”গার ফেরদৌস বার-রুয়ে জমিন আস্ত, হমি আস্ত, হমিন আস্ত, হমি আস্ত’’ (যদি পৃথিবীর মাটিতেই কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে, তা এখানেই, এখানেই, এখানেই।‘’)
– মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর
প্রথমবার কাশ্মীর দর্শনে গিয়ে উপরোক্ত মন্তব্যটি ছিল মুগ্ধ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের। যদিও শুধুমাত্র জাহাঙ্গীর নন, ‘রাজতরঙ্গিনী’ স্রষ্টা কলহন থেকে বর্তমানের কবি শ্রীজাত, সেনা থেকে পুলিশ, অভিজাত শ্রেণী থেকে সাধারণ মানুষ – কাশ্মীরের প্রেমে পড়েননি এরকম মানুষ বিরল। যুগ যুগান্তর ধরেই কাশ্মীর তার রূপে মোহিত করেছে আপামর জনসাধারণকে। শিরোপা পেয়েছে ‘ভূস্বর্গের’। কাশ্মীর, যাকে প্রকৃতি গড়ে তুলেছে নিখুঁত তুলির টানে, যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্যের। আজ সেই কাশ্মীরের সাদা বসতে যখন রক্তের ছোপ দেখা যায়, সুবিশাল হিমালয়ের পাদদেশে যখন স্তূপীকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়, যে কোন সহানুভূতিশীল মন হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত। গত 14 ই ফেব্রুয়ারি ভালবাসার দিনে যখন সেই কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ঝরে গেল 42 টি তাজা প্রাণ, শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। একইসাথে প্রশ্ন জাগে মনে, কি কারণে আজ রক্তাক্ত ভূস্বর্গ? উত্তর লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। বর্তমান নিবন্ধ সেই ইতিহাসটিকেই যথাসম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করবে।
প্রাচীন ভারত ও কাশ্মীর:-
কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিচয় বরাবরই তাদের দ্বৈতসত্তা তুলে ধরেছে। একেবারে প্রাচীন যুগ থেকেই তা পরিলক্ষিত। কাশ্মীর একাধারে ভারতের মূল সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত, আবার একাধারে তা স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে এগিয়েছে। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী ‘র মতে, কাশ্মীর প্রাচীনকালে স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেই অগ্রসর হয়েছিল। মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলেই কাশ্মীর সর্বপ্রথম ভারতের কেন্দ্রীয় কোন মানচিত্রে যুক্ত হয়। কাশ্মীরে অশোক সাদর অভ্যর্থনা পান এবং বৌদ্ধধর্ম হয়ে ওঠে সম্রাট ও জনতার সম্পর্কের সেতু। কাশ্মীরের বারামুলা সহ বহু জায়গায় প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। কাশ্মীরের বর্তমান রাজধানী শ্রীনগর তাঁর আমলেই গড়ে ওঠে, তখন যার নাম ছিল শ্রীনগরী। পরবর্তীতে কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক কাশ্মীরে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বৌদ্ধ সূত্র অনুযায়ী, চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি (72 খ্রীঃ) কণিষ্কের আমলে কাশ্মীরেই অনুষ্ঠিত হয়,যদিও এই মতামত নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু একটি মত উল্লেখ করা যেতে পারে যে,কোনদিনই আর্যাবর্তের সংস্কৃতি অন্ধভাবে কাশ্মীর গ্রহণ করেনি, কাশ্মীরের নিজস্ব সংস্কৃতি বরাবরই বজায় ছিল। ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গার মত কাশ্মীরেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। খ্রীষ্টিয় নবম শতক নাগাদ শৈব ধর্ম কাশ্মীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রাচীন মার্তণ্ড সূর্যমন্দির কাশ্মীরের শৈব ঐতিহ্য বহন করছে। অমরনাথ গুহা ও কাশ্মীরের শৈব ঐতিহ্যের বড় প্রমাণ। যদিও হিন্দু ধর্ম কে বাকি ভারত যেভাবে অনুসরণ করত, কাশ্মীরের শৈব অনুসারীরা তার থেকে কিছুটা হলেও পৃথক ছিলেন।
কাশ্মীরে ইসলামের আবির্ভাব :-
কাশ্মীর কিংবদন্তি অনুযায়ী, ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে রিনচ্যান নামক জনৈক তিব্বতী বৌদ্ধ শরণার্থী কাশ্মীরের সিংহাসন দখল করেন। তৎকালীন সময়ে আরব সহ মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ইসলাম ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কাশ্মীরের পশ্চিমে সিন্ধু অঞ্চলে ও ইসলামী সংস্কৃতি হাজির হয়েছিল। এই পরিস্থিতি তে শাহ মির নামক জনৈক রাজকর্মচারীর উৎসাহে রিনচ্যান ইসলাম গ্রহণ করেন, যদিও পরবর্তীতে শাহ মির নিজেই সিংহাসন লাভে সক্ষম হন। প্রসঙ্গত তৎকালীন সময়ে ভারতের তখতে থাকা সুলতান দের সঙ্গে কাশ্মীরের শাসকদের কোন সম্পর্ক ছিল না, তাঁরা স্বাধীন ছিলেন। কাশ্মীরের তৎকালীন শাসকদের মধ্যে সুলতান জয়নাল আবেদিন শ্রেষ্ঠতম ছিলেন। তাঁর সময়ে কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষই ইসলাম গ্রহণ করেন, যদিও তাঁরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কাশ্মীরের প্রাচীন শৈব ধর্মের প্রভাব তখনো ছিল এবং কাশ্মীরে এক ধর্মনিরপেক্ষ শাসন পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে মুঘলরা কাশ্মীরের শাসন ক্ষমতায় আসেন ,যদিও তাঁদের সময়ে কাশ্মীরের সংস্কৃতি তে পরিবর্তন আসেনি। কাশ্মীর উদারনৈতিক সুফিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয় , যার প্রভাব এখনো বর্তমান।
ব্রিটিশ আমলে কাশ্মীর- ডোগরা শাসন:
ঔরঙ্গজেব পরবর্তী সময়ে মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে শিখরা কাশ্মীর দখল করেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বিপুল অভিনন্দন পান। পরবর্তী কালে ইঙ্গ – শিখ যুদ্ধে পরাজয়ের দরুন কাশ্মীর ব্রিটিশ দের হাতে আসে। প্রসঙ্গত কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মনোভাবের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা কাশ্মীর কে সরাসরি ভারত সরকারের অন্থর্ভুক্ত করেননি। ব্রিটিশ ভক্ত হিন্দু জমিদার গুলাব সিং মুসলিম প্রধান কাশ্মীরের দায়িত্ব পান। এই গুলাব সিং ও তাঁর পরবর্তী শাসকগণই বিখ্যাত ডোগরা বংশীয় শাসক নামে পরিচিত। 1947 খ্রীষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা কালে নাটকীয় মোড় নেয় কাশ্মীরের রাজনীতি। যার কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন শাসক মহারাজা হরি সিং।
ভারতের স্বাধীনতা ও মহারাজা হরি সিংয়ের বিভ্রান্ত রাজনীতি :–
স্বাধীনতাকালে দেশভাগের উদ্দেশ্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন সহ নেতৃবৃন্দ ভারতীয় রাজ্যগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন ও সেই অনুযায়ী ভারত ভাগের পরিকল্পনা করা হয়। কাশ্মীরের মত স্বশাসিত রাজ্য গুলিতে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার তাদেরই দেওয়া হয়। মহারাজা হরি সিং প্রাথমিক ভাবে হিন্দু প্রধান ভারতের অংশ হতে চাইলে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণের কথা ভেবে নিরপেক্ষ থাকাই স্থির করেন। তৎকালীন ভারতীয় নেতৃত্ব এই অবস্থান মেনে নিলেও মানতে নারাজ ছিলেন পাকিস্তানের সর্বেসর্বা মহম্মদ আলি জিন্না। ফলস্বরূপ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বিভিন্ন পাঠান উপজাতি দের নিয়ে গঠিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে ও শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বিপন্ন হরি সিং ভারত সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার সাহায্য দানে রাজি হন কিন্তু বিনিময়ে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি র শর্ত দেন। বিপাকে পড়ে হরি সিং ভারতভুক্তি র দলিলে স্বাক্ষর করেন। পরদিনই শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবতরণ করে। শুরু হয় প্রথম ভারত- পাক যুদ্ধ। যুদ্ধে সাফল্য লাভ করে ভারত। উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পাক বাহিনীর অপসারণ ঘটে। প্রসঙ্গত এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী যেভাবে জনগণের সমর্থন লাভ করেন তা অভাবনীয়। যদিও উপত্যকার পশ্চিম অংশে পাক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
রাষ্ট্রপুঞ্জ ও কাশ্মীর সমস্যা :
1948 সালের যুদ্ধ চলাকালীন ই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং তাঁর মন্ত্রী গোষ্ঠীর উদ্যোগে রাষ্ট্রসঙ্ঘে কাশ্মীর সমস্যা উত্থাপন করে ভারত সরকার। রাষ্ট্রসঙ্ঘ পাকিস্তান কে বাহিনী প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকেন, যদিও প্রাথমিক ভাবে পাকিস্তান যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী কালে যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে পাক বাহিনীর প্রস্থান ঘটে। উপত্যকায় সাময়িক স্থিতিশীলতা আসে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরামর্শ মত ঠিক হয় পরবর্তী কালে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরীরা তাঁদের ভবিষ্যত ঠিক করবেন। ভারত সরকার তাতে কোন আপত্তি করেনি কারণ সেই সময়ে কাশ্মীরের সমর্থন ভারতের সাথে ছিল এবং সরকার গণভোটে জয় নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন ।
শেখ আবদুল্লা এবং কাশ্মীরের রাজনীতি :
যুদ্ধ কালে হিন্দু প্রধান ভারতের প্রতি কাশ্মীরের সমর্থন দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। এর নেপথ্যে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম কাশ্মীরী নেতা শেখ আবদুল্লা। তিনি বিভিন্ন কারণ ও ইতিহাস ব্যাখ্যা করে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সম্ভাব্য কুফল কাশ্মীরের মানুষের সামনে তুলে ধরেন। দেবতা সুলভ এই নেতার সওয়ালে প্রভাবিত হয়ে তৎকালীন কাশ্মীরের মানুষ ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন । পরবর্তী কালে 1957 খ্রীষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অন্তর্ভূত হয় জম্মু ও কাশ্মীর। কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু অঞ্চল ও লাদাখ নিয়ে গঠিত হয় এই রাজ্য। ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে 370 নং ধারা যোগ করে কাশ্মীরের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই পুরো জটিল প্রক্রিয়ার নেপথ্যে ছিলেন শেখ আবদুল্লা যিনি নিজে পরবর্তীতে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর পুত্র ও প্রপৌত্র যথাক্রমে ফারুক আবদুল্লা ও ওমর আবদুল্লা ও পরবর্তী কালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রসঙ্গত, শেখ আবদুল্লা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের বর্তমান সভাপতি ওমর আবদুল্লা।
370 নং ধারা:
একনজরে দেখে নেওয়া যাক 370 নং ধারার বৈশিষ্ট্যাবলী:-
১। জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিকদের জন্য দুইটি পৃথক দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার অধিকার আছে।
২। জম্মু ও কাশ্মীরের পৃথক পতাকা আছে।
৩। জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার কার্যকাল ৬ বছর, ভারতের অন্য সমস্ত রাজ্যের বিধানসভার কার্যকাল ৫ বছর।
৪। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় জাতীয় পতাকা অথবা জাতীয় প্রতীকের অপমান করলে তাতে কোন অপরাধ হয় না।
৫। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের আদেশ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভিতর কার্যকর হয় না।
৬। ভারতীয় সংসদ জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে খুবই সীমিত ক্ষেত্রে আইনকানুন তৈরি করতে পারে।
৭। জম্মু ও কাশ্মীরের কোন মহিলা যদি কোন ভারতীয় ব্যক্তির সাথে বিবাহ করেন তাহলে ঐ মহিলার জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু কোন জম্মু ও কাশ্মীরের মহিলা যদি কোনো পাকিস্তানী ব্যক্তির সাথে বিবাহ করেন তাহলে ঐ মহিলার জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিকত্ব বাতিল হয় না, বরঞ্চ ঐ পাকিস্তানী ব্যক্তিটি জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিকত্ব পেয়ে যায়।
৮। জম্মু ও কাশ্মীরে RTI অ্যাক্ট কার্যকরী হয় না, CAG কার্যকর হয় না এমন কি ভারতের কোন অাইন কার্যকর হয় না।
৯। জম্মু ও কাশ্মীরে মহিলাদের ওপর শরিয়তি আইন জারি আছে।
১০। জম্মু ও কাশ্মীরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নেই। জম্মু ও কাশ্মীরে বাইরের কোন ভারতীয় ব্যক্তি জমিজায়গা কিনতে পারেন না।
1965 সালের সংঘর্ষ এবং সিমলা চুক্তি :
1965 সালে ও কাশ্মীর কে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। যদিও বড় কিছু হওয়ার আগেই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তান শাসক আয়ুব খান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হন। তাঁরা কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার দিকে এগোলেও তাসখন্দে শাস্ত্রীর রহস্য মৃত্যুর পর প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। 1971 সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের পর 1972 সালে যে সিমলা শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে, তাতেও কাশ্মীরের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার কথা বলা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, তখনো কাশ্মীরের অভ্যন্তরে ভারতের প্রতি প্রভূত সমর্থন বজায় ছিল। প্রসঙ্গত এর পূর্বে লাদাখ সংলগ্ন একটি এলাকা চিনের দখলে চলে যায় যা বর্তমানে আকসাই চিন নামে পরিচিত। জায়গাটি জনবিরল ও আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন বলে তা নিয়ে ভারত সরকার কোনদিনই তেমন সরব হননি।
আশি ও নব্বইয়ের দশক- কাশ্মীরী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ :
আশির দশকের আগে থেকেই ইতিউতি আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে নানা কারণে কাশ্মীর ও ভারতের ভালবাসার সম্পর্ক আর স্বাভাবিক নেই। এই দশকের মাঝামাঝি সময়ে তা প্রবল আকার ধারণ করে। কাশ্মীরীরা ভারতীয় সেনার দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাস্তায় নামেন। ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়া ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন আঙ্গিক তুলে ধরে প্রচার করা হতে থাকে যে কাশ্মীর কোন অবস্থা তেই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে পারে না। এমনকি মসজিদ থেকেও উঠতে থাকে ভারত বিরোধী স্লোগান। এই অবস্থায় ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে পাক সরকার। তাদের প্রত্যক্ষ উস্কানি তে উপত্যকায় সৃষ্টি হয় জঙ্গি আন্দোলনের। গড়ে ওঠে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী । যদিও প্রথম দিকে এই বিক্ষোভ ছিল মূলত রাজনৈতিক । ধর্মের খুব একটা প্রভাব ছিলো না। যদিও উপত্যকার কাশ্মীরি পন্ডিত দের উপরে নেমে আসে নির্বাসনের খাঁড়া। বহু আগে থেকেই পন্ডিতেরা কাশ্মীরের সমাজে সম্মানীয় একটি অংশ ছিলেন। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁদের গায়ে ‘ইসলাম বিরোধী’ ও ‘ইন্ডিয়া কি এজেন্ট ‘ এর তকমা মেরে দিয়ে তাঁদের নৃশংস ভাবে উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 1990 সালের আগে কাশ্মীরে বসবাসকারী হিন্দু পন্ডিত দের 65% কেই পরবর্তীতে বিতাড়িত হতে হয়। এর ফলে উপত্যকার জনবিন্যাসেও পরিবর্তন আসে। যদিও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একাংশের দাবি, এই ন্যক্কারজনক কাজের জন্য পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদত দায়ী। অপরদিকে,এই ঘটনা ভারতীয় সেনার এক বড় ব্যর্থতা। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের অবস্থানে বড় পরিবর্তন আসে। নেহরু জমানার গণভোটের দাবি থেকে সরে এসে ভারত সরকার জানিয়ে দেন যে, কাশ্মীর সমস্যায় তৃতীয় কোন পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন নেই। একইসাথে উপত্যকায় চলতে থাকে সেনা তৎপরতা। এই পর্বে ভারত সরকার কাশ্মীরের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন।
কার্গিল সংঘর্ষ :
1998 সালে ঐতিহাসিক লাহোর বাসযাত্রার ঠিক পরেই ফের কাশ্মীরের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।ভারতের সেনার অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে কাশ্মীরের কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চল চলে যায় পাক নিয়ন্ত্রণে। যদিও প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে পাল্টা প্রত্যাঘাত করে ভারত। একমাস ব্যাপী লড়াইয়ের শেষে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয় পাক সেনা। যদিও আগের দুই বারের থেকে এই সংঘর্ষ আলাদা কারণ ভারত কাশ্মীরের জনতার নিঃশর্ত সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। আক্রমণকারী দের প্রতি সহানুভূতি পরিলক্ষিত হয় উপত্যকার অনেক স্থানেই। যদিও একটি নির্দিষ্ট এলাকার সংঘর্ষ টিকে যুদ্ধ তকমা দেয়নি দিল্লি ও ইসলামাবাদ।
বর্তমান অবস্থা:
কার্গিলের পর আর বড় কোন সংঘর্ষে জড়ায়নি দুই দেশ। ঝিলাম দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। কিন্তু ছায়াযুদ্ধ চলছেই। একদিকে ভারত সরকার ও অপরপক্ষে পাকিস্তান পোষিত সন্ত্রাসবাদীরা এবং পাক সেনাবাহিনী। ঘটে চলেছে একের পর এক হামলা। কখনো বা মুম্বই, কখনো দিল্লি কেঁপে উঠেছে বিস্ফোরণে। আর কাশ্মীর উপত্যকায় রক্ত ঝরেই চলেছে। কখনো বা শ্রীনগর, কখনো বা ত্রাল, কখনো বা পুলওয়ামায়। সাধারণ জনতার পাথরের মুখেও পড়তে হচ্ছে ভারতীয় সেনাকে। আর কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, যাঁরা ভারতপন্থী বা পাকপন্থী কোন দলে বিভক্ত নন, তাঁরা আজ অসহায়। আজ কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ সকালে নিশ্চিত থাকেন না যে তাঁরা বিকেলে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন কিনা। কাশ্মীর আজ পরিণত হয়েছে দুটি শক্তিধর রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের আখড়ায়। অন্যান্য রাজ্যের বহু ভারতীয়, যাঁরা একদা কাশ্মীরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, একের পর হিংসাত্মক ঘটনায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন তাঁরাও। বাড়ছে ভারতের বাকি অংশের সাথে কাশ্মীরের দূরত্ব। বাড়ছে জম্মু ও লাদাখের সাথে কাশ্মীর উপত্যকার দূরত্ব ও। কোথায় শেষ এই সমস্যার? কেউ জানে না। সম্রাট জাহাঙ্গীর আজ তাঁর বর্ণিত সেই পার্থিব স্বর্গ কে দেখে কি বলতেন জানা নেই , তবে প্রার্থনা নিশ্চয়ই করতেন, রক্তহীন শান্তিপূর্ণ এক সুখী ভূস্বর্গের। পরিশেষে কবি শ্রীজাতর থেকে ধার করি কটা লাইন-
‘’হয়তো তখনই বুঝতেন কলহন
রাজতরঙ্গ বয়ে যাবে কোন স্রোতে…
হাওয়া ডেকে মরে, ‘রঞ্জন! রঞ্জন!’
কাশ্মীরে আজও রক্তকরবী ফোটে!’’
কাশ্মীরের সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।