ম্যাচের তখন আর গোটা পাঁচেক ওভার বাকি। নিউজিল্যান্ডের বোলারদের তখন তুলোধোনা করছেন রবীন্দ্র জাদেজা। দুই ওভারের বিরতিতে হঠাৎ দেখা গেল চিরপরিচিত সেই দৃশ্য। পিচের মাঝ বরাবর বসেছে এমএস স্যারের ক্লাস। হাত নেড়ে ম্যাচ শেষ করার অঙ্ক বুঝিয়ে যাচ্ছেন তিনি, বহু যুদ্ধের পোড়খাওয়া নায়ক এমএস ধোনি। আর ছাত্র? কে আবার? স্বয়ং জাদেজা। মনে হচ্ছিল ম্যাচের গভীরতম মুহূর্ত দেখছি। জীবদ্দশায় চার্লস ডারউইন কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন যে, তাঁর যুগান্তকারী ‘Survival of the fittest’ তত্ত্বের এমন ব্যবহারিক প্রয়োগ কোনও ক্রিকেট ম্যাচের মাধ্যমে সম্ভব? কার্ল মার্কস ও কি ভাবতে পারতেন, জীবন সংগ্রামের এমন চমৎকার রেপ্লিকা হতে পারে এক ক্রিকেট ম্যাচ?
সত্যিই, ১০ই জুলাই দেখিয়ে দিয়ে গেল একটি ক্রিকেট ম্যাচ কোন পর্যায়ে উন্নীত হলে তাকে জীবনসংগ্রামের জেরক্স কপি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে! কি না দেখা গেল এই দুদিন ধরে চলা একদিনের ম্যাচ কে কেন্দ্র করে! প্রবল প্রতিপক্ষ ভারতীয় বোলিং বাহিনীর গোলাগুলির সামনে কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে কিউই ব্যাটসম্যানদের চোয়াল চাপা সংগ্রাম। কঠিন প্রশ্নপত্রের সামনে পড়ে ভারতীয় ব্যাটিং এর যুদ্ধবিমান গুলির জ্বালানি আচমকা ফুরিয়ে যাওয়া! অচৈতন্য অবস্থা থেকেও ভারতীয় দলের পাল্টা প্রতিরোধ, চূড়ান্ত সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। অবশেষে, মার্টিন গাপটিল কৃত একটি অবিশ্বাস্য থ্রো এবং একশো ত্রিশ কোটির স্বপ্নভঙ্গ। টিকে থাকার এই মরিয়া সংগ্রাম কে কেবল খেলাধুলার জগতে আবদ্ধ করে রাখা যায় কোন যুক্তিতে? এ যেন জীবনযুদ্ধের ময়দানি সংস্করণ। সত্যিই, খুব কম ক্রিকেট ম্যাচের ই সৌভাগ্য হয় এমন জীবনযুদ্ধের পাঠ নেওয়ার। সেই যে কবে কোন এক নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড একটা গাধা! তার সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ১০ই জুলাইয়ের ওল্ড ট্রাফোর্ড। স্কোরবোর্ড সেখানে সত্যিই এক গাধাই, কারণ সে তুলে ধরে না মাঠে ঘটে যাওয়া একের পর এক রোমাঞ্চকর ঘটনাকে, জীবন সংগ্রামের রঙের থেকে তিলমাত্র আলাদা নয় যাদের বর্ণ!
কেই বা জানত দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া নিউজিল্যান্ড মানসিক ভাবে এতটাই মরিয়া থাকবে যে, তাদের বোলিং বাহিনীর সামনে দাঁড়াতেই পারবে না ভারতীয় ব্যাটিং এর মিগ, রাফালে, সুখোই রা! পুরো টুর্নামেন্টে রাজ করে চলা রোহিত শর্মা এবার যে ল অফ এভারেজ এর কবলে পড়তে চলেছেন, এ আশঙ্কা ছিলই, হেনরীর অনবদ্য আউট সুইঙ্গার এই ভয়েই সিলমোহর দিল। প্রথম পাঁচ ওভারেই ড্রেসিংরুমে ফেরত গেলেন রোহিত, বিরাট ও রাহুল। অপরিনত তারুণ্য ধরে রেখেই মরিয়া লড়াই একটা শুরু করলেন পন্থ আর পাণ্ডিয়া। কিন্তু কঠিন ম্যাচে মাথা ঠান্ডা রাখা এখনও আয়ত্ত করেননি তাঁরা। ফলতঃ, ক্রিজে বহু যুদ্ধের পোড়খাওয়া নায়ক এমএস ধোনি। সঙ্গী বিশ্বকাপে প্রথম ব্যাট পাওয়া রবীন্দ্র জাদেজা। একমাস পাঁচদিন ধরে অশ্বমেধ এর ঘোড়া ছোটানো টিম ইন্ডিয়ার সামনে তৈরি হওয়া ৪৫ মিনিটের এক সংকট। সেই সংকট থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতে অভিযানে দুই যোদ্ধা।
বারংবার উপেক্ষিত অপমানিত এক রাজপুত প্রতিভাবান ক্রিকেটারের নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা, অতীতের ছায়া এক মহাতারকার শেষবারের মত রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার মরিয়া প্রয়াস। এমন রোমাঞ্চকর ক্লাইম্যাক্স যেন মতি নন্দীর উপন্যাসের শেষ কটা পাতা! ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে যেন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল জীবনসংগ্রামের নাট্যের মরিয়া শেষ অঙ্ক। যার এক কুশীলব রবীন্দ্র জাদেজা। একদা টেস্টের একনম্বর বোলার, রঞ্জিতে তিনটি ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকানো অল রাউন্ডার যিনি আজ টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে উপেক্ষিত।যিনি প্রথম দলে সুযোগ পান দল মাঠে নামার একমাস একদিন পর, প্রথম ব্যাট হাতে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পান একেবারে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দলের সঙ্কটের মুহূর্তেই। বুদ্ধিমান জাদেজা বুঝে নিতে দেরি করেননি, এটাই তাঁর জীবনের সেরা সুযোগ, নিজেকে প্রমাণ করার, নিজের মস্তানিকে সারা বিশ্বের সামনে উপস্থিত করার। ৯২-৬ স্কোরলাইন কে একঘন্টার এক তাণ্ডবলীলা চালিয়ে পৌঁছে দেন ২১০-৬ স্কোর পর্যন্ত। আউট হবার পর যখন ফিরছেন, আদায় করে নেন মাঠ ভরা দর্শকের অভিবাদন। যে অধিনায়ক কোহলি তাঁকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করে এসেছেন, স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ইনিংস খেললেন আজ রবীন্দ্র। ম্যাচ নাই বা বের করলেন, ক্রিকেট দেবতার অদৃশ্য বিচার সভায় কিন্তু বিচার টা ঠিকই পেলেন বরোদা বাসী এই বাঁহাতি অল রাউন্ডার।
এবং মহেন্দ্র সিং ধোনি! ফিরে যাই প্রবন্ধের শুরুর সেই দৃশ্যে। মাঝ উইকেটে দাঁড়িয়ে জাদেজাকে নিখুঁত ম্যাচ পরিকল্পনা বাতলে দিচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ফিনিশার। ভিনটেজ এমএস। তিনি ছিলেন বলেই ৯২-৬ অবস্থায় ও খুব বেশি টিভি বন্ধ হয়ে যায় নি ভারতে। বয়সের ভার থাবা বসিয়েছে ক্ষিপ্রতায়। শুরু থেকে ঝড় তোলার সেই ক্ষমতা এখন পরিণত হয়েছে মৃদু বাতাস সৃষ্টির ক্ষমতায়। উইকেটের পিছনেও কমেছে রিফ্লেক্স। আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ ম্যাচে স্লো ব্যাটিং এর জন্য বিদ্ধ হয়েছেন সমালোচনায়, তাঁর অবসর দাবি করে তোলপাড় চলছে দেশে। কে জানত, শেষবারের মত নিজেকে প্রমাণের জন্য তিনি বেছে নেবেন তাঁর শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচটিকেই? অন্যপ্রান্তে যখন ঝড় তুলেছেন জাদেজা, তিনি তখন নিঃশব্দে আগলে রেখেছেন একটা দিক। বরাবরের ধোনি কৌশল। ম্যাচটি শেষ অবধি নিয়ে যাও, আচমকা গাড়ি ফোর্থ গিয়ারে তোলো, ম্যাচ নিয়ে যাও – ম্যাচ শেষ করার এই কৌশলকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি, ভারত তথা বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ফিনিশার। ব্যাটিং বিপর্যয়ের দুর্গন্ধ কাটিয়ে ধোনি কৌশলের সুগন্ধে তখন ম ম করছে ম্যানচেস্টার। জাদেজা আউট? তো কি? ভারত তখন টিভির পর্দায়। স্ক্রিনে তিনি, সর্বকালের অন্যতম সেরা ভারতীয় অধিনায়ক, ভারতকে দুটি বিশ্বকাপ দেওয়া, একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দেওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি, সর্বকালের অন্যতম সেরা ভারতীয় ক্রিকেটার। বরাবরের ধোনি চিত্রনাট্য মেনেই গাড়ি আচমকা উঠল ফোর্থ গিয়ারে। ফার্গুসনের ১৪০+ গতির এক্সপ্রেস বল ও উড়ে গেল গ্যালারিতে। সারা মাঠ জুড়ে তখন ধোনি ধোনি চিৎকারে কান পাতা দায়। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে প্রয়োজন আর ১১ বলে ২৫। তাঁর কাছে যে এটা জলভাত। ভারত ও সিএসকে র হয়ে এসব ম্যাচ বলে বলে বের করেছেন তিনি। গোটা ভারত তখন নিশ্চিত, বরাবরের মতই ম্যাচ ফিনিশের অঙ্ক নিখুঁত কষতে ভুল করেননি পোড়খাওয়া প্রাক্তন অধিনায়ক। সাংবাদিকরা আলোচনায় ব্যস্ত, ১৯৮৩ র বিশ্বকাপে কপিল দেবের হাত ধরে ব্যাটিং বিপর্যয় কাটিয়ে টার্নব্রিজ ওয়েলসের সেই বিখ্যাত জিম্বাবুয়ে ম্যাচ জয়ের পাশেই বসতে চলেছে কিনা ৬-৩ স্কোরলাইন থেকে ভারতের এই রোমাঞ্চকর প্রত্যাঘাত! ঠিক সেই সময়ই মার্টিন গাপটিল এবং তাঁর হাত ঘাতক হয়ে হাজির হল। ১৩০ কোটির হৃদয় ভেঙে দেওয়া রান আউট যখন সম্পন্ন হল, তখন ভারতের দরকার আর ৯ বলে ২৪। মহেন্দ্র বাবু থাকলে যা অবশ্যই সম্ভব ছিল। অতঃপর, ভারতের বিদায় এবং নর্থ ইস্ট লন্ডন অভিমুখে নিউজিল্যান্ড দলের যাত্রা শুরু। স্কোরবোর্ড তুলে ধরবে ভারতের পরাজয়। নিউজিল্যান্ডের অবিশ্বাস্য জিত। কিন্তু তুলে ধরবে না কোনও এক রবীন্দ্র জাদেজার নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধ। তুলে ধরবে না কোনও এক প্রাক্তন অধিনায়কের মরিয়া চেষ্টা, দলকে কাপ সাগরে ভাসিয়ে রাখার। তুলে ধরবে না যে, নিজের ক্রিকেট জীবনের বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচেও রোমাঞ্চকর ফিনিশের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ফিনিশার, সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন এক আহত রাজপুত যোদ্ধাকে। সত্যিই কি জয় ই সব? সোনালী কাপ টাই সব? আর জীবনের যুদ্ধের কাপ? সেটা কি হেরে গিয়েও পেলেন না এই দুই যোদ্ধা? আউট হয়ে যখন ফিরে আসছিলেন তাঁরা, পিছনে উড়ছিল না অদৃশ্য তেরঙ্গা? বাজছিল না নিঃশব্দ জন গণ মন? কখনও কখনও পরাজয় কি জয়েরই একটি রূপ নয়? স্কোরবোর্ড সত্যিই একটা আস্ত গাধা!
–প্রোজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়
চিত্র সৌজন্য : গুগল