মেকআপ রুমে বসে একটা ফোনের অপেক্ষা করছে দেবব্রত।র্ফাস্ট ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠল।সবাই রেডি।পার্থ মানে ওদের ডিরেক্টর এসে সবাইকে বেস্ট উইশেজ জানিয়ে গেল।বিশেষ করে দেবব্রতকে,মেন রোলতো ওরই।কিন্তু ভেতর ভেতর ভীষন অস্থির হয়ে আছে ব্রত।লিটিল বলেছিল ভিডিও কল করবে, ওর মেকআপ দেখবে।কিন্তু এখনও…. সেকেন্ড বেল বেজে গেছে আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাতে ধরা ফোনটা ভাইব্রেট হতে থাকল।না ভিডিও কল নয়,ফোনই করেছে লিটিল।
– হ্যালো, কি রে তোর এতক্ষণে সময় হলো?-রেগেমেগে বলল ব্রত।
– তাড়াতাড়ি গ্রীন রুমের পেছনের বারান্দায় এসো।-ফোনটা কেটে দিল লিটিল।
এই হচ্ছে ওর দোষ যখন তখন যা তা।কিন্তু ওর অর্ডার মানবেনা এমন ক্ষমতা নেই ব্রতর।এদিকে লাস্ট বেল বাজল বলে।আর ভেবে লাভ নেই-একছুটে পেছনের বারান্দায় এল সে।চমকে উঠল ব্রত-লাল টুকটুকে মিষ্টি একটা টপ আর জিন্স পরে নিজের বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সবচেয়ে আদরের,সবচেয়ে কাছের মানুষ-তার নাতনি-লিটিল।
-ওয়াওও!!কি লাগছে দাদা তোমায়,, ফাটাফাটি।শোন এমন অভিনয় করবে যেন সবাই চমকে যায়।হাতাহাতি দিতে দিতে হাতে ব্যাথা হয়ে যায়।আর হ্যা,টিফিনের প্যাকেটটা যেন আমি পায়।দাঁড়াও চটপট কটা সেলফি তুলে নিই।তাকাও এদিকে তাকাও-আবার অর্ডার ব্রতকে।এই ফোচকে দাঁতটা বের কর- বয়ফ্রেন্ডের জন্য এই জঘন্য নামটাই ওর পছন্দ।দাদা ফাইনাল বেল পড়ে গেছে,তুমি চলে যাও।অল দ্য বেষ্ট,বিন্দাস অভিনয় করবে।মুআআহ।যাও যাও।
-কিন্তু তুই এলি কখন, আর..
-দাদা আজকের রাতটা আমি আছি।তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেব।এখন যাও।
সময় নষ্ট না করে স্টেজে আসে দেবব্রত।লিটিল কে ও জানে,মাথায় যা আসবে তা ও করেই ছাড়বে।মনে মনে ভীষন খুশি হয় সে।সত্যি ওর হাসিমুখটা না দেখে স্টেজে নামতে পারতো না ব্রত।আফটার অল ওর ইনস্পিরিশনেই তো এত বছর পর আবার স্টেজে নামছে সে। রুমা মারা যাওয়ার পর একরকম মরেই গিয়েছিল ব্রত।ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গিয়েছিল।তখনই অনুব্রত অর্থাৎ তার ছেলের সংসারে আসে ব্রত আর ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ে ওলি,তার আদরের নাতনি, তার ছোট্ট লিটিল।নতুন করে বাচতে শেখায় ও।ভীষণ ছটফটে কিন্তু ভীষণ ম্যাচিওর।খুব কথা বলে কিন্তু অযৌক্তিক কিছু বলেনা। সাংঘাতিক বুদ্ধি,ওর নজর এড়ানো খুব মুশকিল।লাবনী অর্থাৎ ওর বৌমাও খুব ম্যাচিওর,এডজাস্ট করতে পারে তাড়াতাড়ি।
তাইতো ব্রত যখন ইচ্ছা হয় বন্ধুদের সাথে ওলডেজ হোমে গিয়ে থাকে আবার ইচ্ছা হলে অনুর কাছে চলে আসে।বুদ্ধিটাও ওলিই দিয়েছিল আর এতে যে ব্রত ভালোই আছে তা অস্বীকার করবে কিকরে!!স্মার্টফোন ব্যবহার করতেও শিখিয়েছে লিটিল।আর সবচেয়ে বড় কথা পুরনো আ্যলবাম থেকে ব্রতর নাটকের ছবিগুলো বের করে বারবার উশকে উশকে আবার নাটকের ক্লাবে যেতে বাধ্য করেছে ঐ একরত্তি মেয়েটা।তাতেই তো ছাইচাপা আগুনে ঘি পরেছে,নতুন জীবন পেয়েছে ব্রত।লিটিল যখন ম্যানেজমেন্ট পড়তে ওড়িশা চলে গেল তখন সত্যিই ব্রতর খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু ঐ মেয়ে রোজ ভিডিও কল করে আর ওর ঐ ফোচকেকে মাঝে মাঝে খবর নিতে পাঠায়।শুধু তাই নয়, লিটিলের এমন কোন বন্ধু নেই যে ব্রতকে চেনেনা বা দেখা হলে কথা বলেনা।সবমিলিয়ে এই শেষ বয়সে এসে জীবনটাকে নতুন করে উপভোগ করতে শিখিয়েছে তার ছোট্ট লিটিল।এই আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক।সকাল থেকে একবারও বলেনি ও আসতে পারে, এখন কোথা থেকে স্পাইডারম্যানের মত উড়ে চলে এল।ওর বাপ-মা ওকে দেখে ভিমরি না খায়!সাথে আবার ওই ছোড়াটা-ফোচকে।অনুতো ওকে একদম সহ্য করতে পারে না।কিন্তু দুটোতে নাকি সেই স্কুল থেকে একসাথে থাকে।যাকগে, প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর পর স্টেজ পারফর্ম করতে চলেছে ব্রত।
একটু নার্ভাসনেস তো আছেই!পর্দা সরে যাচ্ছে, রঙবাহারী আলোয় গা ভেসে যাচ্ছে, গমগম করে উঠছে প্রেক্ষাগৃহ ব্রতর কন্ঠস্বরে।এভাবে চলল প্রায় দেড় ঘন্টা।পর্দা নেমে এল।স্টেজের আলো নিভে গিয়ে জ্বলে উঠল দর্শক আসনের আলো।হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ।দর্শকদের অনুরোধে সামনে এল কলাকুশলীরা।চারপাশ থেকে অনেকে এসে জড়িয়ে ধরল ব্রতকে।এই বয়সে এইরকম অভিনয়!!প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই।কিন্তু ব্রতর চোখ খুঁজে চলেছে সেই দুষ্টুটাকে,ওকে ছাড়া যে এ অভিনন্দন ভালো লাগছে না।অনু,বৌমা দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছে কিন্তু পাগলিটা কই?ভিড় কাটিয়ে অনুর কাছে এসে বলল ব্রত-
-দুষ্টুটা কইরে?একবার সামনে পাই তারপর দেখাচ্ছি মজা।
বাবাকে জড়িয়ে ধরল অনু -বাড়ি চল বাবা,তোমার দুষ্টু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সারা রাস্তা গাড়িতে অনেক কথা হলেও ব্রতর ভেতর পযর্ন্ত কোনটাই পৌছলনা।বাড়ি গিয়ে মেয়েটার কানটা না মলা পযর্ন্ত শান্তি নেই।এত আনন্দের একটা মুহূর্তে ও আগে চলে এল না দেখা করে।আজ হচ্ছে ওর!
মেনডোর খুলতেই হাততালিতে ভরে উঠল ঘর-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ,কোলের মধ্যে জড়িয়ে ধরল লিটিল-হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার দাদা।ওলডেজ হোমের সব বন্ধুরা, ব্রতর ছেলেবেলার বন্ধু অপূর্ব, ফোচকে আর ওর সব সাঙ্গপাঙ্গরা হইহই করে কেক কাটল ,কেক মাখালো আবার নানান অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলে রাখল।সব ছবি পোস্ট হবে ফেসবুকে।উফফ!!এ সব যেন একটা স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নের কান্ডারী তার ছোট্ট লিটিল,যার হাত ধরে আবার একটা নতুন জন্ম হল দেবব্রতর।কে বলে জেনারেশন গ্যাপ!এই ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো সব দুঃখ যন্ত্রণা ভূলিয়ে দিয়েছে, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।অস্ফুটে বলে ওঠে ব্রত-আমি খুব ভালো আছি।তুমি একদম চিন্তা কোরনা রুমা।
চিত্র সৌজন্য : গুগল