“দাদা, আরেকটু ঝাল হবে। আর কি ছোট ছোট দিচ্ছেন,একটু বড় দেখে দিন না”-
একটা পেল্লাই সাইজের ফুচকা কোনো রকমে মুখে পুরতে পুরতে বলল রিনি।
“তুই আর পালটালি না , আগে মুখের টা তো ঠিক মতো গেল্”- পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজও মুচকি মুচকি হেসে সায়ন দেখছে রিনির ফুচকা খাওয়া। কলেজ ইউনিভার্সিটি মিলিয়ে এই 5 বছরে রবিবার গুলো বাদে একদিন ও এই মুহূর্ত টা মিস হয়নি ওদের জীবন থেকে। কলেজ হোক বা কোচিন ,ফেরার পথে সায়ন এর পকেট কেটে রিনি ফুচকা খাবেই। আর খাওয়ার পর সায়নের পকেট থেকে সায়নের রুমাল বের করে নিয়েই নিজের হাত মুখ মুছবে। আর বাড়ি ফিরে সায়ন ওই রুমাল টা তে রিনির ছোঁয়া টুকু বারবার নিজের চোখে মুখে বুলাবে। এভাবেই তো 5 বছর কেটে গেল। আরেকটু সময় পার হয়ে যেতে পারতো। ততদিনে এই দুস্টু মিস্টি মেয়েটার যোগ্য হয়ে উঠতে পারতো ও। মাঝে মাঝে আফসোস হয় আরো কয়েকবছর আগে কেন জন্মালো না ও। সায়ন অবাক হয়ে দেখতে থাকে রিনি কে। কেমন গো গ্রাসে ফুচকা গিলছে মেয়ে টা। ইচ্ছে করছে ওর টক জলে ভেজা নোনতা ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলতে, “পাগলী, তোকে বড্ডো ভালোবাসি”।
“আর দশ টাকার খাওয়াবি প্লিজ?” এক্কেবারে বাচ্চা একটা মেয়ের মতো কাতর গলায় আব্দার করলো রিনি। ইশ, এমন আব্দার ফেলবে কোন্ পুরুষ মানুষের সাধ্য?
“খা, খা, কে জানে ও দেশে ফুচকা পাওয়া যায় কিনা?”
মনে মনে ভাবে সায়ন, কাল থেকে তো আর এমনিতেও এভাবে ও খাওয়াতে পারবে না রিনি কে। সামনের সপ্তাহে রিনির বিয়ে। NRI পাত্র। বিয়ের পর হুশ করে মেয়েটা উড়ে চলে যাবে এক্কেবারে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ে। আজ বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিল সায়ন দের বাড়ি। এত ভালো বন্ধু সায়ন ওর, সপরিবারে নেমন্তন্ন না করলে চলে!
“নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, না পাওয়া গেলে আমি বানিয়ে নিয়ে খাবো। এই, ফুচকার রেসিপি টা আজ রাতে ডাউনলোড করে পাঠিয়ে দিস তো”
“দেব”- ফুচকার দাম দিতে দিতে শান্ত গলায় মুচকি হেসে বললো সায়ন। সায়নের রুমালে হাত মুছতে মুছতে রিনি বললো,“এই যাহ, বৃষ্টি এসে গেল তো রে। আমি আবার ছাতা টাও আনলাম না । ওই তো তোর সাথে আছে, খোল না তোর ছাতা টা”। রিনির দিকে ছাতা টা বাড়িয়ে দিতে দিতে সায়ন বললো “ভিজিস না, ঠান্ডা লেগে যাবে, সামনের সপ্তাহে বিয়ে, আর এখন জ্বর বাঁধালে মুশকিল”।
“তুই কোথাকার বীরপুরুষ রে, যে, বৃষ্টিতে ভিজলে তোর জ্বর আসবে না? আমার বিয়ে তে তোর কত কাজ আছে তা কি তুই জানিস না? তোর জ্বর হলে আমার পিঁড়ি ধরবে কে? এখুনি ছাতার তলায় আয় বলছি”- কড়া গলায় ধমক দিলো রিনি।
সামনের সপ্তাহ থেকে এই ধমক, এই আব্দার, এই হুকুম কোনোটাই থাকবে না সায়ন এর জীবনে। প্রেম টা কে সযত্নে নিজের বুকের ভেতর চেপে রেখে এতদিন লালন পালন করেছে সে, মুখফুটে কখনো প্রেম টায় সিলমোহর এর দাবি করেনি রিনির কাছে।অপেক্ষায় ছিল সঠিক সময়ের,সে সময় আর এলো না। মনে মনে ভেবেছিল, তাড়া কি, আগে রিনি কে পৃথিবীর সবটুকু সুখ দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করুক, তারপর না হয় বলা যাবে পাগলী টা কে। কিন্তু তার আগে বললে যদি ‘না’ শুনতে হয়। পাগলী টার মুখে ‘না’ শুনতে ও পারবে না। তার চেয়ে বরং ততদিন এই ভালোলাগা গুলোই ভোরের শিউলিফুলের মতো ওর মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকুক। কিন্তু সময় কেমন বদলে যায়, পড়া না বুঝলে যে মেয়েটার মাথায় চাটি মারতে সায়ন দু সেকেন্ড সময় নিতো না, আজ এক ছাতার তলায় হাঁট তে গিয়ে সেই মেয়েটার হাতে ছোঁয়া লেগে গেলেও, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে, রিনি অন্যের সম্পত্তি, তাকে ছোঁয়া র কোনো অধিকার নেই ওর। ইশ, কবে এত দূরের হয়ে গেলি রিনি? সেই আমার পাগলী রিনি। যে নোটস তৈরী করে না দিলে ঝগড়া করে চেঁচিয়ে কিল ঘুষি দিয়ে নাজেহাল করতো, ফুচকা খাওয়াতে না চাইলে এমন জোরে চিমটি কাটতো, চোখে জল এসে যেত। আজও জল আসছে তো, তফাৎ শুধু আজ রিনি না ছুঁতেও চোখে জল আসছে সায়নের, চিমটি তো দূরের কথা। নিজের অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে খামোখা। বৃষ্টির তোড় টাও বাড়লো।
“ঠিক করে ধর না ছাতা টা, ভিজে যাচ্ছি তো। সেই ক্যাবলাই রয়ে গেলি তুই!”
“ঠিক বলেছিস রে, বড্ডো ক্যাবলা আমি। ওখানে গিয়ে মনে থাকবে রিনি তোর এই ক্যাবলা টার কথা?”
রিনি তাকালো সায়নের দিকে। বৃষ্টি ভারী অদ্ভুত, এমন করে ভিজিয়ে দেয় না ,দেখে মনে হয় সবাই কাঁদছে। এই যেমন এখন রিনির চোখ দেখে মনে হচ্ছে,ওর চোখেও জল,ওর গাল টাও ভেজা ভেজা। ধুর জলের ছাটে এত ভিজে গেল মেয়েটা, কি যে করে না সায়ন, একটা ছাতাও ঠিক মতো ধরতে পারেনা। ক্যাবলা ই বটে, ঠিকই বলে রিনি।
“মনে থাকবে না আবার, থাকবে তো, যে, একটা ক্যাবলা ছেলে 5 বছর ধরে আমার হাজার অত্যাচার সহ্য করেও বলেই উঠতে পারলো না…..”
সায়ন চমকে গেল। এটা কি বললো রিনি, না কি ও ভুল শুনলো? রিনি কি কিছু বুঝতে পেরেছে তাহলে? সব্বনাশ। এক সপ্তাহ পর মেয়েটার বিয়ে, এখন এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করা মানে যা তা ব্যাপার হবে।
“কি বলে উঠতে পারলো না?” কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সায়ন।
“ভালোবাসিস…”অস্ফুটে রিনি এরকমই কিছু একটা বলল বলে মনে হলো। সত্যিই শুনতে পায়নি সায়ন।
“কি বললি একটু জোরে বল? বৃষ্টির আওয়াজে কিছু শোনা গেল না।”
“গরু কোথাকার, কি আবার, আমি একটা দজ্জাল ঝগরুকূটে মারকুটে অত্যাচারী মেয়ে এটা কখনো বলিসনি, মুখ বুজে সহ্য করেছিস, তাই বললাম। এবার তো ছাতা টা ধরতে শেখ”- ঝাঁঝিয়ে উঠে সায়নের বাঁ হাত টা টেনে নিয়ে নিজের কাঁধে রাখলো রিনি,শেষ বারের মত।
“আজ তোকে একটা কথা বলবো সায়ন”?
“নাহ, আজ না রিনি। এতদিন যখন বলিসনি, আজ থাক”।
রিনি কিন্তু থামলো না-
“তোর জন্য দুটো লাইন লিখেছিলাম রে,যদি আর বলা না হয়-
যে নোনাজল জ্বালা ধরায় চোখে,
সেই জলেরই বৃষ্টি দিয়েছি তোকে”
সায়ন ভুলেই গেছিলো পাগলী টা বড্ডো ভালো কবিতাও লিখতে পারতো। সন্ধ্যের নিয়ন আলো জ্বলে উঠেছে। 5 বছরে এই প্রথম আর এই শেষ দুজন এক ছাতার তলায় এভাবে একসাথে জল থৈ থৈ রাস্তায় ছপাত ছপাত করে পা ফেলছে। আর সায়ন অপেক্ষা করতে লাগলো, সেই শেষ ছোঁয়া টার, যেদিন রিনিও তার কাঁধে এভাবেই হাত জড়িয়ে ধরবে,যখন সায়ন রিনির বিয়ের পিঁড়ি টা ধরবে। দূরে কোনো দোকানে এফ এমে গান বাজছে
“Man ki gali, tu phuaro si aa-
Bheeg jaye mere, khwabo ka kafila..
Jise tu gungunaye,
meri dhun hain wahi..
Tu bin bataye mujhe le chal kahi
Jaha tu mushkuraye meri manzil wahi…”
খুব চেনা কিন্তু মনের কাছাকাছি থাকার গল্প