেআইনি ছিল। দুজনের জেলও হতে পারতো। সমীরণ এর বাবা ছিলেন পুরীর জনপ্রিয় হোটেল ব্যবসায়ী ও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ, ওনার প্রভাবেই দুজনে পুলিশের ও রাস্টিকেট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায় কিন্তু আর রেগুলার ক্লাস করতে পারেনি। রণদীপ এর বাবা ছিলেন প্রাইভেট একটি সংস্থার কর্মী, তাকে কথা দিতে হয় যে তার ছেলে আর সমীরণ এর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না এই শর্তেই রণদীপ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, গ্রাজুয়েশন এর পর সমীরণ এর বাবা সমীরণকে ম্যানেজমেন্ট পড়তে বাইরে পাঠিয়ে দেন, এবং রণদীপ এর সমকামিতার কথা নিয়ে ময়দানে কানাঘুষো শুরু হয়ে যাওয়ায় কোনো ক্লাবই আর তাকে সই করতে রাজি হয়না। এই অবস্থায় রণদীপ কিছুদিন শিলিগুড়ির একটি ক্লাবে খেলে ও পরে ও ক্লাবেরই ম্যানেজার এর সুপারিশে B.P.Ed করে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দেয় দার্জিলিং এর একটি আবাসিক স্কুলে। সমীরণ এর সাথে আর কোনভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সেই সময়ে তো আর মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, আর তাছাড়া নতুন করে লোকলজ্জারও ভয় ছিল।
কনভেন্ট স্কুলের গেম্স্ টিচার হওয়ার সুবাদে রণদীপ ছিলেন ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়, ওরাই একদিন প্রিয় স্যারকে ফেসবুকে account খুলে দেয়, উনিও স্কুলের বিভিন্ন ইভেন্ট এর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করতেন, হঠাৎ বছরদুয়েক আগে একদিন সমীরণ ঘোষ এর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপর ফোনে নিয়মিত কথা হত রণদীপ জানতে পারলেন যে সমীরণের বাবা গত হয়েছেন, ওই এখন হোটেল সামলাচ্ছে, ওর স্ত্রী কাবেরী আলাদা থাকেন, ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে। রণদীপ এটা জানতে পেরে অবাকই হলেন যে দার্জিলিং এও সমীরণদের একটা গেস্ট হাউস আছে।
ফোনে দুই বন্ধুর ভালোই আড্ডা চলছিল সমীরণ কথা দিয়েছিলেন যে সামনের পুজোর সিজন টা কাটলেই উনি দার্জিলিং এ আসবেন। হঠাৎ 6ই সেপ্টেম্বর রাতে সমীরণ উত্তেজিত ভাবে ফোন করলেন রণদীপ কে, বললো এক্ষুনি news চালা, রণদীপ তাড়াতাড়ি উঠে খবর চালিয়ে নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ধারা 377 কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ আজকে থেকে সমকামিতা আর অপরাধ নয়। এরপরই রণদীপ ও সমীরণ ঠিক করেন অনেক লোকের ও সমাজের কথা চিন্তা করা হয়েছে আর নয়, অনেক দিন লোকলজ্জা র ভয়ে আপস করেছেন দুজনে এবার একসাথে থাকতেই হবে, আইন যখন সাথে আছে তখন আর চিন্তা কি। সমীরণ ঠিক করলেন অনলাইন সংস্থার সাথে পুরীর হোটেলের চুক্তি করে, নিজের বিস্বস্ত লোককে ওখানকার দায়িত্ব দিয়ে নিজে দার্জিলিং এর প্রোপার্টিতে শিফট করবেন। তবে এসবে একটু দেরি হয়ে গেলো গত বছর বর্ষার পর সমীরণ দার্জিলিং চলে এলেন, রণদীপ নিতে এসেছিলেন বাগডোগরায়, সেই থেকে দুই প্রেমী একসাথেই আছেন, গত বছর 6 সেপ্টেম্বরের দিনটা দুজনে খুব ধুমধাম করে পালন করেছিলেন। এবছর বৈশাখে একটু বাড়ি যাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু লকডাউনের জন্য আর হয়ে ওঠেনি।
এর মধ্যে সমীরণ দোকান থেকে ফিরে এসেছিলেন। দুজনে হোটেলে ঢুকতেই দেখতে পেলেন ডাইনিং এ গান চালিয়ে নাচানাচি হচ্ছে, সমীরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেই সবাই একসাথে বললো স্যার শিবুম বাবা হয়েছে, ওর বাবা ফোনে জানালো। সমীরণ খুশী হয়ে বললেন বাহ্ দারুন ব্যাপার, অনেক অনেক অভিনন্দন জানাই নবজাতককে, যখন বাড়ি যাবি আমার থেকে বাচ্চার জন্য উপহারের টাকা নিয়ে যাবি, কিন্তু বাচ্চা হলো কবে ? তোদের ওখানে তো ফোন হয় না। শিবুম বললো না স্যার এই মাস থেকেই আমাদের গ্রামে মোবাইল সার্ভিস চালু হয়েছে, বাবা সরাসরি ফোনে জানালো, বৌয়ের সাথেও কথা বললাম, বাচ্চার কান্নাও শুনলাম। আমি যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। রণদীপও শিবুম কে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললো আচ্ছা by any chance তোমার বাড়ি কি অরুণাচলের বিজয়নগরে ? সমীরণ অবাক হয়ে বললেন তুই কিকরে জানলি ? রণদীপ বললেন আমি পরশুই ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে খবর টা পড়লাম যে ভারতের অন্যতম প্রত্যন্ততম স্থান বিজয়নগর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই BSNL এর 2G পরিষেবা চালু হচ্ছে, তাই গেস করলাম আর মিলেও গেলো।
সমীরণ হাতের প্যাকেটটা শিবুম কে দিয়ে বললো না আজ তোরাই সেলিব্রেট কর আমরা নাহয় কফি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো না স্যার তা হয়না, আপনি নিজের জন্য এনেছেন। রণদীপ বললো ঠিক আছে আজ তাহলে আমরা একসাথেই সেলিব্রেট করি কি বলিস সমীরণ ? সমীরণ হেসে বললেন ঠিক আছে আগামী 6ই সেপ্টেম্বর আমরা আমাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করবো, আজ 8ই আগস্ট শিবুম এর সাথে বিজয়নগরের স্বাধীনতা তথা সংযোগ দিবস পালন করি। রণদীপ বললেন ভালো বলেছিস, সংযোগ নামটা কিন্তু খুব ভালো, শিবুম ছেলের জন্য ভাবতে পারো। দূরে কোথা থেকে যেন বিউগল ও ব্যান্ড এর আওয়াজ ভেসে আস্তে লাগলো, কেউ হয়ত আগামী 15ই আগস্টের জন্য রাত-বিরেতে প্র্যাকটিস শুরু করেছে।
(সমাপ্ত )
খুব ভালো লাগলো