ছোট ছোট খাবলা খাবলা করে কাটা বেখাপ্পা চুল। গায়ে পুরু হয়ে পড়েছে ময়লার আস্তরণ। ছেঁড়া ময়লা একটা শাড়ি কে কোনোরকমে গায়ে পেঁচিয়ে বাচ্চা টা কে আড়াল করার চেষ্টা করছে পাগলী টা। পাগলী ই বটে! এই সিমেন্টের বড় বড় গোল্লা গুলোর মধ্যে তোকে কে দেখবে রে?? পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। পাগলী তখন ওর কুঁচকে যাওয়া শীর্ন স্তন বৃন্ত জোর করে গুঁজে দিতে চাইছে বাচ্চাটার মুখে। বাচ্চা টা দুধ পাওয়ার জন্য হা করছে, কিন্তু পাচ্ছে না। তাই চিৎকার করে কাঁদছে। পাগলী ই বটে! ওরে মা না হলে, তোর বুকে দুধ আসবে কোত্থেকে??? আমিও তো চারটে বাচ্চার মা, জানব না ,তা কি আর হয়!! কিন্তু পাগলী ওসব বোঝে না। নিজেকেই নিজে ঠিকঠাক সামলাতে পারে না, আজ কোত্থেকে একটা ফুটফুটে বাচ্চা জোগাড় করে এনেছে! বাচ্চা টা কে আপ্রাণ চেষ্টা করছে দুধ খাওয়ানোর, বাচ্চাটাকে থামানোর জন্য থাবা দিচ্ছে আর বিড়বিড় করে চলেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, পাগলী টা মা হয়ে উঠতে চাইছিল। কিন্তু ওকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার ছিল না।
আমাকে দেখে পাগলী ফ্যাসফ্যাসে গলায় খিক্ খিক করে হেসে বলল, “ এই দেখ, আমার বাচ্চা। আমার সোনা মা টা। খালের ধারে আজ ভোরে আমার সোনা মা টা পড়ে ছিল। আমার জন্য কাঁদছিলো। এই, এই, এখানটায় দাঁড়া তুই চুপ করে। আমি এক ছুটে আমার মেয়ে টার জন্য খাবার নিয়ে আসবো। পালাবি না কিন্তু। আমার মেয়ে টা কে লক্ষ্য রাখ।” আলুথালু কাপড় কোনোমতে সামলে পাগলী ছুট লাগাল ওর নতুন মেয়ের জন্য খাবার আনতে। আমি জানি, ও খাবার আনতে পারবে না। ও যে দিক টায় দৌড় লাগিয়েছে ওখানে একটা বড় প্যান্ডেল হচ্ছে। দুগ্গা পূজার আর তো মোটে 4 টে দিন বাকি। এখন প্যান্ডেলের কর্মকর্তা রা খুব ব্যস্ত। এই প্যান্ডেল টায় আবার হীরের গয়না পরা মা দুগ্গা আসবেন। তাই এখন থেকেই পুলিশ বসেছে গেটে। আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আর পাগলী আবার ওদিকেই গেল। সাধে কি আর ওকে সবাই পাগলী বলে!!
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে লাগলাম। ফুটফুটে বাচ্চা। মেয়ে। কাছে গিয়ে ছুঁতে সাহস হলো না। কত নোংরা ঘেঁটে এসেছি। এই শরীরে হাত লাগাবো না ওকে। বাচ্চা টা একটা পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে মোড়া । নিশ্চয়ই কেউ ফেলে রেখে গেছিল খালের ধারে। একবার ওই খালটা তেই একটা মরা বাচ্চা ভেসে উঠেছিল। সেটাও মেয়ে। আমিই দেখেছিলাম প্রথম। আমার চিৎকারে লোক জড় হয়েছিল।
বাচ্চাটা ভয়ানক কাঁদছে।রোদের তেজ বাড়ছে। এভাবে আর কতক্ষণ বাঁচবে কে জানে! পাগলী টা কখন ফিরবে জানি না। পাগলী আর আমি এই এক সিমেন্টের খোপেই থাকি। আর থাকে আমার চারটে ছেলে মেয়ে। ওদের বাবা নেই। জন্ম দিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু এখন যে কি করি!! বাচ্চা টা কে যদি কেউ দেখে একটু পুলিশ কে খবর দিত। বেঁচে যেত হয়তো। পাশ দিয়ে বাজারের থলি হাতে একটা লোক হেঁটে গেল। আমি কয়েকবার ডাকলাম। একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল।আবার ডাকলাম। শুনলো না। জানতাম শুনবে না । আমি কি আর ওদের ভাষায় ডাকতে পারি!! অথচ আমি ওদের ভাষা বুঝি। আরে ধুর, সব ভাষা কি মুখে বলে বোঝাতে হয়?? আমি ওদের চোখের ভাষা বুঝি, আদরের ভাষা বুঝি, গায়ের গন্ধ বুঝি।
হঠাৎ খেয়াল হলো, আমার কাছে এসে আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়েছে আমার ছোট মেয়ে টা। আমি আদর করে গা চেটে দিলাম ওর। ইশ, মানুষের বাচ্চা টা কেও যদি এভাবে আদর করে দিতে পারতাম!! আমার ছোট মেয়েটা কে পাহারায় দাঁড়াতে বলে আমি গেলাম মেন রোডের দিকে। ওখানে এখন একজন সাদা পোশাকের দারোগা থাকেন। উনি আমাকে ভুলো বলে ডাকেন। মাঝে মাঝে আমাকে বিস্কুট দেন। ল্যাজ নাড়ালে আর আবদার করে ডাকলে উনি আরো চারটে বিস্কুট দেন আমার ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য।
**
সন্ধ্যের আগেই আমি ফিরে এলাম। আমাদের খুপড়ি টার দিকে যেতেই পাগলী একটা আস্ত চ্যালা কাঠ ছুঁড়ে মারলো আমাকে।
এক খাবলা থুতু ছিটিয়ে দিলো আমার দিকে।
“ দুর হ, শালা কুত্তা। আমার মেয়ে টা কে কেড়ে নিলি। কুকুর টা, দূর হ। কুত্তা কে আমি বিশ্বাস করেছি। ঠিক বলে সব , আমি একটা পাগলী।” বলেই নিজের মাথার চুল টানতে লাগলো আর হাসতে লাগলো।
আমি সরে গেলাম । একটু দূরে উঁচু বালির ঢিবি টার ওপর গিয়ে বসলাম। আমি কষ্ট পাইনি। কুকুর কে কুকুর বলেছে, তাতে দুঃখ কিসের। বরং আজ আমি বেজায় খুশি। এই প্রথমবার কুকুর হয়ে আমি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি একটা মানুষের বাচ্চার প্রাণ বাঁচানোর জন্য। ঠিক সময় মত দারোগা বাবু কে পেয়ে গেছিলাম ভাগ্গিস। ওনার প্যান্ট কামড়ে ওনাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। অন্য কেউ হলে আমাকে লাঠি পেটা করত। কিন্তু ওই যে, উনি আমাকে ভুলো বলে ডাকতেন, তাই বোধহয় ভুলেও আমাকে মারধরের কথা ভাবেননি। পাগলির আর কি! আমি ওকে চিনি গত পাঁচ বছর ধরে। এখন কদিন আমাকে দেখলে তেড়ে আসবে। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লে ও সব ভুলে যাবে আবার। মানুষ বলে দুগ্গা নাকি ওদের ঘরের মেয়ে উমা। কি জানি, আমি বুঝি না, মাটির উমা কে ওরা হীরে দিয়ে সাজায়, কত যত্ন করে পুজো করে, আর কোলের উমা কে খালের ধারে ফেলে রেখে যায় রাতের আঁধারে। আমার মনে আপাতত কোনো গ্লানি নেই। দারোগা বাবু যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন “ তুই যা করলি ভুলো, আমি সারাজীবনেও ভুলব না। তুই কুকুর হয়ে যা করেছিস আজ, তোর থেকে মানুষের শিক্ষা নেয়া উচিত। তুই চিন্তা করিস না, এই শিশু টা আপাতত প্রশাসনের হেফাজতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবে যতক্ষন না ওকে কোনো বাবা মার খালি কোলে দেয়া যাচ্ছে।” আমি কি আর অতো কথা বুঝি! আমি খালি খুশি হয়ে দুবার ল্যাজ টা নেড়ে দিয়েছি। দারোগা বাবু বুঝে নেবেন যা বোঝার। আমি শুধু জানি, আমিও তো মা, আমার ও তো চারটে বাচ্চা আছে। হোক না ওটা মানুষের বাচ্চা, তবু শিশু তো! একটা কোল পাক, দুধে ভাতে থাক। মেন রোডের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লরি করে কোনো প্যান্ডেলের মা দুগ্গা যাচ্ছেন আসন গ্রহন করতে। আমার কোলের চারটে আমার গা ঘেষে বসে আছে। আমি আলতো করে চেটে দিলাম ওদের।
আপাতত শাব্দিক এ পড়া সেরা গল্প
অনেক ধন্যবাদ😊