‘ করোনা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? ‘
যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাসের দাপটে সদাব্যস্ত মানুষকে আজ কাজকর্ম, বিনোদন সব লাটে তুলে দিয়ে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে যেতে হয়েছে, তার উৎস যে ঠিক কি এটা নিয়ে তর্কের কোনও শেষ নেই। আর কিছু না হোক, মেজাজটাই তো আসল রাজা! করোনা মানুষকে ঘরবন্দী করে দিতে পেরেছে ঠিকই, তবে তার মন মেজাজকে সম্পূর্ণ দমাতে পারেনি। সাধারণ মানুষ যখন দাঁত কিড়মিড় করে, হাত মুঠো পাকিয়ে করোনার অজানা জনকের উদ্দেশ্যে একের পর এক বিশেষণ এবং ভবিষ্যতে তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিচ্ছেন, বিজ্ঞানীরাও তখন সেই অদৃশ্য পিতার সন্ধানে, কারণ করোনা ভাইরাসের সৃষ্টিরহস্য খুঁজে বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাকে নিধন করার ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করতে। তবে, সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞানী, সকলেরই সন্দেহের অঙ্গুলি যাদের দিকে তাক করা, তারা আর কেউ নয়, এই ভাইরাসের পবিত্র স্পর্শ যারা প্রথমে পেয়েছিল। বিশ্বের চোখে শি জিনপিং এবং তাঁর সরকার এখন সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
কেন চীন দায়ী?
কিছু হাড় জ্বালানে বিশ্বনিন্দুকের দল আছেই, সবেতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাঁদের জন্মগত অভ্যেস। তো ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার জন্য যেসব নিন্দুকের দল চীনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে দায়ী করছেন, তাঁরা নিম্নোক্ত কি কি বিষয়কে তুলে ধরছেন একবার দেখে নেওয়া যাক,
১। নোভেল করোনা ভাইরাস কাকতালীয় ভাবে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরেই প্রথম তার অস্তিত্ব জানান দেয়। ঘটনাচক্রে এই উহান শহরেই এশিয়ার বৃহত্তম বায়ো টেকনোলজিক্যাাল ল্যাবরেটরী অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, এই গবেষণাগারে সহস্রাধিক ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা হয়, যার মধ্যে আছে এইচআইভি বা ইবোলার মত ক্ষতিকারক ভাইরাসও। ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার মতে, উহাণের এই গবেষণাগারে চীন গোপনে বায়ো যুদ্ধের কৌশল আয়ত্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এই নোভেল করোনা ভাইরাস আসলে একটি ল্যাব সৃষ্ট কৃত্রিম জৈব মারণাস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের এও অনুমান, গবেষণাগারের কোনও কর্মীর অসাবধানতার বশেই সেই কৃত্রিম ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বাইরের সমাজে, যার জন্য চীন সরকার নিজেরাও প্রস্তুত ছিল না, তারই জন্য প্রাথমিকভাবে চীনকে ভাল রকম বিপত্তির মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছে। পরবর্তীকালে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স বা ইংল্যান্ড সরকারের তরফেও এমন সন্দেহই প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তো একধাপ এগিয়ে এই ভাইরাসকে চিনা ভাইরাস হিসেবে অভিহিত করে বসেছেন, যার জেরে নিজেদের অসন্তোষ গোপন করেনি বেজিং। করোনা জাতীয় অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর নোভেল করোনা। তার অত্যন্ত অস্বাভাবিক সংক্রামক ক্ষমতা এবং অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে নিজেকে বদলে ফেলার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা এই জল্পনাকে আরও জল হাওয়া দিয়েছে। জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৭০ বার নিজের গঠনে অদবদল করেছে নোভেল করোনা, যে অস্বাভাবিক ক্ষমতাটি ষড়যন্ত্রের অনুমানের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। অনেকে এই প্রসঙ্গে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মার্কিন লেখক ডিন কুনজ এর ‘ দি আইজ অফ ডার্কনেস ‘ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে উহান শহরের বায়ো ল্যাবরেটরিতে মারণ ভাইরাস চাষের উল্লেখ আছে। এই তথ্য উল্লেখ করে অনেকেই দাবি করছেন, কৃত্রিম মারণ ভাইরাস তৈরিতে চীনের আগ্রহের কথা মোটেই গোপন ছিল না।
২। চীনে কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে অতি জরুরি পি পি ই এবং টেস্ট কিটের কোনও আকাল পড়েনি। অথচ বাকি বিশ্বে এগুলির জন্য হাহাকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি, ভারতেও পি পি ই বা টেস্ট কিটের অমিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আরো আশ্চর্যজনক ভাবে, পুরো বিশ্বকে এগুলি সরবরাহ করছে মূলত চীন। অর্থাৎ, নিজের বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মিটিয়ে চীন অন্য দেশগুলিতেও সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। এই অতি তৎপরতা অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন।
৩। জানুয়ারি মাসে রোগটির প্রকোপ ধরা পড়ার পরে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি চীন উহান শহর তথা হুবেই প্রদেশকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লকডাউন জারি করে। এবং, সেই লকডাউন সম্পূর্ণ। যে বাজারে যাওয়ার নাম করে বাঙালিরা হাওয়া খেতে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ছেন, সেই বাজারও হুবেই প্রদেশে খোলা ছিল না। প্রদেশটির কোনও বাসিন্দাকেই এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ও বাইরে বেরোতে হয় নি, সরকারই বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে সব, কিছু ক্ষেত্রে না চাইতেই। অনেক পশ্চিমী বিশেষজ্ঞের ধারণা, দীর্ঘ প্রস্তুতি ব্যতীত এই সমগ্র পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, কোভিড ১৯ বা তার কারণ নোভেল করোনা ভাইরাস যে কেবলমাত্র মেড ইন চায়না তাই নয়, এটি দুর্ঘটনা স্বরূপ ও আবির্ভূত হয় নি, পরিকল্পনা করেই এটিকে ছড়িয়েছেন চীন সরকার।
৪। International Monetary Fund, বিশ্বব্যাংক এর মত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনের মতে, সারা বিশ্ব আর্থিক মন্দার গ্রাসে পড়লেও চীন এই তালিকার বাইরে। এই ভয়াল বিপর্যয়ের কবলে পড়ে ও তাদের আর্থিক বিকাশ আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা তীব্র বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিষয়টি নিয়ে। তাঁদের সন্দেহ, তবে কি চীন সরকার পুরো বিষয়টি নিয়ে আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল? সেজন্যই কি আগাম আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থাও তারা তৈরি করে রেখেছিল? বিষয়টি সত্যিই উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। বরং, এই বাজারে চীনের সংস্থাগুলি বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছে। সবমিলিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে সত্যিই তাজ্জব হবার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৫। সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে কিছুক্ষেত্রে চীনের সন্দেহজনক আচরণ। বেশ কিছু সংস্থার অন্তর্তদন্তে জানা গিয়েছে, চীনে প্রকৃতপক্ষে যখন প্রথম নোভেল করোনা আঘাত হানে, সেটি গত বছরের মাঝামাঝি। যদিও চীন সরকারের মতে, সেটি হল ডিসেম্বর মাস। উহানে চিকিৎসক লি ওয়েন লিয়াং এর একটি নার্সিং হোম ছিল। ডক্টর লিয়াং প্রথম সোশাল মিডিয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, উহানে আচমকা নিউমোনিয়ার উপসর্গ যুক্ত রোগীর সংখ্যা বিপুল বেড়ে গিয়েছে। এই সত্য প্রকাশের মূল্য অবশ্য ডক্টর লিয়াংকে চোকাতে হয়। তাঁকে গ্রেফতার করে সেন্সর করা হয়, তাঁর নার্সিংহোমে পুলিশি নজরদারি বেড়ে যায়, কার্যত তখনকার মত ডক্টর লিয়াং এর এই দাবি চীন সরকারের ধরপাকড়ের ফলে আর বাইরে আসতে পারেনি। যদিও অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এরপরেই নোভেল করোনা দাবানলের মত সমগ্র হুবেই প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং চীনকে সবকিছুই বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে আনতে হয়। সত্যবাদী এই চিকিৎসক অবশ্য আর ইহজগতে নেই। যে রোগ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেই রোগেরই শিকার হয়ে মৃত্যু ঘটে তাঁর। সম্প্রতি চীন সরকার ডক্টর লিয়াং এর পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, তার জন্য অবশ্য তথ্য লোপাট করায় চীন সরকারের অস্বাভাবিক উৎসাহ চোখ এড়ায় না।
৬। মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও চীনের দ্বিচারিতা অবাক করার মত। বহুদিন অবধি চীন সরকার জানাচ্ছিলেন যে, উহান শহরে মৃতের সংখ্যা ২৫৭৯, অথচ সম্প্রতি তাঁরা ঘোষনা করেছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৩৮৬৯, অর্থাৎ প্রায় ৫০% বৃদ্ধি। যার ফলে চীনের আক্রান্তের সরকারি সংখ্যা বেড়ে ৮০০০০ ছাড়িয়ে গেল। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন যে, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিনগুলিতে সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি, যেটি এখন বাড়ি বাড়ি সার্ভে করে পাওয়া গেছে। আমেরিকা সহ অনেক দেশের সরকার মনে করেন, চীনে প্রকৃত মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা যেটা বলা হচ্ছে, তার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
৭। চীনের কমিউনিস্ট শাসন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বহু বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, দেশটির নেতৃবর্গ একাধিকবার দেশে বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যেহেতু নোভেল করোনা মূলত সমাজের বৃদ্ধ জনসাধারণের ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অনেকেই এর মধ্যে সরকারি ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, দেশের পেনশনভোগী বৃদ্ধ জনসাধারণের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য জেনেবুঝে এই সংক্রমণ ঘটিয়েছে বেজিং।
৮। চীনের পরবর্তীকালে নোভেল করোনা বেশি আক্রমণ করেছে মূলত পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনাচক্রে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক, সবদিক দিয়েই এই দেশগুলি চীনের বিপরীত মেরুর বলে পরিচিত। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন, করোনা ভাইরাসের ছদ্মবেশে আদতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হাজির হল কিনা! কারণ, এপ্রিল মাসের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, এখনও অবধি এই ভাইরাসের তাণ্ডবে চীনের থেকে ঢের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীনের বিরোধী বলে পরিচিত পশ্চিমী বিশ্বের উন্নত দেশগুলিই। যদি এটি সত্যিই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত রাজনৈতিক আক্রমণ হয়ে থাকে, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে চীন এই যুদ্ধে জয়ী। এখনই।
৯। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই যে, হুবেই প্রদেশের বাইরে চীনের অন্যান্য অংশে এই ভাইরাসের তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। রাজধানী বেজিং সহ সাংহাই, গুয়াং ঝু, লাসা সহ বড় শহরগুলিতে সেভাবে বিপজ্জনক কখনোই হয় নি এই ভাইরাস। এখানেই উঠছে প্রশ্ন, কি করে একটা প্রদেশের মধ্যেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ বেঁধে রাখতে এতটা সফল হল চীন? বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের অনুমান, চীন হুবেই প্রদেশটিকে তাদের পরীক্ষা চালানোর প্রাকৃতিক ও সামাজিক ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে। এর বিস্তারিত তদন্তের দাবি ও করেছেন অনেকে।
১০। পুরো ঘটনায় সন্দেহের তীর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকেও ধাবিত হচ্ছে। কারণ, বেশ দৃষ্টিকটূ ভাবে সংস্থা চীন সরকারকে একাধিক বার আড়াল করার চেষ্টা করেছে। চীন সরকারের মত মেনে নিয়ে সংস্থা একবার জানিয়েছিল যে, মানুষ থেকে মানুষে এই রোগ ছড়ায় না। আবার, পরবর্তীকালে চীনের সরকারের বক্তব্য শুনে অবস্থান পাল্টায় তারা। পরবর্তীকালেও একবারের জন্যও চীন সরকারের বিরোধী মত পোষণ করেনি এই সংগঠন। সাম্প্রতিক সময়ে চীন সরকার যখন আচমকা উহান শহরের আক্রান্ত সংখ্যা পরিবর্তন করল, তখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই হঠাৎ পরিবর্তনকে খুব স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করে। যা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেছে অনেকেরই। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তো সরাসরি এই সংস্থাকে পক্ষপাতদুষ্ট ও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে তোপ দেগে মার্কিন অনুদান বন্ধ করে দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে সংস্থার প্রধান ইথিওপিয়ার নাগরিক তেদ্রস আধানমের পরিচয়, যিনি আদতে চিকিৎসকই নন, বরং একজন মাইক্রো বায়োলজিস্ট। ইথিওপিয়ার এই প্রাক্তন স্বাস্থ্য ও বিদেশমন্ত্রীই হলেন প্রথম নন-ফিজিশিয়ান যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথা ভেঙে তাঁর এই পদ লাভের পিছনে চীনের সমর্থনের কথাও তুলে আনছেন অনেকে। সবকিছু বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীনের প্রতি এই অন্ধ বিশ্বাসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বলে বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন না।
কেন চীন দায়ী নয়?
না না, ভাববেন না এই বিশ্ব বাজারে চীনের কোনও বন্ধু নেই। আছে আছে মহাশয়, বন্ধু আছে। আর আছে তাদের পক্ষ থেকে কিছু জোরালো যুক্তি। যুক্তিগুলো দেখে নেওয়া যাক,
১। চীন সরকারের তরফে একাধিকবার দাবি করা হয়েছে যে, এই ভাইরাস একটি প্রাকৃতিক জীবাণু, এটিকে কৃত্রিম আখ্যা দেওয়া একধরনের অপপ্রচার। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরাও গবেষণায় দেখেছেন যে, প্যাঙ্গোলিন বা বাদুড়ের দেহে নোভেল করোনার খুব কাছাকাছি বৈচিত্র্যের ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে। তাঁদের মতে, যে সামান্য তফাৎ টুকু আছে সেটা ভাইরাসের মধ্যে ঘটেছে মানবশরীরে প্রবেশের পর স্বাভাবিক অভিযোজনের মাধ্যমে। অতএব নোভেল করোনা যে মনুষ্যসৃষ্ট, এই ধারণার বাস্তব প্রমাণ নেই। চীনের আরো অভিযোগ যে, পূর্বেও স্প্যানিশ ফ্লু বা প্লেগের মত বিশ্ব মহামারীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তখন কিন্তু উৎসস্থল ইউরোপকে কেউ দায়ী করেননি, তাহলে এখন কেন চীন রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে?
২। চীন সরকারের মতে, উহানের মাছ মাংসের বিখ্যাত বাজার থেকে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাচক্রে, সত্যিই এই বাজারে বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিনের মত প্রাণীদের মাংস বিক্রি হয়। চীনারা যে সবসময় মাংস খাবার জন্য কেনেন তা নয়, বস্তুত প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ইউনানী এই প্রাণীজ উপাদানগুলোর উপর নির্ভরশীল। অতএব, চীনের দাবি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।
৩। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক কল্পনাশ্রয়ী উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে যে এত বড় অভিযোগ আনা যায় না, এটা বহু মানুষই মনে করেন।
৪। যখন চীনে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব চলছে, তখনও বেজিংয়ের কর্তৃপক্ষ একাধিকবার চীনে কর্মরত ও পাঠরত বিদেশি জনতাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা চীন সরকারের দায়িত্ব। চীন কখনোই অসুস্থ মানুষদের বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেনি এটা ঠিকই। বরং চীন সরকার ভারত সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, উহান শহরের ভারতীয়দের পর্যাপ্ত যত্ন নিচ্ছেন তাঁরা। অবশ্য ভারত উহান বিমানবন্দরে বিশেষ বিমান পাঠিয়ে এয়ার্লিফট করে ফিরিয়ে আনে ভারতীয় নাগরিকদের। যদিও বিমানবন্দরে ছয় ভারতীয়কে বিমানে চড়তে দেননি চিনা কর্তৃপক্ষ, তাঁদের কোভিড ১৯ এর উপসর্গ দেখা দেওয়ায়। পরবর্তীকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগের মুখে পড়ে বেজিং স্পষ্ট বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা কোনও বিদেশি নাগরিককে চীন ত্যাগ করে নিজদেশে ফিরে যেতে বাধ্য করেনি। অতএব করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে যাওয়ার পিছনে তাদের কোনোভাবেই যেন দায়ী না করা হয়।
৫। সম্পূর্ণ লকডাউন কার্যকর করার বিষয়ে চীনের দিকে হাজারো সন্দেহের তীর ছুটে গেলেও চীনের কমিউনিস্ট শাসনের কথা মাথায় রেখে বলা যায় যে, চীনের পক্ষে এমন অনেক কিছুই সম্ভব যেটা অন্যত্র অসম্ভব। একদলীয় কঠোর নিয়মতান্ত্রিক চীন জনগনকে সরকারি নির্দেশ মানতে বাধ্য করানোর জন্য যেরকম কঠোরতা অবলম্বন করতে পারে, সেটি কোনও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে অসম্ভব। চীনের এই অতীব কঠোর রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, অনেকের মতেই, মানবিকতার পরিপন্থী। যদিও এধরনের জরুরি সময়ে জনতাকে সরকারি নির্দেশ পালনে বাধ্য করানো বেজিং এর পক্ষে অবশ্যই সম্ভব।
৬। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এই কঠিন সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে চীনের অসাধারণ কাজকে বিশ্বের বহু পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ আগাম প্রস্তুতি মনে করলেও এবং সন্দেহের চোখে দেখলেও কমিউনিস্ট চীনে এটিও অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। সেদেশের ঘোষিত নীতিই হল জনতার সাথে সরকারের সরাসরি সংযোগ স্থাপন। সে দেশে একটা অংশের জনসাধারণের দায়িত্ব এমনিতেই সরকারের হাতেই আছে। তাই, বিষয়টি অসাধ্য নয়।
৭। দেশের বয়স্ক জনতার সংখ্যা হ্রাসের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে পশ্চিমী বিশ্বের বহু পণ্ডিত খারিজ করে দেন। প্রকৃত পক্ষে, একটিমাত্র প্রদেশের বৃদ্ধ জনসাধারণের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে দেড়শো কোটির দেশে এমন কিছুই সংখ্যা হ্রাস হবার কথা নয়। ভুললে চলবে না, সরকারি তথ্যমতে, মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ও ছাড়ায়নি। যদি মেনেই নিই যে, প্রকৃত সংখ্যা বহুগুণ বেশি, তবুও বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার এই দেশে বৃদ্ধ জনসংখ্যা কমানোর জন্য যেরকম মৃতের সংখ্যা হওয়া উচিত, তার ধারেকাছে পৌঁছবে না কোভিড ১৯ এ মৃত বয়স্ক চীনাদের সংখ্যা।
৮। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জল্পনা প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদেরা একটি পরিসংখ্যান হাজির করেছেন। ঘটনাচক্রে, পশ্চিমী বিশ্বের যে দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ সর্বাপেক্ষা বেশি সেটি হল ইতালি। আমেরিকা অথবা ইংল্যান্ড অথবা ফ্রান্সের সঙ্গে চৈনিক বৈরিতার কথা মাথায় রেখেই বলা যায় যে, চীন সরকার নিশ্চয়ই এমন কোনও দেশে আঘাত হানতে চাইবেন না যেখানে তাঁদের দেশের বিনিয়োগ বহুল পরিমাণে উপস্থিত। অথচ, আমরা সবাই জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবলীলা সর্বাপেক্ষা বেশি অনুভূত হচ্ছে ইতালিতে, যেখানে আক্রান্ত লক্ষাধিক।
৯। চীন সরকারের দাবি, তাঁদের দেশে মেডিক্যাল সরঞ্জাম তৈরির ব্যবস্থা বরাবরই উন্নত। বস্তুত, এটি নিছকই ফাঁকা বুলি নয়। বহুদিন ধরে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অনুন্নত দেশ তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য পুরোপুরিই চীনের উপর নির্ভরশীল। এই তালিকায় কিছুটা ভারতও পড়ে। ভারতে ঔষধ প্রস্তুতি পর্যাপ্ত পরিমাণে হলেও, চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য ভারত ও পরোক্ষ ভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। পি পি ই বা টেস্টিং কিট ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্ব বরাবরই নির্ভর করে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার উপর। এই দুর্দিনে সেই ভরসা আরো বেড়েছে। বেজিংও প্রকাশ্যে বার্তা দিয়েছে যে, এই দুর্দিনে তাঁরা পৃথিবীর সব দেশকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। যদিও বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা চিনা সরঞ্জামের মান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
১০। চিনা অর্থনীতি কমিউনিস্ট ধাঁচে পরিচালিত হবার কারণে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত বেশি। ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, এধরনের জরুরি সময়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনেক সময়েই সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, যেটি সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবের ফলে সাম্যবাদী অর্থনীতিতে অতটা হয় না। এধরনের অর্থনীতির অসংখ্য কুপ্রভাব থাকা সত্ত্বেও জরুরি অবস্থায় এর কার্যকারিতা অস্বীকার করার উপায় নেই কারণ, জনতার হাতে যাতে টাকা পৌঁছয় সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, এর জন্য তাঁদের খুব বেশি কিছু ভাবার দরকার পড়ে না। জনতার হাতে অর্থ থাকলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। এজন্যই চীনের আর্থিক স্বাস্থ্য খুব বেশি দুর্বল হবার সম্ভাবনা কম।
আমরা কি বুঝলাম?
দুপক্ষের বক্তব্য শুনে আমরা এটাই বুঝলাম যে, আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই এখনও আছি। ভাইরাস চৈনিক দস্যু নাকি প্রকৃতি প্রেরিত কদমফুল আকারের আশীর্বাদ, এ বিতর্কের অবসান সহজে হবার নয়। আবার, বিতর্কের উত্তর না মিললে করোনা বাবাজিকে ঘায়েল করার মত ব্রহ্মাস্ত্র ও এ ধরাধামে আবির্ভূত হবার কথা নয়। যাই হোক, আশায় বাঁচে চাষা। তো সেই আশার আলোটি হল এই যে, নোভেল করোনা ভাইরাসের প্রকৃত উৎসস্থল খুঁজে বের করা নিয়ে বিজ্ঞানীরা জোর গবেষণা চালাচ্ছেন। যদিও এখনও পর্যন্ত তাঁদের ইঙ্গিত নোভেল করোনার প্রাকৃতিক উৎসের দিকেই, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ দের একাংশ অবশ্য এটি নিয়ে তদন্তের পক্ষপাতী। এর উৎসস্থল যদি প্রাকৃতিক হয় ও, তাও চীন সরকার তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, বহুদিন পর্যন্ত তথ্য গোপন করে তাঁরা বাকি বিশ্বকে অবশ্যই বিভ্রান্ত করেছেন। ডক্টর লি ওয়েন লিয়াং এর মত চিকিৎসকদের কণ্ঠরোধ করে তাঁরা বহির্বিশ্বে সঠিক খবর প্রচারিত হতে বাধা দিয়েছেন, যার ফলে অন্য দেশগুলো এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যখন অবহিত হয়েছে, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে দূরে সরিয়ে রেখেও বলা যেতেই পারে যে, এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর জন্য বেজিং অবশ্যই কিছুটা হলেও দায়ী। একইভাবে দায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তাঁরা চীনের প্রভাবেই হোক বা স্বাধীনভাবেই হোক, নিজেরা বরাবরই বিভ্রান্ত আচরণ করেছেন এবং বিশ্বকে ধন্দে ফেলে দিয়েছেন। এই মহামারী রোধে যেখানে তাঁদেরই নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, সেখানে তাঁদের পরস্পরবিরোধী কাজকর্ম প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে, উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপসংহার টানা সম্ভব নয়। ইতিহাসই এর বিচার করবে। এবং অবশ্যই, চীনকে দায়ী করতে গিয়ে যেন আমরা ভুলে না যাই ইউরোপ ও আমেরিকার দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। বিপদ যখন অনিবার্য, তখনও তাঁরা লকডাউন জারি করতে গড়িমসি করেছেন। ইতালীয়রা এমনকি ভিড়ে ঠাসা স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত আয়োজন করেছেন, সেই ম্যাচে ঘরের দল জিতলে একে অপরকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরেছেন। আমেরিকানরা আবার আরো এককাঠি উপরে। তাঁরা নাকি সমুদ্রতীরে পার্টি করে নাচন কোঁদন করেছেন বলেও এখন শোনা যাচ্ছে। তাঁদের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সাহেব তো প্রকাশ্যেই লকডাউন নামক ধারণার বাপ বাপান্ত করেছেন, শেষমেষ গেরোয় পড়ে রাজি হয়ে গেছেন। আমাদের দেশেও ধর্মীয় সমাবেশ থেকে বিবাহ অনুষ্ঠান, সবই চলেছে লকডাউন ঘোষিত হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। লকডাউন ঘোষিত হবার পরে আবার অন্য গল্প, সেটা হল ব্যাগ নিয়ে বাজারে গিয়ে সময় কাটানো, সে দরকার থাকুক বা না থাকুক। অতএব বলতেই হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্ণিত চিনা ভাইরাস প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজের ভাইরাস গুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। নোভেল করোনা আসলে কেবলমাত্র একটি ভাইরাস নয়, মানবজাতির কাছে একটি শিক্ষামূলক অধ্যায়।
খুব সুন্দর