অর্নবের খুব মন খারাপ। 11 ই মে, ওর মা শুভ্রাদেবীর জন্মদিন। প্রত্যেক বছর অর্ণব এই দিন টা বিশেষভাবে পালন করে। ওর বাবা নেই,ওর ছোটবেলাতেই ওর বাবা মারা যান। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, চাকরিরত অবস্থায় মারা যান বলে ওর মা compassionate ground এ একটি স্কুলে ক্লার্ক এর চাকরি পান এবং সেই থেকেই একা ছেলেকে মানুষ করেন। ছোটবেলা থেকে মায়ের কর্মস্থলে যেতে যেতে অর্নবেরও শিক্ষকতা র চাকরির উপর একটা ঝোঁক ছিল। দীর্ঘদিন ধরে সে প্রস্তুতি ও নিচ্ছিল, কিন্তু রাজ্যে অনেকদিন নিয়োগ বন্ধ ছিল বলে খানিকটা হতাশার মধ্যেই ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত 2018 সালে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শিক্ষকতার চাকরি তে যোগদান করে অর্ণব। স্বাভাবিকভাবেই ওর 2019 এর লোকসভা ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ডিউটি এসেছে, এবং অর্ণব দের লোকসভা কেন্দ্রে ভোট হল 12 ই মে অর্থাৎ আগের দিন অর্ণবকে চলে যেতে হবে ভোটের ডিউটিতে। কোন ভাবেই সেই রাত টা মায়ের সঙ্গে কাটাতে পারবে না অর্ণব।
সরকার গরমের জন্য অতিরিক্ত ছুটি দিয়েছে তাই অর্ণব 10 তারিখ বাড়িতেই ছিল, ওর মা সকাল নটার সময় এক কাপ চা নিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন অর্ণব তখনো শুয়ে আছে শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে। শুভ্রাদেবী চেঁচিয়ে বললেন “হ্যাঁ রে তোদের কি শুয়ে শুয়ে মোটা হওয়ার জন্য ছুটি দিয়েছে নটা বেজে গেল এখন ওঠার নাম নেই কখন উঠবি ? বাজার তো ফাঁকা হয়ে গেল ওঠ চা টা খেয়ে একটু বাজারে যা, দুদিন তো থাকবি না। আমি কি এখন এই বয়সে বাজার যাবো “। অর্ণব একটা কোলবালিশে মুখ গুঁজে বলল “ধুর ভালো লাগছে না, যাব না বাজারে “। শুভ্রাদেবী বললেন “কেন কি হল আবার ? “। অর্ণব বলল দেখো মা সেই ছোটবেলা থেকে কালকের দিনটা আমরা একসাথে কাটাই কেক খাই, মামা মাসিরা আসেন, কত আনন্দ হয়। এবার তো অরুন্ধতী ও আসবে বলেছিল। ধুর এই সময় ভোটের ডিউটি টা পরতে হল “। শুভ্রাদেবী বললেন ” হ্যাঁ তোর গার্লফ্রেন্ডকে তো দেখলাম দুদিন ধরে শপিং করেই চলেছে ফেসবুকে তো পোস্ট দিয়েছে দেখলাম “Preparation for mother’s day” , কে জানে বাপু আমাদের সময় তো এত “ডে” ছিল না, তাও বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা – ভালোবাসা কোন অংশে কম হত না, এখন তোদের যুগে এসব যত কমছে, ডে এর সংখ্যা তত বাড়ছে। হ্যাঁরে, মাদার্স ডে তে একটু রান্না বান্না করে মাকে খাওয়াতে পারত, তাহলেই মা খুশি হত, আমার তো ভয় হয়, এখন দুজনের রান্না করি, তোর বিয়ের পর তিন জনের রান্না করতে হবে, আমার আর ছুটি হবে না “।
অর্ণব হেসে বলল ” ও হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গেছিলাম, যে তুমি তো এখন টেকস্যাভি হয়েছ ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ তো সারাদিন করছই, সেদিন তো দেখলাম অনলাইনে সিরিয়াল ও দেখছো “। শুভ্রাদেবী বললেন ” তো কি করব, তুই সারাদিন স্কুলে থাকিস তারপর তোর বন্ধু বান্ধব আছে, আমি রিটায়ার্ড মানুষ এই নিয়েই থাকি বেশ ভালো লাগে সবাই কি করছে ফেসবুকে দেখতে, তোর মামা মাসি দের সাথে আর ওদের ছেলে মেয়েদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়ে যায়, ভাবছি পরের মাসে নেটফ্লিক্স টা নিয়ে নেব “। অর্ণব চমকে গিয়ে বলল,” বল কি তুমিতো আলট্রা মডার্ন হয়ে গেলে দেখি “। শুভ্রাদেবী বললেন “ফেসবুকে আর একটা মজার জিনিস দেখেছি, অনেকে দেখবি কিছুই করে না মাঝে মাঝে আপডেট দেয় আমি এটা করিনি সমাজ কি আমায় মেনে নেবে”। মা ছেলে দুজনে হো হো করে হেসে উঠলো।
শুভ্রাদেবী বললেন ” নে নে সাড়ে দশটা বেজে গেছে তাড়াতাড়ি বেরো না হলে এই বুড়িকে দুদিন না খেয়ে থাকতে হবে “।
অর্ণব 11 তারিখ রাত্রে ভোটকেন্দ্রে বসে পরদিন এর কাজগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখছিলো মার সাথে কয়েকবার ফোনে ও ভিডিও কলে কথা হয়েছে, মামা ও মাসি রা এসেছে, সবাই গল্পগুজব করছে অর্নবের মনে হচ্ছিল, এক ছুটে বাড়ি চলে যায় কিন্তু কি আর করা যাবে ভোটের ডিউটি বলে কথা। ফোনেই মাকে বার্থডে উইশ করে শুয়ে পরলো সে, পরের দিন ভোর 5 টায় উঠতে হবে। পরের দিন যথাসময়ে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হলো, এলাকাটা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল এবং বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকার জন্য সেরকম গন্ডগোল হচ্ছিল না, অর্ণব তাই মাঝে মাঝে, ফেসবুক চেক করছিল, ওর বন্ধুবান্ধব সবাই মায়ের ছবি দিয়ে ফেসবুক ভরিয়ে ফেলেছে, হ্যাপি মাদার্স ডে, মা ইউ আর দ্যা বেস্ট, ইত্যাদি পোস্ট এর ছড়াছড়ি। এসব দেখতে দেখতে ওর যেমন খারাপ লাগছিল, মাথা ও সেরকম গরম হয়ে যাচ্ছিল। ওর মা কয়েক ঘন্টা অন্তর অন্তর ছেলের খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিলেন আর বলে যাচ্ছিলেন মাথা ঠান্ডা রাখবি,ORS টা খেয়েছিস ?, দুপুরের খাবার খেলি? ইত্যাদি। অর্ণব ভাবল এই মাদার্স ডে তেও ও মায়ের জন্য কিছু করতে পারছে না কিন্তু মা নিজের দায়িত্ব ঠিক পালন করে যাচ্ছেন। সন্ধ্যা 7 টায় ওর কেন্দ্রের কাজকর্ম মিটলো, 7.30 এ RC তে এসে মাল পত্র জমা দিয়ে বেরোতে বেরোতে 8.30 হয়ে গেল। ফেরার সময় যথারীতি গাড়ি পাওয়া যায় না, অনেক কষ্ট করে একটা গাড়ি ম্যানেজ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত পৌনে এগারোটা হয়ে গেল।
এর মধ্যে ও ফেসবুকে দেখেছে ওর would be অরুন্ধতী নিজের মায়ের সঙ্গে প্রচুর ফটো দিয়েছে, ওর মা আবার সেই ছবিতে কমেন্টও করেছেন। অরুন্ধতীর সঙ্গে অর্নবের অবশ্য সারা দিনে দু- তিনবার কথা হয়েছে। যাইহোক এসব দেখে অর্ণব ক্লান্ত দেহে ও মনে বাড়ি ফিরল।
শুভ্রাদেবী দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ওকে ঢুকতে দেখে বললেন “যা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয় নে, আমিও খাইনি, দুজনে একসাথে বসে খাব” । অর্ণব বলল ” তুমি আমার কেন এত রাত্রে……” ।শুভ্রাদেবী বললেন ” অত কথা না বলে তাড়াতাড়ি খাবার ঘরে আয়”। অর্ণব মিনিট 15 বাদে এসে অবাক হয়ে দেখলো, খাওয়ার টেবিলে একটা কেক এবং চাইনিজ খাবার রাখা, এবং ওর মা একটা হাসিমুখে চেয়ারে বসে আছেন।অর্ণব বলল “আরে! এসব কি করেছো ? ” । শুভ্রাদেবী বললেন ” কেন কাল থেকে তো তুই দুঃখে কাতর হয়ে যাচ্ছিলি, যে মায়ের জন্মদিন পালন করতে পারলি না, মাদার্স ডে সেলিব্রেট করতে পারলি না, তোর সব বন্ধু করে ফেলল, তাই আমিই তোর জন্য সব আয়োজন করে রেখেছি, নে কেক কাটছি, তাড়াতাড়ি সেলফি তুলেনে ও তারপর খেয়ে নে, না হলে তো আবার কালকে তুইই পোস্ট দিবি “এ সমাজ কি আমায় মেনে নেবে “, নে তাড়াতাড়ি আয় দেরি করিসনা “। অর্ণব হো হো করে হেসে উঠলো । রাত 12.30 অব্দি মা-ছেলে তে অনেক গল্প করলো, অর্ণব যেন সারাদিনের ক্লান্তি ভুলেই গেল।
শুতে যাওয়ার সময় শুভ্রাদেবী বললেন ” শোন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরবি, সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে অরুন্ধতীর সাথে গল্প করে রাত করার কোন দরকার নেই, আর ফটো গুলো ফেসবুকে আপলোড করে দিস, আমিও শেয়ার করব আর একটু ফিল্টার দিয়ে দিস ছবিগুলোতে, অরুন্ধতী তো দেখলাম এক একটা ছবি এক একটা কালার শেডে আপলোড করেছে “। অর্ণব বললো ” মা সত্যিই তুমি কত কিছু জানো, এত তো আমিই জানি না, you are the best আর, ছবি গুলোর ক্যাপশন কি দেব, সেটাও ঠিক করে দাও” ।শুভ্রাদেবী বললেন ” প্রথমত এমন কিছু বল যেটা আমি জানিনা আর ক্যাপশন আর কি দিবি, দিয়ে দে হ্যাশট্যাগ মাদার্সডে, হ্যাশট্যাগ মাদার্সহ্যাপিবার্থডে “। মা-ছেলে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো ।