বাড়িতে মা ষষ্ঠীর পুজোটা বেশ যত্ন নিয়েই করেন সুচতনা দেবী। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই শাশুড়ি মা বলেছিলেন জামাইষষ্ঠীর দিনে অরন্যষষ্ঠীর ভক্তিভরে পুজো করলে পরিবারের ধন সম্পদ সুখ শান্তি অক্ষয় হয়। ছেলেপুলেদের জীবনও অক্ষয় হয়। সেই দিন আর নেই। শাশুড়িও নেই, আর সুখ শান্তিও অক্ষয় হয়নি সুচেতনার। বিয়ের ৪ বছরের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন। সেই শোকেই অল্পদিনের মধ্যেই গেলেন শাশুড়ি। ছোট্ট রঞ্জুকে বুকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমেছিলেন তিনি। স্বামীর অফিসের চাকরিটা পেয়ে একটা ভরসা পেয়েছিলেন বুকে। আজ তিনি অবসরের দ্বারপ্রান্তে। ছোট্ট রঞ্জু আজ সরকারী অফিসার। ছেলেটা হয়েছে খুব প্রানবন্ত। চাকরির ফাঁকেই নাটক, বেড়ানো,সমাজসেবা,রক্তদান,গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্যাম্প করা সারাদিন শুধু দৌড় আর দৌড়। এবার বাঁধতে হবে ওকে। সংসারের দায়িত্বে জুতে দিতে হবে। আজও কোথায় বেরিয়েছে বাইক নিয়ে। ঠাকুরের সামনে বসে বসে ষষ্ঠীপুজোর যোগাড় করতে করতে এইসবই ভাবছিলেন সুচেতনা। প্রার্থনা করছিলেন ওকে ভালো রেখো ঠাকুর। ছেলের হাতে বাঁধার জন্য হলুদ সুতোয় দূর্বা বাঁধছিলেন। মা ষষ্ঠীর রক্ষাকবচ।
টিংটং,টিংটং করে ব্যস্তভাবে বেল বাজাল কে। রঞ্জু এলো? বাইকের আওয়াজ তো পেলামনা। দরজা খুলতেই দেখেন রঞ্জুর বন্ধু সাগর,প্রবাল,শান্তশ্রী দাঁড়িয়ে আছে।”মাসিমা রঞ্জুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। বাইকে আসছিল, লরিতে ধাক্কা মেরেছে। ছিটকে পড়েছে রাস্তার ধারে। পাথরে মাথা ঠুকে গেছে সজোরে। হেলমেট ছিটকে গেছে। সেন্স নেই। আমরা লোকাল নার্সিংহোমে নিয়ে গেছিলাম। বলেছে এখানে হবেনা। ব্রেনে হেমারেজ হচ্ছে, জলদি বড় হাসপাতালে নিতে হবে।” মুহূর্তে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে সুচেতনার। শরীর অবসন্ন হয়ে আসে। কোনোমতে দরজাটা ধরে সামলান নিজেকে। ওরা তাড়া দেয়, সময় খুব কম। টাকা পয়সা ঘরে যা আছে নিয়ে নিন।আর হেলথ কার্ড কিছু থাকলে নেবেন। আর রিলেটিভদের খবর দেবার থাকলে দিন, আমরা ভাবছি জীবনদান হসপিটালে নিয়ে যাবো। লোকাল নার্সিংহোম বলল ওদের ব্যবস্থাই সবচেয়ে উন্নত। এরপর আপনার ডিসিশান।
দ্রুত হাতে টাকা পয়সা, হেলথ কার্ড ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পরেন তিনি। বন্ধুরা খুবই করেছে। নিজেদের উদ্যোগেই ট্রমা কেয়ার এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে। গিয়ে দেখলেন ছেলে তাঁর ঘুমিয়ে আছে। চোট আঘাত কিচ্ছু বোঝাই যাচ্ছেনা। তারপর সারারাত ভেন্টিলেশন, ডাক্তারদের তৎপরতা, যমে মানুষে টানাটানি। উৎকণ্ঠায় রাত্রি জাগরন।সমানে নারায়নকে ডেকেছেন। সকাল ৮টার দিকে খবর এলো বিজ্ঞান, এতো চেষ্টা, ঠাকুরকে ডাকা সব ব্যর্থ হয়েছে। ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে রঞ্জুর। সুইচ টিপলে যেমন মুহূর্তে ঘরটা অন্ধকার হয়ে যায়,সেইভাবেই মুহূর্তে সারা পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো তাঁর সামনে।অজ্ঞান অবস্থায় কতোক্ষন ছিলেন জানা নেই। যখন জ্ঞান ফিরল কয়েকজন আত্মীয় আর রঞ্জুর বন্ধুদের উৎকণ্ঠিত মুখ দেখতে পেলেন। কিছুটা সামলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন।জল খেলেন একটু। একটু পর একজন আস্তে করে বলল, মাসিমা ডাক্তাররা জিজ্ঞাসা করছেন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম কি খুলে দেবেন? বাড়ির লোকের পারমিশান চাই। অসহায় ভাবে কী যেন খুঁজলেন চারদিকে। তারপর বললেন, আরেক ঘণ্টা থাকুক। যদি ফিরে আসে। আবার চোখ বুজলেন। এতদিন ঝড় ঝাপটা সহ্য করে জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা মানুষটা বসে রইলেন বজ্রাহতের মতো। শোক দুঃখ চিন্তার বাইরে শুধুই অবসন্নতা শরীর মন জুড়ে।
একটা ফুঁপিয়ে কান্নার অস্ফুট শব্দে চোখ মেললেন তিনি। দেখতে পেলেন আর এক বজ্রাহত মানুষকে। মোটা ফ্রেমের চশমা আর ধুতি পাঞ্জাবীর উসকোখুসকো চেহারার বছর ৬০ এর এক ভদ্রলোক। ধপ করে বসে পড়লেন পাশের চেয়ারে। পাশে তাঁর স্ত্রীই হবে। তিনিও ভেঙে পড়েছেন খুব। আরেকটি ছেলে উঠে এসে বলল, কি বললেন ডাক্তার বাবু? বৃদ্ধ নিজেকে একটু সামলালেন, তার পর বললেন মামনির লিভার একদম নষ্ট। রিকভার করার কোনও উপায় নেই। একমাত্র উপায় কারোর লিভার যদি পাওয়া যায়। কিন্তু ডাক্তার বাবু বললেন লিভার পাওয়া খুব শক্ত। কিডনি দুটো থাকে, অনেকে একটা দিতে রাজি হয়। কিন্তু লিভার পেতে গেলে সদ্যমৃত কারোর থেকে নিতে হবে। একটু দেরি হলেই নষ্ট হয়ে যায়। এদেশে নাকি খুব কম মানুষ দেহ বা অঙ্গ দান করে।মেয়ের আয়ু আর মাস খানেক বড়জোর। ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভদ্রলোক।
শুনতে শুনতে আবার অবসন্নতায় ডুবে গেলেন সুচেতনা। মাথাটা কাত হয়ে গেলো। হঠাৎ ডাক মা মা। ধড়মড়িয়ে উঠলেন সুচেতনা। রঞ্জুর ডাক। আমি একটু বেরচ্ছি। এই যাস না, যাস না। কিছু খেয়ে যা। না মা, তাড়া আছে। বাচ্চুর ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। রক্ত লাগবে। ও পজেটিভ, আমার গ্রুপ। শোন শোন, এই তো ২ মাস আগে দিলি। এখন তো আর দেওয়া যাবে না। আমার কথা শোন। একটু নিয়ম মান। আমার দিব্যি দিচ্ছি যাস না। দাঁড়িয়ে যায় রঞ্জু। দেখো মা। রক্ত দিলে আবার রক্ত হবে। ভাবো মা, সবাই বাইরে থেকে উপকার করছে। আর আমি ওর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, রক্তে মিশছি, শিরায় শিরায় বইছি। বাচ্চুর ভাইয়ের শরীরে তোমার ছেলে। ও ভালো হোক, একদিন আনবো ওকে। ছুঁয়ে ফিলিং হবে, তোমার আরেকটা ছেলে বাড়ল। আসলে কি জানো তো মা, যত টাকাই থাকুক, রক্ত কৃত্রিম ভাবে কিছুতেই বানানো যাবে না। আমরা সুস্থ সবল মানুষেরা যদি ফ্রেশ রক্ত না দিই, কারা দেবে মা? যেতে দাও প্লিজ। বয়ে যাই ওর শিরায় শিরায়।যা বাবা, বাঁচা অন্যের প্রান।
আবার চেতনা ফিরল সুচেতনার। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। রঞ্জু কোথায়? তিনি তো হাসপাতালে। মনে পড়লো সবটা।রঞ্জুর সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেলো আবার। রঞ্জুর এক বন্ধুকে বললেন, পাশের ওই ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? বন্ধুটি বলল, তারা তো বেরিয়ে গেছে। চট করে বাইরে যা বাবা, খুঁজে আন। না, বাইরেও পাওয়া গেলো না। হাল ছাড়লেন না সুচেতনা। রঞ্জুকে বাঁচানোর সুযোগ ছাড়বেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, ঠিকানা জোগাড় করলেন। লিভার সমস্যা নিয়ে ভর্তির তথ্য ঘেঁটে ওরা খোঁজ দিলো সেই পরিবারের। ডাকা হল তাদের। রঞ্জুর লিভার দান করবেন। ডাক্তাররা দেখবে এই লিভারে কাজ হবে কিনা। এই মেয়েটির না হলে অন্য কারোর হবে। ডাক্তার বাবুরা ছুটে এলেন অঙ্গ দানের খবর পেয়ে।মা দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের অঙ্গ দান করতে চাইছে এখনও এখানে তা বিরল নিদর্শন। খবর গেলো মিডিয়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে কিডনি, হার্ট, লিভার, চোখ এমনকি স্কিন পর্যন্ত দান করলেন তিনি।
এই প্রথম তাঁর বাড়িতে ষষ্ঠীপুজো নেই। সকাল থেকে খালি চোখ ভিজে যাচ্ছে তাঁর। আগের বছর এই দিনেই রঞ্জু চলে গেছিলো। কি নিষ্ঠুর পরিহাস। ছেলের মঙ্গল কামনায় যে পুজো করতেন, সেই পুজোর দিনেই চলে গেলো ছেলেটা।আজ শুধুই শূন্যতা। টিংটং বেল বাজলো।দরজা খুলতেই একে এক করে ঘরে ঢুকল মামনি,রাজা,সংকল্প,আদিত্য, আয়েশা,রবিন্দর,ঝুমুর। একসঙ্গে সবাই জড়িয়ে ধরল তাকে। সবার হাতে রজনীগন্ধার মালা। রঞ্জুর ছবিটাকে ফুলে ফুলে ঢেকে দিলো। আবার চোখ ভিজল তার। এগিয়ে এলো সংকল্প। আমার চোখের দিকে তাকাও মা, দেখো তোমার সঞ্জুর চোখ।সঞ্জুই তোমায় দেখছে।আয়েশা বলল আমার বুকে কান পাতো মা, রঞ্জু ধুকধুক করছে।সারাক্ষন আমার ভেতর থেকে কথা বলে আমার সঙ্গে। ওই রবিকে টাচ করো তোমার ছেলের স্পর্শ পাবে।আমাদের সবার মধ্যে তোমার ছেলে বেঁচে আছে।
ভেতর ঘরে যান সুচেতনা। একটা ভালো শাড়ি পরে বাইরে আসেন। সবাইকে বলেন যা মিষ্টি, মাংস,পনীর নিয়ে আয়। আজ রঞ্জুর জন্মদিন। এই দিনে যেমন ও চলে গেল, তেমনি এই দিনেই তো ও নতুন করে জন্ম নিয়েছিল তোদের সবার শরীরে। আজ কতো আনন্দের দিন। খুব আনন্দ করবো সারাদিন। সারাদিন হাসি গল্পে গানে আনন্দে কাটল। সকলের হাতে সুচেতনা বেঁধে দিলেন হলুদ সুতো। সবাই সংকল্প করবো রঞ্জুর মতোই তারাও অঙ্গীকার করবে অঙ্গদানের। বেঁচে থাকবে মানুষের মধ্যে। দেবতারা অমরত্ব দিতে না পারলেও অমর হবার চাবিকাঠি নিজেদেরই হাতে। মালায় ঢাকা রঞ্জুর ছবিটা ঝলমল করে উঠছিল অমরত্বের গর্বে। বার্তা দিয়ে গেলো অঙ্গ দান, মহৎ দান।
,,,,,,,,পার্থ চক্রবর্তী
চিত্র সৌজন্য : গুগল