পাড়ার ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প থেকে রক্ত দিয়ে ফিরে আসছিল সুকুমার। প্রত্যেক বছরই ষষ্ঠীর দিন পাড়ার ক্লাব থেকে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়।বেশ কিছু লোকজন রক্তদান করে।এই রক্ত ব্লাড ব্যাংকে জমা করে দেওয়া হয়।
আজ চার বছর ধরে এই ষষ্ঠীর দিন সুকুমার রক্তদান করে আসছে।এই দিনটা যে তার স্মৃতিপটে চিরদিন থেকে যাবে! সেদিনের সেই ঘটনাগুলো এখনও চোখের সামনে ভেসে আছে।
সে বছর পাড়ার পূজোর রজত জয়ন্তী ছিল।অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি ধুমধাম করে পূজো হবে – তাই পাড়ার ছেলেদের উৎসাহের অবধি ছিল না।সুকুমারের পনেরো বছরের একমাত্র ভাই সুমন প্রায় সারাদিনই পাড়ার দাদাদের সাথে পূজোর কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল।
পঞ্চমীর দিন ওভারটাইম করে মার জন্য একটা শাড়ী আর ভাইএর জামা প্যান্ট কিনে একটু রাতেই বাড়ী ফিরেছিল সুকুমার।শরীর খুব অবসন্ন – পরের দিন থেকে দশমী পর্যন্ত ছুটি – ভেবেছিল তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া যাবে।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই সুমনের সাথে দেখা – সে তীরের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে।মা পিছন থেকে চেঁচাচ্ছিলেন -‘ ওরে, দুটো ভাত খেয়ে যা!’ কে শোনে কার কথা!
দাদাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল সুমন।
-‘ দাদা, আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি।সাজানো এখনও কিছু বাকি।আজ রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে যে!’
-‘ তাড়াতাড়ি আয়।তুই এলেই খাবো।পড়াশোনা তো ডকে তুলে দিয়েছো!পূজো মিটলেই টেস্ট, সে খেয়াল আছে?’
একটু হেসে, সুমন সেই রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ওদের বাবা নেই – সুকুমার এই ছোট্ট ভাইটাকে বড্ড ভালোবাসে।সে এবার হাত পা ধুয়ে একটু শুলো।ভাই ফিরলে খাবে।
বোধ হয় মিনিট কুড়ি ও কাটে নি – খুব কাছেই পরপর বেশ কতকগুলো ফায়ারের আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো।সুমন এখনও বাড়ী ফেরে নি – রাত বারোটা প্রায় বাজে, মা ভাত নিয়ে বসে আছেন।একটু উদ্বিগ্ন মুখেই বিছানা থেকে উঠে বাইরে কি হলো , তার খোঁজ নিতে বেরোলো সুকুমার।
বেশিদূর যেতে হলো না – পল্টু আর খোকন ছুটতে ছুটতে এইদিকেই আসছিল। সুকুমারকে দেখে তারা কান্নায় ভেঙে পড়লো।
-‘ সুকুমারদা, তাড়াতাড়ি চলো – সুমনের দুটো গুলি লেগেছে, অনেক রক্ত – তাড়াতাড়ি – দেরি হয়ে যাচ্ছে!’
রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে সুকুমার জানতে পরে – পাশের পাড়ার ক্লাবের টোটন আর তার সঙ্গী সাথীরা দলবল নিয়ে আজ এখানে চড়াও হয়েছিলো।ওদের সাথে গোড়া থেকেই এই ক্লাবের শত্রুতা – ওরা বেশির ভাগই সমাজবিরোধী।টোটন নিজে প্যান্ডেলে ঢুকে লাঠি দিয়ে প্রতিমা ভাঙার চেষ্টা করে।সুমন তখন ছুটে এসে দুহাত ছড়িয়ে মা দুর্গাকে আড়াল করে দাঁড়ায়।এই ক্লাবের সবাই রুখে দাঁড়াতে উপায়ান্তর না দেখে ওরা ফায়ার করতে শুরু করে।একটা গুলি সুমনের কাঁধে, আর একটা বুকের বাঁপাশে লেগেছে।
পাগলের মত ছুটে গিয়ে ভাইকে কোলে টেনে নেয় সুকুমার।অস্ফুটে বলে ওঠে – ‘ অ্যাম্বুলেন্স – কেউ অ্যাম্বুলেন্স এ ফোন কর না!’ ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হয় পুলিশ পেট্রল – ওদের গাড়িতেই সুমনকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয় ওরা।রাত তখন দুটো।
এরপরই শুরু হয় সেই দুঃস্বপ্নের মুহূর্ত।ইমার্জেন্সিতে সুমনকে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলেন – কাঁধের গুলিটা চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলেও বুকের গুলিটা বিঁধে আছে।ওটা অপারেশন করে বার করতে হবে।প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে – তাই এক্ষুনি চার বোতল রক্ত জোগাড় করে রাখতে হবে।
ষষ্ঠীর ভোর হতে না হতেই রক্তের সন্ধানে ক্লাবের ছেলেরা আর সুকুমার পাগলের মত ছুটলো।সুমনের ব্লাড গ্রুপ AB – নেগেটিভ।এই গ্রুপের রক্ত জোগাড় করা খুব শক্ত।অনেক ঘুরে বেলা বারোটা নাগাদ দুই বোতল রক্ত জোগাড় হলো।প্রাইভেট কিছু ব্লাড ব্যাংক বললো – রক্তদানের কার্ড থাকলে ওরা চেষ্টা করে দেখতে পারে।কিন্তু ওদের কেউ আগে রক্তদান করে নি।
সুমনের প্রাণের ঝুঁকি থাকায় বেলা দুটো নাগাদ অপারেশন হলো।কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার বললেন – অবস্থা বিপজ্জনক। বাকি দুই বোতল ব্লাড ও এখনই দিতে হবে।
চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো সুকুমার।ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া তখন ওর আর কোনো উপায় ছিল না।
বিকেল চারটে নাগাদ সুমন তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য চিরতরে রওনা হলো।মা দুর্গা হয় তো তাঁর এই প্রিয় সন্তানটিকে নিজের কাছে চিরদিনের জন্য রেখে দেবেন বলে কৈলাশ ধামে টেনে নিয়ে গেলেন!
শ্মশানে ভাই এর মুখাগ্নি করার সময় সুকুমার সজল চোখে প্রতিজ্ঞা করেছিল – জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে বছরের এই দিনটিতে রক্তদান করে যাবে – যাতে রক্তের অভাবে কোনো মায়ের কোল ছেড়ে সন্তান চলে যাওয়ার আগে সে তাঁকে তার সাধ্যমতো সাহায্য করতে পারে।
যখন সে ফিরছে – পাড়ার প্যান্ডেলে তখন পুষ্পাঞ্জলি চলছে।সেখানে এক মুহুর্ত হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে সে মাকে এই প্রার্থনাই জানালো – ‘ মা জগজ্জননী! এই পৃথিবী থেকে ক্রোধ,গ্লানি,শত্রুতা,বিদ্বেষ দূর করো – সব মায়ের মুখে হাসি থাকুক – কোনো মা যেন চোখের জলে ভেসে তোমাকে কোনো অনুযোগ না জানায়!’