দশা বাগদীর বড় ছেলে গত বছর পদ্ম তুলতে গিয়ে সাপে কেটে মরেছিল ।দশা কেঁদে কেঁদে বলেছিল সে কোন দিন তার ছোট ছেলেকে পদ্ম বনে পাঠাবে না । কিন্তু সে বেমালুম সে কথা ভুলে গিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে এ বছর ও প্রতিদিন পদ্ম তুলতে যাচ্ছে ! না গিয়ে করবে কি ? পেট বড় জ্বালা ।কিছু বাড়তি পয়সা পেলে সংসারে অভাব ঘোচে ।
দশা এক ঝুড়ি পদ্ম নিয়ে ঠাকুর দালানে নামালে বামুন ঠাকুর গঙ্গা জল ছিটিয়ে ফুলের ঝুড়ি তুলে নেয়। বাগদীর ছোঁয়া ফুলে গঙ্গা জল না দিলে নাকি শুদ্ধ হয় না ! তাই…………
এইবার পাট ভাঙ্গা নতুন শাড়ি গয়না পড়া মেয়ে বউরা আধ ফোটা ফুল গুলোকে ফোটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
দশা ফুলের দামের জন্য তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকে । দাম পেলে বউকে একটা শাড়ি আর ছেলেকে নতুন জামা দেবে ।
আমি দেখছি সব কাণ্ড , শেষে বিরক্ত হয়ে বামুন ঠাকুর কে বলি – মামা ফুলের দাম তো দাও, আর কতক্ষণ দাঁড়াবে ?
তিনি রাগত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে দশার দিকে এক খানি নোট ছুঁড়ে দিলে ,দশা নোট তুলে মাথায় ঠেকিয়ে ধীর পায়ে চলে যায় ।
আজও বাড়িতে আমার নামে নালিশ যাবে ! আজ ও দিদু হাসি মুখে আমার সব বেয়াদপি মেনে নেবে !
আজ পুকুরে মাছ ধরা হবে ।একটা লম্বা জাল এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টেনে টেনে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তের পাড়ে তুলে জাল থেকে মাছ আলাদা করে ঝুড়িতে জেলেরা ভর্তি করবে ।
এতো মাছ কি হত ? তখন পর্যন্ত টাটকা জিনিস বাসি করে খাবার যন্ত্র টি ঘরে ঘরে বিরাজ করেনি ।তাই পাড়াতে বিলিয়ে যা থাকবে তা দিয়ে মাছের টক রেঁধে ক দিন খাবার বন্দবস্ত প্রায় সব বাড়িতেই হত ।
পুজো মানেই কাশ ফুল ,পুজো মানেই পেঁজা তুলোর মত মেঘ , নাড়ু ,মুড়কি , গাছ তলাতে শিউলির বিছানা । হ্যাজাকের আলো , দূর কোন গাঁ থেকে কিশোর আর লতার গলা বাতাসে ভেসে ভেসে আমার কানে ,বুকে । এই সব গন্ধ নিয়েই আমার পুজো ।পুজো মানেই আমার দিদুর কাছে যাবার লম্বা ছুটি ।
আজকের বিবর্ন ডাইরির পাতা কত কথা মনে করায় !!
দশার বৌ আমার দিদুর কাছে ঠিকে কাজ করতো ,আমাকে ওর খুব ভয় ছিল ,বড়দের চোখ এড়িয়ে ওকে ছুঁয়ে দিতাম ।ওর বদ্ধমূল ধারনা ছিল আমি ওকে ছুঁলে ওর পাপ হবে ,কারন আমি ‘উঁচু’ জাত আর সে নিচু জাত ! ওর আতঙ্কিত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভীষণ এক নিষিদ্ধ মজা পেতাম ।
তাকে বুঝিয়ে পারতাম না এভাবে জাত যায় না ,সে আমার কাছ থেকে আরও সরে দাঁড়িয়ে থাকতো । তারপর প্রতি বারের মতো সেই এক কথা- ঘরে জানতে পারলে এই অবেলাতে তোমাকে চান করাবে , তোমার দিদু রাগ করবে !
এই একটি ব্যাপারে সাদা থান বড্ড কড়া ছিল ! আমার এই বেয়াদপি তিনি কোন দিন মেনে নেননি
শুধু কি শরীর ছুঁলেই সব অচ্ছুৎ হয়ে যায় ? আর মন ছুঁলে অচ্ছুৎ হয় না ? সে দিন ও উত্তর ছিল না ।আজও নেই !
মায়ের ডাকের সাজ , টানা টানা মায়াবী চোখ ,পরনে কারও দেওয়া মানতের শাড়ি । কিছুক্ষণ এক ভাবে তাকালেই বুকটা কেমন হু হু করে ।
পুজোর আয়জনে আমার নাম নেই ! আমি সারা দিন যত সব ম্লেচ্ছ দের সাথে ঘুরেছি । শুধু ঘুরেছি না ,তাদের ঘরে খেয়েওছি । আমার ছোঁয়ায় সব অপবিত্র হয়ে যাবে ।
এলোমেলো চুলে পুরনো জামা পড়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকি । দিদু রাগ করে । পুজোতে নতুন জামা না পড়লে সংসারে না কি অকল্যাণ ।
বোকা বাক্স টার যে দিন থেকে ঘরে ঘরে আগমন ,সে দিন থেকেই পুজো কর্পোরেট । পুজোর আর ক দিন আছে সে খবর সব্বার আগে সে পায় ।
সেই ঘাম তেল মাখা মুখ । পরনে দামি শাড়ি । ছেলে মেয়েদের গলায় দড়ির সাথে ছোট ছোট সাইন বোর্ড , ওরা সব স্বেচ্ছাসেবক । থিম এর ছড়াছড়ি । এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমি কম কিসের ? বাড়ীতে সোনালী ছোলার ডাল , ঘি চুপচুপে সুজি , পাড়ায় পাড়ায় গুড়ের নাড়ুর সুগন্ধ না থাকলেও সব কিছুর রেস্টুরেন্ট আছে । ফেলো কড়ি মাখ তেল ।
আজও যখন সেই সব থিমের সামনে দাঁড়াই আমার মায়াবী চোখের মাকেই খুঁজি । সেই ডাকের সাজ, সেই হ্যাজাকের আলো , আমার মন ঘুরে বেড়ায় সেই সব ম্লেচ্ছদের ঘরে ঘরে ।
মা আগের মত করে কেন আস না বলত ? বিশ্বাস কর আর একবার চান্স পেলে আমি একদম আগের মত হয়ে যাব । তোমায় পাবার আশায় ম্লেচ্ছ ই হতে চাই ।তাতেই বড় সুখ!
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য : গুগল