খুব আত্মগ্লানি তে ভুগছে মৃত্যুঞ্জয়। বুঝতে পারছে না এমন টা কি করে হলো ? অস্মিতা তো মুক্ত আকাশে , অসীম আলোয় পাপড়ি মেলে দেয়া এক নিষ্পাপ ফুল। দোষ তো তার নয়। সে তো পৃথিবীর যা কিছু ভালো তাকে আঁকড়ে ধরবেই। আঁকড়ে ধরার ই তো বয়স তার। বি. এ. প্রথম বর্ষের ছাত্রীর কাছে কি আকন্ঠ জীবন সুধা পান করা অপেক্ষা ন্যায় অন্যায় বোধ বড় হতে পারে ? কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় ? সে তো একজন অধ্যাপক। সমাজের চোখে বিচক্ষণ, সজ্জন ও সম্ভ্রান্ত মানুষ। সমাজ তো আর বোঝে না মানুষ কখনোই বড় হয় না। তার হৃদয়ে ছেলেমানুষি থেকেই যায়। ভোরের আলো, হঠাৎ বৃষ্টি, দূরের পাহাড় তাকে একই রকম ভাবে ডাকে যেমনটি ডাকতো ছোটবেলায়। তাই যেদিন অস্মিতা প্রথম বলেছিল, স্যার আপনি আমার হৃদয়পুর রাজপ্রাসাদের রাজপুত্র , মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে এক তীব্র আলোড়ন হয়েছিলো। বিষাদময় উত্তেজনার মেঘ ছড়িয়ে পড়েছিলো হৃদয়জুড়ে। তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্ক এগিয়েছে। নিজের ছাত্রাবস্থায় মৃত্যুঞ্জয় পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের দাবির সমীপে বলি দিয়েছিল জীবনের দাবি কে। আজ তার পৌঢ়ত্বে তাই যখন জীবনের দাবি এসে দাঁড়ালো দরজায় সে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে নি। নিজের স্ত্রী তনিমা আর কিশোরী মেয়ে তন্বীর প্রতি সে যে অবিচার করছে এটা তার বিবেক বহুবার বলেছে। তবু এক অদৃশ্য টানে সে এগিয়ে গেছে দিকভ্রান্ত পথিকের মত। এখন মনে হচ্ছে জীবনের ডিঙি অতি ক্ষুদ্র। তাতে নিজের সঙ্গে দুজন কে তোলা যায় না। তুললেই তা ডুবে যাবে। পুকুরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়। বিবেকের দংশন টা কাঁটার মত বুকে বিঁধে আছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঢেউ উঠছে পুকুরে। কয়েকটা বড় মাছ ঘাই মারছে মাঝে মাঝে। মাছগুলোকে দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের কথা মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের গন্ডী ঠিক একটা পুকুরের মত। যত বড় মাছ ই সে হোক পুকুর থেকে বেরোনোর চেস্টা মানেই মৃত্যু। একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো। বুকের পকেট টা কাঁপছে। মোবাইল বাজছে। কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল টা বের করলো মৃত্যুঞ্জয়। হে ভগবান , এ গ্লানির বন্ধন থেকে আমায় মুক্তি দাও। সংসারে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি ঠিক। অস্মিতা আমার মুক্তির আলো। তবু আজ মনে হচ্ছে কিছু মুক্তি যেন কর্কশ বন্ধন। কিছু বন্ধন মুক্তির নিকানো উঠান।
ফোনটা বেজেই চলেছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে অস্মিতার নাম। ধরা গলায় মৃত্যুঞ্জয় বললো হ্যালো। এত অসহায় সে জীবনে কখনো বোধ করেনি।
অস্মিতা বললো , ” শোন, বাবা আমার মোবাইল দেখে সব জেনে ফেলেছে। বাড়িতে খুব অশান্তি। ” এক মুহূর্তে পৃথিবীটা কালো হয়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের। গলা তার বুজে এলো। মন বলে উঠলো, তালে তো সব শেষ। তবু প্রশ্ন করলো , ” এখন কি হবে ? তোমার বাবা তো আমায় শ্রদ্ধা করতেন। বিশ্বাস করতেন। ” অস্মিতা বললো ” আমি জানি। আমি ধ্বংস কে সৃষ্টির দিকে ঠেলে দিয়েছি। আমি বলেছি ওটা অন্য ছেলে । ওর নাম নিশীথ। আমার সঙ্গে মেলায় আলাপ হয়েছিলো। নিজেকে বাঁচাবার জন্য আমি নিশীথের নম্বর মৃত্যুঞ্জয় স্যারের নামে সেভ করেছিলাম। ” বাবা বললো ” এটা তুই ঠিক করিস নি। তা নিশীথ এর সঙ্গে এখনো তোর সম্পর্ক আছে ?” আমি বললাম , ” না। নিশীথ চলে গেছে। স্যার, আমাদের ও সংযত হওয়া উচিত” একটা গভীর নিঃস্বাস নিলো মৃত্যুঞ্জয়। অস্মিতাকে তার দেবী মনে হচ্ছে। মনে মনে তাকে প্রণাম করলো। একেই তো বলে প্রেম যেখানে কোনো অধিকারবোধ নেই। আছে আত্মনিবেদন , একে অন্যের কল্যানকামনা। মুখে বললো , ” তুমি ঠিক ই করেছো অস্মিতা। এসো, আমরা সংযত হই। সংযম চৈতন্যের বহিপ্রকাশ যেমন তাপ আগুনের।” শান্ত কণ্ঠে বললো অস্মিতা, ” আপনি ভালো থাকবেন স্যার। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশুদ্ধ ভালোবাসা আজীবন থাকবে।”
একটা হলুদ প্রজাপতি মৃত্যুঞ্জয়ের কাঁধে এসে বসলো। আলতো করে তাকে উড়িয়ে দিয়ে পথ চলতে লাগলো সে । দুপাশের সবুজ বৃক্ষ, লতা , গুল্ম মৃত্যুঞ্জয় কে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আজ সে সত্যিকরে অস্মিতাকে ভালোবাসতে শিখলো। ভালোবাসলো অস্মিতার অন্তরের দেবত্ব কে । এতদিন তার অন্তরে এক নিশীথ ছিল। সেই নিশীথ অস্মিতার প্রতি আসক্ত ছিল। আসক্তি ভালোবাসা নয়। অস্মিতা ঠিক ই বলেছে। “নিশীথ চলে গেছে” । যে রয়ে গেছে সে ই প্রকৃত মৃত্যুঞ্জয়।