শুধু ভ্রমণ কাহিনী পড়তে পড়তে মানুষ বড্ড একঘেয়ে হয়ে যায়। কিন্তু যদি ভ্রমণ কাহিনীর সাথে বেশ মশলাদার পৌরাণিক কাহিনীর মজা পাওয়া যায় তবে তার স্বাদটা বোধহয় দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আমার কিন্তু সেরকম ই হয়েছিল। তাই আজকের ভ্রমণ কাহিনীটি শুরু করব একটু অন্যরকম ভাবে, ওই একটু দেব দেবী নিয়ে আর কি।
কৈলাসে আমাদের সকলের প্রিয় বাবা, মা আর তার দুই পুত্রের সুখের সংসার। দুই পোলা মানে কাতু আর গনু ভাই। তো এই দুই ভাইয়ের হঠাৎ করে ভগবান হিসেবে স্বর্গে জায়গা পাবার দিন এল।কিন্তু জায়গা কি আর এমনি পাওয়া যায়? মা দুগ্গা বলে দিলেন পুরো পৃথিবীর চারদিকে দুই ভাইকে তিন পাক চক্কর মেরে আসতে হবে। শোনামাত্রই কার্তিক ময়ূরের পিঠে চেপে উড়ে চললেন। বেচারা গনেশ ইদুরের পিঠে চেপে কত জোরে ই বা দৌড়াবেন? তিনি মজাসে লাড্ডুর মজা নিতে লাগলেন।
কার্তিক ফিরে আসার আগেই গনেশ বাবা মা কে বসিয়ে রেখে তাদের চারপাশ দিয়ে টুক করে তিনবার ঘুরে নিলেন। এদিকে কার্তিক এসে দেখলেন দিব্বি গনেশ কৈলাসে বসে রয়েছে। দেখেই কার্তিক বিদ্রুপের হাসি হেসে মায়ের কাছে ফলাফল জানতে চাইলেন। মা পার্বতী মুচকি হেসে গনেশকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন। কারন সন্তানের কাছে বাবা মা ই তো আসল পৃথিবী। এদিকে কার্তিক তো চটে লাল। তবে মা একটা বিকল্প রাস্তা বলে দিলেন। কার্তিক কে অধুনা হিমাচল প্রদেশের পার্বতী নদীর ধারে এক গুহায় এগারো বছর তপস্যা করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল মায়ের মন তো? ছেলের জন্য আকুল। ভাবনা হল ছেলে এতদিন ধরে খাবে কি? ব্যস ওমনি ভোলা মহেশ্বরের ডাক পড়ল।ভোলে বাবা ওমনি টুক গুহার পাশ দিয়ে দুধের নদী বইয়ে দিলেন। দুধের নদীতে স্নান করে খেয়ে তপস্যা করে নির্ধারিত সময় পর স্বর্গে চলে গেলেন। কিন্তু মা পার্বতী আবার চিন্তায় পরলেন, সামনে আসছে ঘোর পাপের কলিযুগ।। এই দুধ গঙ্গার কি হবে?ব্যাস আবার ডাক পরল পরশুরামের। শিবের পরামর্শ অনুযায়ী পরশুরাম ওই স্হানে ধ্যান শুরু করলেন। আর দুধ নদী থেকে দুধ এনে ক্ষীর বানিয়ে মহাদবের মূর্তিতে নিবেদন করতে লাগলেন। শিবের ই ছলে একদিন পরশুরামের হাত থেকে ক্ষীরের বাটি পড়ে গেল।এবার কি হবে? পরশুরাম তো চটে লাল। ওমনি সেখানে নাটের গুরু নারদমুনি হাজির। তিনি পরশুরামকে দিলেন চটিয়ে। বললেন আসলে এই দুধের নদীর হেব্বি দেমাগ তাই তার দেমাগেই এমন হল। ব্যস আগুনে ওমনি ঘৃতাহূতী। পরশুরাম রেগে দুধগঙ্গাকে দিয়ে দিলেন অভিশাপ। বললেন” এখন থেকে তুই হয়ে যাবি ক্ষীরের গঙ্গা, আর সত্যযুগ ফিরে এলে আবার দুধঙ্গায় পরিনত হবি।”
অনেক গল্প দিয়েছি, এবার আমি ও থামি। আরে মশাই ঠিকই পড়েছেন, ক্ষীরগঙ্গা। আমাদের আসল ভ্রমণ শুরু হবে এই ক্ষীরগঙ্গা তেই। হিমাচলপ্রদেশ এর তথাকথিত ভ্রমণ জায়গা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই ভ্রমণযাত্রা। কিন্তু বাঙ্গালীর পায়ের তলায় তো সরষে। একবার অফবিট জায়গা শুনল তো ছুটল। ক্ষীরগঙ্গা আসলে একটি ট্রেকরুট, তাই পায়ে হেঁটেই পৌঁছাতে হয় প্রকৃতির এই স্বর্গরাজ্যে। যাত্রা শুরু করতে হয় কালগা অথবা তোস গ্রাম থেকে পেয়ে হেঁটে। তবে কালগা গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করলে পথের সৌন্দর্য অনেক বেশি উপভোগ করা যায়। কালগা থেকে সকাল সকাল দুপুরের খাবারটা বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়ুন। কারন এ পথে খাবার জন্য আর কোনো গ্রাম পড়বে না।পুরো পথটাই চলতে হয় ঘন পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এ পথে আপনার কোনো গাইডের প্রয়োজন হবে না, একটাই মাত্র রাস্তা। আর পথে যাতে আপনার ভুল না হয় তাই পথে পথে প্রচুর দিক নির্দেশ করা আছে। হাঁটতে হাঁটতে হয়ত আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন হঠাৎ দেখবেন পাথরের গায়ে লেখা “সামনেই সুন্দর জলপ্রপাত “। কিছু ক্ষন হাঁটার পরই আপনি পৌঁছে যাবেন দারুণ সুন্দর এক জলপ্রপাত এর পাশে। মোবাইল টা বার করুন সবরকম ভঙ্গিতে নিজস্বী তুলুন, কিন্তু আর নয়। এগিয়ে চলুন, কারন অনেকটা পথবাকি এখনো। আপনার ভাগ্য ভালো থাকলে পথেই দেখতে পাবেন হিমালয়ান মাঙ্কি আর হরেক কিসমের পাখি। আপনার খিদে টাও এতক্ষনে বেশ জোরদার হয়েছে, লাঞ্চটা বার করুন প্রকৃতির লাঞ্চটেবিলে বসে লাঞ্চটা সেরে ফেলুন। এরপর দু চারটি ল্যান্ডস্লাইড পার করলেই আপনার জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছে। দেখবেন একটা ঝর্না পুরো রাস্তার উপর দিয়ে বইছে। দাঁড়িয়ে ছবি তুলুন, সঙ্গীর গায়ে ঝর্নার জল ছুড়ে মারুন। তারপর আরও পথ বাকি আছে মনে করে বেজার মুখে এগিয়ে চলুন।এই কষ্ট, ক্লান্তি সব পার করে প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর পৌঁছে যাবেন আপনার আকাঙ্ক্ষীত গন্তব্য ক্ষীরগঙ্গায়। তবে এই পথে প্রকৃতি আপনাকে কখনই নিরাশ করবে না। পৌঁছেই আনন্দে হাত পা ছুড়ুন আর টুক করে একটা মনমত টেন্ট বুক করে নিন এক বা দু রাতের জন্য।
পাকোড়া সহযোগে একগ্লাস গরম চা পান করুন, দেখবেন অনেকটা ক্লান্তি কমে গেছে। ক্লান্তি আরও কমাতে চান? একটা অতিরিক্ত জামা কাপড় আর বাঙালির প্রিয় গামছা নিয়ে চলে যান ক্ষীরগঙ্গায় ডুব দিতে। ঠাণ্ডায় জমে যাবার ভয় পাচ্ছেন? কোনো ভয় নেই এটা আসলে একটা উষ্ণ প্রস্রবণ। স্নান করে দেখবেন শরীরের সব ব্যাথা উধাও। স্নান করতে নেমে আবার পৌরাণিক কাহিনীর যুক্তি তর্ক বিচার করতে বসবেন না যেনো। তাহলে সব মজাটাই মাঠে মারা যাবে। একবার ভাবুন আপনি এই ঠাণ্ডায় এমন এক গরম সুইমিং পুলে আছেন যার উপরে খোলা আকাশ, চারদিকে হিমালয়ের অতন্দ্র প্রহরা। হলফ করে বলতে পারি কোন একশত তারা যুক্ত হোটেল ও আপনাকে এই সুযোগ আর ভিউ দিতে পারবে না। স্নান সেরে ফিরে আসুন নিজের টেন্টে। অক্টোবর এর সময়ে এলে স্নো ফল দেখতে পারেন। রাতের নৈশভোজ সেরে চারটে কম্বল মুড়ি দিয়ে সুখে নিদ্রা যান। সকালবেলা উঠে হেঁটে দেখে আসুন কার্তিকের তপস্যার সেই গুহাটি। চাইলে ক্ষীরগঙ্গার জল দিয়ে শিবের পূজা দিতে পারেন। দুদিন কাটিয়ে আবার সেই জঙ্গলের পথ দিয়ে ফিরে আসুন কালগা বা তোস এ। পিছনে পড়ে থাকুক দেবতাদের অসামান্য কীর্তি কল্প।
বি:দ্র: সিমলা থেকে মানালি যাবার পথে পরবে ভুন্টার। ভুন্টার থেকে মনিকরন এর দিকে আর ও কিছু সময় গেলেই পড়বে তোস ও কালগা গ্রাম দুটি।এ পথে বাস প্রাইভেট গাড়ি দুটোই পাবেন। হোটেল সংখ্যা এখানে অনেক। আগে বুকিং এর প্রয়োজন পড়বে না। ক্ষীরগঙ্গায় টেন্ট আগে থেকে বুক করতে চাইলে কালগাতে হোটেলে বলুন। ওরাই ব্যবস্থা করে দেবে।