একেবারে খোলামনের মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঘন্টু একদম সেইরকমই। সবসময় হালকা মেজাজে থাকে। রাগের বালাই নেই। মুখে হাসি লেগেই থাকে। কথায়-কথায় মজা করে। নিজেও হাসে অন্যকেও হাসায়। যবে থেকে পরিচয় হয়েছে তবে থেকেই ওকে আমার খুব ভালো লাগে। সদা-মনখুশ অমন ফুর্তিবাজ মানুষকে কার না ভালো লাগে ?
তাই আজ যখন ঘন্টুকে দেখলাম, মনের শ্বাসরোধী ঘেরাটোপে কেউ যেন এক মুঠো ফুরফুরে বাতাস ছুঁড়ে দিল সহসা — কারণটা মোটেও এমন নয় যে, আমার ওকে ভালো লাগে বা ওকে আমি খুব পছন্দ করি সেই জন্য। আসলে কারণটা কিছুটা হাস্যোদ্দীপক হলেও অনেকটাই যেন কেমন-কেমন অন্যরকমও বটে। অনেকটাই নস্টালজিয়ার মত বলা যেতে পারে। তবে যাই হোক, আমার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একেবারেই নিখাদ সত্যি । ওকে শেষ দেখেছিলাম সেই ফেব্রুয়ারিতে —- মনে হয়, যেন সেই কোন অতীতে, কোভিড যুগের আগে! যুগ থেকে যুগান্তরে মহাকাল গড়িয়ে চলেছে সেই সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে। সত্য, ত্রেতা, দাপর, কলি। সব যুগেরই একটা আদি-অন্ত আছে। কিন্তু কোভিড যুগ? যেন অনন্তকালব্যাপী !
আহা! আগের যুগের কথা খুব মনে পড়ে! কি ছিল তখন! আমরা একদল, একসাথে পাশাপাশি, ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে, দাড়িয়ে বাসুর চায়ের দোকানে চা খেতাম । শুধু খেতাম বললে ভুল হবে, চায়ের কাপে তুফান তুলতাম । সোশাল ডিসট্যান্স বলে যে কোন বস্তু আছে, লোকে জানত নাকি তখন?
লকডাউনের আগে শেষ যেদিন ঘন্টুর সাথে দেখা হয়েছিল, তারও বেশ কয়েকদিন আগের কথা বলছি। একদিন মাস্ক পড়ে রাস্তা দিয়ে গটগট করে হেঁটে এসে বাসুর চায়ের দোকানে ঢুকেছিলো ঘন্টু। হঠাৎ ওকে মাস্ক পড়া দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম পরে ভেবেছিলাম রাস্তায় ধূলোবালির উপদ্রব, হয়তো সেই কারণেই পড়েছে।
” কিরে নাকেমুখে লিকোপ্লাস্ট বেঁধে গিয়েছিলি কোথায়?”
ওকে ওই অবস্থায় দেখে তো চিকুর ভাই পল্টু ছোট্ট করে একটা টিপ্পুনি পটাং করে ছুঁড়ে দিল। ও যেহেতু সর্বক্ষণ এর ওর পিছনে লেগে বেড়ায়, তারাই বা সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবে কেন?
পত্রপাঠ প্রতিবাদ করেছিল ঘন্টু,”ওটা লিকোপ্লাস্ট নয়, মাস্ক।”
—- ওটা সাঁটালে কী হয়?
—- নাকে-মুখে কোন জার্ম-জীবানু ঢুকবে না ।
—- ওরে আমার হরিপদ রে! এতই যখন জীবানুর ভয় তোমার, যাও না ঘরে গিয়ে শো-কেশের মধ্যে ঢুকে বসে থাক। উঁ…! ধরি তো মাছ না ছুঁই পানি!”
“সুযোগ পেয়েই ঝেড়ে দিলি, না! এক মাঘে শীত যায় না গুরু …..”
সেইসময় কী ঘন্টু জানতো যে ঐ মাঘটা কোভিডের ফেরে, ছ’মাস যেতে না যেতেই হাজির হয়ে তাকে পাল্টা দেবার এমন মোক্ষম সুযোগ এনে দেবে!
জুলাইয়ের শেষ । লকডাউনের ঢাকঢাক-গুড়গুড় ঝেড়ে ফেলে এখন আনলক-টুয়ে অনেকেই অনেকটাই ঝাড়াঝাপটা। খোলামেলা। যদিও আগের থেকে আরো আরো নিবিড়ভাবে আমাদের চারপাশটাকে আপন করে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। এমনকি পরম আত্মীয়ের মত আশপাশের অনেকের অন্তরের অন্তস্থলেও স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এই অন্তরঙ্গ সখ্যতা শুধুই তোমার আর আমার, আমাদের দুজনার। তাই যাকে করোনার মনে ধরে, সবাইকে বাইবাই করে করোনাকে নিয়ে হয় তার ঠাঁই হয় ঘরের কোণে আইসোলেসনে, নয় সোজা হসপিটালে মধুচন্দ্রিমায়। কিন্তু এমন বিষাক্ত মিত্রতায় কোথায় শঙ্কা জনমনে? অন্তত সোনাকে দেখে তাই তো মনে হল আমার। এই তো সেদিন, হঠাৎ দেখা, মাস্কটা গলায় ঝুলিয়ে চলেছে সোনা। আমাকে দেখতে পেয়ে বত্রিশ পাটি বার করে বললো, ” আমাদের বাড়ির দু-তিনটে বাড়ির পরে থাকে, বিকাশ — বিকাশকে চেন তো..…”
বললাম, ” চিনি তো, বিলক্ষণ চিনি, কিন্তু ওর হয়েছেটা কী?”
সোনা বড়মুখ করে বললো, “করোনা হয়েছে।”
দাঁতে দাঁত চেপে একটু শ্লেষের সাথেই বললাম,”তাই কি তুমি গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো, হতভাগা?”
সোনা গা-পিত্তি জ্বলে যাওয়া বেহায়ার মত হ্যাহ্যা করে হেসে বললো,”সরি।” বলেই মাস্কটা মুখে সেঁটে দিল।
বললাম,” আমাকে সরি বলে পার পেয়ে গেলি, করোনার কাছে পাবি তো?”
সোনা তখন পালাতে পারলেই বাঁচে।
যা হোক যেটা বলছিলাম, সকাল-সকাল বেরিয়ে চট করে বাজারটা নিয়ে ফিরে আসব ভেবেই বেরিয়েছিলাম । পল্টুর সাথে পথে দেখা । মুখে পেল্লাই একটা এন-নাইনটি-ফাইভ লাগিয়ে, পর্দায় হাওয়ার ঝাপট মারলে যেমন পত্পত্ শব্দ হয়, সে রকম শব্দ তুলে সবেমাত্র আমার কুশল-সংবাদ নিতে শুরু করেছে কী করেনি, হঠাৎ শুনি ফ্যাচফ্যাচ হাসি । ঘাড় ঈষৎ ঘোরাতেই দেখি একেবারে আমার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলা দূরত্বে দাড়িয়ে দন্ত বিকশিত করে আছে ঘন্টু। কখন নি:শব্দে গুটিগুটি এসেছে কে জানে! চোখের আইডিয়ায় মেপে নিয়ে এক লাফে সোশ্যাল ডিসট্যান্সে নিরাপদ হলাম ।
ঘন্টু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মেতে উঠল রঙ্গরসিকতায়।
“কিরে আমি মাস্ক পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বলে খুব হ্যাটা করেছিলিরে ব্যাটা, এখন তো দুশো টাকার মাস্ক সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে ব্ল্যাকে কিনে, মুখে সাঁটিয়ে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিস —- কী ভেবেছিস, কোনো খবর রাখিনা ?”
বলেই আবার মুখোসের আড়াল থেকে একটা ফ্যাচফ্যাচে হাসি ভাসিয়ে দিল ঘন্টু।
আমি পল্টুর দিকে ঝোল টেনে বললাম,”ও কী আর সাধ করে কিনেছে, নাকি মজা করে পড়েছে ?”
কিছু একটা আমাকে বলবে বলে এক পা এগিয়েও যেন পায়ে গরম ছ্যাঁকা লেগেছে এমন ভাবে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,”তোমার তো দেখছি আবার সোশ্যাল ডিসট্যান্স নিয়ে ছুতমার্গ আছে। ফিতে থাকলে মেপে নিতে পার মাঝখানে পাক্কা দুগজ আছে কিনা!”
আমি কোনো উত্তর না করে ঘন্টুর মুখে শুধুই চেয়েছিলাম।
তা’ দেখে ঘন্টু জানতে চাইল, “তাজমহল দেখার মত অমন করে কী দেখছো আমাকে হারুদা?”
ওর কথাবার্তার ধরনই এরকম । মনেহল, করোনা-আশঙ্কায় চারপাশ যতই স্যাঁতস্যাঁত করুক না কেন, ঘন্টু ঘন্টুতেই আছে। রসের ঘাটতি নেই।ঘন্টুর সংস্পর্ষে আমার ঘরপচা হাঁফসে ওঠা প্রাণে যেন খোলা ছাদের দখিনা বাতাসের ঝাপট লাগে, বললাম, “তুই ভুল দেখছিস রে ঘন্টু, আমি দেখছি না রে, ভাবছি — ভাবছি আমরা যখন কোভিডের ভয়ে, আতঙ্কে, আশঙ্কায় নিজের ভিতরে এতখানি সেঁটিয়ে গেছি, তুই তখন এতখানি স্মার্ট কী করে থাকতে পারলি রে?”
——- কেন গো দাদা এমন করে বলছ, দুটি কথা বেশি বলে ফেললাম তাই ?
পরিস্কার বুঝতে পারলাম বেটা আচ্ছা সেয়ানা, কথার ভাঁজে ফেলে আমাকে বেকায়দায় ফেলার ফিকির আঁটছে ।
——ন্যাকা! যেন কিছুই বোঝেনা ….
চোখমুখ যেন বদলে গেল ঘন্টুর। গলায়ও বেশ ঝাঁজ। মনেমনে ভাবলাম মজা করার কত রকম কায়দাই না রপ্ত করেছে।
“সরকারি চাকরি করছ, যেতে হয় তাই সপ্তাহে দু-তিন দিন অফিসে যাচ্ছ, কোনরকমে দু-চারটে ফুল ফেলেই ফিরে আসছ, বলতে গেলে ঘরে বসে বসেই পয়সা পাচ্ছ, তোমার আর আমার বোঝা কি একরকম হবে?”
আমরা সচারচর যে ভাষায় এবং ভাবে নিজেদের মধ্যে মজা করে থাকি, সেই পথ অনুসরণ করে বললাম,”এই করোনা ভাইরাস আর লকডাউনের আবহাওয়ায় তুই কি একটু অন্যরকম বুজছিস নাকি আজকাল?”
“হ্যাঁ..হ্যাঁ, বুঝছি-বুঝছি-বুঝছি, আমার জায়গায় তুমি থাকলেও বুঝতে!”
না, ঘন্টু যেন একটু বেসুরেই বাজছে মনে হল! কিন্তু ওতো এরকম নয়। মনে তবুও সংশয়! রঙ্গরসিকতার অনেক ছলাকলা জানে ও । আরো একটু খেলে দেখব নাকি! না থাক।
“আরে দুর পাগল, মজা করছিলাম মাত্র ! তুই সিরিয়াস হয়ে গেলি নাকি?”
—- এখন তো তোমাদেরই মজা করার সময়, হারুদা!
—- চিরকালই তো আমরা সময়-সুযোগ বুঝেই মজা করি। তুই তো তা নস। জাত মজাদার লোক। সবসময় মজিয়ে রাখিস সব্বাইকে।
—- তাই নাকি! কী মনে হয় তোমার আমাকে, সার্কাসের জোকার, তাই তো? সার্কাসের জোকার?
—- কী সব পাগলের মত বকছিস, বল দিকি?
—- আমাকে পাগল মনে হচ্ছে তোমার ? আমি পাগল? আমি যখনতখন হাসি, হাসাই, মজা করি — এগুলো আমার পাগলামি মনে হয় তোমার?
সেই থেকে একটা কথাও বলেনি পল্টু। প্রথমদিকে ঘন্টুর কথায় মজা পেয়ে মিচকে মিচকে হাসছিল, এখন যেন বিস্ময়ে পাথর বনে গেছে। বনবে না-ই বা কেন? আমারও তো ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা! এই মানুষটা কি সত্যি ঘন্টু নাকি অন্য কেউ!
ঘন্টুর কথা তখনো শেষ হয়নি।
“হারুদা, খাচ্ছ-দাচ্ছ, দিব্যি আছ, যাকে-তাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছ —– এখন তো তোমাদেরই দিন, না…..”
এবার একটু আমাকে সিরিয়াস হতেই হল।
“এই তোর কী হয়েছে বল দিকি, হঠাৎ করে এরকম আচরণ করছিস কেন, হ্যাঁ……..”
“হারুদা, দাঁড়াও-দাঁড়াও….”আমাকে থামিয়ে দিয়ে এবার পল্টু শুরু করল,”এবার আমি বলছি, তোর মাথার ঠিক আছে তো? সেই থেকে কী সব আনসান বকছিস, হ্যাঁ?”
—– তুইও আমাকে পাগল বলছিস পল্টু?
—– তুই যেমন বকছিস, আচরণ করছিস, তাতে আমি কেন বিশ্বসুদ্ধ লোকই তোকে তাই বলবে। তুই-ই তো প্রথম মজা করা শুরু করেছিস। তুই করেছিস তাই হারুদা করেছে। হারুদা তো যেচে করতে যায়নি।
চুপ মেরে গেল ঘন্টু। কতক মাথা নিচু করে থেকে যখন মুখ তুলল দেখি ওর চোখদুটো ছলছল করছে।
“পল্টু, হারুদা, তোমরা আমাকে একটু ভুল চিনে ফেলেছিলে গো। মজা করতে ভালবাসি ঠিকই কিন্তু আমি তো চার্লি চাপলিনের মত কেউ নই। বুকফাটা কষ্ট বুকে চেপে রেখেও মজা করে যাওয়া চারটি খানি কথা নয়! দেখলে না, শুরু করেও শেষ করতে পারলাম না। পারলে আমাকে মাফ করে দিও। মাথাটা ঠিক রাখতে পারিনা আজকাল আর! আসি। ঘরের রেফ্রিজারেটরটা আজকে একজনের কিনতে আসার কথা আছে……”
বিস্ময়ে চমকে উঠে বললাম,”ঘরের রেফ্রিজারেটর কিনতে আসবে মানে?”
—– মানে তো খুব সোজা, জলেরদরে বেচে দিচ্ছি। গতবছর মোটা দাম দিয়ে সখ করে কিনেছিলাম। ডবল ডোরের। ……আর কোন পথ খোলা নেই। লকডাউনের পর চাকরিটা গেছে। গচ্ছিত টাকা-পয়সা যেটুকু ছিল সব শেষ। গায়ে জন্মগতভাবেই একেবারে পাকাপাকি ভদ্দরলোকের সিল মারা, দোরেদোরে গিয়ে যে ফলসব্জি বেচব —- উপায় নেই, সেখানেও ‘সম্মানে’র পেল্লাই পাঁচিল তোলা । জানিনা–জানিনা, ঘর উজার করে এভাবে সব বেচেবুচে দিয়ে কদিন চলবে ? ….. বাদ দাও। বাদ দাও ওসব। প্লিজ–প্লিজ হারুদা, কিছু মনে করো না। তুমি বরং ভেবেই নিও তোমার এই ভাইটার মাথাটা সত্যি সত্যি বিগড়ে গেছে।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনের দিকে হনহন হাঁটা লাগাল ঘন্টু।
আমি, পল্টু দুজনেই হতবাক। মুখে ভাষা নেই। দুজন খানিক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করার পর যখন কী বলব ভাবছি, মাস্টারমশাই এসে হাজির। বাসুর চায়ের দোকানের আমাদের আড্ডার-আসরে একজন নিয়মিত সক্রিয় সদস্য হলেন মাস্টারমশাই । নাম কার্ত্তিক সামন্ত । ঐ নামে তাকে ক’জন চেনে বলা মুশকিল, এলাকায় সবাই তাকে মাস্টারমশাই বলেই জানে।স্থানীয় হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। দিলখোলা সজ্জন মানুষ। প্রচুর বইপত্র ঘাঁটেন। পড়াশুনা করেন। বলতে গেলে প্রায় সব বিষয়েই তার অগাধ পান্ডিত্য। একটা সময় ছিল যখন কোন একটা আলোচনার সূত্র ধরে তার পান্ডিত্যের দৃপ্ত ছটায় এক-একদিন আড্ডার আসর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। আমরা উপস্থিত সবাই সমৃদ্ধ হয়ে উঠতাম। ‘একটাসময়’ বলছি এই কারণেই যে, বাসুর চায়ের দোকানটা এখন খুললেও শুন্য বেঞ্চগুলোতে একাএকা শুয়ে থাকে শুধুই করোনার ভয়। তাই ‘আড্ডাটা আজ আর নেই’। যারা আসত আড্ডায়, তাদের সাথে আজকাল পথেঘাটে কচ্চিত-কখনো দেখা হয় অথবা হয়না। এই যেমন মাস্টারমশাই, কত যুগ বাদে যেন দেখছি তাকে।
কী ব্যাপার হারুবাবু, পল্টু — এতদিন বাদে দেখা অথচ কোনো উচ্ছ্বাসের এতটুকু লক্ষণ পর্যন্ত দেখলাম না | আমার তো ভীষণ ভাল লাগছে এতদিন বাদে তোমাদের দেখে।
আমি মুখ খুললাম ।
“মাষ্টারমশাই আপনাকে দেখে আন্তরিকভাবেই হয়ত আমরাও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতাম। কারণ সেটাই খুব স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু একটু আগে ঘন্টুর সাথে সাক্ষাত হয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো ••••
মাষ্টারমশাইয়ের দুচোখে টলটল করে উঠল জিজ্ঞাসা।
আমিও তৎক্ষণাৎ তৎপর হয়ে উঠলাম তার সেই জিজ্ঞাসা নিরসনে। অনুপূর্বিক বর্ণনায় দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ পর্যন্ত বাদ দিলাম না।
মাষ্টারমশাই দু ঠোঁটের মাঝে একটা অর্থবহ হাসি ফুটিয়ে তুলে মৃদু মাথা ঝাঁকালেন।
তারপর মাস্কের মধ্যেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”হারুবাবু ঘটনাটিতে আপনারা অবাক হয়েছেন কারণ আপনারা ওই মানুষটার চেনা ভাবমূর্তিকে সামনে রেখে বিচার করছেন পুরো ঘটনাটিকে, কিন্তু সেটা না করে যদি এই মুহূর্তের চারপাশের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে ঘটনাটাকে দেখতেন তাহলে বুঝতেন অবাক হবার মত অস্বাভবিকতা এতটুকুও নেই কোথাও।
এবার আমাদের আবার হবার পালা! অবাক হবার মত যে কিছুই নেই এমন ঘটনায়, সেটা শুনেই অবাক হতে হলো এবার। কিন্তু যার মুখ থেকে শুনলাম তিনি যে আর কেউ নয়, স্বয়ং মাষ্টারমশাই। অবান্তর কথা বলার মানুষ তো তিনি নন। আগেও দেখেছি, যখন কোনো কথা বলেন, তা কখনো আলটপকা বলেননা। তার পিছনে অনেক ভাবনা যুক্তি কাজ করে।
মাষ্টারমশাই নিজে থেকেই ঘটনাটির ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করলেন।
“করোনা ভাইরাসের আক্রমণ, তার সংক্রমণের বিধ্বংসী চরিত্র, দুরুদুরু করা প্রতিনিয়ত সংক্রমণের আশঙ্কা। স্রেফ বাণিজ্যিক কারণে মিডিয়াগুলোর জনমানসে আতঙ্ক ছড়ানোর প্রতিযোগিতা।সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বকপোল-কল্পিত তথ্য ও চিত্রের নির্বিচার মিথ্যাচার। বলা যেতে পারে……”
মাষ্টারমশাই যখন বলা শুরু করেন তখন বক্তৃতার মত একটানাই বলে যান। আমরা শুনে যাই। তার বলা শেষ হলে আমরা আমাদের মতামত জানাই বা প্রশ্ন থাকলে করি। তারপর শুরু হয় বিষয়টার উপর আলোচনা। আড্ডায় ব্যাপারটা এরকমই ছিল। সেইমতই আজকেও বলে চললেন তিনি।
“… এভাবেই জনমানসে ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর করোনাফোবিয়ার মাঝেই আচমকা একদিন আগমণ ঘটেছিল একটানা অচেনা লকডাউনের, অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে অভ্যস্ত জীবন-ছন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে অবাঞ্ছিত গৃহবন্দী হয়ে থাকা। রাষ্ট্র থেকে পরিবার সর্বত্রই যার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য। কলকারখানা বন্ধ। উন্নয়ন স্তব্ধ। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। কাজ হারিয়ে আজ প্রশ্নের মুখে হাজার হাজার মানুষের জীবনজীবিকার নিশ্চয়তা। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর ঘরে ঘরে অভাবের ছদ্মবেশে হানা দিচ্ছে নিষ্ঠুর বিভীষিকা। আসলে কী জানো, বেঁচে থাকার একটা গতি আছে, যদি সেটা কোনোভাবে ব্যাহত হয়, তবে জীবনের বাস্তবতায় তার বিরূপ একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবেই। শুধু আমাদের দেশেই নয়, এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে গোটাবিশ্বের আর্থসামাজিক অবস্থার একটা বিরাট নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যা বদলে দিয়েছে একটা বিরাট অংশের মানুষের মনোজগতের আবহাওয়াটাও। ভীতি, উদ্বেগ, নৈরাশ্য, হতাশা, উত্তেজনা, বিরক্তি আপাদমস্তক গ্রাস করছে মানুষকে। ভারতের মত জনবহুল, গরীব দেশগুলোর অবস্থা তো আরো শোচনীয়। লাখেলাখে মানুষ কাজ হারিয়ে আজ বেকার, নিরন্ন। তাই ঘন্টুর ঘটনাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চারপাশে যা ঘটছে তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসংখ্য প্ররোচনা, যার থেকে উদ্ভুত হওয়া বিপন্নতার শঙ্কিত উপলব্ধিগুলোই মানুষের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে তার স্বাভাবিক ভাবনায় ভয়ানক বিকার বা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। এক কথায় ভয়াবহ ডিপ্রেসন। কারোকারোর অবস্থা এতটাই ভয়ানক যে তাদের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মত মারাত্মক মানসিক ব্যাধির সম্ভবনাও বাড়ছে। তাই শুধু ঘন্টু নয়, চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখো, ঘন্টুর মত আরো অনেককেই নজরে আসবে। এমনকি তোমার পরিবারের মধ্যেও আসতে পারে। আচ্ছা, আমরা নিজেদেরকেও মাঝেমধ্যে চেখে দেখি কি, যে আমরা আগের মত আছি কিনা?”
মাষ্টারমশাইয়ের শেষ কথাটায় চমকে উঠলাম। কথাটা ভাবার মতই। সেই ভাবনার মাঝেই মাষ্টারমশাই থামলেন।
“বোঝাতে পারলাম?”
আমি বললাম,”শুধুই বোঝাতেই পারলেন না, ভাবালেনও।”
“আমি কিন্তু শুধু বোঝাতেই চেয়েছি•••” মাষ্টারমশাই আবার বললেন,”ভাবাতে চাইনি, কারণ এ নিয়ে বেশি ভাবলেই বিপত্তি আছে। খুব সাবধান।”
এ আবার কেমনতর কথা! মনেমনে ভাবলাম। তবে এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করিনি।
“আসি।”
মাষ্টারমশাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। আমি আর পল্টুও আমাদের পথ ধরলাম। কিন্তু ভাবনাটা আমার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েই চলল।
বাড়িতে ঢুকেও টিকে থাকল ভাবনাটা। বোধহয় সহজে যাওয়ার নয়। এখন বাইরে থেকে এসে বাড়িতে ঢুকলে অনেক কাজ। জামাকাপড় কাচো । মাস্ক ধোও। রোদে খোলা হাওয়ায় মেলে দাও। গায়ে সাবান ডলে ডলে ভালো করে স্নান করো। যন্ত্রণার শেষ নেই!
সব সেরে ছেলের ঘরে কী একটা কাজে ঢুকেই দেখি আজকেও বালিশে মুখ গুজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই ওকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখছি। ভাবতাম ঘুমোচ্ছে। অনেক রাত অবধি জেগে পড়াশুনা করার অভ্যাসতো! সামনের বছর বারো ক্লাসের ফাইনাল দেবে। গর্ব করে বলার মতই মেধাবী সে। মাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিল। স্কুলে প্রথমতো বটেই, জেলাতেও। উচ্চমাধ্যমিকেও ওই ফলাফলের কোনো রকমফের ঘটবেনা বলেই সবাই আশাবাদী।
আজ ওর গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে জানতে চাইলাম, “ঘুমাচ্ছিস।”
ও ঘুমোয় নি। আমার কথাটা কানে যেতেই, যে ভাবে ছিল সে ভাবে থেকেই বললো,” আমার কিছু ভালো লাগছেনা বাবা।”
“আমি উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম,”কেন, শরীর খারাপ লাগছে?”
এবার সোজা হয়ে শুয়ে আমার চোখে তাকালো। দৃষ্টি যেন একটু ভেজাভেজা।
“আমি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি বাবা… এইচ.এসের রেজাল্ট কোনোভাবেই অ্যাজ পার এক্সপেক্টেশন হবেনা।”
চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল স্কুলে পঠনপাঠন স্তব্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে প্রাইভেট কোচিং-এ গিয়ে পড়াশুনাও। কেউ কেউ অনলাইন ক্লাস করাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোটাই নতুন। অনেকেই ধাতস্ত হয়ে উঠতে পারছে না। বন্ধুবান্ধবদের সাথেও সেভাবে যোগাযোগ নেই। ওর ভিতরেও হয়ত কোনো একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাহলে কি সেটা ডিপ্রেসন? আঁতকে উঠলাম। মাষ্টারমশাইয়ের কথাগুলোর আবার প্রতিধ্বনি শুনলাম নিজের ভিতরে। “ভয়াবহ ডিপ্রেসন!” নিজেকে আশ্বস্ত করতেই যেন মনেমনে বললাম নিজেকে, এত ভালো ছেলে এইটুকুতেই ডিপ্রেসন আসবে? না-না । নিজে ভয় পেয়েও ওকে সাহস দিতে বললাম,”এসব নেগেটিভ কথা ভেবে কেন নিজেকে দুর্বল করে ফেলছিস। তোকে তো এত ভেঙে পড়তে কোনোদিন দেখিনি। মনে জোর আন।নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট হবে।”
ও শুধুই ঘাড় নাড়লো।
দুদিন পরের কথা।
ঘরে ঘুরঘুর করতে করতেই হঠাৎ দৃষ্টি ছিটকে গেলো রান্নাঘরে। ওমা একি কান্ড! পরমা, আমার বউ, খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে জানালার ওপাশে। এদিকে ভাত উথলে চলকাবে চলকাবে করছে —- কোনো হুঁশ নেই। কী দেখছে? ভাতে একটু জল দিয়ে ওর পিছনে গিয়ে চুপটি করে দাড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কই কিছু নেই তো! নাকবরাবর সাগরবাবুর বাড়ির সানসেটে একটা হুলো বেড়াল অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বউয়ের মুখে চোখ তাক করে দেখি, এযে উদাস নেত্রে চেয়ে আছে। হঠাৎ কী হলো ওর আবার? কুড়ি বছর বিয়ে হয়েছে, কোনোদিন ওর মধ্যে কোন কবিত্ব বা দার্শনিকতার, এমনকি সামান্যতম চিন্তাশীলতার ভাবও চোখে পড়ে নি কখনো। সহজ সরল অতি সাধারণ এক গৃহবধূ।হাউহাউ করে কথা বলে। হাঃহাঃ করে হাসে।
ওর কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলো।
“কী হয়েছে?”
ও এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যে কি বলবে যেন কিছুই খুঁজে পেল না।
আমিই বললাম,”কিছু হয়নি,কিছু একটা ভাবছিলে, তাই তো?”
ও সলজ্জে ঘাড় নাড়লো। তারপর হেসে বললো,” যত সব আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসে আজকাল!”
আমি জানতে চাইলাম,”কী রকম?”
ও জানলার ওপাশে আটফুটের পায়েচলা পথটাকে নির্দেশ করে বললো,”ওই রাস্তাটা ধরে কতদিন, কত জায়গায় গেছি, কত দূরে দূরেও। দিল্লি, উটি, কাশ্মীর, গোয়া …. ওই রাস্তাটা প্রথমে পার হয়েই তো সব জায়গায় যেতে হয়েছে বলো? সেই লকডাউন হলো, তারপর দেখতেদেখতে কতগুলো মাস কেটে গেলো, ও পথে আর পা রাখাই হয়নি। এই, আবার রাখতে পারবো তো কোনদিন?”
বউটাও? প্রমাদ গুনলাম। মাষ্টারমশাইয়ের কথা যে অক্ষরে অক্ষরে খেটে যাচ্ছে। —-“এমনকি তোমার পরিবারের মধ্যেও আসতে পারে..……”
পরমা হাইডায়াবেটিক পেশেন্ট। বলা যেতে পারে, করোনা সংক্রমণের জন্য মোস্ট ভার্নারেবল। ও নিজে থেকেই কোনো ঝুঁকি নিতে চায় নি। একদমই বাড়ি থেকে বেরোয় নি এই কয়মাস। পরমাও কি ভয়ানক ডিপ্রেসনে আক্রান্ত?
ডাক্তার মুখার্জি একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন,”এইসব ডিপ্রেসন, অ্যাংজাইটি — ব্যাপারগুলোকে মোটেই হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়। এগুলো মনের সমস্যা হলেও দেহেও মারাত্মক মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।”
কি করা যায় এখন? আমার ছেলে, বউ — সত্যি কি ওরা ডিপ্রেসনে ভুগছে। কী করা উচিত এখন আমার? মাষ্টারমশাই তো সমস্যার কথাই বললেন সমাধানের কথাতো কিছুই বললেন না। কার সাথে আলোচনা করবো এটা নিয়ে? ….. আরে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমিও ডিপ্রেশনে ডুবে যাবো না তো? না না, মাষ্টারমশাই তো ভাবতে বারণ করলেন। কিন্তু না ভেবেও বা কিভাবে থাকা যায়?
ভাবনার মধ্যে থেকেই যখন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাবো, দেখি লম্বা পিপড়ের সারি। যে তাকে চিনি, গুড়োদুধ এসব জিনিসগুলো রাখা থাকে, সারির একটা মাথা সেখানে শেষ হয়েছে। আরেকটা মাথা? না জানালার দিকে তো নয়। তাহলে কোন গর্তে গিয়ে শেষ হয়েছে? মার্বেল পাথরের মেঝে ফুঁড়ে ওই পুঁচকে প্রাণীগুলোর পক্ষে কি সম্ভব কোনো গর্ত তৈরি করা? খুঁজে দেখতে হয়। তীব্র অনুসন্ধিৎসার এক ধাক্কায় ভাবনা তখন হওয়া।
অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেলো। কিন্তু চোখ কপালে। দুটো মার্বেলখণ্ড যেখানে পুডিং দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে সেখানে সেই পুডিং ভেদ করে তৈরি করেছে নিখুঁত গর্ত।
গর্তটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেই হঠাৎ যেন আমার বোধিলাভ ঘটলো। আর তার ভাগ দিতেই হইচই করে বউকে, ছেলেকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলাম। ওরা হাজির হতেই গর্তটা দেখিয়ে বললাম,”কিছু বোঝা যাচ্ছে?”
বউ বললো,”এতে বোঝার কি আছে শুনি? আমিতো কবেই দেখেছি। ওদের ঠোঁটে যা ধার!”
ছেলের দিকে তাকালাম।
চৌকস ছেলে আমার! দেখামাত্রই চট করে ধরে ফেলেছে।
“সমস্যা যতই কঠিন বোধ হোক, সমাধান আছেই। সো, নো ডিপ্রেসন, লুক ফরোয়ার্ড। তাই তো?”
আমি উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারলাম না। ছেলের পিঠ চাপড়ে বললাম,”ঠিক তাই।”
ছেলের মুখে বিজয়ীর হাসি। দৃপ্ত ভঙ্গিতে হাতমুঠো করে বুড়ো আঙুলটা টানটান সোজা করে দেখালো। আমিও একই মুদ্রায় প্রত্যুত্তর করলাম। এবার বউয়ের মুখে চোখ রাখার পালা। আমি কিছু বলার আগেই ও লাজুক হেসে বললো,”মামুলি ঘটনাগুলোকে তো কোনোদিন এভাবে ভেবে দেখিনি……।”