( ১ )
সেই মুখ
দেয়ালঘড়ির একটা ঘন্টাধনি সমস্ত নীরবতা ভঙ্গ করে কেঁপে কেঁপে বাতাসে মিশে গেল । এই কদিন থেকে রাত্রিতে ঘুমোতে পারছেন না সোমনীলবাবু । পুরনো সেই ভয়ংকর স্মৃতিটা বারবার মনকে নাড়া দিচ্ছে । কদিন থেকে রাতে যা দেখছেন সবকিছুই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সোমনীলবাবুর । আজ আসল জিনিসটা কি জানতেই হবে । মনে মনে উনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন । অথচ গত কয়েক রাত্রির ঘটনা কাউকেই প্রকাশ করেননি সোমনীলবাবু ।
আজ বাইরে বজ্রবিদ্যুতের উদ্ভাসন আর রুদ্র প্রকৃতির উদ্দাম নৃত্য একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে । ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতিতে জানলাগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে । দেয়ালে ক্যালেন্ডার উড়ছে । স্তূপীকৃত করে রাখা গানের স্বরলিপিগুলো আর নিজের জায়গায় নেই ।
সোমনীলবাবু বিছানা ছেড়ে উঠে দপ করে গ্যাসলাইটটা জ্বালিয়ে ফেললেন । কিন্তু নিজেরই দীর্ঘনিঃশ্বাসে এক ঝলক জ্বলেই সেটা নিভে গেল । বাইরে হাওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে । হঠাৎ টেলিফোনটা বেপরোয়া ভাবে বেজে উঠল । ওনার বুকটা একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল । রিসিভারটা তুলে সামান্য কাঁপা গলায় ওনার আওয়াজ বেরিয়ে এল …
“ হ্যা , হ্যালো । ”
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই ।
এবার সোমনীলবাবু ঘরের কাঁচের দরজার বাইরে আবছা এক নারীমূর্তিকে দেখলেন । সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল চাপা অট্টহাসি । মুহূর্তের মধ্যে সোমনীলবাবুর হাত থেকে রিসিভারটা পিছলে গেল । টর্চলাইটটা ড্রয়ার থেকে বের করে জ্বেলে ফেললেন সোমনীলবাবু । চিৎকার করে উঠলেন …
“ কে , কে ওখানে ? কে ওখানে ? তু … তুমি কে ? ”
দরজা খুলে বাইরে এলেন । কেউ কোথাও নেই । বাইরে ঝড়ের দামামা কিছুটা কমেছে । চারদিকটা আলকাতরার মত অন্ধকার , যার মধ্যে দিয়ে টর্চের আলো ভেদ করে যেতে পারে না । দোতলার বারান্দা থেকে সোমনীলবাবুর দুটো সন্ধানী চোখ আর টর্চ লাইটের আলো ঠিকরে পড়ছে । হঠাৎ ওনার চোখটা সরে গেল নিচের আধভেজা অন্ধকার রাস্তার ওপর । স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেই নারীমূর্তিকে । নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি । পনেরো বছর আগে সেই ভয়ংকর সেই রাতটার কথা কল্পনা করে সোমনীলবাবুর ডান হাতের টর্চটা সামান্য কেঁপে উঠল । এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না , যা দেখছেন সত্যি তো ? দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলেন উনি ।
“ তুমি … তুমি কে ? তু … তুমি তো … কি করে সম্ভব ? সত্যি করে বলো তুমি কে ? ”
আবার অট্টহাসি । সোমনীলবাবু ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন । হাত দশেক দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই নারীমূর্তি । আবার কাঁপা গলায় সোমনীলবাবুর একই প্রশ্ন । এবার সেই নারীমূর্তি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল …
“ আমি পনেরো বছরের অতীত । ”
সোমনীলবাবুর হাত থেকে টর্চটা ততক্ষনে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তার ওপর পড়ে চৌচির হয়ে গেছে । আবছা অন্ধকার মেশানো আলোতে সেই পুরোনো মুখ চিনে নিতে এক মুহুর্তও সময় লাগল না সোমনীলবাবুর । চোখের সামনে রহস্যমাখা দৃশ্যপট একটু একটু করে আবছা হয়ে গেল ওনার । সিঁড়ির কাছে দেয়ালটা খামচে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন উনি । বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল । হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো আলোতে সেই রহস্যময়ী নারীমূর্তি তখন আঁধারের বুক চিরে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
(ক্রমশঃ)